আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

কিছু ‘না বলা স্যরি’

জীবনে চলার পথে অনেক ঘটনাই ঘটে- যার কিছু আমরা মনে রাখি, কিছু রাখি না। কিছু ভুলে যাই এক নিমেষেই, আর কিছু কোনদিনও ভোলা যায় না; স্মৃতি হয়ে জমাট বাঁধে অস্তিত্বের গহীনকোণে। আবার সময়ে-অসময়ে ছড়িয়ে পড়ে আলোড়িত করে তোলে পুরো সত্ত্বাকেই। সেইসাথে স্মৃতির সঙ্গী হয়ে কিছু প্রিয়মুখ জীবন্ত হয়ে উঠে চিরচেনা রূপে। এই গল্পগুলো তেমনি কিছু প্রিয়মুখের……সময়ের সাথে যাদের চেহারা বদলায় না, মনের সেলুলয়েড তাদেরকে বন্দী করে ফেলেছে একটা নির্দিষ্ট সময়ে……… ১| আমি তখন ক্লাস-থ্রি তে পড়ি।

রোলনম্বর এক হওয়ার সুবাদে ক্লাসক্যাপ্টেন ছিলাম। কম্বাইণ্ড স্কুল। আমাদের সাথে ফারজানা নামে একটা মেয়ে পড়ত। পয়সাওলার মেয়ে হওয়ায় বেশ ভাবে চলত। তা সত্ত্বেও ওর সাথে ভালো সম্পর্ক গড়ে তুলেছিলাম ওর ব্যাগভর্তি চকোলেট-টফি-চুইংগামের লোভেই।

যাই হোক, বেশ ভালোই চলছিলো আমাদের পিচ্চিবেলার দিনগুলো। ক্যাপ্টেন হিসেবে ফার্স্টবেঞ্চে আমার জায়গা কনফার্মই ছিলো। আমি সেইসাথে মেয়েদের সারিতে ওর জায়গাটাও কনফার্ম করে রাখতাম। ওর বন্ধুত্বে-সাহচর্যে আমার সময়গুলো বেশ রঙ্গে রঙ্গেই কাটছিলো। আর এদিকে নিন্দুকেরা জ্বলে-পুড়ে মরছিলো ওর ব্যাগের চকোলেট-চুইংগামের উপর আমার এককাধিকার দেখে।

শুনেছি শকুনের দোয়ায় নাকি গরু মরে না। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্যি এ যাত্রায় তা বোধকরি মিথ্যে প্রমাণিত হলো। একদিন খেলাধূলার মধ্যে কি একটা ছোটোখাটো বিষয় নিয়ে ওর সাথে ঝগড়া লেগে গেলো। সেই বয়সে খুব রগচটাই ছিলাম মনে হয়(এ বয়সে কেমন জানি না)। রাগের মাথায় সামনে পাওয়া ওর বইটা ছুঁড়ে মারলাম ওপরের দিকে।

সিলিংফ্যানের সাথে কয়েক পাক ঘুরে বইটা যখন নিচে পড়লো, ততক্ষণে কভার পেজটা আলাদা হয়ে গেছে। আর তাই দেখে, ওর সে কি কান্না! তারপর থেকেই ও আমার সাথে জম্মের আড়ি নিলো। কিছুদিন আগে বাড়ি গিয়ে ওর সাথে দেখা হলো। ঘাম জমে লেগে যাওয়া ঠাণ্ডা থেকে মুক্তি পেতে বিকেলবেলা বাজারে আসলাম ঔষধ কিনতে। হটাৎ চোখ পড়লো দোকানের একপাশে বাচ্চা কোলে একজন অভিজাত মহিলা বসে আছেন।

(থাকতেই পারেন; এ আর এমন কি!) কিন্তু যে ব্যাপারটা ভাবালো সেটা হলো চেহারাটা যেনো চেনা চেনা লাগে। আরে! এ যে ফারজানা। কিন্তু কোথায় সেই পাটকাঠির মতো ফোকলা দাঁতের ফারজানা, যে হাসলে গালে টোল পড়তো, যে গালফুলিয়ে অভিমান করতো, চিঁচিঁ করে কাঁদতো। এ যে দেখি কুড়িতেই বুড়িয়ে যাওয়া এক ভারিক্কি মহিলা! ফারজানা কে স্যরি বলা হয় নি। চাইলে হয়তো এ যাত্রায় বলা যেতো।

কিন্তু এতো সেই ফারজানা না। সেই ফারজানা শুধু একটি স্যরিতেই কান্না ভুলে ফিক করে হেসে দিতো। আড়ি ভাঙ্গতে ছড়া কাটতো, “ইচিং পাতা, মিচিং বাটা তোর সাথে আড়ি কাটা” ২| ক্লাস সিক্সে পড়ার সময় আকরামের সাথে আমার বন্ধুত্বটা স্কুলে সেইরকম আলোচিত একটা ব্যাপার ছিলো। কদিন পরপরই আমাদেরকে মারামারি করে শার্ট ছিড়তে দেখা যেতো। আবার কদিন বাদেই দোস্তি।

একজন আরেকজনকে ছেড়ে থাকতে পারতাম না। তাই প্রাণের টানেই যত মান-অভিমান মিটে যেতো। আকরামের বাবা ছিলো উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা। সেইসূত্রে ওরা সরকারী কোয়াটারে থাকতো। মাঝে মাঝে ক্লাস ফাঁকি দিয়ে সবান্ধবে সেই কোয়াটারের মাঠে ক্রিকেট খেলতে চলে যেতাম।

ঈদ, পূজা, শবেবরাত যা কিছু হোক আমাদের যত আনন্দ একসাথেই। ক্লাস সেভেনে ওঠার দু’তিন দিন পরেই ওর সাথে মারামারি বাঁধলো। (এই মারামারি জিনিসটা খুব রেগুলার ব্যাপারই ছিলো বলা চলে। ) জামা-কোর্তা ছিঁড়ে বাড়ি ফিরলাম। আমার অবস্থা দেখে মা মুচকি হাসলেন।

ততোদিনে তিনিও বুঝে গেছেন, এ নিয়ে আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই। কিন্তু আকরাম আমাকে এবার আর স্যরি বলার জন্য খুব একটা সুযোগ দিলো না। মাঝে কি একটা উপলক্ষ্যে স্কুল বন্ধ ছিলো। স্কুল খোলার পরই জানলাম যে, ওর বাবার বদলি হয়েছে। ওরাও কোয়াটার ছেড়ে চলে গেছে।

সেদিন আমি কী পরিমাণ যে কেঁদেছিলাম আজো মনে পড়ে। কিছুদিন আগে ওকে ফেসবুকে খুঁজে পেলাম। কিন্তু সেই কৈশোরের আন্তরিক বন্ধুত্বে যেন ভাটা পড়েছে। ওকে এখনো স্যরি বলা হয় নি। অবশ্য চাইলেই খুব সহজে ম্যাসেজে-চ্যাটে কিংবা ফোনে বলতে পারি।

কিন্তু মনে হয় না বলবো। কি হবে বলে? সেই জানের বন্ধু আকরামকে কি আর ফিরে পাবো?? ৩| ক্লাসটেনে পড়ি তখন। ততোদিনে মেয়েলি ব্যাপারে বেশ পক্ক হয়ে গেছি। কয়েকজনের পেছনে অলরেডি ঘোরাও হয়ে গেছে। যদিও বেশ একটা সুবিধা করতে পারি নি।

স্কুল থেকে আমাদেরকে গণিত আর ইংরেজীর জন্য বিশেষ কোচিং করানো হতো। এ সেকশন আটটা থেকে নয়টা পর্যন্ত কোচিং করে বের হওয়ার পরপরই বি সেকশন ঢুকতো। আমি ছিলাম এ-সেকশনে আর রুবা ছিলো বি-সেকশনে। যথারীতি সেদিন কোচিং শেষ হওয়ার পর আমরা বেরোচ্ছি আর বি-সেকশনের ছেলে মেয়েরা ঢুকছে। মনে হয় কিছু একতা ভাবতে ভাবতে বেরোচ্ছিলাম।

হটাৎই সামনে থেকে ধাক্কা খেলাম। মুখ তুলে দেখি রুবা সামনে দাঁড়িয়ে। (ও তখন আমার চেয়ে লম্বাই ছিলো। ) এর আগে থেকে যতোই পাকনা হই না কেন, ওটাই কোনো মেয়ের সাথে আমার প্রথম ও এখনো পর্যন্ত একমাত্র ধাক্কা খাওয়ার অভিজ্ঞতা। ঘেমে গিয়েছিলাম, মুখ মনে হয় পুরাই লাল হয়ে গিয়েছিলো।

ওর অবস্থাও তাই। যাই হোক, সেদিনের মতো সেখান থেকে পালিয়ে বাঁচলাম। আধুনিক কায়দা-কানুন অনুযায়ী ধাক্কাহেতু ভদ্রতার নিমিত্তে একটা স্যরি বলা উচিত ছিল নিশ্চয়ই। কিন্তু বলা হয় নি। এদিকে, বন্ধুদের পঁচানির ভয়ে এতোটাই ভীত হয়ে পড়লাম যে অসুখের ভান করে তিন দিন আর স্কুলেই গেলাম না।

পরে গেলেও বেশসময় লেগেছিল স্বাভাবিক হতে। পৌরসভা নির্বাচনের সময় ভোটাধিকার প্রয়োগ করে নাগরিক অধিকার পালনের নিমিত্তে বাড়ি গেলাম। ঘটনাচক্রে, আমাদের ওয়ার্ড থেকেই কমিশনার পদে দাঁড়িয়েছেন রুবার বাবা। একদিন বিকেলবেলা উঠোনে বসে মায়ের হাতে বানানো কাসুন্দি সহযোগে টক-ঝাল খাওয়া চলছিলো। এমন সময় বেশ কয়েকজন লোক সহযোগে দু’জন মহিলা বাড়িতে এলেন।

দু’জনেই বোরকাপরিহিত, তাই চেনা যাচ্ছে না। যাই হোক বাড়িতে আসার পর তারা দয়াপরায়ণ মুখদর্শনে ধন্য করলেন। সেইসাথে উদ্দেশ্যও জানা গেলো। নির্বাচনী প্রচারণার অংশ হিসেবে কর্তার জন্য ভোট চাইতে এসেছেন মা-কন্যা। একসময় আবিষ্কার করলাম, আররে! এই কন্যাটিই তো আমার প্রথম ক্র্যাশের [ধাক্কার্থেই ] স্মৃতি বিজড়িত সেই দিলরুবা আফরিন রুবা।

কিন্তু বদলে গেছে অনেকখানি। সেই রুবা আর নেই…… ওরা থাকে না। ওদের থাকতে নেই এই বাস্তবতার জগতে। ফারজানা, আকরাম, রুবা- ওদের শুধু খুঁজে পাওয়া যাবে আমার মনের সেলুলয়েডেই……ওরা সেখানেই থাক…… ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।