আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

ড. জাফর ইকবাল ও সমসাময়িক কয়েকটি বিষয়ে কিছু প্রতিক্রিয়াশীল ভাবনা

সবকিছুই চুকিয়ে গেছে গালিব! বাকি আছে শুধু মৃত্যু!! ঈদ আসলে দাদা-দাদীর কথা খুব মনে পড়ে। গ্রামের বাড়িতে ঈদ করার জন্য বৃদ্ধ দাদা অনেক কষ্ট করে আমাদের দুই ভাই-বোনকে নিতে আসতেন। পেশাগত কারণে বাবা-মা পরে যেতেন। গ্রামের বাড়িতে ঢুকার পথে সরু একটা খালের উপর একটি কাঠের সাঁকো ছিল। দাদীকে দেখতাম সাঁকোটির একপ্রান্তে আমাদের আগমন প্রতিক্ষায় নিবিষ্ট মনে দাড়িয়ে থাকতে।

জীবনের শেষ কয়েকটা বৎসর আমার দাদী অন্ধ ছিলেন। এমন অন্ধাবস্থায়ও তাঁকে দেখতাম আমাদের আগমন প্রতিক্ষায় কাঠের সাঁকোটির একপ্রান্তে নিবিষ্ট মনে দাড়িয়ে থাকতে। এমন অকৃত্রিম ভালবাসা আজকাল কোথাও দেখিনা। বন্ধুদের মাঝে দেখিনা, আত্মীয়-স্বজনের মাঝে দেখিনা, প্রতিবেশীর মাঝে দেখিনা। নিশ্চিতভাবে আমি নিজেও অন্যদের-কে অকৃত্রিমভাবে এই ভালবাসা বিলাইনা।

ভালবাসা বা ভাল ব্যবহার আজকাল একটি ‍"পণ্য"। এটা আপনাকে মূল্য দিয়ে কিনতে হবে। যদি সমাজের উচুতলার হন তাহলে অন্যদের কাছ থেকে ভাল ব্যবহার বা ভালবাসাটা একটু বেশি পাবেন। লাক্সারী বাসে ভ্রমণ করলে অন্য সাধারণ বাসের তুলনায় সংশ্লিষ্টদের কাছ একটু বেশি আদর আপ্যায়ন পাবেন। তেমনি পাঁচতারা বা ভাল হোটেলে থাকলে সাধারণ হোটেলের তুলনায় একটু বেশি খাতির পাবেন।

সমাজের সবক্ষেত্রেই এই ভাবনা, এটা বিচ্ছিন্ন কোন ক্ষেত্রের ঘটনা নয়। জাতি হিসেবে আমি বাঙ্গালী (বিশেষ করে বাংলাদেশী) হিন্দুদের সবচেয়ে নীরিহ গোছের বলে মনে করি। সবকিছুই তাঁরা সহজে মেনে নেয়। যতদিন পারে মুখ বুঝে সহ্য করে। যখন সহ্যের সীমা অতিক্রম করে তখন দামে-অদামে পিতৃ-পুরুষের বসতভিটাটি বিক্রি করে শুধু নিরাপদ জীবনের আশায় ওপারে পারি জমায়।

অনেক হিন্দু সহপাঠীকে দেখেছি যাদের একসময়ে বিস্তর জমি ছিল কিন্তু ক্ষমতাবান ভূমিদস্যুদের কাছে সব সঁপে দিয়ে শূধু জীবনটুকু নিয়ে একসময়ে ওপারে চলে গেছে। পত্রিকা পাঠে জানতে পারি, চিরকালের সর্বংসহা এ জাতির কেউ কেউ নাকি আজকাল রাষ্ট্রের প্রধান ধর্মের বা রাষ্ট্রধর্মের অবমাননা শুরু করেছেন। ধানমন্ডি বয়েজ হাইস্কুলের সহকারী প্রধান শিক্ষক মদন মোহন-কে দিয়ে এ অধ্যায়ের শুরু, ফরিদপুরের বোয়ালমারীর আরেক শিক্ষক সমর বাগচী এর সর্বশেষ সংযোজন। লক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে অভিযুক্তদের সবাই শিক্ষক। এটা কি চিরকালের অবদমনের অস্ফুট প্রতিবাদ? নাকি ষড়যন্ত্র? অবশ্য তদন্তের কোন প্রয়োজন নেই।

অভিযোগ উত্থাপিত হওয়ার সাথে সাথেই ধর্মরক্ষকদের বিক্ষোভ, অল্প সময়ের মধ্যেই অভিযুক্তের চাকরীচ্যুতি, অবশেষে জেল। প্রমাণের বিষয়টি এখানে অপাংতেয়। মানুষটির বিরুদ্ধে কোন ষড়যন্ত্র আছে কিনা এটা ভাবার মতো সময়ও রাষ্ট্রের নেই। যেহেতু ধর্মরক্ষকেরা অভিযোগ এনেছেন তাই তিনি অপরাধী হোন আর না হোন শাস্তি তাঁকে পেতেই হবে। রাষ্ট্রধর্মের অবমাননা বলে কথা।

সর্বংসহা এ জাতিটির নেতারাও সর্বংসহা। রাষ্ট্রের কাছে দেন-দরবার করে মা দুর্গাকে নির্বিঘ্নে একটু পুজা দিতে পারলেই তাঁদের তৃপ্তির শেষ নেই। এতটুকুনেই তাঁরা সন্তুষ্ট। নিজেদের মেয়েদের সম্পদের অধিকার, শিক্ষাক্ষেত্রে বা চাকুরী ক্ষেত্রে কোন বিশেষ কোটা এসব নিয়ে তাঁদের কোন মাথাব্যাথা নেই। আমাদের রাজনীতিবিদদেরও তাঁদের নিয়ে কোন আগ্রহ নেই।

ভোটের রাজনীতির কারণেও কেউ তাঁদেরকে বিশেষ সুবিধার টোপ দেননা। তাঁদেরকে সব সময়ই হিসাবের বাইরে রাখা হয়। ১৯৪৭ সালে দেশভাগ হওয়ার সময়ে পাকিস্তানের এ অংশে মোট জনসংখ্যার এক-চতুর্থাংশ ছিল হিন্দু। আজ এক-দশমাংসও হবেনা। এত বিপুল জনসংখ্যা কোথায় গেল, কেন দেশান্তরী হল তা নিয়ে রাষ্ট্রের কোন মাথাব্যাথা নেই।

রাষ্ট্র এটাকে ব্যর্থতা বা গ্লানি মনে করেনা। জনগণের দ্বারা গঠিত, জনগণের জন্য নিবেদিত, জনগণের সরকার- মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিংকন প্রদত্ত এ ধারণাটিই গণতান্ত্রিক সরকারের সবচেয়ে জনপ্রিয় সংজ্ঞা। তবে আমাদের বর্তমান শাসন ব্যবস্থার আলোকে সংজ্ঞাটি যদি এমনভাবে ব্যক্ত করা হয়, "জনগণের দ্বারা গঠিত, আবুল হোসেনের জন্য নিবেদিত, আওয়ামী লীগের সরকার" তাহলে খুব একটা বেমানান বা অত্যুক্তি হবেনা। ভদ্রলোকের ব্যর্থতা যতোই থাক, দূর্নীতির যতোই অভিযোগ থাক, সরকারের জনপ্রিয়তা যতোই কমে যাক, দলের শীর্ষ নেতৃত্ব তাঁর প্রতি আস্থাশীল। অনেক ক্ষেত্রে প্রশংসায়ও পঞ্চমুখ।

এতো অপকর্ম, অযোগ্যার পরেও কিভাবে শীর্ষ নেতৃত্বকে সন্তুষ্ট রাখা যায় তা রাষ্ট্রবিজ্ঞানের ছাত্রদের জন্য অতি গুরুত্বপূর্ণ একটি গবেষণার বিষয় হতে পারে। আমি নিশ্চিতভাবেই বলতে পারি এ গবেষণার ফলাফল ভবিষ্যতের চাটুকার রাজনীতিবিদদের জন্য ব্যাপক ফলদায়ক হবে। কারণ এর মাধ্যমে তাঁরাও জানতে পারবেন শত অপকর্মের পরেও কিভাবে শীর্ষ নেতৃত্বকে সন্তুষ্ট রাখা যাবে। আমাদের মহান বুদ্ধিজীবী এবং মহমান্য বিচারালয় সময়ে সময়ে আমাদের মেয়েদের পোশাক নিয়ে অতিমাত্রায় উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েন। তাঁরা এটাকে প্রগতির অন্তরায় হিসেবে মনে করেন।

পোশাক কিভাবে প্রগতির অন্তরায় তা আমার মতো স্বল্পজ্ঞানীর বোধগম্য নয়। প্রগতিটা আসলে পোশাকে নয়। প্রগতি ধ্যানে, প্রগতি মননে। অঞ্চল বিশেষে সংস্কৃতির ভিন্নতায় পোশাক ভিন্ন হতে পারে, ধর্মের প্রভাবও থাকতে পারে। কিন্তু একটি বিশেষ অঞ্চলের পোশাক অতিমাত্রায় প্রগতি সহায়ক এবং কোন বিশেষ অঞ্চলের পোশাক প্রগতি বিরুদ্ধ এমনটা ভাবা বোকামী।

ব্যক্তি স্বতঃস্ফুর্তভাবে যা পরিধান করতে চায় তা পরার অধিকার তার আছে। এখানে জোর করার কিছু নেই। আর যদি কোন পরিবর্তন হতে হয় সেটাও হতে হবে স্বতঃস্ফুর্ত। প্রশাসনের উচ্চস্তরে বা গুরুত্বপূর্ণ পেশাক্ষেত্রে আমাদের অনেক মেয়েদের দেখেছি যারা পর্দা প্রথা রক্ষা করেও স্ব স্ব ক্ষেত্রে দক্ষতার সাথে কাজ করে যাচ্ছেন। পর্দা মানাটা তার ব্যক্তিগত এবং মানার কারণে তিনি প্রগতিবিরুদ্ধ হয়ে গেছেন তেমনটা ভাবা অন্যায়।

আর সনাতনী যে পর্দা ছিল তা কিন্তু প্রায় বিলীনের পথে। মানুষ কিন্তু স্বতঃস্ফুর্তভাবেই জীবনযাত্রায় এ পরিবর্তনটা এনেছে। আমাদের মনে হয়না আমাদের মহান বুদ্ধিজীবী বা মহামান্য বিচারালয়ের এ বিষয়টা নিয়ে অতিরিক্ত উদ্বিগ্ন হয়ে অহেতুক ঝড় সৃষ্টির প্রয়োজন আছে। নারীর প্রকৃত প্রগতি নিহিত তাঁর অর্থনৈতিক স্বাবলম্বীতা অর্জনের মধ্যে। ধীরে হলেও আমাদের মেয়েরা তা অর্জন করছে।

মহামান্য বিচারালয় বা মহান বুদ্ধিজীবীদের কিছুটা অগোচোরেই তা হচ্ছে। দাপ্তরিক বা পেশাভিত্তিক কাজের বাইরেও আমাদের মেয়েরা তাঁদের পদচিহ্ন রেখে যাচ্ছেন। আপনি গ্রামে গেলে দেখবেন রাস্তায় মেয়েরা পুরুষদের পাশাপাশি কায়িক শ্রমের কাজ করছে। নির্মাণ শিল্পে এখন তাঁরা পুরুষের পাশাপাশি কাজ করছে। আর পোশাক শিল্পেতো আমাদের মেয়েরা বিপ্লব ঘটিয়েছে।

লক্ষ লক্ষ মেয়ে আজ শুধুমাত্র কায়িক শ্রমের মাধ্যমে স্বাবলম্বীতা অর্জনের সংগ্রাম করছে। আমার এখানে এটা অস্বীকার করার উপায় নেই যে, তাদের এ মুক্তির সংগ্রামে ধর্ম বাধা হিসেবে কাজ করছেনা। অবশ্যই ক্ষেত্রবিশেষে ধর্ম বাধা হিসেবে কাজ করছে। কিন্তু আমাদের মেয়েরা এ বাধাকে জয় করছে। নিজেদের পিতা-মাতাকে, নিজেদের সন্তানদেরকে একটু উন্নত জীবন দেয়ার বিশাল বাসনার কাছে ধর্মের এই বাধা দিন দিন হার মানছে।

এই বাসনাটাই আসলে প্রগতি, পোশাক নয়। কারো প্রতি ভক্তি শ্রদ্ধা থাকা ভাল। কিন্তু অতিরিক্ত ভক্তি দেখাতে গিয়ে ঐ ব্যক্তিকে অপমান করা হচ্ছে কিনা সেটাও ভেবে দেখা উচিত। আমাদের দেশের একজন প্রতিথযশা বুদ্ধিজীবী তথা ড. জাফর ইকবালের মেয়ের পোশাক নিয়ে গত কয়েকদিনে ফেসবুক এবং ব্লগ সাইটগুলোতে তুমুল কান্ড ঘটে যাচ্ছে। ব্যক্তি হিসেবে আমি মনে করি ওনার মেয়ের পোশাক নিয়ে কৃ-তর্ক করার প্রয়াসটা ভদ্রতার মাঝে পড়েনা।

তাঁর যা পছন্দের বা স্বাচ্ছন্দ্যের তা পরিধান করা তাঁর অধিকার। কিন্তু প্রতিক্রিয়াশীলদের কাছে ভদ্রতা আশা করা অন্যায়। স্বভাবতই প্রতিক্রিয়াশীল গোষ্ঠীটি মেয়ের পোশাকের ছুতায় ড. ইকবাল-কে শায়েস্তা করার আশায় দল বেধে জিহাদে অবতীর্ণ হলেন। স্বস্তির কথা হচ্ছে যে, এই জিহাদীরা ফাকা মাঠে গোল দিতে পারেননি। স্বতঃস্ফুর্তভাবেই এই জিহাদীদের প্রতিরোধ করা চেষ্টা চলেছে বা চলছে।

তবে এই প্রতিরোধের চেষ্টায় কিছু কিছু লেখা দেখলে মনে হয় এগুলোর মাধ্যমে প্রকারান্তরে ড. ইকবাল ছোটই করা হচ্ছে। ড. ইকবাল একজন শহীদ মুক্তিযোদ্ধার সন্তান। এদেশের শিক্ষা, সাহিত্যের উন্নয়নে ওনার এবং ওনার ভাইদের ভূমিকা প্রবাদতুল্য। এমন প্রতিথযশা একজন মানুষকে বা তাঁর মেয়েকে ডিফেন্ড করতে যেয়ে স্বীকৃত রাজাকার তথা ঘাতকের ছেলের কর্মকে সামনে নিয়ে আসা হচ্ছে বা তুলনা করা হচ্ছে। ব্যাপারটা এমন যে, সে (রাজাকারের ছেলে) এমনটা করেছে তাই তার (ড. ইকবালের মেয়ের) কাজটাও জায়েয।

বিষয়টা অনেকটা আমাদের মাননীয় দুই নেত্রীর আচরণের মতো। যখনই তাঁদের কোন কর্ম নিয়ে প্রশ্ন ওঠে তখনই তাঁরা বলেন তাঁর পূর্বসুরীও এমনটা করেছেন। অর্থাৎ সে অন্যায়টা করেছে বলে আমার অন্যায়টাও জায়েয। এখানে ড. ইকবালের মেয়েকে ডিফেন্ড করতে যেয়ে রাজাকার পুত্রের কুকর্মের তুলনা করে প্রকারান্তরে দুজনকেই সমগোত্রীয় করে ফেলা হচ্ছে- যেখানে ব্যক্তিগতভাবে আমি বিশ্বাস করি ড. ইকবালের মেয়ে কোন অপরাধেই অপরাধী নন। আমি রাষ্ট্রবিজ্ঞানের একজন সাধারণ ছাত্র।

সাধারণত কম মেধাসম্পন্ন ছেলেরাই এ বিষয়গুলো নিয়ে পড়ে। সে কারণে আমার এ বোধোদয়ে হয়তো ভুলও থাকতে পারে। তাই অগ্রিম মার্জনা চেয়ে নিলাম। ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।