আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

চল যাব তোকে নিয়ে...!

:-) গাছ মৃত্যু বনাম মানব মৃত্যু কলেজের গেইট ক্রস করে সামনে এগুতেই পায়ের নিচে সবুজ কিছু পিষ্ট হতে দেখে বেশ হকচকিয়ে গেলাম। দ্রুত পা সরিয়ে সবুজ জিনিসটার দিকে আগ্রহ নিয়ে তাকাতেই চোখে পড়ল একটা মানিপ্ল্যান্ট গাছের দুই-তিনটা পাতা একসাথে মাটিতে পড়ে আছে। রোদে-তাপে একেবারে নেতিয়ে গেছে। কেন জানি খুব মায়া হল দেখে। পরম যত্নে হাতে তুলে নিলাম।

আমাদের বাসার বারান্দায় একটা রুক্ষপ্রায় মানিপ্ল্যান্টের গাছ ধীরে ধীরে বেশ বড় হয়েছে, লতা-পাতা মেলে দিয়ে সবুজ রঙ্গা সাপের মত পেঁচিয়ে পেঁচিয়ে উপরে উঠছে। সেই গাছের টবে এই নেতিয়ে যাওয়া, অবহেলিত, পিষ্ট পাতা দুইটা লাগিয়ে দিলেই নিশ্চয় বেঁচে যাবে। এই ভেবে ব্যাগের মধ্যে পাতাগুলো আলতো করে ঢুকিয়ে নিলাম। বাসায় ফিরেই মানিপ্ল্যাণ্টটাকে পানির বোতলে ছেড়ে দিতে হবে! গাছটা বেঁচে যাবে। কচি কচি পাতা ছাড়বে।

চিন্তা করতেই আমার মনটা ফুরফুরে হয়ে গেল। একটা অর্ধমৃত গাছকে বাঁচিয়ে তুলতে পারা বিশাল কঠিন কাজ। সেই অসাধ্য আমাকে সাধন করতেই হবে! বাসায় ফিরে নানা কাজে ব্যস্ত হয়ে ভুলেই গেলাম মানিপ্ল্যান্টের কথা। সন্ধ্যার দিকে খেয়াল হল ব্যাগের মধ্যে গাছটার কথা। তাড়াহুড়ো করে বের করে দেখি সেটা আরো নেতিয়ে গেছে।

খুব মন খারাপ হল। গোমড়া মুখ করে গাছের জন্য পানি আনতে যাব, হঠাৎ শুনি মুঠোফোন বেজে উঠার শব্দ। ভাল কোন কাজের সময় ফোনটা বড় যন্ত্রনা করে! --হ্যালো! --শুনসিস? --কি? --ফেসবুকে দেখিস নাই? --ফেসবুকে যাই নাই। কি হয়েছে? --এনাটমির খালা দুপুরে মারা গেছেন। --কিভাবে? খালার সাথে তো কালকেই আমার দেখা হল।

খালাকে তো ভাল-ই দেখলাম। খালার খোজখবর নিলাম। --খালা রোড এক্সিডেন্টে মারা গেছেন। মেট্রো শপিং মলের সামনে। বিকল্প পরিবহনের একটা বাস এসে চাপা দিয়েছে।

প্রচন্ড কান্না পাচ্ছে। প্রচন্ড। এখন যথেষ্ট বড় হয়েছি। অনাত্মীয় একজনের জন্য ভ্যাঁ ভ্যাঁ করে কাঁদা যায়না। তারপর ও বাথরুমের দরজা বন্ধ করে আমি বেশ কিছুক্ষণ কাঁদলাম।

এই এনাটমির খালা আমাকে বড় আদর করতেন। ফার্ষ্ট প্রফের আগে মাথায় হাত বুলিয়ে দোয়া করেছিলেন। গতকাল-ও খালার সাথে আমার কথা হয়েছে। খালার চোখের দিকে তাকিয়ে কথা বলেছি। কে জানত এই মানুষটা আজকে “নাই” হয়ে যাবে? কলেজ লিফটে আর কোনদিন খালার সাথে দেখা হবেনা।

কোনদিন আর খালা স্যার-ম্যাডামদের জন্য পরোটা-ডাল নিয়ে এনাটমি ডিপার্টমেন্টে যাবেননা। কোনদিন না! আমার টেবিলের উপর নুয়ে পড়া মানিপ্ল্যান্টের পাতা। আমি শক্ত হাতে মানিপ্ল্যান্টটা ধরলাম। এটাকে ফেলে দিব। ছুড়ে ফেলে দিব।

যে দেশে মানুষের স্বাভাবিক মৃত্যুর নিশ্চয়তা নাই, সেই দেশে গাছ বাঁচিয়ে কি হবে? গাছেরও মৃত্যু হোক। মৃত্যু হোক। মৃত্যু হোক। চক্ষুলজ্জা! আমি ফুটপাত দিয়ে শান্ত ভাবে হাঁটছি। হঠাৎ চোখে পড়ল ফুটপাতে একটা শিশু হামাগুড়ি দিচ্ছে।

শ্যামবর্ন। ধুলোয় মাখামাখি উদোম শরীর। ফুটপাতের এক কোণে শিশুটার মা শুয়ে আছে। ধানমন্ডি আট নম্বর রোডের ব্যস্ত সড়কের ব্যস্ত ফুটপাতে শিশুটিকে পাশ কাটিয়ে সবাই চলে যাচ্ছে। ফুটপাতে শিশু হামাগুড়ি দেওয়ায় অনেকে বিরক্ত হচ্ছে।

আমি ও হাঁটতে হাঁটতে শিশুটিকে চলার পথে দেখে খুব বিরক্ত হলাম। বিরক্ত এবং কিছুটা তীর্যক চোখে শিশুটির দিকে তাকাতেই দেখি বাবুটা হাসছে, একা একা হাসছে। ছোট্ট একটা শিশু। ফুটপাথে হামা দেওয়া শিশু। এই শিশু হাসতে পারে? ধূলোময় ঐ শিশুটির হাসির চেয়েও কি দেবশিশুর হাসি সুন্দর হতে পারে? কক্ষণো না! আমি ও শিশুটির দিকে তাকিয়ে হাসলাম।

আমার খুব ইচ্ছা করল শিশুটিকে কোলে তুলে নিই। পারলাম না। চক্ষুলজ্জা। চক্ষুলজ্জার জন্য আমি আমার জীবনের বেশির ভাগ আনন্দময় কাজ গুলো করতে পারিনি। আশেপাশের অনেকেই আমাকে শিশুটির সামনে থেমে যেতে দেখে অবাক চোখে তাকাচ্ছে।

কি লজ্জা! কি লজ্জা! আমি বাড়ির দিকে পা বাড়ালাম। একদিন চক্ষুলজ্জা নিশ্চয়-ই ভেঙ্গে যাবে। আমি সেই দিনের জন্য বহুদিন ধরে অপেক্ষা করে আছি। মায়াবতীদের গল্প কিংবা একজন কঠোর মায়াবতী আমি আমার ক্ষুদ্র জীবনে অসংখ্য মায়াবতীদের সন্ধান পেয়েছি। এই মায়াবতীদের কেউ কেউ আমার স্কুল জীবনের বন্ধু, কেউ কলেজ জীবনের আবার কেউ মেডিকেল লাইফের।

মেডিকেল লাইফে চার জন মায়াবতী আমার বন্ধু, খুব কাছের বন্ধু। এই চার জন মায়াবতী আমাকে একটা তীব্র ঋণে আবদ্ধ করে ফেলেছে। এই ঋণ আনন্দের ঋণ, আনন্দ দানের ঋণ। তাদের আশেপাশে থাকলে যে কেউ কিছুক্ষণ থাকলে “হাসি রোগে” আক্রান্ত হবে। আমি নিজেও হয়েছি।

আইটেম, কার্ড, টার্মে জর্জরিত জীবনে হাসিটুকু বেঁচে আছে ঐ মায়াবতীদের জন্য-ই। তারপর ও মাঝে মাঝে বিষণ্ণ লাগে। ক্লান্ত লাগে। তখন মায়াবতীরা চুপিচুপি আসে। আমার পাশে বসে।

আমাকে সাহস দেয়। কখনো কখনো আমি মায়াবতীদের সাহস দিই। মায়াবতীরা আমার চার পাশে মাকড়শার মত করে ভালবাসার জাল বিছিয়ে দিয়েছে। এই জাল ছিন্ন করার সাধ্য আমার নেই। চার জন মায়াবতীর কথা অন্য দিন বলা যাবে।

আসলে তাদের গল্প বলে শেষ করা যাবেনা। আজ বলি, এক জন কঠোর মায়াবতীর গল্প। সেই কঠোর মায়াবতী আমার “মা”! আম্মু! এই মানুষটা অনেক রাগী। অনেক। খালি বকে, খালি রাগ করে।

তবুও মানুষটা মায়াবতী। কঠোর মায়াবতী। জীবনের সবচে’ প্রয়োজনের মুহূর্তগুলোতে যাঁর বুকে বারবার মাথা লুকিয়েছি, যাঁর অনুপ্রেরণায় একটু একটু করে এগিয়ে গেছি, সেই মানুষটা আমার মা--আমার সবচে’ বড় অবলম্বন—মায়াবতী, একজন কঠোর মায়াবতী! Inner peace! Inner peace! এনিমেশন মুভি “কুংফু পান্ডা- টু” তে একটা চমৎকার কথা আছে। -- "Anything is possible when you have inner peace". আমার কথাটা খুব পছন্দ হয়েছিল। কিছুদিন আগে এই “inner peace” ব্যাপারটা একেবারেই আমার মধ্যে ছিল না।

এমনিতে আমি খুব নির্লিপ্ত এবং শান্ত টাইপের মানুষ, কিন্তু সেই সময়টাতে ভেতরে ভেতরে কেন জানি খুব বিক্ষিপ্ত হয়ে ছিলাম। পরপর দুইটা মৃত্যু সংবাদ, কলেজে পড়াশোনার তীব্র চাপ, একটার পর একটা পরীক্ষা, এক জন আরেকজনকে ডিঙ্গিয়ে ভাল করার সেই পুরোনো মানসিকতা—সবকিছু নিয়ে নিজেকে কেমন জানি এলোমেলো লাগছিল। বারবার সৃষ্টিকর্তাকে ডাকছিলাম। অবশেষে মানসিক শান্তি পাওয়া গেছে। মেঘ কেটে গেছে।

ছোট্ট একটা কারণে মন ভাল হয়ে গেছে। এখন আমি অত্যন্ত আনন্দিত। আনন্দিত হওয়ার কারণটা বলা যাক— মুঠোফোনে টাকা থাকলেই আমি নেট এক্টিভেট করে ফেলি। টাকা রিচার্জ করা মাত্র p7 লিখে 5000-এ send করি। সেদিন ইন্টারনেট এক্টিভেট করব এমন সময় দেখি আমার নানীর ফোন।

অভিমান ভরা কন্ঠে বৃদ্ধ ছেলেমানুষটা আমাকে বললেন,"তোমার তো আমাকে আজকে ফোন করার কথা ছিল। করলা না তো! তাই আমি নিজেই করলাম। " তারপর অনেক অনেক কথা। “ভাত খেয়েছ কি দিয়ে?" "কে মুরগী রান্না করল?” "আম্মু কখন আসবে অফিস থেকে?” আমার ছেলেবেলাটা কেটে গেছে এই মানুষটার কোলে চড়ে, মানুষটার আদরে, শাসনে। নানা যখন ঢাকায় থাকে, তখন আমার কোন চিন্তা নাই।

নানা-ই আমাকে এখনো, এই বয়সেও দেখে রাখে। অথচ আমি মানুষটাকে ফোন করতেই ভুলে যাই রোজ। তাঁকে ফোন করার আগেই টাকা শেষ হয়ে যায়। সেদিন মনে মনে কতটা অনুতপ্ত হলাম বলার মত না। আমি মানুষটা বেশি সুবিধার না—এই চরম সত্যটা আবার ও বুঝতে পারলাম।

আমি প্রতিজ্ঞা করলাম, আমি আর কোনদিন মুঠোফোনে নেট অন করব না। কোনদিন না! ব্লগে, ফেসবুকে ভার্চুয়াল সম্পর্কগুলোর সাথে সাধারণ নিয়মরক্ষার কিছু কথোপকথনের চেয়ে আমার নানীর পরম মমতাময় “ভাত খেয়েছ?” শোনাটাই যে বেশি আনন্দের! কেউ একজন পরম মমতামাখা কন্ঠে রোজ আমার খোঁজ নেয়, এর চেয়ে বড় inner peace মনে হয় আর নাই! ...তবুও গল্প লিখছি বাঁচবার! মানিপ্ল্যান্টটা ছুঁড়ে ফেলে দিতে চেয়েছিলাম এনাটমির খালার মৃত্যু সংবাদ পেয়ে। কিন্তু খুব আশ্চর্য হলেও সত্য, মানিপ্ল্যান্টের ঐ জীর্ণ গাছটা ছুঁড়ে ফেলা হয়নি। কেন জানি মনে হয়েছিল, হাতের মুঠোয় রাখা মৃতপ্রায় গাছটার সাথে খালার মিল আছে। খালা বাসের চাপায় পিষ্ট হওয়ার আগে নিশ্চয় এই গাছটার মত-ই ভীত হয়ে, কুঁকড়ে গিয়েছিলেন।

আমি গাছটাকে একটা পানিভর্তি বোতলে জানালার কাছে রেখে দিয়েছিলাম। ফেলে দিতে পারিনি! গাছটা এখন নতুন নতুন পাতা ছাড়ছে অল্প অল্প করে। গাছটা বেঁচে গেছে! জীর্ণ গাছটা বেঁচে গেছে! আমি মাঝে মাঝে মানিপ্ল্যান্টটার পাশে গিয়ে দাঁড়াই। সবুজ সবুজ কচি পাতা দেখে আমার ফুটপাতের ধূলোয় লুটানো পথশিশুটার হাসির কথা মনে পড়ে। মনে হয় গাছটাও হাসছে।

শিশুর মত নিষ্পাপ হাসি। দলিত মানিপ্ল্যান্টের পাতাগুলো যেভাবে পরম যত্নে তুলে এনেছিলাম, সেই একই রকম যত্নে সবুজ, কচি পাতায় হাত রাখি। মাথার ভেতর হঠাৎ নচিকেতা গুণগুণ করে— “চল যাব তোকে নিয়ে, এই নরকের অনেক দূরে, এই মিথ্যে কথার মেকী শহরের সীমানা ছাড়িয়ে...!”  ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।