আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

হিম-শীতল ছোট গল্প

( এক ) সব সময় ওরকম -" দস্যি-মেয়ে , দস্যি-মেয়ে _" বল কেন গো? আমার অত সুন্দর একটা নাম আছ সে নামে ডাকতে পারনা?----- -- তা দস্যি মেয়েকে, দস্যি মেয়ে বলব নাতো কি বলব? সারাটা দিন যেন ল্যাজে আগুন দিয়ে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। ---- হি, হি, হি, হাসতে , হাসতে একেবারে গড়িয়ে পড়ে, ---- " আচ্ছা মা, আমার কি ল্যাজ আছে যে আগুন দেব? ---- ওই হোল। -" এ যে সোহাগ মাখান শাসন, ফলে নবোঢ়ার আহ্লাদ যায় আর এক ধাপ বেড়ে। -" জান মা, আমার নামের না একটা ইতিহাস আছে। -" -" কি করে জানব?-" সেই শুরু হোল তার গল্প বলা।

------------ পরপর তিন দিদির পর আমার যখন জন্ম হোল, সকলে ছেলের আশায় ছিল। আর হোল কিনা আমার মত একটা কাল কুষ্টি মেয়ে। আমি নাকি এতই কালো ছিলাম যে, আমার চোখ নাকই ভাল বোঝা যেত না। ----- ---কোথায় তুমি কালো? অমন সুন্দর কচি পাতার মত গায়ের রং ?-" -" ওমা, সে তো ঠাকুমার জন্য। একে মেয়ে, তার ওপর কালো দেখে, আমার বাবা - মাতো আর কোলেই তোলেনি।

সেই থেকেই আমার ঠাকুমার যত্নেই আমি মানুষ। ঠাকুমাতো অনেক কিছু জানত, সেসব ব্যবহার করে করে তবে আমি একটু উজ্জ্বল হোলাম। আমার বয়স যখন একুশ দিন, ঠাকুমা, বাবার কোলে আমায় দিয়ে বললেন,-----" কি রে তোর মেয়ের কি নাম রাখবি দেখ। -" বাবা বললেন, ---- " রং দেখে তো নাম করণ করা যায় কাউয়া। -" -" এ্যা, রাম রাম, তুই এইডা কি কস?-" -" আচ্ছা কাউয়া না হয় ময়না।

-" সেই থেকে আমার নাম হোল ময়না। -" বাঃ, তোমার বাবারতো বেশ রসবোধ ছিল। -" এই হোল বৌদির নামের ইতিহাস। গল্পে একেবারে পটিয়সী। সারাক্ষন একজনের সাথে নয় একজনের সাথে শুধু গল্পই করে চলেছে।

আর , তার গল্প করার মস্ত একটা সুবিধা হোল, শুধু একজন শ্রোতা চাই। মার জীবনে এতদিনতো এরকম একজন বক্তারই শুধু প্রয়োজন ছিল। সারাদিনে মায়ের সাথে কথা বলার বা শোনার কেউ ছিলনা। এখন মাকে দেখে মনে হয়, মা যেন এতদিনে মার সেই ছোট্ট বেলার পুতুল আবার খুঁজে পেয়েছে। সর্বক্ষন বৌদির পেছন পেছন মা ছুটে বেড়াচ্ছে।

বাড়ীতে যেন চোর-পুলিশ খেলা চলছে। এসব দেখে আমারতো খুব মজাই লাগে। বাবা, দাদাও মুখে যাই বলুক মনে মনে যে উপভোগ করে, তা আমি ভালই বুঝি। এখন মাকে দেখে আমারও মনটা ভরে যায়। এতদিন মনে হোত, মা যেন যন্ত্র চালিত এক নির্বাক কর্মী।

মার কাছে সংসারে কারুর কোন আব্দার ছিল না। মা নিজেই সবার প্রতি কর্তব্য করে গেছে। সেজন্য বৌদির এই সহজ, সরল জুলুমটা মার মনে হয় এক পরম পাওনা। এক কথায়, বুকের অনেকটা ফাঁকা যায়গা ভরে রাখে মার ময়না। আমার আরও ভাল লাগে, বৌদি যখন নির্দ্ধাধায় বাবার কাছে মায়ের নামেও নালিশ জানাত ------ ওরকম গুরু-গম্ভীর বাবাও দেখতাম, বৌদিকে সর্বান্ত করনে সমর্ধন করে, একটা চাপা ভালবাসায় মাকে বলতেন, ---- "ঠিকই তো, মাঝে মাঝে খাওয়ার মেনুটা পাল্টালেওতো পার।

----- " এইসব ছোট্ট-খাট্টো সুখ যে আমাদের জীবনে এতদিন কোথায় লুকিয়ে ছিল, কে জানে? কে বলবে মাত্র কদিন আগেও এ বাড়ীকেই মনে হোত যেন পৃথিবীর সকল শব্দ দূষণ নিয়ন্ত্রনের ভার দেওয়া হয়েছে। শব্দ দূষণতো অনেক দূরের কথা। বাড়ীতে একমাত্র রান্নার আওয়াজ ছাড়া আর কোন শব্দই ছিলনা। নিঃশব্দে সকাল থেকে রাত্রি, প্রতিদিন একই নিয়মে কেটে যায়। এর কোন পরিবর্তন নেই।

বাবা ঘুম ও খাওয়া বাদে সব সময়ই মুখ ঢেকে বসে আছেন এক হয় পেপার নাহয় বই নিয়ে। এর মাঝেই সকালে জল-খাবারটা খেয়েই বাজারটাও সেরে আসেন এবং তখনই মার কাছে সংসারের যাবতীয় প্রয়োজনীয় কথা-বার্তাও সেরে নেন। বাজার ফিরেই, সংসারের প্রতি এবং সকলের প্রতি কর্তব্যের অবসান। পুনরায় আর এক কাপ চা এবং যথারীতি অধ্যায়নে মনোনিবেশ। এই নিয়মের ব্যাতিক্রম আমার আজও পর্যন্ত চোখে পড়েনি।

দাদা আবার বাবার থেকেও আর এক ধাপ ওপরে। ঘুম থেকে উঠেই ব্যাচের পর ব্যাচ নিয়ে ব্যাস্ত। তারপর কোন রকমে মুখে দুটো গুঁজেই কলেজ। আবার বাড়ী ফিরেই রাত নটা পর্যন্ত চলে টিউশানি। কারুর সাথে কথা বলাতো দূরের কথা, কারুর দিকে তাকাবারও সময় নেই ওর।

মা, সারাদিন আছে মার ঠাকুর ঘর আর রান্নাঘর নিয়ে। জানিনা মার এতে কোন অসুবিধা হয় কিনা? কারণ মা দেখি, প্রতিদিন সমান নিষ্ঠা সহকারে, নিখুঁতভাবে সকলের সব প্রয়োজন মিটিয়ে যাচ্ছেন। আমার বোধ হওয়ার পর, আমি কখনও কোনদিন মাকে কোথাও বেড়াতে যেতে দেখিনি। একমাত্র অসুখ-বিসুখ হলে মা, বাবার সাথে পাড়ার চিত্ত ডাক্তারকে দেখাতে যেতেন। এছাড়া আমার আর দাদার জন্মদিনে, খুব সকাল সকাল বাড়ীর সামনের শিব মন্দিরে পূজো দিয়ে আসতেন।

সর্ব-সাকূল্যে এই হোল মার বেড়ান। এরকম গন্ডীবদ্ধ অবস্থায়, মা এমনই অভ্যস্ত হয়ে গেছিল যে, এর বেশীও যে কিছু চাওয়ার বা পাওয়ার আছে মা তা ভুলেই গেছিল। রাত নটার সময় বাবা তারপর সাড়ে নটার সময় দাদা খেয়ে যে যার ঘরে চলে গেলে , আমি আর মা খেতে বসে অনেক গল্প করতাম। মা যে কত বিষয়ে, কত সুন্দর সুন্দর কথা বলতে জানে শুধু তাই-ই দেখতাম। অথচ এ বাড়ীতে কারুর কোন কথা নেই।

সবার কথা যেন ফুরিয়ে গেছে। সামান্য আন্তরিকতার স্পর্শে প্রতিদিনের দেখা শোনাও যে কত নতুন হয়ে উঠতে পারে তা উপলব্ধি করার বড়ই অভাব। বৈচিত্র-হীন, দৈনন্দিন এই জীবন যাত্রা তাই বড় এক ঘেঁয়ে লাগে। এসব জিনিস আমাকে বড় ভাবায়। আমি ভেবে পাইনা, সামান্য একটু কথা বলে, মানুষকে শান্তি দিতে এত কার্পণ্য কেন? এতেতো কারুর কোন খরচা হয়না? প্রয়োজন ছাড়াও বিনা প্রয়োজনেও যদি একজন আর একজনের একটু খোঁজ-খবর নেয়, দু-দন্ড পাশে বসে দু-চারটে কথা বলে, তাতে কি এমন ক্ষতি? ------------ শুধু ভালবাসায় মনটা ভরে যায়।

-------- বেঁচে থাকার আকাঙ্খাটাও বোধহয় একটু বেড়ে যায়। ছোট্ট এই জীবনের মূল্য মানুষের চাইতে বেশী আর কে বোঝে? চালক সর্বস্ব এই জীবন, তাই পায়না নিজেকে জানতে, চায়না নিজেকে দেখতে। ------- মায়ের যদিও কারুর কাছে এসবের জন্য কোন নালিশ ছিলনা। তবুও মায়ের এই একাকীত্ব আমায় বড় পীড়া দিত। বাড়ীতে মাত্র চারটা প্রাণী, যে যার মত কাজ করে চলেছে।

----------- এরকম তৃতীয় ব্যাক্তির মত মাকে দেখতে আমার ভালো লাগেনা । ----- এই কি জীবন? এ যে মৃত্যুর চেয়েও হিম-শীতল! ( দুই ) হঠাৎ কে যেন অগোচরে থেকে, আমাদের এই তরঙ্গ-হীন সংসারে, এক আনন্দের ঢেউ তুলে, সব ওলট-পালট করে আবার মিলিয়ে দিল। কে--- ন যে এমন হয়?----------------- ময়েরা দুবোন। ছোট মাসির মেয়ের বিয়ে উপলক্ষ্যে আমাদের বারবার যেতে লিখেছে। ছোটমাসি পাটনায় থাকে।

সেই উপলক্ষ্যে আমরা সপরিবার এই প্রথম বাইরে বেড়াতে বেরোলাম। আমারতো ভীষণই আনন্দ মাও খুব খুশি। সেখানে গিয়ে খুব হৈ-চৈ করে দিন কাটাতে লাগলাম। দেখলাম, বাবাও শ্যালিকার সাথে একটু হাসি-খুশি ভাবেই গল্প করতে চেষ্টা করছেন। দাদাও গৌতমদাকে নিয়ে নানান দায়িত্বপূর্ণ কাজে নিজেকে ব্যাস্ত রাখতে চাইছে।

আর মা-মাসি দুবোনতো কলকল করে কত যে গল্প করে চলেছে, যেন এর আর শেষ নেই। এই প্রথম সবার মাঝে এসে আমরা নিজেদের নতুন করে দেখলাম, চিনলাম। মাকে দেখে মনে হোল, মাও উচ্ছল হতে জানে। ----- কিন্তু আমরা, আমাদের সংসার কিভাবে মাকে স্তব্ধ করে দিয়েছে। ভাল না লাগলেও, মেনে না নিলেও, ভালবেসে সবার সব কিছু কেমন হাসিমুখে মা, মানিয়ে নিয়েছে।

( তিন ) মিতাদির এক বান্ধবী, প্রায় সর্বক্ষণ মিতাদির পাশেই বসেছিল। দেখতে বেশ ভালই। শ্যামলা, শ্যামলা গায়ের রং, চোখ, নাক টিকালো, এক ঢাল পিঠভর্তি কোঁচকানো কালো চুল। সব মিলিয়ে বেশ দেখতে লাগে। মা-মাসি দুজনে মিলে, দাদার সাথে হলে কেমন হয়, এসব কথা চালিয়ে যাচ্ছেন।

আসলে দাদার বিয়ের কথা-বার্তাও চলছিল, তাই পছন্দ মত মেয়ে চোখে পড়লেই, নিজের ছেলের কথাটাই আগে মনে পড়ে যায়। মিতাদির বিয়ের পর্ব্ব চুকে-বুকে গেলে, সবাই মিলে আলোচনা করে, নিজেদের মধ্যে কথা-বার্তা একরকম প্রায় স্থিরই হয়ে গেল। ----- যদিও দাদার একটু অমত ছিল। কারণ দাদার যোগ্যতা অনুযায়ী স্ত্রী হিসেবে, একটু শিক্ষিত পাত্রী কাম্য হওয়াই স্বাভাবিক। এদিকে পাত্রী গতবার হায়ার-সেকেন্ডারী দিয়েছিল।

রেজাল্ট ইন-কমপ্লিট থাকায় এবার আবার দেবে। তা বাবা-মার আগ্রহ সমস্ত অসুবিধাকে ছাপিয়ে গেল। বাবা বললেন,----- " তাতে কি হয়েছে? ফাইনাল পরীক্ষাটা এখানে হয়ে গেলে, তারপর কোলকাতার কলেজে পড়বে?----------" সুতরাং পাত্রী একরকম স্থিরই হয়ে গেল। পুরো সাতদিন বাইরে কাটিয়ে, এক নেমন্তন্ন খেয়ে, আর এক নেমন্তন্নের ব্যবস্থা করে, আমরা আমাদের আস্তানায় ফিরে এলাম। বাবা আর দাদা পুনরায় তাদের রুটিন বুঝে নিয়েছেন।

আমি আর মা, বিয়ের ব্যাপারে নানান জল্পনা-কল্পনা করে চলেছি। যদিও জানি, দাদা এইসব অনুষ্ঠানের ঘোরতর বিরোধী। তাই ফাইনাল পরীক্ষার পর পরই, ভাল দিন দেখে সামান্য আয়োজনেই বিয়ে হয়ে গেল। ------ বৌদি বেশ খুশি খুশি মনেই আমাদের সংসারে এসে প্রবেশ করল। আমাদের বাড়ীর সেই রাশভারী মেজাজও যেন কিছুটা হালকা হয়ে গেল।

মার মুখেতো সর্বক্ষন সেই একটাই বুলি, ময়না আর ময়না। ইদানিং বাবাও যেন একটু হালকা হতে চান, তবে পুরোপুরি পারেন না। কিজানি যদি ওজন কমে যায়? ( চার ) বেশ হাসি-খুশি ভাবেই দিন-গুলো কাটছিল। কিন্তু সব মন মত হলেতো আর সংসার চলেনা? আমরা যে একেকটি সমস্যা তৈরীর যন্ত্র। ক্রমশ ওরকম ছটফটে মেয়েটিও কেমন যেন ঠান্ডা হয়ে যায়।

তার মধ্যের সেই চঞ্চল কিশোরিটি যেন কোথায় হারিয়ে গেছে। আগের মত, স্বামীকে দেখলেই ---------------- মাষ্টার মশাই আসছেন, মাষ্টার মশাই আসছেন ----------- বলে হৈ হৈ করে ছুটে আসেনা। মাকেও আর আগের ,মত জ্বালাতন করেনা, বাবার কাছেও কোন নালিশ জানায় না। প্রথমে গোপনে মন কষাকষি, তারপর আড়ালে রেষারেষি, ক্রমশ প্রকাশ্যে বিরক্তি। প্রকৃত সত্য একটাই, দাম্পত্য সমস্যা।

যা আগেও ছিল, এখনও আছে, পরেও থাকবে। যুগে যুগে শুধু তার রূপ বদলেছে। কেউ মেনে নিয়ে বোবা হয়েছে, কেউ না মেনে বোবা হয়েছে। পরের বাড়ী থেকে একটি মেয়ে এসে, যে কিনা আমাদের সকলকে আপন করে নিল -------- তার মন উজাঢ় করা ভালবাসা দিয়ে ভালবাসতে শেখাল, মন মাতানো হাসি দিয়ে সকলকে ভরিয়ে তুলল ----- তার সমস্ত টুকু দিয়ে সে বুঝি আজ নিঃস্ব হয়ে গেল। জীবিকা যেখানে জীবনকে গ্রাস করে নেয়, জীবন সেখানে এমনি একটু একটু করেই বুঝি তার মাধুর্য হারিয়ে ফেলে।

------------------- মা-বাবা বিচলিত। আমিও আতঙ্কিত। -------------- দাদা আবার ময়নার বুলিকেও কেড়ে নেবে নাতো? ? ? ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.