আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

সড়ক দুর্ঘটনা দাও ফিরিয়ে মিশুক ও তারেককে

১৩ আগস্ট ২০১১ মিশুককে হারিয়ে ছেলেকে নিয়ে চলে এলাম টরন্টোতে। কারণ, আমি তো দেশে গিয়েছিলাম ছুটিতে। সব হারিয়ে বাঁচার চেষ্টায় যখন যুদ্ধ করে যাচ্ছি, তখনই বাংলা টেলিভিশনে একটি সংবাদ দেখি। সংবাদটা হচ্ছে, মিশুক মুনীর ও তারেক মাসুদদের ঘাতক বাসচালকের মুক্তির দাবিতে বাস ধর্মঘট। সংবাদটি দেখে মর্মাহত হয়েছি।

পরিবহন শ্রমিকনেতা জোবায়ের জাকির ও কামরুজ্জামান সিদ্দিকী যেভাবে কথা বললেন, যেন সেই ঘাতক চালক কোনো অন্যায় করেনি। যেন পাঁচটি মশা-মাছি মেরেছে বলে তাকে জেলে দেওয়া হয়েছে। আমাদের যোগাযোগমন্ত্রী ও নৌপরিবহনমন্ত্রী সেই ঘাতক চালককে আইনি সহায়তা দেওয়ারও আশ্বাস দেন। আমাদের রাজনৈতিক নেতারা সংসদে উত্তপ্ত ভাষণে সে সময় বলেছিলেন, ‘মিশুক মুনীর ও তারেক মাসুদ বারবার আসে না। ’ তাহলে এই দুই গুণী মানুষের হত্যার বিচার হবে না কেন? নিরাপদ সড়কের দাবিতে আন্দোলন হবে না কেন? ভুয়া ড্রাইভিং লাইসেন্স ও নৌমন্ত্রীর অন্যায় আবদারের প্রতিবাদ হবে না কেন? তিন মাসও হয়নি, এই দুই মানুষকে হত্যা করেছে বাসচালক, সঙ্গে আরও তিনজনকে।

মানুষের জীবনের কি কোনো দাম নেই ওই দুই মন্ত্রীর কাছে? যোগাযোগমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেনকে নাকি নৌমন্ত্রী শাজাহান খান অঙ্গুলির হেলানে ওঠান আর বসান। তোতাপাখির মতো যা ওনাকে মুখস্থ করানো হয়েছে, তিনি তা-ই বলছেন। যখন সাংবাদিকেরা প্রশ্ন করলেন, তখন আবুল হোসেন তোতলাতে আরম্ভ করলেন। শাজাহান খান পরিবহন নেতা এবং যতটুকু জানি, তাঁর পরিবহনের ব্যবসাও আছে। ২৮ হাজার পরিবহন লাইসেন্সের আবদার নাকি তাঁর ব্যবসারই একটা দিক।

ওনাকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নৌপরিবহনমন্ত্রী না করে লাইসেন্স ব্যবসার মন্ত্রী করলেই তো পারতেন। শাজাহান খান ও তাঁর দুই সাগরেদ তথাকথিত শ্রমিক পরিবহনের নেতা জোবায়ের ও কামরুজ্জামানের কথাবার্তায় মনে হলো, যেহেতু রোজার ঈদের ঠিক আগে মিশুক-তারেকের দুর্ঘটনাটি হয়, তাই তাঁরা কিছুই বলতে বা করতে পারেননি জনগণের রোষের কারণে। এখন তাঁরা তা করছেন। সাধারণ মানুষকে জিম্মি করে তাঁরা তাঁদের আসল নোংরা চেহারাটা দেখাচ্ছেন এবং বাংলাদেশের সরকারপ্রধান তা দেখেও না দেখার চেষ্টা করছেন। সরকারপ্রধানের ছায়ায় তাঁরা নিরাপদেই আছেন।

প্রধানমন্ত্রী ছলছল চোখে বললেন, ‘স্বজন হারানোর ব্যথা আমি জানি। ’ তাহলে আমরা যাঁরা সড়ক দুর্ঘটনায় স্বজন হারিয়েছি, তাঁদের ব্যথা কেন তিনি বুঝতে চেষ্টা করছেন না? তিনি তো ঠিকই তাঁর পরিবারের হত্যার বিচার করেছেন, অপরাধীদেরও সাজা হলো। আর বিরোধীদলীয় নেত্রীও তাঁর স্বামীর হত্যার বিচার পেয়ে গেলেন। তাহলে আমরা কেন স্বজন হারানোর বিচার পাব না? তাঁরা রাষ্ট্রের কর্ণধার বলে বিচার পাবেন, আর আমরা সাধারণ মানুষ বলে পাব না? কী করে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীর সামনে সৈয়দ আবুল হোসেন বলতে পারলেন, ওই ঘাতক চালকের জামিনের জন্য আইনি ব্যবস্থা করা হবে। বিবেকের চেয়ে চেয়ারের মোহ কি এতই বেশি যে সাহারা খাতুন কিছুই বললেন না? কোথায় গেল তাঁর ন্যায়-নীতি নিয়ে বিপ্লবী চেহারা? সৈয়দ আবুল হোসেন ও শাজাহান খানের কাছে আমি যদি প্রশ্ন করি, ওই ঘাতক চালককে ছেড়ে দিন, তার বদলে মিশুক ও তারেককে ফিরিয়ে দিন—পারবেন দিতে? শাজাহান খান আপনি তো পরিবহন শ্রমিকদের নেতা, দিন তো বাংলাদেশকে একজন মিশুক মুনীর ও একজন তারেক মাসুদ।

আপনার সামনে কী করে পরিবহন শ্রমিকেরা ইলিয়াস কাঞ্চনের ছবিতে জুতা মারে? তার মানে, এতে আপনারও হাত রয়েছে। এই শোডাউনে কী প্রমাণ করলেন আপনি? বাংলাদেশের দুর্ভাগ্য, দেশের প্রধানমন্ত্রীও মনে মনে এ ধরনের শোডাউন সমর্থন করেন বলেই না দেখার ভান করে থাকেন এবং শাজাহান খান ও সৈয়দ আবুল হোসেনের মতো মানুষদের মন্ত্রিত্ব দিয়ে বহাল তবিয়তে রেখেছেন। গত ঈদে শহীদ মিনারে যখন প্রতিবাদ হলো, তখন কী করে প্রধানমন্ত্রী বললেন, ‘যাঁরা শহীদ মিনারে গিয়েছিলেন, তাঁরা কেউ বাড়িতে যান না। ’ আমি যদি প্রধানমন্ত্রীকে বলি, আপনি যখন আপনার বাড়িতে যান, তখন গাড়িবহর নিয়ে যান এবং সামনে-পিছে নিরাপত্তাকর্মীরা থাকেন বা হেলিকপ্টারে চড়ে যান। আপনি কীভাবে বুঝবেন, সাধারণ যাত্রী পরিবহনে যাওয়ার কষ্ট! আমার এ প্রশ্নের উত্তর দিতে পারবেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী? না, তা পারবেন না এবং বিরোধীদলীয় নেত্রী, আপনিও পারবেন না।

কারণ আপনারা মুখে বলেন দেশের মানুষের কথা, আর বাস্তবে সাধারণ মানুষকে নিয়ে খেলা করেন। আমরা সাধারণ মানুষ দেখছি এবং নিজেদের প্রস্তুত করছি নিজেদের রক্ষা করার জন্য। ইতিহাসের কথা ভুলে যাবেন না, চোখের সামনে এখনো টাটকা উদাহরণ রয়েছে। দেশের জনসাধারণকে যদি মূর্খ বা অন্ধ ভাবেন, তাহলে ভুল করবেন। সাধারণ মানুষের হয়তো বিদ্যালয় শিক্ষা নেই, আছে প্রকৃতিগত শিক্ষা, যে শিক্ষায় একজন সাধারণ মানুষ ভালো-মন্দ বুঝতে বা চিনতে পারে।

তাই বলছি, যে অন্যায় আবদার মন্ত্রীরা বা শ্রমিকনেতারা করতে পারেন, তেমনি আমিও মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কাছে বলতে পারি, ‘দাও ফিরিয়ে মিশুককে, দাও ফিরিয়ে তারেককে’। মঞ্জুলী কাজী: প্রয়াত চিত্রগ্রাহক ও সাংবাদিক মিশুক মুনীরের স্ত্রী। সুত্রঃ এখানে লিংক ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।