আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

গল্প: বর্ণচোরা ভালোবাসা

ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাড়িঁয়ে ব্যস্ত দক্ষ হাতে চোখে কাজলের লাইন টানে নীলা। ওর সাজগোজের বালাই তেমন একটা কখনোই ছিল না , আজকাল সময়ও পাওয়া যায় না, উর্দ্ধশ্বাসে ছুটে চলা জীবন ওর। শুধু এই বিলাসিতা টুকু আজও রয়ে গেছে। ওর এই কাজল কালো চোখই তো কোন এক কালে হৃদয়ের হৃদয়কে দোলায়িত করেছিল। প্রায়ই বলতো হরিনচোখা , খেপাবার সময় বলতো গরুর মত বেকুব বেকুব বড় বড় চোখ।

কত দিন হয়ে গেছে তারপর ,নীলার চোখ এখনও তেমনিই সুন্দর আছে, কিন্তু কমেন্ট করার মানুষটা নেই। কোন একদিন যে তার এই মায়াবী চোখের বানে কেউ আটকা পড়েছিল তা আজ বোধ হয় এমনকি নীলারও মনে পড়ে না। ঠিকঠাক টাইয়ের নটটা বাঁধতে শিখেছে হৃদয় আজ অনেক দিন হল। আগে একেবারেই পারতো না, ওর ভাইবার দিন প্রথমবারের মত নীলা বেঁধে দিয়েছিল, প্রেমিকার হাতের উষ্ঞ ছোঁয়া লেগে ছিল শুভকামনার মত করে। এমনকি শিখে ফেলার পরও বহুদিন পর্যন্ত নীলাই প্রতিদিন বেঁধে দিয়েছে।

এতো শুধু একটুকরো কাপড়কে কৌশলে গ্রন্থিবদ্ধ করে ফেলা নয়, সকালের শুরুতে নিকট সান্নিধ্যের একটা মওকা। টাইটা উপলক্ষ্য ,লক্ষ্যটা অন্য জায়গায়। ব্যস্ত দিনপ্রহরে দুজনেই দুইজায়গায় থাকে পুরোটা সময়, তাই দিনশুরুটা একটু একসাথে থাকা, একটু রোমান্ঞের স্বাদ। এখন অফিসে যাবার সময় তাড়াহুড়োয় নাওয়া খাওয়াই ঠিকমতো হয়ে ওঠে না,মুখে পাউরুটির অবশেষটা গুঁজে নিয়ে টাইটা হাতে করে বের হয়ে যায় হ্বদয়। অফিসে ঢুকে বেঁধে নেয় এক্সপার্টের হাতে।

যে জ্যাম রাস্তায় , এই গরমে স্থির বসে বসে স্রেফ সেদ্ধ হতে হয়, এর মধ্যে গলায় একটা ফাঁস জড়িয়ে বসে থাকার কোন মানে হয় না। ফুচকা খেতে খুব ভালোবাসে, নাকি বাসত নীলা। বিয়ের প্রথম দিকে পুরো শহরময় ঘুরে বেড়িয়েছে ওরা, হুডতোলা ভলোবাসার পালা এখন শেষ। কোথাও গেলে ফুচকা খাওয়া চাই-ই নীলার। এমনও হয়েছে শুধু ফুচকাওয়ালার খোঁজে ওরা প্রায় মাইলখানেক হেঁটেছে।

পেয়ে যাওয়ার পর নীলার সে কি খুশি! ঢাকার সব ফুচকাওয়ালার কাছ থেকেই সম্ভবত সে খেয়েছে । নীলার ভাষ্যে এটা একটা রেকর্ড। প্রেগন্যান্সির সময় তো কথাই নেই। ভুতুরে ইচ্ছা চাপতো ওর ফুচকা খাওয়ার, তাও অসম্ভব অসম্ভব সব সময়ে। ওর এই ইচ্ছের সামনে রীতিমত বিপর্যয় বোধ করতো হৃদয়।

শেষ কবে এমন খেয়েছে তা নীলার মনেও নেই। ওর অষ্টপ্রহর কাটে এখন তুলির খাওয়া নিয়ে চিন্তায়। মেয়ের খাওয়ায় মন নেই একেবারেই , এই খাবে না সেই খাবে না , তাও আজ যদি বা খেল পরের বেলা তা হয়তো আর মুখেই তুলবেনা। ওর যে কি নখরা খাওয়া নিয়ে। নানা মজার আইটেম বানিয়ে নিত্য ওর রসনার পরিবর্তনের সাথে পাল্লা দেয় নীলা।

আজ অফিস ছুটির কাঁটায় কাঁটায় প্রায় দৌড়ে বের হল সে, মেয়েকে কোচিং এ নিতে হবে, এক ফাঁকে জাহান ভাবির কাছ থেকে ভেজ সমুচার রেসিপেটাও নিযে নেবে, মনে আশা এটা বানিয়ে মেয়ের টিফিনে দেবে সে, তাতেও যদি সবজিটা ওর খাওয়া হয়। বাসায় ফিরেও হৃদয়ের কাজ শেষ হয় না, একটা এমবিএর খুবই দরকার এই যুগে, তাই ইভনিং ব্যাচে ভর্তি হয়েছে , ক্লাস সবদিন না থাকলেও পড়া , অ্যাসাইনমেন্ট, প্রেজেন্টেশন ও অফিসের বাড়তি কাজের ভারে পর্যুদস্ত হয়ে থকে সে। কাল একটা প্রেজেন্টেশন আছে, এককাপ ধুমায়িত চায়ের কাপ নিয়ে তার কাজে বসে যায় হৃদয়। মাঝে নীলার ফোন আসে , কোচিংফেরত নানুর বাসায় যাবার জেদ ধরায় তুলিকে নিয়ে ওখানে গেছে সে। আজ আর বাড়িতে ফিরবে না, হাড়ির খাবারের বিস্তারিত খবর দিয়ে সে বলে খাবারটা ওভেনে গরম করে যেন হৃদয় খেয়ে নেয়।

যাক, আজ তাহলে ফাঁকা বাড়ির নিঃস্তব্দতায় কাজে ঠিকঠাক কন্সেন্ট্রেশন হবে। অন্যদিনের মত তুলির শোরগোল নেই, ডাইনিং টেবিলে সময়মত খাবার খাওয়ার জন্য নীলার কড়া তাগাদা নেই। সহসা যেন একদিনের জন্য ব্যাচেলার লাইফে ফেরার স্বাধীনতা। বিয়ের পরপর খুব ঘন ঘন বাপের বাড়িতে যেত নীলা। অদৃশ্য সুতো দোটানায় বাঁধা, ছিঁড়েও ছেঁড়ে না।

জীবনে একরাতও যে বাড়ির বাইরে কাটায়নি, সেই আপাদমস্তক চেনা গন্ডির মায়া এতসহজে কি ছাড়া যায়! হৃদয় খুব অভিমান করতো, কপট রাগে বলত, 'তুমি আমার চেয়ে তোমার মাবাবাকেই বেশি ভালোবাসো '। সকালে হৃদয়ের দেরী হয়ে যাচ্ছিলো দেখে নীলার অফিস কারের একটা লিফট নিয়ে নিল সে। অন্যদিন এর অনেক আগে বেরিয়ে পড়তে হয় তাকে, আজ উঠতে দেরী হওয়ায় অলরেডি লেট। প্রথম গন্তব্য তুলির স্কুল। ওর স্কুলের শুরুই সবচেয়ে আগে।

যানজটে আটকে থাকতে থাকতে অস্হির হয়ে ওঠে ওরা তিনজনই। এর মাঝেই এক ফুলবালিকা সুরভিত বেলির মালা নিয়ে ওদের বন্ধ জানালায় নক করে। রুক্ষ স্বরে ওকে যেতে বলে নীলা। ওর টেনশন নিরপরাধীর উপর ঝাড়ে সে। ওহ! সিগনালটা ছাড়ছেনা কেন, তুলিরও না আজ লেট হয়ে যায়।

এসি গাড়িতে বসেও ঘামতে থাকে নীলা। আগে এই পথ দিয়ে যাবার সময় সিগনালে থামতেই অবধারিত বেলী ফুলের গুচ্ছ তুলে দিত হৃদয় নীলার হাতে। কোন দিন সিগনালটা না পেলে মন খারাপ হতো ওদের দুজনেরই। দামী কৃত্রিম সুগন্ধিকে আচ্ছন্ন করে নীলার চুলে জড়িয়ে থাকতো প্রাকৃতিক সফেদ ফুলগুলো। সাপ্তাহিক ছুটির দিন গুলোতে ঘুম ভাঙে অন্যদিনের চেয়ে তাড়াতাড়ি , অফিস ডেতে যেখানে সাড়ে সাতটাতেও বিছানার আরাম ছাড়তে মন চায় না, সেখানে ছয়টার মাঝেই ঘুম ভেঙে গেছে নীলার, কিছুক্ষণ এপাশ ওপাশ করে আর ঘুম আসবে না বুঝে বৃথা চেষ্টা ছেড়ে উঠে পড়লো সে।

ফেসবুকের পাতায় চোখ রেখে উদাসীন দৃষ্টি বিলিয়ে যেতে যেতে একটা সুদৃশ্য খাবারের ডিশের ছবিতে চোখ আটকে গেল ওর। ওর বান্ধবী লোপা, রান্না করে আবার রেসিপি সমেত ছবি তুলে দিয়েছে। রান্নবান্নায় সে বরাবরই প্যাশনেট, এই পাতাটার এডমিনও সে। ছবিটা দেখতে দেখতে ভাবলো নীলা- ওটা রান্না করে হৃদয়কে চমকে দিলে কেমন হয়, ঘুম থেকে উঠেই টেবিলে এই ডিশটা সাজানো দেখবে সে। যেই ভাবা সেই কাজ।

কড়াই কুন্তি নিয়ে রান্নায় লেগে গেল নীলা। রান্নাটা হতে খুব বেশী সময় লাগলো না, ডেকরেশনে গিয়ে ওর একটু সমস্যা হলো। সব উপকরন বাসায় নেই , তাতে কি?নিজের আইডিয়া থেকে কিছু যোগ করে সে অভাব পূরণ করলো সে। বাহ ! সবকিছু শেষে টেবিলে নিজের সাজানো ডিশটার দিকে তাকিয়ে নিজেই মোহিত হয়ে গেল সে, ফেবুর ছবিটার চেয়েও ভালো লাগছে দেখতে। হৃদয়কে দেখানোর জন্য অধীর উত্তেজনা বোধ করল নীলা।

ওকে ডাকার জন্য এক্ষনি যাবে সে,কিন্তু হায়, পিছু ঘুরতেই হৃদয়ের মুখোমুখি হয়ে গেল । কোন ফাঁকে উঠে পা টিপে টিপে পেছনে এসে দাঁড়িয়েছে সে। চোখে মুখে মিটি মিটি হাসি। নীলার চমকের বদলে উল্টা তাকেই চমকে দিয়েছে সে। নিরাশ হল নীলা ওর সারপ্রাইজটা ঠিকমত দেবার সুযোগটা গেল বলে।

ওদিকে এক খাবলা দিয়ে ডিশটা থেকে তুলে মুখে দেবার জন্য লম্বা হাত বাড়িয়েছে হৃদয়। ওর পাশে দাড়িঁয়ে মুখ কোঁচকালো নীলা, 'এই তুমি মুখ ধুয়েছো?' ' না ', বলেই হা হা করে নীলা বাঁধা দেয়ার আগেই একটা বিশাল টুকরা মুখে পুরে চাবানো শুরু করলো হৃদয়। এরপরই মুখ বিকৃত করলো সে। ওর মুখের ভাব দেখে শঙ্কিত নীলা জিজ্ঞেস করলো ' কি হলো , খেতে ভালো হয়নি? ' 'উঁহু, একেবারে অখাদ্য হয়েছে। 'সোজাসাপটা জবাব দিলো হৃদয়।

নীলা টেস্ট বেসিসে খেয়ে দেখল, আসলেই ,এই জীবনে এত বাজে কোন আইটেম সে চেখে দেখে নি। লোপাকে মনে মনে একটা গাল দিল সে। কি ঘোড়ার ডিমের একটা জঘন্য রেসিপি দিয়েছে আবার রান্না পেজের অ্যাডমিন হয়েছে! এতক্ষণের সব কষ্ট পুরোটাই পন্ডশ্রম। ওর মুখভাব দেখে মনের ভাবটাও আঁচ করে নিল হৃদয়। সান্তনা দিল, 'আহহা খেতে খারাপ হয়েছে তো কি হয়েছে, বি পজেটিভ।

' 'এ্যাই এখানে পজেটিভের কি আছে?' 'আরে আছে তো,এই যে এই ডেকরেশনটা, আমি আমার জীবনে এত সুন্দর ফুড ডেকোরেশন দেখি নি। ' ভার্সিটি লাইফের সদা ক্যাজুয়াল, নেভার সিরিয়াস হৃদয়ের চোখেমুখে সে-ই ভাবভঙ্গি- যাতে নীলার সব চিন্তা, অভিমান , রাগ সব ভেসে যেত- সবসময়। কোন কিছু গায়ে মাখতো না সে আর ওর কাছে গেলে হৃদয়ের এই কেয়ার ফ্রি ভাবটা সংক্রমিত হতো নীলার মাঝেই। সব অপ্রাপ্তিগুলো নেই হয়ে যেত মুহূর্তে। সেই পুরানো সদাহাস্য হৃদয়ের প্রেমে পড়ার পেছনে এটা ছিল একটা বড় অনুঘটক।

ঐ মুখভঙ্গির জয় হলো আজও , হতাশ নীলা হেসে ফেলল। এখন দুইজনই হাসছে। হৃদয়ের হাসির জোর বেশি। তুলির ঘুম ভেঙ্গে গেল ওর হাসির শব্দে, সোজা ডাইনিং এ এসে দেখে আব্বু আম্মুর অকারণ হাসাহাসি। তারপরই ওর চোখ গেল টেবিলের দিকে।

সুন্দর ডিশটা খাবার অপেক্ষায় সাজানো। ওকে যেন হাতছানি দিয়ে ডাকছে। তুলির লোভাতুর দৃষ্টি দেখে ওর মনের ভাবটা ঠিক টের পেল দুইজনই। ওটা সরাতে সরাতে জীবনে এই প্রথমবারের মত কোন খাবার খেতে মেয়েকে বাঁধা দিল নীলা। এই অখাদ্য মেয়েকে খেতে দেয়া যাবে না।

'তুলি মা ,যাও হাত মুখ ধুয়ে আসো, আমি আজকে তোমার ফেবারিট মোগলাই পরোটা বানাচ্ছি। ' বলে নীলা হৃদয়ের দিকে শাসনের ভঙ্গিতে তাকালো, 'আর তুমিও , কুইক। দুইজনেরর চালই তো গদাইলস্করী, টেবিলে খাবার লাগালোর পর যেন একটুও দেরী না হয়। ' ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.