আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

ভারত বাংলাদেশ বানিজ্য।

প্রবাসী ভারত এবং বাংলাদেশ। পাশাপাশি দুটো স্বাধীন রাস্ট্র। আর প্রতিবেশী দেশ হিসেবে এক এর উপর অন্যের নির্ভরশীলতা, বা প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য। ভারত বৃহৎ শক্তিশালী অর্থনীতির দেশ, শিল্পে বাংলাদেশের চেয়ে অগ্রসর , আয়তনে বাংলাদেশের ২০ গুনের বেশী এবং জনসংখ্যায় ৮ গুন বেশী। ভারত বাংলাদেশ বানিজ্য সম্পর্ক দু দেশের জন্য একাধিক কারনে গুরুত্বপুর্ন।

প্রথম কারন হল বানিজ্যে বৈষম্য এবং সার্বিক আমদানী রফতানীর পরিমান। ভারত থেকে বাংলাদেশ তার মোট আমদানীর ১৫% ভাগের বেশী মিটিয়ে থাকে, অন্য দিকে পশ্চিমা দুনিয়ার বাইরে ভারতের রফতানীর বড় বাজার বাংলাদেশ। দ্বিতীয় কারন হল বৈধ আমদানী রফতানীর পাশাপাশি রয়েছে অবৈধ বানিজ্য, যার মোট পরিমান বৈ্ধ বানিজ্যের প্রায় সমান। এই অবৈধ বানিজ্যের কারনেই বাংলাদেশ সরকার বঞ্চিত হচ্ছে বৈধ শুল্ক আয়ের সমপরিমান অর্থ থেকে। এই অবৈধ বানিজ্য বা “Informal trade” এর ক্ষেত্রেও ভারত থেকে অনেক বেশী মালামাল আসে বাংলাদেশে, পক্ষান্তরে বাংলাদেশ থেকে ভারতে চোরাচালান হচ্ছে অনেক কম।

এই Informal trade” এর ক্ষেত্রেও ভারতের উদবৃত্ত থাকছে। বাংলাদেশে ভারতের রফতানী এবং বাংলাদেশ থেকে ভারতে রফতানীর পরিমানের মধ্যে পার্থক্য পর্বত প্রমান। সাম্প্রতিক বছরে ভারত বাংলাদেশ দ্বিপাক্ষিক বানিজ্যের মোট পরিমান ৫০০ কোটি ডলার ছাড়িয়ে গেছে। ২০১০-১১ অর্থবছরে বাংলাদেশ ভারত থেকে আমদানী করেছে ৪৫৮ কোটী ৬৮ লক্ষ ডলারের পন্য সামগ্রী, পক্ষান্তরে ভারত বাংলাদেশ থেকে আমদানী করেছে ৫১ কোটি ৬০ লক্ষ ডলারের পন্য সামগ্রী। গত বছরের তুলনায় বাংলাদেশ্র রফতানী বৃদ্ধির হার ৬৮% পক্ষান্তরে ভারতের রফতানী বৃদ্ধির হার ৪৩%।

বাংলাদেশ এবং ভারতের বানিজ্য দুই দেশের মধ্যে এক অস্বস্তিকর অনস্বীকার্য ব্যাপার। ভারত বাংলাদেশ থেকে যে পন্য আমদানী করে তার পরিমান ভারতের মোট আমদানীর ক্ষুদ্র এক অংশ(.০১%) পক্ষান্তরে ভারত থেকে বাংলাদেশ আমদানী করে থাকে তার মোট আমদানীর ১৫% ভাগ। ২০০৪ সালে বাংলাদেশে ভারতের রফতানী ছিল ১৭০ কোটী ডলার আর বাংলাদেশের রফতানী ছিল মাত্র ৭ কোটি ৮০ লক্ষ ডলার। ১৯৯৬/৯৭ সাল থেকে বাংলাদেশে ভারতের রফতানী বেড়েছে প্রতিবছর গড়ে ৯.১% হারে, যা ভারতের জাতীয় রফতানীর গড় বৃদ্ধির হার ৮.৪ থেকে সামান্য বেশী। কিন্তু বাংলাদেশ থেকে ভারতের আমদানী বৃদ্ধি পেয়েছে তাদের জাতীয় গড় বৃদ্ধি হার ৯।

২ % এর চেয়ে অনেক নীচে মাত্র ৩% হারে, ফলে গড়ে উঠেছে বিপূল ব্যাবধান যা প্রতিবছরই বেড়ে চলেছে গড়ে ৯। ৫% হারে। শুধুমাত্র ২০০৫/২০০৬ অর্থ বছরে এসে ব্যাবধান কিছুটা কমে । ঐ বছর পূর্ব্ববর্তি বছরের তুলনায় বাংলাদেশের আমদানী কিছুটা কমে হয় ২০০ কোটি ডলারের স্থানে ১৮০ কোটি ডলার এবং রফতানী ১৪ কোটী ৪০ লক্ষ ডলার থেকে বেড়ে দাঁড়ায় ২৪ কোটি ২০ লক্ষ ডলারে। বাংলাদেশের রফতানী সামগ্রীগুলো হল কাচাপাট, পাটজাত সামগ্রী, মাছ, খনিজ ডিস্টিলেট, ফল, পোষাক, ঝুট, নীট সামগ্রী, চামড়াজাত দ্রব্য, সিরামিক, ইত্যাদি।

ভারত থেকে বাংলাদেশ যা আমদানী করে থাকেঃ- তুলা, কাপড় এবং সুতা, যানবাহন এবং যানবাহনের যন্ত্রাংশ, পশুখাদ্য, যন্ত্রপাতি, খাদ্য শস্য, লোহা এবং ইস্পাত, রাষায়নিক দ্রব্যাদি, বৈদ্যুতিক যন্ত্রপাতি, ফল, মসলা, কফি, চা ইত্যাদি। উপরের তালিকা সামগ্রীগুলোর ২০১০/২০১১ সালের মোট মুল্যের ক্রমানুসারে। অর্থাৎ বাংলাদেশ সবচে বেশী রফতানী করেছে পাট এবং পাটজাত দ্রব্য , যার পরিমান মোট রফতানীর অর্ধেক, পক্ষান্তরে ভারত থেকে সবচে’ বেশী আমদানী করেছে, তুলা সুতা , কাপড়- যার পরিমান মোট আমদানীর এক তৃতীয়াংশ। ভারতে যে সমস্ত কারনে বাংলাদেশের রফাতানী ব্যাহত হয় তা হল “ প্রতিটি চালানের ল্যাবরেটরী পরীক্ষা, পরীক্ষার ফল পেতে বিলম্ব, বিভিন্ন রাজ্যের নিজস্ব “শুল্ক” , এন্টী –ডাম্পিং, এবং কাউন্টারভেইলিং ডিউটী, ইত্যাদি। এর বাইরে রয়েছে স্থলপথে পন্য রফতানীর বাধা সমূহ, যেমন, গুদাম ব্যাবস্থা অপ্রতুল, রাস্তাঘাটের দুরবস্থা, ভারতীয় কাস্টমস, পন্যবাহী যানবাহনের পার্কিং এর অসুবিধা, ট্রানশিপমেন্ট ইয়ার্ডের অপ্রতুলতা ইত্যাদি।

কাউন্টারভেইলিং ডিউটি হল আমদানী পন্যের উপর আরোপিত শুল্ক । WTA এর আওতায় যখন আমদানীকারক দেশ মনে করে যে রফতানী কারক দেশ ভর্তুকি দিয়ে পন্য রফতানী করছে ফলে স্থানীয় ভাবে উৎপাদিত পন্য ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে তখন এই শুল্ক আরোপের সুযোগ রয়েছে। ভারত সম্প্রতি বাংলাদেশ থেকে পাট আমদানীর উপর ৪% হারে কাউন্টারভেইলিং ডিউটী বা কর আরোপ করেছে। বলা হয়ে থাকে ভারতের অতিরিক্ত সংরক্ষনশীলতার কারনে ভারতে বাংলাদেশের রফতানী ব্যাহত হচ্ছে। বিগত এক দশক কাল ধরে ভারতের আমদানী প্রতি বছর ৯% হা্রে বাড়ছে, এক বছরে ভারতের আমদানী বৃদ্ধির পরিমান বাংলাদেশের মোট রফতানীর চেয়েও বেশী।

ভারতে অনান্য রফতানীকারক দেশ গুলো যে হারে শুল্ক দিয়ে থাকে তার চেয়ে কম শুল্ক দিতে হচ্ছে বাংলাদেশকে। কারন SAFTA(South Asian Free trade agreement) চুক্তির অধীনে বাংলাদেশ কর সুবিধা পেয়ে থাকে। তার পর ও ভারতে রফতানী উল্লেখযোগ্য হারে বাড়ছে না এবং বানিজ্যে বৈষম্য বেড়েই চলেছে। সার্ক দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ , নেপাল ভূটান এবং মালদ্বীপকে গন্য করা হয় LDC(least developed country) এবং ভারত, পাকিস্তান এবং শ্রীলঙ্কা কে ধরা হয় অপেক্ষাকৃত উন্নত অর্থনীতির দেশ Non LDC(least developed country)। SAFTA(South Asian Free trade agreement) সাক্ষরিত হয়েছিল ২০০৪ সালে পাকিস্তানের ১২ তম সার্ক শীর্ষ সম্মেলনে, ইসলমাবাদে।

এর আগে ১৯৯৪ সালে সাক্ষরিত হয় SAPTA( south Asian preferential trade agreement)। আন্ত সার্ক দেশ গুলোর মধ্যে বানিজ্য বৃদ্ধির উদ্দেশ্যে সাক্ষরিত এই চুক্তি যা ২০০৬ সালের ১লা জানুয়ারি থেকে কার্যকর রয়েছে। শুল্কের পরিমান কমিয়ে এনে ২০১৩ সালের মধ্যে তা হবে শুন্য। সার্ক দেশ সমূহের মধ্যে স্বল্পোন্নত দেশ হিসেবে বাংলাদেশ আরো তিন বছর অর্থাৎ ২০১৬ সাল পর্যন্ত ভারত থেকে আমদানীর উপর শুল্ক আদায় করবে কিন্তু রফতানীর সময় ভারতকে কোন কর দিতে হবে না। সেক্ষেত্রে ভারতের বাজারে অপেক্ষাকৃত কম দামে মিলবে বাংলাদেশী পন্য।

এর মধ্যে ৪৮০ টি পন্যকে “স্পর্শকাতর” তালিকায় রেখেছে ভারত। ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর বাংলাদেশ সফরকালে ৪৬ টি পন্যকে শুন্য শুল্কে ভারতে রফতানীর চুক্তি হয়েছে। বাংলাদেশের প্রধান রফতানী পন্য তৈরীকৃত পোষাক। গত বছর বাংলাদেশ রফতানী করেছে ১৮০০ কোটি ডলারের তৈরী পোশাক যা বাঙ্গলাদেশের মোট রফতানীর প্রায় ৮০ ভাগ। এই রফতানীর প্রধান বাজার হল ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন এবং উত্তর আমেরিকা।

কিন্তু ভারতে তৈরী পোশাক রফতানীর পরিমান নগন্য। বিশ্বব্যাঙ্কের রিপোর্ট অনুসারে যে সমস্ত কারনে ভারতে তৈরী পোষাক রফতানী বাড়ছে না সেগুলো হলঃ- ১) ভারত নিজেও তৈরী পোষাক রফতানী কারক দেশ। ২) বাংলাদেশে তূলা উৎপাদিত হয় না, তুলা সুতা এমনকি কাপড় ও আসে ভারত থেকে। বাংলাদেশের পোশাক শিল্প মূলতঃ C&M (Cutting and making) বা Value Addition। যদি ফ্রী ট্রেড এগ্রিমেন্টে “রুল অফ অরিজিন” কে বিবেচনা করা হয় তাহলে তৈরী পোষাকের এক বিরাট অংশ বাইরে থেকে যাবে।

( একবার ভারতের অরবিন্দ মিলসের মার্কেটিং ম্যানেজারের সাথে আলাপ করার সুযোগ হয়েছিল ঢাকাতে বেশ কয়েক বছর আগে। তার দাবী অনুসারে তারা বাংলাদেশের পোষাক শিল্পে ৩৫% কাপড়ের যোগান দিয়ে থাকে) ৩) বাংলাদেশ এবং ভারতে উৎপাদিত তৈরী পোষাকের মূল্যের পার্থক্য খুব বেশী নয়। ৪) ভারতের চেয়ে ইউরোপীয় ইউনিয়ন বা যুক্তরাস্ট্রে পোষাক রফতানী অনেক বেশী লাভ জনক। ৫) ভারত এবং শ্রীলঙ্কার মধ্যে বিদ্যমান রয়েছে “ Free Trade Agreement” ভারতে প্রায় বিনা শুল্কে তৈরী পোষাক রফতানী করে থাকে অপর সার্ক দেশ শ্রীলঙ্কা। কিন্তু শ্রীলঙ্কার তৈরী পোষাকের পরিমান ও খুব বেশী নয়।

বানিজ্য নির্ভর করে চাহিদা এবং লাভের উপর। এখানে বিক্রেতা এবং ক্রেতা উভয়েই লাভবান হয়ে থাকেন। রাজনৈতিক মত পার্থক্য থাকলেও বানিজ্য থেমে থাকে না। ১৯৪৭ সালের ভাগ হওয়ার পর এক দেশ ছিল অপরের শত্রু । তারপরও ভারত এবং পাকিস্তান ছিল একে অপরের প্রধান বানিজ্যের অংশীদার।

দ্বিপাক্ষিক বানিজ্যে ভারতের সাথে ঘাটতি থাকলেও অনান্য দেশের সাথে উদবৃত্ত রয়েছে বাংলাদেশের। ভারতের তুলা এবং সুতা বা কেমিকেল আমাদের পোশাক শিল্প বা চামড়া শিল্পের জন্য প্রয়োজন। খাদ্য শস্য বা যানবাহন, যন্ত্রপাতি ইত্যাদির লাভজনক উৎস ও ভারত। ভারত থেকে আমদানীর বৃহৎ অংশ হয়ে থাকে বেসরকারী খাতে এবং তা উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাবে। ভারতের সাথে নদীর পানিবন্টন, সমুদ্রসীমা, সীমান্তে হত্যা ইত্যাদি নিয়ে সমস্যা থাকা সত্বেও বানিজ্য যে উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাবে এ ব্যাপারে সন্দেহ নেই।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.