আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

গল্প: বেড়াল

বাংলার মাটি বাংলার জল, বাংলার বায়ু, বাংলার ফল, পুন্য হউক, পুন্য হউক, পুন্য হউক, হে ভগবান। বাংলার ঘর, বাংলার হাট, বাংলার বন, বাংলার মাঠ, পুর্ন হউক, পূর্ন হউক, পূর্ন হ্‌উক, হে ভগবান। রবীন্দ্রনাথ হাসনাতের মেয়েটি গতকাল বিকেলের দিকে সুইসাইড করেছে। হাসনাতই সন্ধ্যার পর ফোন করে জানাল। তখন খুব বৃষ্টি পড়ছিল।

কেমন লাগছিল সামিহার? তখন? বৃষ্টির ভিতর মর্মান্তিক শ্বাসকষ্ট আর পৃথিবীকে বিদায় জানাতে? সামিহার বারো বয়স হয়েছিল। ওইটুকুন বয়েসে অত সাহস হল ওর ? অবশ্য ছোট মেয়েটির মনে চাপা কষ্টও ছিল অনেক। বাবা চোখের সামনে হারিয়ে গেল ... মেয়ের কাছে হাসনাত তো আর বেঁচে ছিল না। সামিহার বাবাকে কেড়ে নিল সানজিদা। এখন ডাইনিং টেবিলে বসে শিউরে উঠল সানজিদা।

হাত কাঁপছিল। একটু আগে এক কাপ কফি বানিয়েছে। ড্রইংরুমে রোদে ভরে আছে। অক্টোবরের সুন্দর সকাল। সানজিদা দীর্ঘশ্বাস ফেলে।

সামিহার জন্মদিন ছিল এ মাসেই। বাবাকে কাছে না পেয়ে সামিহা অসুস্থ হয়ে পড়েছিল। সামিহার মা ফাহমিদা হয়তো মেয়েকে সান্ত্বনা দিতে পারেনি। অসুস্থ অবস্থায় সুইসাইডের সিদ্ধান্ত নিল সামিহা । সামিহা যে সুইসাইড করবে তা ভাবতে পারেনি সানজিদা।

গতরাতে হাসনাত আসেনি। আজ সকালে একবারও ফোন করেনি। সানজিদাও বারবার ফোন করে পায়নি হাসনাতকে। ফাহমিদা কি করছে এখন? ও তো একা হয়ে গেল। ভীষণ একা।

মেয়েকে নিয়ে বেঁচে ছিল যাহোক। এখন? বাকি জীবন একা একা কাটাবে দারুন মর্মযন্ত্রণায় ... আর আমাকে অভিশাপ দেবে? কফিতে চুমুক দেয় সানজিদা। বিস্বাদ ঠেকে। কেন? এত যত্ন করে বানালাম। ভিতরে একটা রাগ টের পায় সানজিদা।

কার ওপর রাগ কে জানে। তবে মাংস-চর্বি ভেদ করে রাগটা ঠিকই উঠে আসছে। ঠিক তখনই পোড়া গন্ধ পেল। সর্বনাশ! গ্যাসের চুলা কি বন্ধ করিনি? দৌড়ে কিচেনে যায় । না।

চুলা তো বন্ধ। তা হলে? তা হলে পোড়া গন্ধ পেলাম কেন? মনের ভুল? কাল রাতেও একবার পচা গন্ধ পেয়েছিল সানজিদা। ফাঁকা ফ্ল্যাট। হাসনাত নেই। ঘুম আসছিল না।

তখন কেমন পচা একটা গন্ধ পেয়েছিল । বিছানায় ছটফট করছিল। যে বিছানায় এখন থেকে চরম পুলক আর স্খলনের মুহূর্তে খুব কাছ থেকে একটি বেড়াল ডেকে উঠবে। তখন অনেক রাত। ঝিরঝির বৃষ্টি পড়ছিল।

তখন ... যখন সামিহার লাশ সম্ভবত মর্গে; কিংবা হাসপাতালের হিমাগারে। পচা গন্ধ নীচের গলি থেকে উঠে আসছে; এভাবে নিজেকে সান্ত্বনা দিয়েছিল। হাসনাত কে বেশ ক’বার ফোন করেছিল। পায়নি। তারপরই একবার ভূমিকম্প হল মনে হল।

বিছানাশুদ্ধ ঘরটা দুলে উঠল। বেশ ক’বার। মনের ভুল? হতে পারে। আবার নাও হতে পারে। দেশটায় আজকাল এত ঘন ঘন ভূমিকম্প হচ্ছে।

যে দিন ওরা এ ফ্ল্যাটে উঠে এল, ঠিক সেদিনই ভূমিকম্প হল। কী ভয় আর আতঙ্ক যে গ্রাস করেছিল! রাত নটায় নীচে নামার জন্য সিঁড়িতে হুড়োহুড়ি। খালি মনে হচ্ছিল এখনি? আরও কিছু সুখশান্তির পরে নয়? এ মাসে মালয়েশিয়া যাওয়ার কথা। তারপরে? মাস চারেক হল বনানীর এই ফ্ল্যাট ভাড়া নিয়েছে হাসনাত। আজকাল হাজার দুয়েক টাকা বেশি ভাড়া দিলে বাড়িওয়ালা বেশি প্রশ্ন করে না।

বাড়িওয়ালার চোখে হাসনাত আর সানজিদা স্বামী-স্ত্রী। মনের সুখে ঘর সাজিয়েছে সানজিদা। গুলশান মার্কেট থেকে বেছে বেছে ফার্নিচার কিনেছে । সানজিদার রুচি ভালো। খানিকটা অ্যাম্বিশ্যাস বলেই হোম ইকোনমিক্সে পড়া শেষ করে ইন্টেরিয়র ডোকোরেশনের দু-বছরের কোর্স করেছিল।

‘ইয়োলো হোম’ নামে একটা ইন্টেরিয়র ফার্মে কিছুদিন চাকরিও করেছে। ( জামিল কনজারভেটিভ বলে বেশি দিন অবশ্য চাকরি করতে দেয়নি। ) সবাই সানজিদার গুণের প্রশংসা করত; লক্ষ্মী মেয়ে বলত। অবশ্য ওর ভিতরের সংকীর্ণ স্বার্থপরতা (যা হয়তো প্রতিটি মানুষের মধ্যেই বিরাজমান) কেউই টের পেত না, বরং ওর আয়ত চোখ আর চোখে দীর্ঘ আঁখিপল্লবের প্রশংসা করত। সানজিদার গায়ের রং শ্যামলার দিকে হলেও কমনীয় শরীরে টলটলে যৌবন উপছে পড়ত ... হাসনাত তো তাতেই মজেছিল ... এতকাল দূর থেকে মুগ্ধ প্রশংসার চোখে তাকাত।

ফাটকাবাজারে ফুলে ফেঁপে উঠার পরই লোভী হাতটা বাড়াল ... হাসনাত ব্যাঙ্কার, বেশ নামী একটা প্রাইভেট ব্যাংকে আছে। হঠাৎই শেয়ার মার্কেট থেকে কয়েক কোটি টাকা লাভ হল । তার পরপরই হাসনাত কেমন বেপরোয়া হয়ে ওঠে। এসব কি সামিহা বুঝত? হাসনাতের কাছে জামিল তুচ্ছ হয়ে যায়। এত দিনের বন্ধুত্বও তুচ্ছ হয়ে যায়।

জামিলও অবশ্য সানজিদার সঙ্গে মিসবিহেভ করত। সানজিদাও মুক্তি চাইছিল। সানজিদার বাচ্চাকাচ্চা হয়নি বলে সামিহাই ছিল সানজিদার মেয়ে। দত্তক মেয়ে নয়। আপন মেয়ে।

দুটি পরিবার গত বছর মাইক্রোবাস ভাড়া করে বান্দরবান বেড়াতে গেল। সামিহা তো সারাক্ষণ সানজিদার পাশেই ছিল। আড়ষ্ট হলেও সামিহা সানজিদাকে মা ডাকার চেষ্ট করত। এতে অবশ্য মুখ কালো করত ফাহমিদা । না, ফাহমিদাকে ডির্ভোস দেয়নি হাসনাত ।

সানজিদাও জামিলকে ডির্ভোস দেয়নি। সানজিদাকে ডিভোর্স দেওয়ার সাহস নেই জামিলের । শিশু একাডেমীতে চাকরি করে জামিল । বাংলাদেশ বেতারে নজরুলগীতির এনলিস্টেড শিল্পী। এ যুগে কি এদের গলা উঁচু করে কথা বলার সাহস আছে? গানের স্কুল খোলার জন্য জামিলকে অবশ্য মোটা অঙ্কের চেক দিয়েছে হাসনাত ।

হাসনাত আর সানজিদা বিয়েও করেনি। একসঙ্গে আছে। এই। চার মাস হল। একে কি বলে? এ এক নতুন ধরনের জীবন।

ঈর্ষাকাতর লোকে বলবে: ‘পরকীয়া’ । সানজিদা বলে: ‘প্রেম’। ফাহমিদা হেরে গেছে। কাউকে না কাউকে তো জীবনস্রোতে হারতেই হয়। বেশির ভাগ মানুষই কূলে পৌঁছতে পারে না।

তবে সামিহার মৃত্যুটা বড্ড বারাবারি হয়ে গেছে। মেয়েটা কেন যে অমন করল? হাসনাত আজকাল ব্যাঙ্ক থেকে সরাসরি এ ফ্ল্যাটেই চলে আসে। বাড়ি প্রায়ই ফেরে না। ফাহমিদা ফোন করে। হাসনাত ধরে না।

মাঝেমাঝে দুজনের ফোনে ঝগড়া হয় । ফাহমিদা একটা বিদেশি সাহায্য সংস্থায় চাকরি করে। বেতন ভালো। হাসনাত ওদিক দিয়ে অনেকটাই নিশ্চিন্ত । হাসনাত আর ফাহমিদার কাছে ফিরবে না।

পয়ত্রিশেই কেমন বুড়িয়ে গেছে ফাহমিদা । আর দিন দিন হাসনাতের বয়স যেন কমছে। দু’জন পার্টারকে নিয়ে উত্তরায় ফাইভ স্টার হোটেলের জন্য জায়গা দেখছে। থাইল্যান্ডের একটা কোম্পানীর সঙ্গে জয়েন্ট ভেঞ্চারে দেড়শ কোটি টাকার প্রজেক্ট। এরই মধ্যে দু’বার থাইল্যান্ডও ঘুরে এল।

হাসনাত এখন ব্যাংকার না ব্যবসায়ী, নাকি ব্যাবসায়ী না ব্যাংকার ঠিক বোঝা যাচ্ছে না। সানজিদা ড্রইংরুমে ফিরে আসে। নগ্ন। খালি পা। কেবল স্বচ্ছ নাইটি পরে আছে।

চুল এলোমেলো। মাস চারেক আগেও প্রায় কোমর অবধি দীঘল চুল ছিল। বনানীর একটা পারলারে যেয়ে কেটেছে। তার আগে অবশ্য হাসনাতের পারমিশন নিয়েছে। পারমিশন হাসনাত এরও নিতে হয়।

মোবাইলে সানজিদার নেকেড ছবি তোলে। তার পারমিশন। কখনও সোফায়। কখনও বাথটাবে। বিভিন্ন ভঙ্গিতে।

হয়তো পার্টনারদের সে ছবি দেখায় হাসনাত। দৃশ্যটা কল্পটা করতেই এক ধরনের চাপা আনন্দ বোধ করে সানজিদা। গতমাসে দু’জন থাই পার্টনারকে নিয়ে এসেছিল হাসনাত। অনেক রাত অবধি ড্রিংক করতে করতে গল্পগুজব করলেও ওদের সঙ্গে বিছানায় যাওয়ার ইঙ্গিত দেয়নি হাসনাত। দেবে।

খুব শীঘ্রি। সানজিদা জানে। হাসনাত কে কখনও অর্ধনগ্ন ছবি তোলার পারমিশন দেয়নি ফাহমিদা । আর সেক্সেও ফাহমিদা খুব প্যাসিভ। আর কনজারভেটিভ।

বিয়ের পর হাসনাত নাকি পুলক অনুভব করে নি। অবশ্য সানজিদার সঙ্গে ফ্যান্টাসির যেন শেষ নেই। থাইল্যান্ড থেকে সেক্স টয় এনেছে হাসনাত ... ওসব ... যদিও হাসনাত আর আনন্দ পাবে না। চরম পুলক আর স্খলনের মুহূর্তে খুব কাছ থেকে এখন একটি বেড়াল ডেকে উঠবে। কাল খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে আয়নায় মুখ দেখছিল সানজিদা।

না, শ্যামলা মিষ্টি মুখে পাপের কোনও ছাপ পড়েনি তো। কেবল চোখের মনির রং বদলে যাচ্ছে। অল্প অল্প ড্রিংকস করছে আজকাল। তাই বুঝি। সানজিদার মুখটি অভিজাত রক্ষিতার মতন স্নিগ্ধ।

এবং সুন্দর। ছবিতে মুগল হেরেমের নারীর মুখ দেখেছে সানজিদা। কি সুন্দর। সুন্দর আর পবিত্র ... কফি। ঠান্ডা হয়ে গেছে।

বিষাদ টের পায় সানজিদা। সেই সঙ্গে আলস্য। আরেক কাপ কফি বানাতে ইচ্ছে করছে না। আজকাল এমন হচ্ছে। ভীষণ আলস্য জমছে শরীরে।

ড্রইংরুমের সোফায় এসে বসল। ড্রইংরুমে টিভি চলছে। অবশ্য শব্দ কমানো। একটা নিউজ চ্যানেলে গতকালের একটা খবর দেখাচ্ছে। শেয়ার মার্কেটে পুঁজি হারিয়ে ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদের বিক্ষোভ ।

মতিঝিলে যানবাহন চলাচল বন্ধ। অর্থমন্ত্রীর পদত্যাগ চায়। প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ চায়। সানজিদা হাসল। কাউকে না কাউকে তো পুঁজি হারাতে হবেই।

নইলে হাসনাতরা টাকার পাহাড়ে উঠবে কীভাবে? ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীরা সর্বশ্রান্ত্র হলেই না তবে হাসনাত আবদুল্লারা রাতারাতি কোটিপতি বনে যাবে। মালয়েশিয়ায় ফ্ল্যাট কেনার কথা ভাবছে হাসনাত । ফ্ল্যাট সানজিদাই পছন্দ করবে। এ মাসেই কুয়ালালামপুর যাওয়ার কথা। ভবিষ্যতের সেই সব সুখের দিনের কথা ভেবে সানজিদা পুলক বোধ করতে চায়।

পারে না। সামিহার শ্যামলা বিষন্ন মুখটি মনে পড়ে। ড্রইংরুমের জানালায় ঝলমলে রোদ। আকাশের রং কি সুন্দর! ফ্যাকাশে নীল। অক্টোবরের সুন্দর সকাল।

ভারি নির্জন সকাল । এমন কী নীচের গলি থেকেও কোনও শব্দ উঠে আসছে না। গত বছর অক্টোবরে বান্দরবন শহরটিও এমনই নির্জন ছিল। দুপুরে একটি বৌদ্ধ মন্দিরের প্রাঙ্গনে সামিহার সঙ্গে হাঁটছিল সানজিদা। একজন বৃদ্ধ বৌদ্ধ ভিক্ষু বিষন্ন চোখে চেয়ে ছিল সামিহার দিকে।

যেন তিনি দেখতে পাচ্ছেন আসন্ন ভবিষ্যৎ। অজানা আশঙ্কায় বুক কেঁপে উঠেছিল সানজিদার। বৌদ্ধ মন্দিরের নীচে মাইক্রোবাসে উঠল সন্ধ্যার আগে আগে। মাইক্রোবাসটা টার্ন নেওয়ার সময় একটি বেড়াল পিষে মারল ... সানজিদা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে। চারদিক কী নির্জন! যেন শহরের কেউই বেঁচে নেই।

যেন শহরের সব নাগরিক মরে গেছে। যারা অর্থহীন জীবন কাটাত। একটি কি দুটি বেড়াল বেঁচে আছে কেবল। আর অজস্র শকুন। এমন তো হতে পারে।

হতে পারে না কি? এক মুহূর্তে ধসে যেতে পারে শহরটা। যেমন সামিহার মৃত্যুর পর হাসনাত এখন বদলে যেতে পারে। সানজিদার পায়ের তলার মাটি ধসে পড়তে পারে। কথাটা কাল থেকে যতই ভাবছে সানজিদা ততই আতঙ্কগ্রস্থ হয়ে উঠছে। মোবাইলের রিং টোনের আওয়াজে সম্বিৎ ফিরে পায় সানজিদা।

ঝুঁকে সোফার ওপর থেকে মোবাইল তুলে নেয় । ফাহমিদা। সানজিদার শরীর অবশ হয়ে আসে। এখন যদি আমিই হেরে যাই? সানজিদা পায়ের কাছে নরম স্পর্শ পায়। যেন একটি বেড়াল মুখ ঘঁষছে ... ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.