আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

(Part-৮) 'ট্রানজিট'-এর সহজপাঠ। ট্রানজিট ও করিডোর কি, ভারতকে ট্রানজিট না করিডোর দেওয়া হলো?

29. ভারতকে ট্রানজিট দিতে ব্যয় হবে ৩৬ হাজার কোটি টাকা : ভারতকে ট্রানজিট সুবিধা দিতে অবকাঠামো উন্নয়নে বাংলাদেশের প্রায় ৩৬ হাজার কোটি টাকা ব্যয় হবে। এর মধ্যে রেলপথে ব্যয় হবে সবচেয়ে বেশি, প্রায় ১৭ হাজার কোটি টাকা। তবে ট্রানজিট থেকে বাংলাদেশ কি পাবে বা কত আয় হবে সে হিসাব এখনও করা হয়নি। ট্রানজিট দেয়ার বিনিময়ে বাংলাদেশ কতটা লাভবান হবে বা এর জন্য কীভাবে দর কষাকষি করা উচিত, সে বিষয়ে সুস্পষ্ট কোনো তত্পরতা এখনও শুরু হয়নি। অন্যদিকে গত বছরের সেপ্টেম্বরে বিদ্যমান নৌপথে ট্রানজিট সুবিধার বিপরীতে ভারতীয় জাহাজ থেকে মাশুল আদায় নিয়ে বিপত্তি ঘটে।

সরকারের একটি অংশ কোনোরকম মাশুল বা ফি ছাড়াই ভারতকে ট্রানজিট দিতে সচেষ্ট হয়। একপর্যায়ে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) জারি করা ট্রানজিট বিষয়ক বিধিমালাও স্থগিত করা হয়। এর আগে গত বছরের জুনে এনবিআর এই বিধিমালা জারি করে স্থল ও রেলপথে ট্রানজিটের আওতায় পণ্য পরিবহনের মাশুল নির্ধারণ করেছিল। সম্প্রতি ট্রানজিট ও ট্রানশিপমেন্ট সংক্রান্ত কোর কমিটির বৈঠকে ব্যয়ের বিষয়টি তুলে ধরা হয়েছে। ওই বৈঠকে ভারত, নেপাল ও ভুটানসহ সম্ভাব্য দেশগুলো যে পথে ট্রানজিট সুবিধা পাবে সেটিও চিহ্নিত করা হয়েছে।

সম্ভাব্য ১৩টি রুট চিহ্নিত করা হয়েছে ট্রানজিট ও ট্রানশিপমেন্টের জন্য। এসব রুটে ট্রানজিট সুবিধা পেলে ভারতের এক অঞ্চল থেকে অন্য অঞ্চলে পণ্য পরিবহনে সর্বোচ্চ ৭৬ থেকে সর্বনিম্ন ১২ শতাংশ খরচ সাশ্রয় হবে। প্রসঙ্গত, ট্রানজিট সংক্রান্ত অবকাঠামো উন্নয়নে কি পরিমাণ ব্যয় হতে পারে সেটি খতিয়ে দেখতে ট্রানজিট সংক্রান্ত কোর কমিটি একটি উপকমিটি গঠন করে। পরে ওই উপকমিটি অবকাঠামো উন্নয়নে যে ব্যয় হতে পারে তার একটি প্রতিবেদন জমা দেয় কোর কমিটির কাছে। সে অনুযায়ী ট্রানজিট সংক্রান্ত অবকাঠামো খাতে সম্ভাব্য ব্যয় হচ্ছে ৩৬ হাজার ২৯০ কোটি টাকা।

এর মধ্যে রেলপথে ব্যয় ১৭ হাজার ৩১৮ কোটি টাকা; সড়কপথে ৯ হাজার ৪৮৭ কোটি টাকা; নৌপথে ৪ হাজার ৫৭৮ কোটি টাকা; চট্টগ্রাম বন্দর উন্নয়নে ১ হাজার ৭২৮ কোটি টাকা; মংলা বন্দরের অবকাঠামো উন্নয়নে প্রায় ২ হাজার ৬৯০ কোটি টাকা এবং বিভিন্ন স্থলবন্দর অবকাঠামো উন্নয়নে ব্যয় হবে বাকি ৪৮৯ কোটি টাকা। 30. বাংলাদেশ কি পাবে হিসাব নেই : ভারত দাবি করে আসছে, প্রচলিত টোল ছাড়া ট্রানজিটের জন্য কোনো প্রকার ফি তারা দেবে না। সরকারের শীর্ষ পর্যায়ের একটা অংশ বলে আসছে, ট্রানজিটের জন্য ফি নেয়ার কোনো আন্তর্জাতিক বিধান নেই। তবে বিশ্ববাণিজ্য সংস্থার (ডব্লিউটিও) ট্র্রানজিটবিষয়ক বিধিমালায় বলা হয়েছে, ট্রানজিট প্রদানকারী দেশ সেবা প্রদান ও ব্যয়ভার বহনের জন্য প্রশাসনিক মাশুল আরোপ করতে পারে। বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে ট্রানজিট বিষয়ে এখনও কোনো সমীক্ষা চালানোর উদ্যোগ নেয়া হয়নি।

বরং এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের (এডিবি) এক সমীক্ষা প্রতিবেদন সামনে রেখে ট্রানজিট থেকে লাভালাভের বিষয়টি বাড়িয়ে দেখানোর অভিযোগ উঠেছে। তবে ২০১০ এর শেষদিকে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের নির্দেশনায় বাণিজ্য মন্ত্রণালয়কে সম্পৃক্ত করে ট্রানজিট বিষয়ে একটি কোর গ্রুপ গঠন করা হয়। ট্যারিফ কমিশনের চেয়ারম্যানকে এই গ্রুপের প্রধান করা হয়েছে। এর আওতায় পাঁচটি উপদল কাজ করছে। তবে যে সময়ের মধ্যে (১৫ জানুয়ারি, ২০১১) ট্রানজিটের পূর্ণাঙ্গ বিধিমালা প্রণয়নসহ বিভিন্ন বিষয়ে প্রতিবেদন দাখিল করতে বলা হয়েছে, তা অত্যন্ত অপ্রতুল বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।

তারা আরও বলছেন, এরকম গুরুত্বপূর্ণ ও স্পর্শকাতর বিষয়ে এত অল্প সময়ে ভালো কোনো কাজ করা সম্ভব নয়। ট্রানজিট বিষয়ে এডিবি যে সমীক্ষা প্রতিবেদন প্রস্তুত করেছে, তা এখনও আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকাশ না করলেও সরকারের কাছে দাখিল করা হয়েছে। সেই সমীক্ষায় দেখানো হয়েছে, আগামী পাঁচ বছরে বাংলাদেশকে ৩৪৭ কোটি ডলার বা ২৪ হাজার ২৯০ কোটি টাকা বিনিয়োগ করতে হবে। এই বিনিয়োগের মাধ্যমে প্রয়োজনীয় অবকাঠামো গড়ে তোলার পর বছরে বাংলাদেশ ৫০ কোটি ডলার বা প্রায় সাত হাজার কোটি টাকা আয় করতে পারবে। অর্থাৎ অবকাঠামো উন্নয়নের পাঁচ বছর পর থেকে বছরে এই আয় আসবে।

অবশ্য এর আগে শুরুতে প্রতিবছর মাশুল থেকে পাঁচ কোটি ডলার বা ৩৫০ কোটি টাকা আয় হবে বলে সমীক্ষায় বলা হয়েছে। দীর্ঘমেয়াদে এই আয় বেড়ে দাঁড়াবে বছরে ১০০ কোটি ডলার বা প্রায় সাত হাজার কোটি টাকা। অন্যদিকে বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) পলিসি রিসোর্স প্রোগ্রামের আওতায় কেএএস মুরশিদ যে গবেষণা করেছেন, তাতে ট্রানজিট থেকে বাংলাদেশের প্রত্যক্ষ লাভ সীমিত হবে বলে উল্লেখ করা হয়েছে। এই গবেষণায় বলা হয়েছে, ভারতের প্রধান অংশের সঙ্গে উত্তর-পূর্ব রাজ্যগুলোর পণ্যবহন রেলপথনির্ভর এবং আসামকেন্দ্রিক। কাজেই আসামমুখী বাণিজ্যের কতটা বাংলাদেশের ওপর দিয়ে সম্পন্ন হবে তার ওপর বহুলাংশে নির্ভর করছে ট্রানজিটের লাভক্ষতির বিষয়টি।

আবার আসামের বাণিজ্য কেন্দ্রীয় সরকারের ভর্তুকি পেয়ে থাকে। বিআইডিএসের গবেষণায় আরও বলা হয়েছে, ত্রিপুরা, নাগাল্যান্ড, মিজোরাম ও মনিপুরের ক্ষেত্রে প্রায় পুরোটাই এবং মেঘালয়ের ক্ষেত্রে কিছুটা পণ্য বাংলাদেশের ওপর দিয়ে আনা-নেয়া হতে পারে। এভাবে বছরে সমন্বিতভাবে ৩৩ লাখ মেট্রিক টন (১০ লাখ মেট্রিক টন রেলপথে ও ২৩ লাখ মেট্রিক টন সড়কপথে) পণ্য পরিবহন হতে পারে ট্রানজিটের আওতায়, যা বর্তমানের সাড়ে পাঁচ কোটি মেট্রিক টন পণ্য আনা-নেয়ার বাজারের অতি ক্ষুদ্র অংশ। এ অবস্থায় রেল অবকাঠামো উন্নয়নে ১০ কোটি ডলার বিনিয়োগ করে বছরে দেড় কোটি ডলার থেকে তিন কোটি ডলার পর্যন্ত বাংলাদেশের আয় হতে পারে বলে মন্তব্য করা হয়েছে এই সমীক্ষায়। আবার ভারতের একাংশ থেকে আরেকাংশে যাওয়ার জন্য বাংলাদেশ ভূখণ্ড ব্যবহার করতে দেয়া ট্রানজিট নাকি করিডর সুবিধা, সেটা নিয়েও বিতর্ক রয়েছে।

এ বিষয়ে অভিজ্ঞরা বলছেন, তৃতীয় কোনো দেশের সঙ্গে সম্পৃক্ততার জন্য কোনো দেশ তার ভূখণ্ড দ্বিতীয় দেশকে ব্যবহার করতে দিলে তা হবে ট্রানজিট। যেমন : ভারত যদি নেপাল ও ভুটানকে বাংলাদেশে আসার জন্য তার ভূখণ্ড ব্যবহারের অনুমতি দেয়। কিন্তু কলকাতা থেকে বাংলাদেশের ওপর দিয়ে আগরতলা যাওয়ার সুবিধাটি করিডর হিসেবে বিবেচিত হবে। 31. যেভাবে হবে ট্রানজিট : ট্রানজিটের জন্য সম্ভাব্য যে ১৩টি রুট চিহ্নিত করা হয়েছে সেগুলো হচ্ছে সুতারকান্দি-বেনাপোল, আখাউড়া-বেনাপোল, তামাবিল-চট্টগ্রাম, সুতারকান্দি-চট্টগ্রাম, আখাউড়া-চট্টগ্রাম, বাংলাবান্ধা-মংলা, বুড়িমারি-মংলা, শাহবাজপুর-দর্শনা, শাহবাজপুর-চট্টগ্রাম, আখাউড়া-দর্শনা, আখাউড়া-চট্টগ্রাম, রোহানপুর-মংলা এবং রায়মঙ্গল-আশুগঞ্জ। কোর কমিটির এক সদস্য বলেন, বর্তমানে দেশে যে অবকাঠামো সুবিধা আছে এটা দিয়ে স্বল্প পরিসরে ট্রানজিট বা ট্রানশিপমেন্টের বিষয়টি চিন্তা করা যায়; কিন্তু ভবিষ্যতের কথা মাথায় রেখে বৃহৎ পরিসরে ট্রানজিট নিয়ে ভাবতে গেলে অবকাঠামো উন্নয়ন করতেই হবে।

ভারত তার এক অঞ্চল থেকে অন্য অঞ্চলে বাংলাদেশের ওপর দিয়ে পণ্য ট্রানজিট বা ট্রানশিপমেন্টের ক্ষেত্রে এ পথগুলো ব্যবহারে যে সাশ্রয় হবে সেটিও উল্লেখ করা হয়েছে কোর কমিটির প্রতিবেদনে। প্রতিবেদন অনুসারে সুতারকান্দি-বেনাপোল ট্রানজিট সুবিধা পেলে ভারতের অর্থ সাশ্রয় হবে ৩৩ শতাংশ, আখাউড়া-বেনাপোলে ৪৮ শতাংশ, তামাবিল-চট্টগ্রামে ১২ শতাংশ, সুতারকান্দি-চট্টগ্রামে ৫৩ শতাংশ, আখাউড়া-চট্টগ্রামে ৭০ শতাংশ, বাংলাবান্ধা-মংলা ২৯ শতাংশ, বুড়িমারি-মংলা ১২ শতাংশ, শাহবাজপুর-দর্শনা ৫৭ শতাংশ, শাহবাজপুর-চট্টগ্রাম ৬৭ শতাংশ, আখাউড়া-দর্শনা ৭০ শতাংশ, আখাউড়া-চট্টগ্রাম ৭৬ শতাংশ এবং রায়মঙ্গল-আশুগঞ্জে ট্রানজিট সুবিধা পেলে ভারতের প্রায় ৫০ শতাংশ খরচ সাশ্রয় হবে। ট্রানজিট ও ট্রানশিপমেন্ট সংক্রান্ত কোর কমিটির প্রধান ও ট্যারিফ কমিশনের চেয়ারম্যান মজিবুর রহমান সাংবাদিকদের বলেন, ট্রানজিটের জন্য নির্ধারিত পথগুলোর অবকাঠামো উন্নয়নের জন্য আমরা ৩ ধরনের অর্থায়নের ওপর জোর দিচ্ছি। এর মধ্যে রয়েছে ঋণ, অনুদান এবং দাতা সংস্থার সহায়তা। তিনি বলেন, এখন যে অবস্থা আছে এতে রেলপথ ও সড়কপথে বিনিয়োগের প্রয়োজন পড়বে।

তবে নৌপথে যেহেতু ট্রানজিট চালু আছে এবং সংশ্লিষ্ট নদীর নাব্য রক্ষায় কাজ করা হচ্ছে তাই সেখানে অবকাঠামো খরচ খুব একটা হবে না। কোর কমিটির প্রধান বলেন, যে পথগুলো ব্যবহার হবে সেটি প্রায় চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে। এরই মধ্যে এ বিষয়ে কয়েকটি বৈঠক হয়েছে। জানুয়ারির মধ্যেই এ সংক্রান্ত সুপারিশমালা সরকারের কাছে জমা দেয়া হবে। তিনি বলেন, নেপাল ও ভুটান মূলত একটি পথ ব্যবহার করবে।

বাংলাবান্ধা ও বুড়িমারি হয়ে মূলত নেপাল ও ভুটান ট্রানজিট পাবে। তবে ভারত যেহেতু একাধিক পথ ব্যবহার করবে (জলপথ, স্থলপথ ও রেলপথ) তাই এ বিষয়টি আরও পর্যালোচনা করা হচ্ছে। তিনি আরও বলেন, ট্রানজিটের জন্য পৃথক কোনো রুট থাকবে না। আমরা যে পথগুলো ব্যবহার করি সবার মতো ট্রানজিট সুবিধাপ্রাপ্ত দেশের যানবাহনও সে পথ ব্যবহার করবে। প্রসঙ্গত, কোর কমিটির একজন কর্মকর্তা বলেন, ভারত, নেপাল ও ভুটান ছাড়াও এশিয়ান হাইওয়ে, বিমসটেক ও সার্কভুক্ত দেশগুলোর সঙ্গে যোগাযোগের কথা মাথায় রেখে ট্রানজিট রোড চূড়ান্ত করা হচ্ছে।

ট্রানজিট সমন্বয়ের জন্য পৃথক সচিবালয় করা হবে। এছাড়া ট্রানজিট পরিচালনার জন্য ৪টি কমিটিও থাকবে। এর মধ্যে দুটি কমিটি জাতীয় পর্যায়ে এবং দুটি আন্তর্জাতিক কমিটি হবে। ট্রানজিট ও ট্রানশিপমেন্টের জন্য কোনো পৃথক রাস্তা থাকবে না। ট্রানজিট সুবিধাপ্রাপ্ত দেশগুলোর যানবাহন ট্রানজিট বিধিমালা অনুযায়ী চলবে।

ট্রানজিট ও ট্রানশিপমেন্ট সংক্রান্ত কোর কমিটির সুপারিশমালায় এসব বিষয় অন্তর্ভুক্ত করা হচ্ছে। 32. ট্রানজিটের নামে শুল্ক ছাড়াই চারশ’ কি.মি. পথ ব্যবহার করছে ভারত: ভারতের পালাটানা বিদ্যুৎকেন্দ্রের ভারী যন্ত্রাংশ ট্রান্সশিপমেন্টে বাংলাদেশের প্রায় চারশ’ কিলোমিটার নৌ ও সড়কপথ কোনো ধরনের শুল্ক ছাড়াই ব্যবহার করা হচ্ছে। ভারতের এই দীর্ঘ ট্রানজিট পথে আশুগঞ্জ বন্দর থেকে আখাউড়া স্থলবন্দর পর্যন্ত কিছু রাস্তা সংস্কার ও তাদের এসব ভারী যন্ত্রপাতি বহনের সুবিধার্থে কিছু বাইপাস তৈরি ছাড়া এক ইঞ্চি পরিমাণ মৌলিক রাস্তাও তৈরি করেনি ভারত। মূলত অতিরিক্ত ওজনের ১৩০ চাকার বিরাট ট্রেইলার যাতায়াতের জন্য বাংলাদেশ সড়কপথের ব্রিজগুলো ভেঙে যাওয়ার আশঙ্কা থাকায় ব্রিজের নিচ দিয়ে ১৯টি ক্ষুদ্র বাইপাস তৈরি করা হয়েছে। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, ৩শ’ থেকে সাড়ে ৩শ’ টন ওজনের গাড়ি নিয়মিত ৬-৭ মাস চলাচল করলে সড়কপথের ব্যাপক ক্ষতি হবে, যা সংস্কারে বাংলাদেশ সরকারকে কয়েকশ’ কোটি টাকা খরচ করতে হবে।

এদিকে মালামাল ট্রান্সশিপমেন্টে ভারতীয় ক্রেনসহ অন্যান্য যন্ত্রপাতি ব্যবহার করা হলেও বাংলাদেশের বন্দর ব্যবহারের জন্য কোনো ধরনের শুল্ক দেয়া হয়নি বলে জানা গেছে। সংশ্লিষ্টদের মতে, এই গোটা কার্যক্রমের মধ্যে রাস্তা সংস্কারসহ অন্যান্য কাজে দৈনিক মজুরিভিত্তিক কিছু বাংলাদেশী শ্রমিকের কাজের সুযোগ সৃষ্টি ছাড়া দেশের আর কোনো প্রাপ্তি নেই। ত্রিপুরার পালাটানা বিদ্যুেকন্দ্রের মালামাল পরিবহনে মধ্য ব্রাহ্মণবাড়িয়ার চারটি থানার শতাধিক পুলিশকে রাত থেকে ভোর পর্যন্ত পাহারা দিতে হচ্ছে। ভারত সরকার ত্রিপুরার পালাটানা বিদ্যুৎকেন্দ্রের ভারী যন্ত্রাংশ বিনাশুল্কে পরিবহনের অনুমতি পেয়ে সেদেশের একটি বিশেষজ্ঞ দল বাংলাদেশ সড়কপথ পরিদর্শন করে। বিদ্যুৎকেন্দ্রের ভারী মালামাল নিয়ে ৮০ থেকে সাড়ে ৩শ’ টন ওজনের ট্রেইলারগুলোর যাতায়াতে আশুগঞ্জ-আখাউড়া সড়কপথের ব্রিজগুলো নিরাপদ নয় বলে ভারত সরকারকে জানিয়ে দেয় বিশেষজ্ঞ দলটি।

এর পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশ সরকারের অনুমতিক্রমে আশুগঞ্জ থেকে আখাউড়া পর্যন্ত মোট ২৫ কোটি টাকা ব্যয়ে ঝুঁকিপূর্ণ ব্রিজগুলোর নিচ দিয়ে বাইপাস সড়ক তৈরি করা হয়। পাশাপাশি সুলতানপুর থেকে আখাউড়া পর্যন্ত কিছু সংস্কার কাজ করা হয়। ভারতীয় কর্তৃপক্ষের তত্ত্বাবধানে স্থানীয় মোনেম অ্যান্ড কোং এবং ওয়েস্টার্ন ব্রডগ্রিল জয়েন্ট ভেনচার কোম্পানি লিমিটেডের মাধ্যমে এই কাজ করানো হয়। এতে দৈনিক মজুরি বাবদ বাংলাদেশের কিছু শ্রমিক কাজ করে মাত্র। ব্রাহ্মণবাড়িয়া সড়ক ও জনপথ বিভাগের সহকারী প্রকৌশলী জাহাঙ্গীর আলম জানান, রাস্তা সংস্কার ও বাইপাস নির্মাণে আমাদের কোনো দায়িত্ব ছিল না এবং আমরা এর কোনো তদারকিও করিনি।

কোনো ধরনের শুল্ক ছাড়াই পালাটানা বিদ্যুৎকেন্দ্রের মালামাল বাংলাদেশে প্রবেশ এবং বাহির সিলমোহর দিতে হচ্ছে। এরই মধ্যে দু’দফায় ৭টি ট্রেইলারে প্রায় সাড়ে ৫শ’ টন ভারী যন্ত্রাংশ ভারতে প্রবেশ করেছে। এদিকে ভারতীয় মালামালের নিরাপত্তায় ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা প্রশাসনকে সার্বক্ষণিক উদ্বিগ্ন থাকতে দেখা গেছে। মালামাল পরিবহনের সময় এসএসএফের একটি নিরাপত্তা দলসহ আশুগঞ্জ, সরাইল, ব্রাহ্মণবাড়িয়া ও আখাউড়া থানার পুলিশ বাহিনীকে সারারাত জেগে ট্রেইলারগুলো পারাপারে নিরাপত্তা দিতে হচ্ছে। গাড়িবহরের অতিরিক্ত নিরাপত্তায় স্থানীয় লোকজনকে আতঙ্কিত হতে দেখা গেছে।

এসব ট্রেইলার মাত্র ৫ কিলোমিটার গতিতে চলায় রাস্তায় ব্যাপক যানজটের সৃষ্টি হচ্ছে। এদিকে ভারতীয় গাড়িবহর ও আশুগঞ্জ বন্দর জেটিতে জাহাজের অবস্থানের কারণে আশুগঞ্জ বন্দর ব্যবহারকারীরা বিপাকে পড়েছেন। স্থবিরতা নেমে এসেছে ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলোতে। আশুগঞ্জ বন্দর ট্রান্সপোর্ট মালিক সমিতি, আশুগঞ্জ পরিবহন শ্রমিক ইউনিয়ন, আশুগঞ্জ সার ব্যবসায়ী সমিতির নেতারা জানান, বিশাল বিশাল ভারতীয় ট্রেইলার ও জাহাজগুলোর অনিয়মতান্ত্রিক পার্কিংয়ের কারণে অভ্যন্তরীণ ট্রান্সপোর্ট সার্ভিসে ব্যাপক ক্ষতি হচ্ছে। বিশেষ করে, পিক মৌসুমে দেশের ৬টি জেলাসহ হাওর অঞ্চলের কৃষকরা সার নিতে এসে সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছেন।

এদিকে আশুগঞ্জ থেকে আখাউড়া পর্যন্ত ৪০ কিলোমিটার রাস্তায় ভারতীয় বিদ্যুেকন্দ্রের ভারী যন্ত্রাংশ নিয়ে মালামাল পরিবহনের কারণে ঢাকা-সিলেট মহাসড়ক ও সিলেট-কুমিল্লা মহাসড়কের ট্রানজিটে ব্যবহার করা রাস্তাটির অবকাঠামোগত ব্যাপক ক্ষতি হবে বলে জানা গেছে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন প্রকৌশলী আমার দেশকে জানান, ৩শ’ থেকে সাড়ে ৩শ’ টন ওজনের গাড়ি নিয়মিত ৬-৭ মাস চলাচল করলে সড়কপথের যে ক্ষতি হবে তা নির্মাণ করতে বাংলাদেশ সরকারের কয়েকশ’ কোটি টাকা ব্যয় হবে। একইসঙ্গে আমাদের অভ্যন্তরীণ যোগাযোগ ব্যবস্থা ব্যাপক সমস্যার সম্মুখীন হবে। (আমার দেশ) 33. ট্রানজিট নিয়ে ট্যারিফ কমিশনের সুপারিশ : দেশের স্বার্থে বর্তমান সরকারের আমলেই ভারতের সঙ্গে ট্রানজিটের সবকিছু পাকাপোক্ত করার সুপারিশ করেছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অধীন ট্যারিফ কমিশন। ট্যারিফ কমিশন ভারতকে নৌ, সড়ক ও রেলপথে ট্রানজিট সুবিধা দিতে সম্প্রতি ৪২ পৃষ্ঠার এক প্রতিবেদন জমা দিয়েছে বাণিজ্য ও অর্থ মন্ত্রণালয়ে।

প্রতিবেদনের পুরোটাই বাংলাদেশ ট্রানজিটের মাধ্যমে ব্যাপকভাবে লাভবান হবে বলে আশার বাণী তুলে ধরা হয়েছে। বলা হয়েছে—ভারতকে ট্রানজিট দেয়ার মাধ্যমে বিনিয়োগ, অবকাঠামো এবং অর্থনৈতিক উন্নয়নসহ বিভিন্ন ধরনের উন্নয়নে বাংলাদেশের অর্থনীতি সমৃদ্ধশালী হয়ে উঠবে। ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী ৩০টি জেলার বাণিজ্য, পরিবহন এবং বিনিয়োগের ক্ষেত্রে বাধা তুলে দিলে জেলাগুলো অর্থনৈতিকভাবে উন্নয়নের চরম শিখরে পৌঁছে যাবে। এছাড়া ট্রানজিটের মাধ্যমে নেপাল এবং ভুটানে প্রবেশের সুবিধা পাবে বাংলাদেশ। পাশাপাশি নেপাল এবং ভুটান বাংলাদেশের ভূখণ্ড ব্যবহার করে চট্টগ্রাম ও মংলা সমুদ্রবন্দর ব্যবহার করতে পারবে।

যা বাংলাদেশের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে বলেও উল্লেখ করা হয়েছে প্রতিবেদনে। তাই বাংলাদেশের উন্নয়নের জন্যই ট্রানজিট কার্যক্রমকে দ্রুততার সঙ্গে শেষ করার ব্যাপারে তাগিদ দেয়া হয়েছে। ভারতকে ট্রানজিট সুবিধা দিতে সম্প্রতি বাণিজ্য মন্ত্রণালয় একটি সাব-কমিটি গঠন করে। এ কমিটির প্রধান করা হয় ট্যারিফ কমিশনের চেয়ারম্যান ড. মজিবুর রহমানকে। ড. মজিবুর রহমান এরই মধ্যে এ সংক্রান্ত একটি প্রতিবেদন বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ও অর্থ মন্ত্রণালয়ে জমা দিয়েছেন।

৪২ পৃষ্ঠার এ প্রতিবেদনের প্রায় পুরোটাতেই রয়েছে ট্রানজিটের বহুমাত্রিক সুবিধার কথা। সাব-কমিটির প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে ট্রানজিটের কারণে দেশে বিনিয়োগের পরিমাণ অনেকগুণ বেড়ে যাবে। ভারতের সঙ্গে এনার্জির (জ্বালানি ও বিদ্যুৎ) বাণিজ্য ত্বরান্বিত করা সম্ভব হবে ট্রানজিটের মাধ্যমে। সর্বোপরি ট্রানজিট সুবিধা দেয়ার মাধ্যমে ভারতের কাছ থেকে বাংলাদেশের পানি পাওয়ার বিষয়টির মীমাংসা হতে পারে। বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধির উন্নয়ন এবং দারিদ্র্য দূরীকরণ হবে বলেও উচ্চাকাঙ্ক্ষা প্রকাশ করা হয়েছে প্রতিবেদনে।

এমনকি বাংলাদেশের জলবায়ু পরিবর্তনে ট্রানজিটপ্রাপ্ত দেশগুলোর ভূমিকা দেশের দরিদ্রদের অবস্থার উন্নয়ন ঘটাবে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ট্রানজিট থেকে বাংলাদেশ বিভিন্নমুখী সুবিধা পাবে। বাংলাদেশের সমুদ্রবন্দরের উচ্চ ও দক্ষ ব্যবহার নিশ্চিত হবে। ট্রানজিটের মাধ্যমে বাংলাদেশ বড় পরিমাণে ফি আদায় করতে পারবে, যা দেশের রাজস্ব বৃদ্ধিতে সহায়তা করবে বলেও উল্লেখ করা হয়েছে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিভিন্ন গবেষণার আলোকে দেখা যায় ভারতের ট্রাক বাংলাদেশের মধ্য দিয়ে চলাচলের জন্য প্রতি ট্রিপে ৫৫ দশমিক ৬ ডলার এবং প্রতি ১০০ কিলোমিটারে ১১ দশমিক ২ ডলার ফি দেবে।

এছাড়া ট্রানজিটের মাধ্যমে ভারত, নেপাল এবং ভুটানের সঙ্গে বাংলাদেশের বাণিজ্য খরচ অনেকাংশে কমে যাবে, যা দেশের বাণিজ্যের উন্নয়নে ভূমিকা রাখবে। এমনকি প্রতিবেদনে এটাও উল্লেখ করা হয়েছে, ট্রানজিটের মাধ্যমে ব্যবহারকারীর ফি (ইউজার ফি) দিয়ে বাংলাদেশের পরিবহনের নেটওয়ার্ক বৃদ্ধি করতে পারবে। ট্রানজিটের কারণে বাংলাদেশের পিছিয়ে পড়া গ্রামগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপিত হবে এবং যোগাযোগে খরচ কমে যাবে, যা গ্রামগুলোর অর্থনৈতিক উন্নয়নে অগ্রগামী ভূমিকা পালন করবে বলে উল্লেখ করা হয়েছে প্রতিবেদনে। চট্টগ্রাম বন্দরে কনটেইনার খালাসকরণ ক্ষমতার ৫৭ শতাংশ বর্তমানে ব্যবহার করা হচ্ছে। পাশাপাশি স্টোরেজ ক্ষমতার মাত্র ৫৪ শতাংশ ব্যবহার হয়ে থাকে।

অর্থাত্ ক্ষমতার পুরোপুরি ব্যবহারের মাধ্যমে ভারতকে ট্রানজিট সুবিধা দেয়া যেতে পারে বলে মন্তব্য করা হয়েছে প্রতিবেদনে। প্রতিবেদনে ট্রানজিট চুক্তির মাধ্যমে উভয় দেশই দ্রুত উন্নতির পথে পাড়ি দেবে বলে উল্লেখ করা হয়েছে। উপরন্তু ট্রানজিটের অভাবে উভয় দেশই অর্থনৈতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। সাব-কমিটি রিপোর্টে উল্লেখ করেছে নদীপথ ট্রানজিটের (রিভার ট্রানজিট) ক্ষেত্রে বাংলাদেশের আশুগঞ্জ এবং ভারতের শিলঘাট উভয় দেশই চাওয়া মাত্র ব্যবহার করতে পারবে। এক্ষেত্রে যথাযথ বাস্তবায়নের লক্ষ্যে ইনল্যান্ড ওয়াটার ট্রান্সপোর্ট ট্রানজিট (আইডব্লিউটিটি) সংশোধন করা হবে।

ভারত মংলা এবং চিটাগাং সমুদ্রবন্দর আমদানি ও রফতানি বাণিজ্যের জন্য ব্যবহার করার ক্ষেত্রে সড়ক ও রেলপথ ব্যবহারের অনুমতি পাবে। একই সুবিধা নেপাল এবং ভুটানও পাবে। আখাউড়া থেকে আগরতলা রেলপথ নির্মাণে ভারত অর্থায়ন করবে বলেও উল্লেখ করা হয়েছে প্রতিবেদনে। এছাড়া ভারতের রোহানপুর থেকে সিংগাবাদ রেললাইন বাংলাদেশ এবং নেপালের ট্রানজিটের জন্য ব্যবহার করার অনুমতি দেয়া হবে। ট্রানজিট কার্যক্রমকে দক্ষভাবে সম্পাদন করার লক্ষ্যে যানবাহনের যাতায়াতে কিছু নিয়মকানুন নির্দিষ্ট করে দেয়া, ড্রাইভারদের জন্য ভিসা প্রাপ্যতায় সহজীকরণ এবং উভয় দেশের আর্থিক খাতের একত্রীকরণ প্রয়োজন বলে উল্লেখ করা হয়েছে।

একদিকে এ ধরনের উন্নয়নের কথা বলা হলেও অন্যদিকে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এই ট্রানজিট থেকে বাংলাদেশের চেয়ে ভারতই বেশি সুবিধা পাবে। এমনকি ট্রানজিটের শর্তগুলোকে অসমতাপূর্ণ বলেও বিবেচনা করা হয়েছে প্রতিবেদনে। এতে বলা হয়েছে, ভারতের ক্ষেত্রে মালামাল আনয়নে কলকাতা সমুদ্রবন্দরের ওপর চাপ বেশি পড়ায় ভারত চট্টগ্রাম এবং মংলা বন্দর ব্যবহার করে সুবিধা আদায় করবে বলেও এতে উল্লেখ করা হয়। প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে ভারতের আগরতলা এবং কলকাতার মধ্যে দূরত্ব ১৬শ’ কিলোমিটারের উপরে। ট্রানজিটের মাধ্যমে আগরতলা ১০০ কিলোমিটারের দূরত্বে চট্টগ্রাম বন্দর ব্যবহার করতে পারবে।

যা তাদের অর্থনীতিকে এক নতুন দিগন্তে নিয়ে যাবে। তাছাড়া নেপাল এবং ভুটান বাংলাদেশের সমুদ্রবন্দর ব্যবহারের মাধ্যমে তাদের অর্থনীতিতে উচ্চ গতি নিয়ে আসতে সক্ষম হবে বলেও উল্লেখ করা হয় প্রতিবেদনে। একটি গবেষণায় দেখা যায়, কোনো দেশের সঙ্গে পণ্য পরিবহনে খরচ ১০ শতাংশ কমলে তাদের রফতানির পরিমাণ বেড়ে যায় ৩ শতাংশ। এদিক হিসাব করলে ভারত, নেপাল এবং ভুটানের রফতানি অনেকগুণ বেড়ে যাবে। কিন্তু বাংলাদেশের অর্থনীতি সত্যিকার অর্থে কতটা লাভবান হবে তা উল্লেখ করা হয়নি প্রতিবেদনে।

ট্রানজিট কমিশনের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশ ডিজেলে ভর্তুকি দিয়ে থাকে। এ কারণে বাংলাদেশের সিএনজি কম দামে ভারতের পরিবহনগুলো ব্যবহার করতে পারবে যাতায়াতের সময়। ফলে এদিক থেকে বাংলাদেশ ক্ষতিগ্রস্ত হবে। তারপরও ভারত এ সুবিধাগুলো ভোগ করবে অনায়াসেই। আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটে বিভিন্ন দেশ এজন্য একটা বিশাল অংকের কর আদায় করলেও বাংলাদেশ এ ক্ষেত্রে কতটা দক্ষ ভূমিকা পালন করতে পারবে তা নিয়ে সংশয় রয়েছে।

এদিকে ট্রানজিটের মাধ্যমে বাংলাদেশের অবকাঠামো ব্যবহার করবে ভারত এ ক্ষেত্রে দেশের অবকাঠামোর অবচয় ব্যয় রয়েছে; যা বাংলাদেশের জন্য বোঝা হয়ে উঠবে। তাছাড়া প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আগামী ১০ বছরে ট্রানজিটের জন্য যেসব অবকাঠামোগত উন্নয়ন করতে হবে তাতে দেশের মোট ৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের প্রয়োজন হবে। তবে ট্রানজিট নিয়ে সবচেয়ে আশঙ্কার বিষয় হলো ভারতের মালামাল বাংলাদেশে প্রবেশের সময় কাস্টমস বা অন্য কোনো কর্তৃপক্ষ চেক করতে পারবে না বলে উল্লেখ করা হয়েছে; যা দেশের নিরাপত্তার জন্য হুমকিস্বরূপ বলে বিবেচনা করছেন বিশেষজ্ঞরা। এদিকে ট্রানজিট চুক্তিকে শুধু অর্থনৈতিকভাবেই বিবেচনা না করে রাজনৈতিকভাবেও এর গুরুত্ব দেয়া হয়েছে প্রতিবেদনে। এতে উল্লেখ করা হয়েছে, ট্রানজিটের মাধ্যমে দু’দেশের মধ্যে সম্পর্ক গভীর হবে।

বর্তমান সরকার থাকাকালেই ট্রানজিটের কার্যক্রম শেষ করার ব্যাপারে গুরুত্ব দেয়া হয়েছে প্রতিবেদনে। অন্যথায় ট্রানজিট বাস্তবায়ন না হওয়ার আশঙ্কা করা হয়েছে প্রতিবেদনে। বাংলাদেশ সরকারের বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের জন্য রচিত Economics of Transit Access to India, Nepal And Bhutan Through Bangladesh. সাবকমিটি-৩ এই প্রতিবেদনটি রচনা করেছে। খসড়া রিপোর্ট হিসেবে উল্লিখিত প্রতিবেদনের তারিখ মার্চ, ২০১১। প্রতিবেনটির কিছু কিছু অংশ এরই মধ্যে বিভিন্ন সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয়েছে।

প্রতিবেদনের সূচনা ভূবদ্ধ দেশ ও ভূবদ্ধ অঞ্চলের প্রসঙ্গ উল্লেখ করে। আন্তর্জাতিক আইন অনুসারে একটি ভূবদ্ধ দেশ প্রতিবেশী দেশের মধ্য দিয়ে আন্তর্জাতিক বাণিজ্য পরিচালনার জন্য ট্রানজিট সুবিধা পেতে পারে। একটা সময় পর্যন্ত দক্ষিণ এশিয়া উপমহাদেশে ৩টি দেশ ভূবদ্ধ দেশের মর্যাদা ভোগ করত। দেশ ৩টি ছিল নেপাল, ভুটান ও সিকিম। তথাকথিত গণতান্ত্রিক অভ্যুত্থানের পরিণতিতে সিকিম ভারতের অঙ্গীভূত হয়।

এখন ভূবদ্ধ রাষ্ট্র ২টি—নেপাল ও ভুটান। ভারত কর্তৃক ভূবদ্ধ হওয়ার ফলে নেপালকে বহু ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে। ১৯৮৯ সালে নেপাল চীনের কাছ থেকে তার সামরিক বাহিনীর জন্য ১৮টি ফিল্ড গান ক্রয় করার ফলে ভারতের রোষানলের শিকার হয়। ভারত নেপালের ওপর অবরোধ আরোপ করে। কয়েক মাস ধরে বহাল রাখা অবরোধের ফলে নেপাল ভয়াবহ অর্থনৈতিক দুর্যোগের শিকার হয়।

নেপালের জনগণ খাদ্যসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের অভাবে নিদারুণ দুর্দশার সম্মুখীন হয়। বর্তমানেও নেপালের পরিস্থিতি মোটেও সন্তোষজনক নয়। নেপালে রাজতন্ত্র উচ্ছেদের পর প্রজাতান্ত্রিক নেপালের জন্য একটি সংবিধান রচনায় যে অচলাবস্থার সৃষ্টি হয়েছে তার জন্য নেপাল ও ভারতের পত্র-পত্রিকায় ভারতের অনভিপ্রেত হস্তক্ষেপকেই দায়ী করা হয়েছে। নেপালের ভাগ্য ভালো যে, এর উত্তর সীমান্তজুড়ে গণচীনের অবস্থান। ফলে নেপাল গণচীনকে ভারতীয় চাপের প্রতিষেধক হিসেবে ব্যবহার করতে পারছে।

এই মুহূর্তে ক্ষমতাসীন নেপাল সরকারের সঙ্গে গণচীনের সম্পর্ক বেশ ভালো। অবশ্য নেপাল সরকার ভারতের সঙ্গেও সুসম্পর্ক বজায় রাখতে চায়। ভুটানের অবস্থা সম্পর্কে বিশদ বিবরণ দেয়ার প্রয়োজন নেই। পাঠক ভালো করেই জানেন, ভুটান রাষ্ট্রটির সার্বভৌমত্ব কোন পর্যায়ে। প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, 'Bangladesh does not allow India Transit access for trade to the north-eastern states. These seven north eastern states of India also do not have access to sea through Kolkata that requires passage through the round about chicken neck'. কীভাবে চিকেন নেকের মধ্য দিয়ে ভারতের মূল ভূখণ্ড উত্তর-পূর্ব ভারতের সঙ্গে যুক্ত হলো সেই কাহিনীটি পাঠকের জানা দরকার।

১৯৪৭ সালে স্যার সিরিল রেডক্লিফের কলমের আঁচড়ে ভারত ও পাকিস্তানের রাজনৈতিক সীমারেখা বিভাজিত হয়েছিল। কথা ছিল জলপাইগুড়ি জেলা পূর্ব পাকিস্তানের সঙ্গে যুক্ত হবে। কিন্তু সেটি করা হলে উত্তর-পূর্ব ভারতের ৭টি রাজ্য ভারতের মূল ভূখণ্ড থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে ভূবদ্ধ হয়ে পড়বে বিধায় জলপাইগুড়ি জেলাটি ভারতের সঙ্গে জুড়ে দেয়া হয়। এর ফলে ভারতের মূল ভূখণ্ড মোরগের গ্রিবার মতো দেখতে একটি সংকীর্ণ ভূখণ্ড দিয়ে উত্তর-পূর্ব ভারতের সঙ্গে যুক্ত হয়। ফলে ভারতের মূল ভূখণ্ড থেকে উত্তর-পূর্ব ভারতে রেল ও সড়কপথে যাতায়াত করা সম্ভব।

সুতরাং উত্তর-পূর্ব ভারতকে ভূবদ্ধ অঞ্চল হিসেবে চিহ্নিত করা রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। একইভাবে গণভোটের মাধ্যমে সিলেট আসাম প্রদেশ থেকে আলাদা হয়ে ১৯৪৭ সালে পূর্ব পাকিস্তানের ভূখণ্ডে পরিণত হওয়া সত্ত্বেও সিলেটের একটি থানা করিমগঞ্জ ভারতের অঙ্গীভূত হয়। এটিও ছিল ভারতের জন্য রেডক্লিফের উপহার। কারণ পার্বত্য ত্রিপুরাকে ভারতের মূল ভূখণ্ডের সঙ্গে যুক্ত করতে হবে। সুতরাং ঐতিহাসিকভাবে ১৯৪৭ সালে উত্তর-পূর্ব ভারত ও পার্বত্য ত্রিপুরার সঙ্গে ভারতের মূল ভূখণ্ড ট্রানজিট পেয়ে গেছে।

এই অঞ্চলটিকে ভূবদ্ধ অঞ্চলের সঙ্গে তুলনা করার কোনো যৌক্তিকতা নেই। ১৯৪৭-এ পূর্ব পাকিস্তানের একমাত্র সমুদ্র বন্দর ছিল চট্টগ্রাম। এই বন্দরটির তখনকার অবস্থা একটি মত্স্য বন্দরের চেয়ে বেশি ভালো ছিল না। ব্রিটিশ-ভারতে পূর্ববঙ্গের পাট ও চা কলকাতা বন্দর দিয়েই বিদেশে রফতানি হতো। তত্কালীন পরিস্থিতিতে শুধু চট্টগ্রাম বন্দর ব্যবহার করে এই বাণিজ্য সম্পর্ক বজায় রাখা সম্ভব ছিল না।

তত্কালীন পাকিস্তান সরকার ভারত সরকারের কাছে ৬ মাসের জন্য কলকাতা বন্দর দিয়ে পূর্ব পাকিস্তানের জন্য ট্রানজিট সুবিধা চাইলে ভারত সরকারের কেন্দ্রীয় মন্ত্রী বল্লভ ভাই প্যাটেল জানিয়ে দিলেন, ৬ মাস তো দূরে থাক ৬ মিনিটের জন্যও কলকাতা বন্দর দিয়ে পূর্ব পাকিস্তানকে ট্রানজিট সুবিধা দেয়া যাবে না। আজ উত্তর-পূর্ব ভারতের অর্থনৈতিক অনুন্নয়নের জন্য বাংলাদেশের মধ্য দিয়ে করিডোর না পাওয়াকে যেভাবে ভারত ও বাংলাদেশের কোনো কোনো মহল দায়ী করছে তাদের ইতিহাসের প্রেক্ষাপট অজ্ঞাত থাকার কথা নয়। এছাড়া উত্তর-পূর্ব ভারতের প্রতি ভারতের অনগ্রসরতার কেন্দ্রীয় সরকার ১৯৪৭ সাল থেকে যেভাবে বিমাতাসুলভ আচরণ করছে, সেই আচরণের সঙ্গে পূর্ব পাকিস্তানের প্রতি পশ্চিম পাকিস্তানের বিমাতাসুলভ আচরণকেই তুলনা করা যায়। এছাড়াও ভারতে অনেক অনগ্রসর রাজ্যের প্রতিও ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার বিমাতাসুলভ আচরণ করছে। এর ফলে সেসব রাজ্যে মাওবাদীদের অভ্যুত্থান ঘটেছে।

উত্তর-পূর্ব ভারতের জন্য বাংলাদেশের অসহযোগিতাকে দায়ী করা অত্যন্ত অযৌক্তিক। উত্তর-পূর্ব ভারত খনিজ, বনজ ও পানি সম্পদে সমৃদ্ধ হওয়া সত্ত্বেও দারিদ্র্যর যাঁতাকলে পিষ্ট হচ্ছে। চলবে........ পূর্বের পর্ব সমূহ  ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।