আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

(Part-৫) 'ট্রানজিট'-এর সহজপাঠ। ট্রানজিট ও করিডোর কি, ভারতকে ট্রানজিট না করিডোর দেওয়া হলো?

(Part-1) 'ট্রানজিট'-এর সহজপাঠ। ট্রানজিট ও করিডোর কি, ভারতকে ট্রানজিট না করিডোর দেওয়া হলো? (Part-2) 'ট্রানজিট'-এর সহজপাঠ। ট্রানজিট ও করিডোর কি, ভারতকে ট্রানজিট না করিডোর দেওয়া হলো? (Part-3) 'ট্রানজিট'-এর সহজপাঠ। ট্রানজিট ও করিডোর কি, ভারতকে ট্রানজিট না করিডোর দেওয়া হলো? (Part-4) 'ট্রানজিট'-এর সহজপাঠ। ট্রানজিট ও করিডোর কি, ভারতকে ট্রানজিট না করিডোর দেওয়া হলো? 11. কার অর্থে ট্রানজিট: এত দিন জনগণ জেনে এসেছে ট্রানজিট হলে বাংলাদেশের লাভ।

এখন বাংলাদেশের অর্থমন্ত্রী বলছেন, ট্রানজিটের ওপর কোনো ফি নির্ধারণ করা হবে না। তাহলে প্রশ্ন, এই ট্রানজিটে আমাদের লাভ কোথায়? বিদেশি ব্যাংক থেকে অতিথি আপ্যায়নের জন্য আমাদের গচ্চা দিতে হবে ২৪ হাজার কোটি টাকা। তার বিনিময়ে আমরা কিছু পাব না, চড়া সুদের বোঝা ছাড়া। তাহলে প্রশ্ন, এই অতিথি আপ্যায়নের দরকারটি কী? এত দিন জনগণ জেনে এসেছে বাংলাদেশের ওপর দিয়ে ভারতের গাড়িগুলো চলাচলের জন্য ভারত নিজেই রাস্তাঘাট নির্মাণ করবে। কিন্তু সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দিলি্লর সঙ্গে চুক্তি করার পর জানা যাচ্ছে যে ভারত বাংলাদেশের ওপর দিয়ে যেসব রাস্তা ব্যবহার করবে তার কোনোটির নির্মাণ খরচ বহন করবে না।

ভারতের এঙ্মি ব্যাংক এ খাতের উন্নয়নের জন্য বাংলাদেশকে ১০০ কোটি ডলার ঋণ দেবে। এ জন্য ওই ভারতীয় ব্যাংকের সঙ্গে বাংলাদেশ সরকারের একটি ঋণচুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে। ঋণচুক্তির শর্তগুলো বেশ কঠিন এবং বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, শর্তগুলো বাংলাদেশের বিপক্ষে গেছে। শর্তগুলোর মধ্যে কিছু শর্ত এ রকম যে বাংলাদেশের রাস্তাঘাট নির্মাণের জন্য যে যন্ত্রপাতির দরকার পড়বে, তার সব কিছুই ভারতীয় কম্পানির কাছ থেকে কিনতে হবে। যাঁরা এত দিন বিশ্বব্যাংক, এডিবি, আইএমফের ঋণের বিরোধিতা করেছেন ওই ঋণদাতা সংগঠনগুলোর কঠিন শর্তের কারণে তাঁরাই বলছেন, বিশ্বব্যাংকের মতো অনুরূপ শর্ত ভারতীয় ব্যাংকও বেঁধে দিয়েছে।

আর এ কারণে বহুজাতিক ঋণদাতা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে মূলত ভারতীয় এঙ্মি ব্যাংকের কোনো পার্থক্য নেই বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। বিশেষজ্ঞরা প্রশ্ন তুলেছেন ভারতীয় ঋণের শর্ত এবং সুদের হার নিয়ে। বিশ্বব্যাংক সাধারণত ৩৫ থেকে ৪০ বছরের জন্য ঋণ দিয়ে থাকে। ঋণ পরিশোধের সর্বশেষ সময় থেকে আরো ১০ বছরের মতো বাড়তি সময় দেওয়া হয়। সে ক্ষেত্রে বাড়তি ১০ বছরের জন্য কোনো সুদ নেওয়া হয় না, শুধু সার্ভিস চার্জ বাবদ দশমিক ৭৫ শতাংশ হারে সংশ্লিষ্ট দেশটিকে প্রদান করতে হয়।

সূত্রমতে, ভারত ঋণ দিয়েছে ১.৭ শতাংশ হারে। এই ঋণের কোনো অর্থ অব্যয়িত থাকলে তার জন্য বাংলাদেশকে বার্ষিক দশমিক ৫০ শতাংশ হারে কমিটমেন্ট চার্জ দিতে হবে। পাঁচ বছরের গ্রেস পিরিয়ডসহ এই ঋণ পরিশোধের মেয়াদ হচ্ছে ২০ বছর। ভারতের অর্থমন্ত্রী প্রণব মুখার্জির উপস্থিতিতে গত ৭ আগস্ট ভারতের এঙ্মি ব্যাংকের চেয়ারম্যান ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক টিসিএ রঙ্গনাথন এবং বাংলাদেশ সরকারের অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের সচিব মোশাররফ হোসেন ভূঁইয়া এই ঋণচুক্তিতে স্বাক্ষর করেন। ঋণ নিলেই কোনো দেশের লাভ হবে_এমনটি মনে করেন না অর্থনীতিবিদরা।

সেই ঋণকে কাজে না লাগিয়ে যদি অলসভাবে বসিয়ে রাখা হয় তাহলে উল্টো ক্ষতির পরিমাণই বেশি। যেমন বাংলাদেশকে দেওয়া বিশ্বব্যাংকের ১৭৯ কোটি ডলার কোনো কাজে না লাগায় অব্যবহৃত পড়ে আছে। বিশ্বব্যাংক ইতিমধ্যে বাংলাদেশকে দেওয়া ১৭৫ কোটি ডলার ঋণ বাতিল করেছে। বিশ্বব্যাংকের পাশাপাশি অন্যান্য দাতা সংস্থা কর্তৃক বাংলাদেশকে দেওয়া ৪০০ কোটি ডলারের ওপর ঋণ অব্যবহৃত পড়ে আছে। ভারতের ব্যাংক থেকে নেওয়া ১০০ কোটি ডলারের মধ্যে বাংলাদেশের রেলওয়ে খাত উন্নত করার পরিকল্পনা রয়েছে।

অথচ বাংলাদেশের রেলওয়ে সংস্কারের জন্য প্রায় ৪৬ কোটি ডলার পড়ে আছে, কিন্তু কোনো কাজে আসছে না। ভারতকে ট্রানজিট সুবিধা দিতে গেলে বাংলাদেশের রাস্তাঘাট ভারতের ট্রাক-লরি বহনের ক্ষমতা অনুযায়ী তৈরি করতে হবে। তৈরি করতে হবে নৌপথ ও রেল যোগাযোগ। এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের এক হিসাব মতে, বাংলাদেশের সড়ক, নৌ, রেল ও বন্দর অবকাঠামো ঢেলে সাজাতে ২৪ হাজার কোটি টাকা ব্যয় হবে। অধ্যাপক ড. আনু মুহাম্মদ বলেন, এই ঋণ বাংলাদেশের জন্য ক্ষতিকর।

এই ঋণ নেয়া হচ্ছে ভারতের প্রয়োজনে। এছাড়া এই ঋণের সুদের হার বেশি। ভারতের স্বার্থ রক্ষার্থে অর্থাৎ ভারতকে ট্রানজিট দেয়ার জন্যই এই ঋণ। আর ভারতকে ট্রানজিট দেয়া বাংলাদেশের জন্য ইতিবাচক নয়। ভারতীয় ব্যাংক থেকে গ্রহণ করা এই ঋণের ১.৭৫ শতাংশ হারে সুদ দিতে হবে।

এর বাইরে ০.৫৭ শতাংশ হারে দিতে হবে কমিটমেন্ট ফি। আন্তর্জাতিক কোনো অর্থলগ্নিকারী সংস্থা বা এডিবি বিশ্ব ব্যাংক থেকে ঋণ নিলে এতো সুদ দিতে হতো না। ভারতীয় ব্যাংকের এই ঋণ ২৪ বছরে পরিশোধ করতে হবে। এর বেশি হলেই জরিমানা। অন্য কোনো আন্তর্জাতিক সংস্থা বা ব্যাংক থেকে নিলে ৪০ বছরে পরিশোধ করা যেতো এই হিসাবে বাংলাদেশকে ৪০ হাজার কোটি টাকার বেশি ক্ষতির মুখে পড়তে হবে।

২৪ বছরে ঋণ পরিশোধ করতে না পারলে প্রায় দ্বিগুণ হারে (২ শতাংশ হারে) সুদ দিতে হবে। শিষ্ট অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক ড. মাহবুব উল্লাহ বলেছেন, এই ঋণ গ্রহণ বাংলাদেশের জন্য ক্ষতিকর। এর সুদের হার বেশি। আর কি ধরনের প্রকল্পে ঋণ গ্রহণ করা হচ্ছে তাও দেখতে হবে। যেসব প্রকল্পে ঋণ নেয়া হচ্ছে সেগুলো ভারতের স্বার্থসংশ্লিষ্ট।

এতে ভারত ট্রানজিট সুবিধা পাবে। আর এই ঋণ হচ্ছে অর্থনীতির ভাষায় ‘টাইট লোন'। অল্প সময়ের মধ্যে (২৫ বছরে) সুদ পরিশোধ করতে হবে। সুদের হার বেশি। সময় মত পরিশোধ করতে না পারলে জরিমানা সুদ দিতে হবে।

ভারতের বেসরকারি ব্যাংক থেকে চড়া সুদে ঋণ এনে ভারতকেই করিডোর দেয়া বাংলাদেশের জন্য আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত। এক এক নজরে ১৪টি প্রকল্প ....... - ভারত থেকে নেয়া ঋণে ৬টি উচ্চ ক্ষমতা সম্পন্ন ড্রেজার কেনা হবে। এ খাতে বরাদ্দ ১.৭ মিলিয়ন ডলার। কলকাতা থেকে আশুগঞ্জ পর্যন্ত নৌ-পথের উন্নয়নে এই প্রকল্প। বিআইডব্লিউটিএ এবং পানি উন্নয়ন বোর্ড এই প্রকল্প বাস্তবায়ন করবে।

- দ্বিতীয় প্রকল্প হচ্ছে আশুগঞ্জ নৌ-বন্দরের উন্নয়ন। এ খাতে বরাদ্দ ৬.২ মিলিয়ন ডলার। - তৃতীয় প্রকল্প হচ্ছে- ১০টি ব্রড গেইজ রেল ইঞ্জিন ক্রয়। এ খাতে বরাদ্দ ৫.৫ মিলিয়ন ডলার। - ৪র্থ প্রকল্প ১২৫টি রেল কোচ (বগি) ক্রয়।

এখাতে ব্যয় ধরা হয়েছে ৫৩.৬ মিলিয়ন ডলার। - ৫ম ও ষষ্ঠ হচ্ছে- ৫০ ও ৬০ টন ধারণ ক্ষমতাসম্পন্ন ওয়াগন। এখাতে মোট ব্যয় ধরা হয়েছে ১৩.৪০ মিলিয়ন ডলার। - সপ্তম প্রকল্প হচ্ছে- তিতাস নদীর ওপর রেল সেতু করা। ব্যয় ধরা হয়েছে ১২০ মিলিয়ন ডলার।

ভারতকে রেল ট্রানজিট দিতেই এসব প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। - ৮ম প্রকল্প হচ্ছে ৩০০ দ্বিতল বাস ক্রয়। কেনা হবে ভারত থেকে। ব্যয় ৩০ মিলিয়ন ডলার। - ৯ম প্রকল্প ৫০টি বিলাস বহুল বাস ক্রয়, ব্যয় ধরা হয়েছে ৬ মিলিয়ন ডলার, ক্রয় করা হবে ভারত থেকে।

ভারত সড়ক পথে ট্রানজিট পাচ্ছে। তাদের সুবিধার্থেই এই প্রকল্প। - ১০ম প্রকল্প হচ্ছে- সরাইল থেকে আগর তলা পর্যন্ত সড়ক উন্নয়ন এবং আখাউড়া স্থল বন্দর উন্নয়ন। ব্যয় ৩৩ মিলিয়ন ডলার। - ১১তম প্রকল্প ঢাকার জুরাইন থেকে মালিবাগ রেলক্রসিং পর্যন্ত ফ্লাইওভার।

যেহেতু কলকাতা থেকে সরাসরি আগরতলা পর্যন্ত ঢাকার ওপর দিয়ে মোটরযান চলবে, তা সহজ করতেই এই প্রকল্প। ব্যয় ধরা হয়েছে ৩১ মিলিয়ন ডলার। - ১২তম প্রকল্প হচ্ছে- রামগড় থেকে ত্রিপুরা সীমান্ত পর্যন্ত সড়ক উন্নয়ন (৭৫ কিলোমিটার)। ব্যয় ধরা হয়েছে ১৪.৫ মিলিয়ন ডলার। এই প্রকল্প বাস্তবায়নে ভারত সরাসরি সড়ক পথে চট্টগ্রাম বন্দর পর্যন্ত যোগাযোগ সুবিধা পাবে।

- ১৩তম প্রকল্প ভারত থেকে বিদ্যুৎ আমদানির নামে বিদ্যুৎ লাইন ও সাব স্টেশন নির্মাণ। ব্যয় ধরা হয়েছে ১৫৮ মিলিয়ন ডলার। - ১৪তম প্রকল্প পণ্যের মান নিয়ন্ত্রণ উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন। ভারতে যেসব পণ্য রফতানি হবে, তার মান নিশ্চিত করতেই এই প্রকল্প। ব্যয় ধরা হয়েছে ৮.৯২ মিলিয়ন ডলার।

‘ট্রানজিট’ প্রক্রিয়ার নিরাপত্তা অবকাঠামোর দায়িত্ব: ট্রানজিট, ট্রান্সশিপমেন্ট কিংবা করিডর যে ধরনের সুবিধাই বাংলাদেশ প্রতিবেশীকে দিক না কেন, এতে গুরুত্বের সঙ্গে জড়িয়ে আছে নিরাপত্তা প্রসঙ্গ। পণ্য হিসেবে কী আসছে তা যেমন প্রতিনিয়ত যাচাই-বাছাই ও তদারকির প্রয়োজন তেমনি এসব পণ্য পাহারা দিয়ে আনা-নেয়ার বিষয়ও রয়েছে। এই উভয় ধরনের নিরাপত্তা ব্যবস্থাপনা বর্তমানে আমাদের পরিবহন অবকাঠামোয় অনুপুস্থিত। প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক, সম্ভাব্য ও জরুরি এই নিরাপত্তা অবকাঠামো কখন গড়ে উঠবে এবং কারা পরিচালনা করবে তা? এর নিয়ন্ত্রণ কার হাতে থাকবে এবং ব্যয়ভার কীভাবে নির্বাহ হবে সেসবও এক বড় প্রশ্ন। ভারত কেবল সড়ক পথে বা রেলপথেই পণ্য পরিবহন সুবিধা চাচ্ছে না, জলপথেও চাচ্ছে।

বর্তমানে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের জলপথগুলোতে কার্যত কোন নিরাপত্তা অবকাঠামো নেই। কিন্তু ভারত ‘ট্রানজিট’-এর জন্য ছয়টি নদী রুটেরও প্রস্তাব দিয়ে রেখেছে। এসব নদী রুটে আবার ১৭টি স্টেশন থাকবে। 12. ট্রানজিট সুবিধার বিনিময়ে ভারতের কাছ থেকে বাংলাদেশের অর্জন: যেহেতু ভারতকে যে সুবিধা দেয়া হচ্ছে তা ট্রানজিট, ট্রান্সশিফমেন্ট, না করিডর- সে সম্পর্কেই এখনো সরকারিভাবে আনুষ্ঠানিক কোন বক্তব্য পাওয়া যাচ্ছে না- সে কারণে প্রাপ্ত সুবিধার বিনিময়ে ভারত কিরূপ ফি দেবে তা নিয়েও ধুম্রজাল সৃষ্টি হয়েছে। আদৌ এরূপ কোনো ফি থাকবে কি না সে নিয়েও নীতি-নির্ধারক পর্যায়ে বিপরীতমুখী মতামত লক্ষ্য করা গেছে সম্প্রতি।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অর্থনৈতিক উপদেষ্টা মশিউর রহমান ট্রানজিট সুবিধা থেকে কোন ধরনের ফি বা মাশুল আদায়ের ঘোরতর বিরোধী। তিনি এও বলেছেন যে, ট্রানজিটের বিনিময়ে কোন ধরনের অর্থ চাওয়া এক ধরনের অসভ্যতা হবে। অথচ ট্যারিফ কমিশন বলেছে ট্রানজিটের বিনিময়ে বাংলাদেশ অন্তত ১১ ধরনের মাশুল দাবি করতে পারে। যার মধ্যে রয়েছে: প্রশাসনিক মাশুল, রক্ষণাবেক্ষণ মাশুল, শব্দদূষণ মাশুল, দুর্ঘটনাজনিত মাশুল ইত্যাদি। (প্রথম আলো, ১৯ এপ্রিল ২০১১) যেসব অঞ্চলের জন্য ভারত প্রধানত ট্রানজিট চাচ্ছে সেখানে (শিলিগুড়ি করিডোর দিয়ে) বর্তমানে পণ্য পরিবহনে ভারতের খরচ হচ্ছে বছরে প্রায় এক শত বিলিয়ন ডলার।

‘ট্রানজিট’ সুবিধা পেলে ভারতের পণ্য পরিবহনে সর্বোচ্চ ৭৬ থেকে সর্বনিম্ন ১২ শতাংশ খরচ সাশ্রয় হবে। কিন্তু বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে পণ্য পরিবহনে ভারতের বাড়তি খরচ লাঘব হলেও করিডোর প্রদানকারী তার কি পরিমাণ হিস্যা পাবে এবং সে নিয়ে দুই দেশের মধ্যে কোনো সমঝোতা হয়েছে কি না- সে বিষয়টি আজো অজ্ঞাত। বর্তমানে আসামের চা প্রায় ১৪ শত কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে কলকাতা বন্দরে এসে বহির্বিশ্বে রফতানি হয়; একই স্থান থেকে কোন যান ত্রিপুরা পৌঁছতে পেরোতে হয় ১৬৫০ কিলোমিটার। অথচ ট্রানজিট সুবিধা পেলে আসাম ও ত্রিপুরার যানগুলো মাত্র ৪ শত কিলোমিটার পাড়ি দিয়েই গন্তব্যে পৌঁছে যাবে। ভারতের অর্থনীতির জন্য এ এক বড় প্রাপ্তি হয়ে উঠবে।

স্বভাবতই এইরূপ আর্থিক সুবিধার বিপরীতে বাংলাদেশও আর্থিক প্রাপ্তির কিছু হিস্যা চাইবে এমনটি প্রত্যাশিত। কিন্তু ট্রানজিট সুবিধার বিনিময়ে ভারতের কাছ থেকে ন্যায্য ফি আদায়ের ব্যাপারে বাংলাদেশের নীতি-নির্ধারকদের মাঝে যে সুস্পষ্ট দোদুল্যমানতা এবং মতদ্বৈততা আছে তার প্রকাশ হিসেবে আমরা দেখেছি, গত ২০১০ জুনে এনবিআর ট্রানজিটের এক ধরনের ফি নির্ধারণ করে এসআরও জারি করার মাত্র কয়েকদিনের মধ্যে তা প্রত্যাহার করতে বাধ্য হয়। ওই এসআরও-তে এনবিআর প্রতি কনটেইনার পণ্যের জন্য ১০ হাজার টাকা এবং খোলা পণ্যের ক্ষেত্রে প্রতি টনে এক হাজার টাকা ফি ধার্য করেছিল। ভারত বর্তমানে তার মূল ভূখন্ড থেকে উত্তর-পূর্ব ভারতে পণ্য পরিবহনে যে খরচ করে তার চেয়ে আমাদের এনবিআর-এর নির্ধারিত ফি অনেক কম হওয়া সত্ত্বেও আপাতদৃষ্টিতে মনে হচ্ছে বাংলাদেশের নীতি-নির্ধারকদের শক্তিশালী একটি অংশ এরূপ ফি আদায়েরও বিরোধী। ওইরূপ বিরোধিতার কারণেই নদী পথে ভারত বর্তমানে যে ট্রানজিট সুবিধা নিচ্ছে তার ফি বাড়ানোর চেষ্টাও স্থগিত হয়ে আছে দীর্ঘদিন।

২০০৯-১০ অর্থ বছরে নদী পথে ব্যাপক ভারতীয় পণ্য পরিবহনের জন্য বাংলাদেশ ফি হিসেবে পেয়েছে মাত্র ৪ দশমিক ৫ কোটি টাকা (দ্য ফিন্যানশিয়াল এক্সপ্রেস, ঢাকা, ১৩ নভেম্বর ২০১০)। বর্তমান অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত ২০১০ সালের ২ নভেম্বর সচিবালয়ে সাংবাদিকদের বলেছেন, ‘ট্রানজিটের ওপর কোন শুল্ক ফি আরোপ করা হবে না। ’ তাঁর এই মন্তব্য বিস্ময়কর এ কারণে যে, গত এক যুগ ধরে একটি মহল গণমাধ্যমে ট্রানজিটের বিনিময়ে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার আয়ের গল্প শুনিয়ে যাচ্ছিলো । 13.‘ট্রানজিট’-এর পরিবেশগত ক্ষতির দিক: যেহেত বাংলাদেশ ঘণবসতিপূর্ণ একটি দেশ এবং যেহেতু এখানকার পরিবেশ বিবিধ কারণে ইতিমধ্যে বিপন্ন সে কারণে ‘ট্রানজিট’ কার্যক্রমের মধ্য দিয়ে এখানে বাড়তি কী কী পরিবেশগত জটিলতা তৈরি হবে সে সম্পর্কেও আমাদের জানামতে এখনো কোনো স্টাডি করা হয়নি। বর্তমান বিশ্বে এবং বাংলাদেশেও বড় কোনো প্রকল্প বাসত্মবায়নের সময় তার পরিবেশগত প্রতিক্রিয়া যাচাই-বাছাই করা হয়।

ইউরোপে সুইজারল্যান্ড পার্শ্ববর্তী দেশসমূহকে ট্রানজিট সুবিধা দেয়ার ক্ষেত্রে পরিবেশগত ক্ষতি মূল্যায়নে ট্রানজিটের যাপনবাহনের কারণে তাদের আলপস্ পর্বতের কী ক্ষতি হবে সেটাও শুল্ক নির্ধারণ প্রক্রিয়ায় অন্তর্ভুক্ত করেছে। অথচ বাংলাদেশ যখন দেশের ৮-১০টি রুট দিয়ে ভারতকে ট্রানজিট সুবিধা দিচ্ছে তখন কেন পরিবেশগত বিষয়গুলো এড়িয়ে যাওয়া হচ্ছে তা বোধগম্য নয়। বলাবাহুল্য, ‘ট্রানজিট’-এর কারণে সম্ভাব্য যেসব পরিবেশগত ক্ষতি হবে তার লাঘবের জন্য কিংবা তার পুনর্বাসনের জন্য ভারত কোন ভূমিকা রাখবে কি না তা ট্রানজিট প্রক্রিয়া টিকিয়ে রাখার জন্য ভবিষ্যতের এক বড় প্রশ্ন। কারণ যতই দিন যাবে জনগণের মাঝে ট্রানজিটের পরিবেশগত ক্ষতি স্পষ্ট হয়ে উঠবে। যেমন, আশুগঞ্জের অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে, সেখান থেকে আখাউড়া হয়ে ভারতের আগরতলায় হেভি মেশিনারী পরিবহনের জন্য (যা ওডিসি বা ওভার ডাইমেনশনাল কনসাইনমেন্ট নামে পরিচিত) সড়ক সম্প্রসারণের ঠিকাদারী পাওয়া ভারতীয় কোম্পানি এবিসি কন্সট্রাকশন এমনভাবে তাড়াহুড়ো করে ৪৯ কিলোমিটার সড়ক সম্প্রসারণ করার উদ্যোগ নিয়েছে যে, তার ফলে পার্শ্ববর্তী একটি খাল চিরতরে ভরাট হয়ে গেছে এবং এর মধ্যদিয়ে ঐ এলাকায় স্থায়ী জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হবে (প্রোব নিউজ ম্যাগাজিন, ৫-১১ নভেম্বর ২০১০)।

কিন্তু স্থানীয় কোন সরকারি কর্মকর্তারই এখন এ বিষয়ে মনযোগী হওয়ার উপায় নেই- কারণ তা হলে তারা ক্ষমতাসীনদের রোষানলের সম্মুখীন হওয়ার আশংকা করছেন। একইভাবে বিশ্ব ঐতিহ্য ক্ষেত্র হওয়া সত্ত্বেও ট্রানজিটের স্বার্থে সুন্দরবনের ভেতর দিয়ে রেললাইন বসানো এবং মংলা বন্দরকে ব্যবহার করে ঐ রেললাইন দিয়ে ভারতীয় পণ্য ব্যবহারের কথাও প্রস্তাব আকারে উত্থাপিত হতে দেখা যাচ্ছে। পরিবেশগত আরো বিষয় হিসেবে রয়েছে ট্রানজিট পরিবহনের ক্ষেত্রে পণ্য তালিকা উন্মুক্ত হবে, নাকি নির্দিষ্ট হবে তাও স্পষ্ট নয়। ভারত যে অঞ্চলের জন্য ট্রানজিট সুবিধা চাচ্ছে সেখানে কমবেশি যুদ্ধাবস্থা চলছে। বিভিন্ন জাতিসত্তার স্বাধীনতা সংগ্রাম দমনে সেখানে ভারতকে প্রতিনিয়ত যুদ্ধ সামগ্রী প্রেরণ করতে হয়।

সেগুলোও ট্রানজিট সুবিধার আওতায় পড়বে কি না তাও ফয়সালা হওয়া প্রয়োজন। ওইরূপ ক্ষেত্রে বাংলাদেশও সংশ্লিষ্ট জাতিসত্তাগুলোর ক্রোধের লক্ষ্যবস্তু হয়ে উঠবে কি না? 14. ‘ট্রানজিট’ সংশ্লিষ্ট চোরাচালান ও মাদক পাচার সমস্যা: ইউরোপ, মধ্য এশিয়া এবং আফ্রিকার ট্রানজিট কার্যক্রমের অভিজ্ঞতা থেকে আমরা আরও দেখেছি, এরূপ বাণিজ্যিক কার্যক্রমের মাধ্যমে চোরাচালান ও মাদকের বিস্তৃতি ঘটে থাকে। ভারতের সঙ্গে আমাদের অর্থনৈতিক সম্পর্ক ইতিমধ্যে চোরাচালান কবলিত। ‘ট্রানজিট’ সেক্ষেত্রে কতটা বাড়তি সমস্যা তৈরি করবে এবং তার মোকাবেলায় কিরূপ পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে তা সম্পর্কেও কোনো বক্তব্য পাওয়া যাচ্ছে না। এ প্রসঙ্গে উল্লেখ্য, ভারত থেকে ফেনসিডিল পাচার বাংলাদেশের জন্য এক বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে উঠেছে।

ফেনসিডিল বাণিজ্যকে ভারতীয়রা এত প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিয়েছে, বাংলাদেশ সীমান্ত সংলগ্ন গ্রামগুলোয় এ পর্যন্ত ১৩২টি ফেনসিডিল কারখানা শনাক্ত করা গেছে। এ বিষয়ে বর্ডার গার্ড অব বাংলাদেশ (বিজিবি)-এর তরফ থেকে ইতিমধ্যে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর কাছে বিস্তারিত তথ্য তুলে ধরা হলেও প্রতিকার পাওয়া যায়নি। ফেনসিডিল কারখানাগুলোর মধ্যে কেবল পশ্চিমবঙ্গেই আছে ৫২টি। ফ্যামিলি হেলথ ইন্টারন্যাশনাল নামক সংস্থার স্টাডি অনুযায়ী বাংলাদেশে কেবল মাদক পাচারের মাধ্যমে ভারতীয়দের আয় ৩৪৭ কোটি রুপি (নিউজ টুডে, ২৯ ডিসেম্বর ২০১০)। অন্তত ৩২ ধরনের মাদক ৫১২টি পয়েন্ট দিয়ে ভারত থেকে এ দেশে ঢুকছে।

এ ধরনের সমস্যার মোকাবেলায় এ মুহূর্তে সড়ক ও রেলপথে বাংলাদেশে পণ্য পরিবহন কার্যক্রমে যে স্ক্যানিং অবকাঠামো রয়েছে তা অতি অপ্রতুল। ‘ট্রানজিট’ শুরু হলে বাড়তি স্ক্যানিং অবকাঠামো স্থাপিত হবে কি না এবং স্ক্যানিংস্থলগুলো কোথায়, কোন কর্তৃপক্ষ কর্তৃক নিয়ন্ত্রিত হবে সে বিষয়েও এখনো কোনো সুনির্দিষ্ট বক্তব্য জানা যায়নি। পুরো ট্রানজিট কার্যক্রম তদারকির জন্য পৃথক কোন কর্তৃপক্ষও এখনো সৃষ্টি হয়নি। 15. ‘ট্রানজিট’ সংশ্লিষ্ট স্বাস্থ্য ঝুঁকি: ইউরোপ, মধ্য এশিয়া এবং বিশেষ করে আফ্রিকার অভিজ্ঞতা থেকে আমরা দেখেছি, ট্রানজিট কার্যক্রমের অনুষঙ্গ হিসেবে নতুন করে ব্যাপক স্বাস্থ্য সমস্যার আবির্ভাব ঘটে। ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে প্রতিদিন যদি নতুন করে শত শত যানবাহন চলাচল করে তবে তার ফল হিসেবে কিছু স্বাস্থ্য সমস্যার আবির্ভাব প্রায় অনিবার্য।

এক্ষেত্রে অবধারিতভাবে এইডস সমস্যার কথা চলে আসে। ভারতে ইতিমধ্যে ছয় মিলিয়ন এইডস রোপী শনাক্ত করা হয়েছে। এ সংখ্যা বিশ্বের যে কোনো দেশের চেয়ে সর্বোচ্চ। বাংলাদেশের জন্য উদ্বেগের বিষয় হলো, ভারতে সবচেয়ে এইডস উপদ্রুত তিন প্রদেশই বাংলাদেশ সীমান্তের কাছে মিজোরাম, মনিপুর, নাগাল্যান্ড। ভারত বাংলাদেশের মধ্য দিয়ে যে ট্রানজিট সুবিধা চাচ্ছে তার এক দিকেই রয়েছে উপরোক্ত তিনটি প্রদেশ।

আরো বিপদের ব্যাপার হলো ট্রানজিটের প্রধান যে উপাদান ট্রাক- তার চালকরাই ভারতে সবচেয়ে বেশি এইডস বহন করে চলেছে। প্রশ্ন হলো আমরা আদৌ এসব বিষয় সম্পর্কে সচেতন কি না? এর জন্য কিংবা এর মোকাবেলায় পূর্ব প্রস্তুতিমূলক কোনো পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে কি না? ট্রানজিটের নামে যেসব যান চলাচল করবে তার চালকদের স্বাস্থ্য পরীক্ষার মতো কোনো অবকাঠামোগত সুবিধা কিংবা চিন্তা-ভাবনা কি আদৌ বাংলাদেশের রয়েছে। চলবে............ ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।