আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

ভয়ঃ ১৯৭৪ সালের একটি গল্প (শেষ পর্ব)

যারা প্রথম পর্ব পড়েন নি তাদের জন্যে প্রতম পর্বের লিঙ্ক প্রথম পর্ব View this link শেষ পর্ব বলতে না বলতেই কলিং বেলের শব্দে চমকে উঠলেন। মালেকা সাহানাও ততক্ষণে ফিরোজের পিছনে এসে দাঁড়িয়েছেন। “এত সকালে আবার কে এল?” স্বামীর চোখের দিকে তাকালেন। চোখ দেখে বুঝতে চাইলেন তিনিও একই কথা ভাবছেন কী না। পুলিশ টুলিশ আসেনি তো! আবার বেজে উঠল বেল।

বাবা মাকে দ্বিধা গ্রস্থ অবস্থায় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ফিরোজ বলল, “দেখি”। মালেকা সাহানা ঘাবড়ে গেলেন। “ না, না তুই যাবি কেন? বাজুক না আরেকবার। মান্নান সাহেব বললেন “আগে উপর থেকে দেখ, একেবারে সামনে চলে যেওনা আবার। ।

বাসার ভিতরের কথা বার্তা আর কলিং বেলের শব্দ ছাপিয়ে কার গলা শোনা যেতে লাগল। ও ফিরোজ তোরা দরজা খুলবি না? মান্নান সাহেব যেন ধড়ে প্রাণ পেলেন। “উকিল সাহেবের গলা না? উকিল সাহেব মানে এডভোকেট রহমত আলী মান্নান সাহেবের বাল্য বন্ধু। জজ কোর্টের দুঁদে উকিল। জেলা আওয়ামী লীগের বড় নেতাদের সাথেও ভালো যোগাযগ আছে।

মিটিং টিটিঙ্গে দাওয়াত পান। মালেকা সাহানা বললেন ফিরোজ তোর চাচা এসেছেন দরজা খুলে দে। প্রতদিন ফযরের নামাজ শেষ করে প্রাতঃ ভ্রমণে বের হন রহমত আলী । এক এক দিন এক এক রাস্তায় হাটেন তিনি। এক রাস্তায় প্রতিদিন হাটলে এক ঘেয়েমি লাগে।

এই রাস্তায় হাটার দিন একটু বন্ধুর খোঁজ খবর নিয়ে যান। সব শুনে বললেন “তোমাদের কতবার বলেছি জাসদের ছেলেটাকে বিদেয় কর। আমার কথাতো শুন বা না। এখন? যদি কিছু পাওয়া যায় কী যন্ত্রণায় যে পড়বা। ছোকরাটা কই?” মালেকা সাহানা বললেন ভাইসাব কী করবো এখন? - রওশন আলী সাহেবের সাথে একটু কথা বলা দরকার।

সিটিং এমপি, আমার সাথে পরিচয়ও আছে। তার আগে দ্যাখন মসিউর কোথায়। ফিরোজ উপর থেকেই ডাকা শুরু করলো, মসিউর ভাই, ও মসিঊর ভাই, প্রথমে কোন সাড়া শব্দ পাওয়া গেল না। একটু পর দরোজা খুলে চোখ ডলতে ডলতে বের হলেন মসিউরের মা করিমুন্নেসা। এ ফিরোজ! এত ব্যানে (বিহানে) ডাকা ডাকি শুরু করলি ক্যন? রাত্তিরি বাঁতের ব্যথায় ঘোম হইনি।

এট্টু চোক বুজলাম আরা ডাকা ডাকি শুরু করলি, কী হইয়েছে? - মসিউর ভাই কই? - মসি তো রাত্তিরি বাড়ি ফিরিনি। নাভারণ না কনে মিটিং ছেল। শ্যনেই রইয়েছে মনে হয়। - উকিল সাহেব পুরো পুরি বিশ্বাস করলেন না বিষয়টা। মসিউরের উপর তার একটু রাগও আছে।

একবার তার বড় মেয়েকে প্রেমের চিঠি দিয়েছিল ছোকরা। তিনি মৃদু স্বরে মান্নান সাহেব কে বললেন মসিউর বাড়িতে লুকিয়ে নেই তো! তার সন্দেহ নিচে পর্যন্ত পৌছাল কী না বোঝা গেলনা। “হ্যা, দাদি এত সকালে তুমরা কি কত্তিছো সবাই?” মসিউরের মা গলা বাড়িয়ে মালেকা সাহানার কাছে জানতে চাইলেন। এতক্ষণে উকিল সাহেব পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে নিয়ে নিয়েছেন। তিনি বললেন ফিরোজ, তোর খালাকে উপরে আসতে বল।

করিমুন্নেসা কথাটা শুনতে পেয়ে বললেন “কিরে ফিরোজ তোর চাচা আমার ডাকছে ক্যান? ফিরোজ বলল, “খালা একটু উপরে আসবেন? টালির ছাঁদে... কথা শেষ করার আগেই মান্নান সাহেব বলে ওঠেন আস্তে বল, বাড়ির সামনে পেছনে রাস্তা, সারাদিন লোক জন যাওয়া আসে করে কে কী শুনে ফেলে এ উলটা পাল্টা লাগাবে। এসব কথা বারতা করিমুন্নেসার কানেও যাচ্ছিল। তিনি কথা না বাড়িয়ে উপরে উঠে এলেন। ছাদ জুড়ে কাপরের টুকরা দেখে চোখ কপালে উঠে গেল তার। বললেন, এ কাপড়ের গাইট থুয়ে গেল কিডা? সে কথাই তো ভাবছি বললেন মালেকা সাহানা।

এগুলো এল কোথা থেকে? আনোয়ারুল কাদির বললেন, “ভাবি, এই কাপড়ের তলে যদি আস্ত্রপাতি পাওয়া যায়, বিপদে পড়ে যাবে মসিউর। কতবার ছেলেটাকে বলেছি এসব পলিটিক্স টলিটিক্স ছাড়”। ছেলের বিপদের আশঙ্কায় করিমুন্নেসা ঘাবড়ে গেলেও তা প্রকাশ করতে চাইলেন না। বললেন, “তার কী দোষ! মসি যখন খানেদেরে সাথে লড়াই করল তখন বিপদ হল না। এখন মজিবারের সময় বিপদ হবে ক্যান।

আমার ছেলে কী কাপড় চুরি করে ছাদে থুইয়েছে? না কী চুরি করা কম্বল গায়ে ঘুরে বেড়ায়?” এ কথায় একটু বিব্রত হলেন উকিল সাহেব। রিলিফের একটা কম্বল তিনিও পেয়েছেন এক আওয়ামীলীগ নেতার কাছ থেকে, কম্বল গুলোয় বেশ ওম। তিনি বললেন “কম্বলের কথা আসছে কেন?” - ও মা আমি কী তাই বললাম নাকি? আমার পুত বাড়ি না থাইকেও দোষের ভাগী হচ্ছে, আমতা আমতা করলেন করিমুন্নেসা। সুযোগ পেয়ে উকিল সাহেব বললেন রক্ষীবাহিনী ঠিকই বের করে ফেলবে তলে তলে কার ফন্দি। মান্নান, থানায় খবর দাও।

থানার কথা শুনে ভয় পেয়ে গেলেন করিমুন্নেসা। তিনি মান্নান সাহেব কে বললেন, ও নুন্দাই পুলিশ বেটারা খালি খালি আমার পুতেরে ধইরে নিয়ে যাবে নে। আর রক্ষীতো শুনিছি কোন কথাই শোনে না। আমি ভাবতিছিলাম আর একটা কাজ করলি কেমন হয়? উকিল সাহেব বললেন ও ভাবি আপনি ভয় পাচ্ছেন কেন? মসিউর তো বাড়ি নেই। করিমুন্নেসা কান্নায় ভেঙ্গে পড়লেন।

“আপনারা সবাই জানেন ভয় ক্যান পাতিছি। মসি যতি একবার রক্ষীবাহিনীর হাতে পড়ে তারে কিডা ছাইড়ে আনবেনে? ও নুন্দাই আমার মসি ত কিছু করিনি। বিনা দোষে সাজা খাবে আমার বাপমরা ছেলেডা?” মান্নান সাহেব সায় দিলেন তার কথায়। “ আনোয়ার ভাই, মসিঊর কিন্তু আমাদের সে রকম ছেলে নয়। ভাবি, আপনি কি করতে বলেন?” তাঁর কথায় একটু আশার আলো দেখতে পেলেন করিমুন্নেসা।

“আমি বলছিলাম কি, এসব মজু মিয়ার পুকুরি ফেলে দিলি কেমন হয়?” বিষয়টা একবারও কারো মাথায় আসেনি। এখনও তেমন লোকজনের যাওয়া আসা শুরু হয় নি। বড় কোন ঝামেলায় না গিয়েও পুকুরে ফেলে দেওয়া যায়। উকিল সাহেব বললেন কাপড় চোপড় ধরবে কে? যদি কিছু থাকে? যদি বারষ্ট করে? করিমুন্নেসা বললেন, “আমার পুতির যখন দোষ আমি ফ্যলবো। আমি বুড়ো মান্নুষ আমি মরে গেলে কার কি ক্ষতি? ফিরোজ এট্টা লগি টগী পাস নাকি দ্যাকতো”।

চোখ ছল ছল করে উঠল মালেকা সাহানার । করিমুন্নেসা একটু ঝগড়ুটে হলেও মানুষ খারাপ না। তিনি বললেন, “সকালে তো পৌর সভার ‘ডোমেরা’ আসে পায়খানার চাড়ি পরিষ্কার করতে। তাদের একজনকে পয়সা টয়সা দিলে তারাই হয়তো ফেলে দেবে”। শেষ পর্যন্ত তাদেরই একজন ছাদের উপর থেকে কাপড়ের টুকরো গুলো পুকুরে ফেলে দিল।

ফিরোজ হাত লাগাতে গিয়েছিল, উকিল সাহেবের ইশারায় তাকে দূরেই থকতে হল। সবাই হাফ ছেড়ে বাঁচলেন। যাক অন্য কিছু নয়। আনোয়ার সাহেবের গায়ে তখনও কম্বলের খোটা বিধছে। তিনি বললেন, “পুরো ঘটনার পিছনে ওই ছোকরার হাত আছে।

এবার কাপড় রেখে বাড়ি মাথায় করলো। এর পর রাখবে আসল জিনিষ”। মসিউরের মা সিড়ি দিয়ে নামতে নামতে তাঁর কথা শুনতে পেলেন। মান্নান সাহেব গম্ভীর হয়ে গেলেন। এই ধরণের কথা বারতা তাঁর ভালো লাগে না।

তিনি উকিল সাহেব কে বললেন। দোস্ত, চিন্তা করতে পারো মানূষ কি দমবন্ধ অবস্থায় আছে? যুদ্ধের পুরো নয় মাস জান হাতে করে পালিয়ে বেড়িয়েছি আর এখন রক্ষীর ভয়ে বিপদে সাহাজ্য চাইতেও সাহস পাচ্ছি না। উকিল সাহেব মাথা নাড়তে নাড়তে নেমে গেলেন। মালেকা সাহানা নাস্তা করার জন্যে অনুরোধ করেছিলেন। ততক্ষণে সূর্য অনেকটা উপরে উঠে গেছে, নাস্তার জন্যে বসলে কোর্টে পৌছাতে দেরি হয়ে যাবে।

মালেকা সাহানা নাস্তা বানাতে রান্না ঘরে ঢুকেছিলেন। এমন সময় আবার কলিং বেল বেজে উঠল। মান্নান সাহেব দরোজা খুলে অবাক হয়ে গেলেন। লম্বা একটা হাফ প্যান্ট পরে শিবু পাগলা দাঁড়িয়ে। নিরীহ ধরণের পাগল ।

শীত গ্রীষ্ম সব ঋতুতেই তাঁর একই পোষাক। হাফ প্যান্ট আর খালি গা। সরলতার জন্যে পাড়ার মানুষের কাছে একটু প্রশ্রয়ও পায় সে। ঘোলা চোখ দু’টি ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে কিছু একটা খুঁজছে সে। মান্নান সাহেব বললেন কাকিমা কে খুঁজছিস?নাস্তা খাবি? এ কথার উত্তর দিলনা শিবু।

বলল, এক খান জামা বানানোর জন্যি কাইল রাত্তিরি আমি আপনাদের হেসেলের চালে এক গাদা কাপুড় থুইয়ে গিইলাম। কাকা, একটা কথা বলেন তো, “আমার কাপুড় নেলে কিডা?” ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।