আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

আমার বই পড়া

ওয়াসিকুজ্জামান অনি ছোটবেলা থেকেই বই পড়াটা আমার কাছে চিত্তবিনোদনের সর্বশ্রেষ্ঠ উপায়। বই এ একরকম নেশাগ্রস্থ বলা যায়। আমার যখন বয়েস ৬ বছর, আমার বাবা তখন সামরিক বাহিনিতে মেজর পদে কর্মরত এবং সৈয়দপুর কেন্টনম্যান্ট এর উপ-অধিনায়ক (মুক্তিযুদ্ধে সাবসেক্টর কমান্ডার ছিলেন) , তখন আমার জন্মদিন উপলক্ষে সৈয়দপুর টাউনের কোন এক লাইব্রেরীতে নিয়ে গিয়ে একটা ঠাকুরমার ঝুলী আর টারজান এর কাহিনী নিয়ে দুটা বই কিনে দিলেন। সেই সম্ভবত বই পড়ার শুরু। সে সময় স্কুল গুলোতে যারা ভালো রেজাল্ট করতো তাদের বছরের শুরুতে অনুষ্ঠান করে বই উপহার দেয়া হতো, আজকাল এর মনে হয় খুব একটা প্রচলন নেই।

তা সেসময় সবসময় ক্লাসে প্রথম হতাম যার ফলে প্রচুর বই উপহার হিসেবে পেয়েছি। স্কুল থেকে দেয়া “সাইকেল এলো কেমন করে” এবং পাগলা দাশু বইগুলোর কথা আজো মনে আছে। সাইকেল এলো কেমন করে বইটি আজো আমার কাছে আছে। ১৯৮৭ সালের দিকে আমি পড়াশুনার জন্য সিলেটে আমার দাদার কাছে চলে এলাম, বাবা-মা আর আমার ছোট ভাই ঢাকায় থাকলেন। আমার বই পড়ার নতুন অধ্যায় শুরু হল।

আমার চাচা ফুপুরা সবাই বই এর ব্যাপারে আগ্রহী ছিলেন বিধায় বাসায় প্রচুর বই ছিলো। মৌলানা আবুল কালাম আজাদ থেকে হালের মাসুদ রানা কিছুই বাকি নেই। আমিও গোগ্রাসে পড়তে থাকলাম। সিনেমার ম্যাগাজীন চিত্রালি, বিচিত্রা, বামপন্থি রাজনৈতিক দর্শন কিছুই বাদ গেলোনা। একা থাকি বলে ঘনিষ্ট আত্মিয়স্বজনরা কিছু প্রয়োজন কিনা জিজ্ঞেস করলে অবলীলায় বই চাইতাম।

প্রতিদিন একটা নতুন বই না হলে অশান্তি লাগতো। এমনকি পড়ার টেবিলে স্কুলের বইএর মতো মলাট বেধে গল্প উপন্যাস লুকিয়ে পড়তাম, স্কুলেও পড়তে গিয়ে অনেকবার শিক্ষকদের হাতে ধরা খেয়ে বই বাজেয়াপ্ত হয়েছে। তবে বোধকরি শিক্ষকরা খুব একটা অখুশী হতেননা। এই সময় আমি বই কেনার জন্য কত কিছুইনা করেছি। স্কুলে হেটে যেতাম আসতাম তাতে প্রতিদিন ৮ টাকা সঞ্চয় হতো, সপ্তাহের শেষে ৪৮ টাকা, মানে অন্তত ৩ খানা বই কেনা যেত।

এসময় শিখলাম যে লাইব্রেরীতে মলাট ছেড়া বা পুরোন বই খুজে বার করলে হাফ দামে পাওয়া যায়। এতে সুবিধা হলো কখোন কখোন ৬/৭ টি বই পেয়ে যেতাম। তার পরে শিখলাম চুরী করা, লাইব্রেরীতে গিয়ে ৫ খানা বই কিনলে কৌশলে ১/২ টা চুরী করে ফেলতাম, একবার বন্দরবাজারের এক লাইব্রেরীতে ধরাও পড়ে যাই, মালিক ভদ্রলোক স্কুলের নাম জিজ্ঞেস করে আর বইটি দেখে (তালপাতার সেপাই) আমাকে সস্নেহে বইটি উপহার দিয়ে দেন। বই কেনার জন্য বাসাতেও চুরী শুরু করলাম, দাদীর পার্স থেকে সুযোগ পেলে ২০/৫০ টাকা চুরী করতাম বই কেনার জন্য। তিনি হয়তো বুঝতেন কিন্তু কখোন কিছু বলতেন না।

একবার কি কারনে আমি অভিমান করায় আমাকে দোকানে নিয়ে গিয়ে ১০ খানা বই উপহার দিয়েছিলেন। এই সময়টাতে আমি মুলত বিদেশী ক্লাসিক, গোয়েন্দা কাহিনী বেশি পড়তাম। কিন্তু সমসাময়িক কিছু ঘটনা আমার পাঠ্যাভাস আর বিস্তৃত করে দেয়। আমি অঙ্ক শিখতে যেতাম একজন মহৎ হৃদয় শিক্ষক মখলুকুর রব সাহেবের কাছে, তিনি আমাকে বিষেহ স্নেহ করতেন। একদিন আমার হাতে ৩টা বই দিয়ে বললেন – সুন্দর করে ক্যলান্ডারের পাতা দিয়ে বাধাই করে আনবি, আর পড়ে দেখবি।

তার একটা ছিল বঙ্কিম সমগ্র, আরেকটা রবীন্দ্রনাথের গল্পসমগ্র এবং ম্যাক্সীম গোর্কীর মা। আমি পড়লাম আর আরো বেশী করে বই এর প্রেমে পড়ে গেলাম। সে সময় ঈদে পরবে জামা কেনার জন্য টাকা দিলে আমি জামা না কিনে ঢাকা চলে যেতাম বই কিনতে। তখন ঢাকা যেতে ট্রেনে ৫৫ টাকা লাগতো, হাজার খানেক টাকা হাতে এলেই দে ছুট ঢাকায়। তখন বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামে একটা দোকান ছিল সুবর্ণ (এখন আর নেই) সেখান থেকে প্রচুর বই কিনেছি।

এছাড়াও নিউমার্কেট, নীলক্ষেত, আর বাঙ্গলাবাজার ঘেটে কত বইযে কিনেছি। এ সময়টাতেই পুরোদমে খেলাধুলা শুরু করলাম , ফলে আমার আয়ের একটা বন্দোবস্ত হলো, তার মানে আসলে বই কেনার বন্দোবস্ত হলো। আজ মনে পড়লে হাসি পায় কত কিছু করে যে বই পড়তাম, শুধু বই না ম্যাগাজীন, না পত্রিকা সব পড়তাম। কোন কোন বই খুব ভাবীত করত, পড়ার পর বই নিয়ে অনেক চিন্তা করতাম। শির্ষেন্দুর দূরবীন বইখানা সম্ভবত হাজার পৃষ্ঠার উপরে হবে, তা এক বসায় না ঘুমিয়ে এক সন্ধ্যায় শুরু করে পরের সন্ধ্যায় শেষ করেছিলাম।

রাতে বকুনির ভয়ে লেপের নিচে টর্চ জালিয়ে বই পড়েছি। বেশীরভাগ বই এখন আর আমার সংগ্রহে নেই, চাকুরীর কারনে বাইরে থাকা অবস্থায় বাসা থেকে সব গায়েব হয়ে গেছে। এখনো সময় সুযোগমত পড়ে যাচ্ছি, অফিসে বাসায় বা গাড়িতে যখন সময় পাই। আমি যতটুকু সাফল্য অর্জন করছি জীবনে তাতে বই এর অবদানই অধিক। আমার জ্ঞ্যানের বিকাশ হয়েছে, ভাষা জ্ঞ্যান বৃদ্ধি পেয়েছে যা পরবর্তি কর্মজীবনে খুব সহায়ক হয়েছে।

অনেক বিখ্যাত সিনেমা দেখার আগে সে বই পড়া থাকায় অনেক মজা পেয়েছি। আজকের কম্পিউটার এর যুগে বই এর সেই সমাদর আর নেই, তারপরেও বই এর চেয়ে ভালো বন্ধু আমি কল্পনা করতেও পারিনা। এখনকার শিশুরা বা তরুনরা আগের মত বই পড়ে না, সহজ বিনোদন টেলিভিশন আর ইন্টারনেট এই মানসিক বিকাশের সহজ পথকে আরো হয়তো সহজতর করেছে, কিন্তু তাতে কি সেই বই এর পুর্নতার আস্মাদ পাওয়া সম্ভব? বিছানায় হেলান দিয়ে অলস দুপুরে কি ঘুরে আসা যাবে সারা বিশ্বে বই এর পাতায় ঘুরে? আসলে যুগ বদলে অনেক কিছু বদলে যায়। আমি আশা করবো আমার দুই ছেলের কিছুটা হলেও যেন পাঠ্যাভাস হয়। এতে আর কিছু না হোক ভাষাজ্ঞ্যান বাড়লে পরবর্তি কর্মজীবনে অনেক সুবিধে হবে।

নিছক জ্ঞ্যানার্জনের বা বিনোদনের হয়তো প্রধান মাধ্যম আর বই নয় , তারপরও এর ব্যাপ্তি অস্বীকার করার কন উপায় নেই। ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।