আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

তিস্তা চুক্তি ও ট্রানজিট অধিকার থেকে অনুগ্রহ

ক্লিন'স অল্টারনেটিভ ওয়ার্ল্ড এখন থেকে কয়েক মাস (অর্থমন্ত্রীর বক্তব্য অনুযায়ী- তিন মাস) পরের ঘটনা। ভারতের পানিসম্পদ মন্ত্রী বাংলাদেশ সফরে এলেন। সাথে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জী। বাংলাদেশের দাবি অনুযায়ী ত্রিশ শতাংশের উপরে পানি দিতে শেষ পর্যন্ত রাজি হয়েছেন মমতা। যারা তাকে এতদিন অত্যন্ত নির্দয় ভেবেছিলো, তারাও শেষ পর্যন্ত মমতার এই গভীর মমত্ববোধে আপ্লুত।

বাংলদেশের মানুষের প্রাণের দাবি তিস্তার পানির হিস্যা দিতে রাজী হয়েছে বন্ধুপ্রতীম দেশ ভারত। এবার বাংলাদেশেরও দায় ভারতের প্রতি তার বন্ধুত্বের প্রমাণ রাখা। এখন থেকে কয়েক মাস আগে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ড. মনমোহন সিং-এর ঢাকা সফরকালে বাংলাদেশ অত্যন্ত দৃঢ়তার (!?) সাথে ভারতের মূল দাবি ট্রানজিট চুক্তির সাথে তিস্তার পানি বণ্টন চুক্তিকে জড়িয়ে দিয়েছিলো। প্রধানমন্ত্রীসহ অন্যান্য মন্ত্রী ও উপদেষ্টারের দৃঢ়তার কারণে এমনকি মনমোহন সিং-এর কাছেও নত হয়নি বাংলাদেশ। হোন না তিনি ভারতের প্রধানমন্ত্রী।

সরাসরি তাকে জানিয়ে দেয়া হয়- তিস্তা চুক্তি না হলে ট্রানজিট বিষয়ক কোন চুক্তি বা স্মারকে সই করবে না বাংলাদেশ- করেও নি। বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বারংবার আশাবাদ সত্ত্বেও তাই শেষ পর্যন্ত তিস্তা চুক্তি না হওয়ায় ট্রানজিট বিষয়ক কোন ধরনের কাগজেই সই করে নি বাংলাদেশ। যারা আশংকা করেছিলেন- আওয়ামীলীগ ‘বিনা যুদ্ধেই দেশের মেদিনি’ ভারতের কাছে সপে দিয়ে বসে আছে তারাও শেষ পর্যন্ত মুখ লুকাতে বাধ্য হন। আওয়ামীলীগ সরকার হতে পারে ভারতের বন্ধু, কিন্তু দেশের স্বার্থ রক্ষায় তারা বদ্ধ পরিকর। সে প্রমাণ তারা দিয়েছে তিস্তার পানি বণ্টন চুক্তি না হওয়ায় ট্রানজিট সংক্রান্ত চুক্তি বা সমঝোতা স্মারকে সই না করে।

কিন্তু এখন প্রেক্ষাপট ভিন্ন। যে মমতা ব্যানার্জীর কারণে শেষ পর্যন্ত নাকে খত দিতে হয় বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে- শেষ পর্যন্ত আশাবাদ ব্যক্ত করেও যার জন্য তিস্তা চুক্তির বায়বীয় আশ্বাসকে বাস্তবে রূপ দিতে পারেন নি, সেই মমতা ব্যানার্জীকেই দেখা যাচ্ছে সানন্দে তিস্তা চুক্তি মেনে নিচ্ছেন। বাংলাদেশের জন্য এ এক বিরাট কূটনৈতিক বিজয়। কূটনৈতিক প্রজ্ঞা থাকলে ছোট দেশ হয়েও যে বড় দেশের বিরুদ্ধে জয়লাভ করা সম্ভব তার প্রমাণ দিয়েছে বাংলাদেশ। গওহর রিজভী’র ত্রিকালদর্শী পররাষ্ট্রীয় অভিজ্ঞতা, ড. আলাউদ্দিনের ভদ্রতার চূড়ান্ত বহিঃপ্রকাশ আর অর্থমন্ত্রী ও পররাষ্ট্রমন্ত্রীর অনিঃশেষ আশাবাদ শেষ পর্যণÍ বাংলাদেশকে এ বিজয় এনে দিয়েছে।

এখন ভারতের এই বন্ধুসুলভ আচরণের পর ট্রানজিট বিষয়ক চুক্তি সই করতে বাংলাদেশের আর কোন বাধা রইলো না। সুতরাং তিস্তার পানি বণ্টন চুক্তির পর এখন প্রত্যাশা মতো ভারত-বাংলাদেশ ট্রানজিট বিষয়ক চুক্তি সাক্ষরের আয়োজন শুরু হচ্ছে। কয়েকমাস পরের ঘটনার বর্ণনা হিসেবে কেমন লাগলো উপরের বিবরণ? খুব অস্বাভাবিক লাগলো কী? লাগার কারণ তো নেই। কারণ, ভারতের প্রধানমন্ত্রীর সাম্প্রতিক সফরের পর দেশের সাধারণতম মানুষটি থেকে শুরু করে শীর্ষ কূটনৈতিক ব্যক্তিত্ব সবাই এখন কী ভাবছে? ভাবছে- “তিস্তার পানি বণ্টন চুক্তি সই করলি না ভারত, দেখ্ আমরা ট্রানজিটও দিলাম না। ” এ কথাটিকেই ঘুরিয়ে বলা যায়- “আমাদের সাথে তিস্তার পানি বণ্টন চুক্তি করো ভারত, আমরা তোমাকে ট্রানজিট দেব”।

তিস্তার পানি- যা আমাদের ন্যায্য অধিকার, তার বদৌলতে এভাবেই ট্রানজিটের মতো একটি স্পর্শকাতর ও বাংলাদেশের একমাত্র শক্তিশালী কূটনৈতি গুটিকে নিজের আয়ত্বে নিয়ে নিলো ভারত। এতদিন ভারত ট্রানজিট চাইতো, আর এখন আমরা তাদের ট্রানজিট দেয়ার জন্য উদগ্রীব হয়ে আছি। তিস্তার পানি বণ্টন চুক্তির মতো নগন্য একটি বিষয়কে (কেন নগন্য বলছি তা পরে আসছে) যে অনবদ্য কূটনৈতিক দক্ষতায় ট্রানজিটের মতো একটি মহা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের সাথে যুক্ত করে ফেললো ভারত তা আমাদের কর্তা ব্যক্তিরা বুঝেছেন কি-না জানি না। কিন্তু তিস্তা চুক্তির বিষয়টিকে এভাবে সামনে এনে আমাদের সর্বনাশ যা হবার হয়ে গেছে। আমাদের অনভিজ্ঞ পররাষ্ট্রমন্ত্রী আর বোধহীন মন্ত্রীগণ উপদেষ্টাদের দুষ্টচক্রে (ইচ্ছায় বা অনিচ্ছায়) পা দিয়ে দেশের সর্বনাশের পথ উন্মুক্ত করেছেন।

সে পথে কেবলই হারানোর সম্ভাবনা অপেক্ষমান। ড. মনমোহন সিং-এর এ সফরের পর আমাদের আর তেমন কিছু পাবার নেই ভারতের কাছে। আমরা আমাদের সর্বস্ব হারাতে বসেছি। আমি জানিনা লেখার শুরুতে আমি যে আশঙ্কার কথা বলেছি তা সত্যি হবে কি-না। না হোক সেটাই চাই।

কিন্তু যদি কখনো সত্যি হবার সম্ভাবনা দেখা দেয় তাহলে আমাদের জনগণ যেন কিছুতেই তিস্তা চুক্তিকে ট্রানজিটের সাথে বিনিময়যোগ্য করে না তোলেন। আর এজন্য দরকার তাদের মধ্যে এ বোধ জাগ্রত করা যে, তিস্তা চুক্তি আমাদের অধিকার, আর ট্রানজিট ভারতের প্রতি আমাদের দান। আমরা আমাদের অধিকারকে যেন ভারতের অনুগ্রহ হিসেবে গ্রহণ না করি। বাংলাদেশের প্রায় সকল নদী ভারতের অবৈধ পদক্ষেপের কারণে মৃতপ্রায়। ট্রানজিটের বিনিময়ে আমরা শুধু তিস্তা নয় আরো অনেকগুলো নদীকে উদ্ধার করতে পারি- পদ্মা, ব্রক্ষ্মপুত্র, যমুনা- আরো অনেক নদী, আদায় করে নিতে পারি আরো অনেক অধিকার ও সুবিধা।

আর যদি এসব ফিরে না-ই পাই তাহলে দরকার নেই তিস্তার পানি। বাংলাদেশ বাঁচলে তিস্তার পানি ছাড়াও বাঁচবে, আর মরলে কেবল তিস্তার পানি বাংলাদেশকে বাঁচাতে পারবে না। দেশের প্রধান নদীকে আমরা ভারতের আগ্রাসন থেকে রক্ষা করতে পারি নি, শেখ হাসিনা সরকারের গত আমলের চুক্তি পারে নি, এবারের চুক্তিও আমাদের বাঁচাবে না। সুতরাং, তিস্তার চুক্তির বিনিময়ে যেন ট্রানজিট দেয়া না হয়। বর্তমান আওয়ামীগ সরকারে যদি একজনও দেশপ্রেমিক মন্ত্রী এমপি থাকেন- তাহলে সোচ্চার হোন, দেশকে বাঁচান, তারপর রাজনীতি করুন।

ড. মনমোহন সিং-এর সাম্প্রতিক সফরে বাংলাদেশ কী পেয়েছে তা হিসেব করা কঠিন। কিন্তু হারিয়েছে অনেক কিছু- তারমধ্যে অন্যতম হচ্ছে আমাদের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বিশ্বাসযোগ্যতা। পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডা. দীপুমনি যেভাবে শেষ পর্যন্ত অপদস্ত হলেন তা যেকোন ব্যক্তিত্বসম্পন্ন মানুষের জন্য সহ্য করা কঠিন। এটা তার ব্যক্তিগত লাভ- লোকসানের বিষয় নয় কেবল, এটা দেশ হিসেবে আমাদের অবস্থানকেও খাটো করেছে। এছাড়া সরকারের মধ্যে সমন্বয়হীনতার নগ্ন প্রকাশও দেখা গেলো এ সফরকালে।

সরকারের দায়িত্বশীল এক এক ব্যক্তি নানা চুক্তি বিষয়ক বিপরীতমুখী বক্তব্য দিয়ে জাতিকে বিভ্রান্ত করেছেন। সবচেয়ে লজ্জাজনক বিষয় হচ্ছে ড. মনমোহন সিং-এর সফরটিকে ঘিরে পুরো জাতিকে ভারতের কাছ থেকে কিছু পাবার প্রত্যাশায় উদ্বেল করে তুলেছিলো সরকারের প্রচারযন্ত্র। এ বিষয়টি আমাদের জাতীয় দৈন্যকেই আবার নতুন করে তুলে ধরলো। আমরা আমাদের সম্মান রক্ষার চেয়ে কিছু পাবার বিষয়টি সবচেয়ে বেশী গুরুত্ব দিয়েছি। ভারত সেটা বুঝেই হয়তো শেষ পর্যন্ত আর কোন কিছুতেই আগ্রহ দেখায় নি।

করজোড়ে দণ্ডায়মান কাউকে কিছু দেবার নৈতিক দায় থাকতে পারে, বাধ্যবাধকতা নেই। ভারত তাই নির্দ্বিধায় আমাদের সকল প্রত্যাশাকে অবজ্ঞা করার সুযোগ পেয়েছে। ভবিষ্যতে যেকোন আলোচনার আগে দরকার আমাদের মেরুদ- শক্ত করা। আর দেশের ভিতরে দেশের স্বার্থ বিরোধী কাজে লিপ্ত কর্তাব্যক্তিদের দেশ থেকে বিতাড়িত করা। তবেই একসময় হয়তো আমাদের অধিকার আমরা আদায় করে নিতে পারবো।

তা না হলে সকল অধিকারই ওদের অনুগ্রহে পরিণত হবে। যেমন হচ্ছে তিস্তার পানি। আর আমাদের সকল দানই হয়ে যাবে সম্প্রদান- যেমনটি হয়ে যাচ্ছে ট্রানজিট। যা ছিলো আমাদের শক্তি তা-ই এখন আমাদের সর্বনাশের মূল উপাদান হয়ে গেলো। ক্লিন ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।