আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

গল্প: "আমি আজো আশায় থাকি, একদিন তুই আমার হবি"

"আমারে ফিরায়ে লহো অয়ি বসুন্ধরে, কোলের সন্তানে তব কোলের ভিতরে"-শ্রী রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর আমি শশী। শত সহস্র বিনিদ্র রাতের আলোক বার্তাবাহী শশী আমি নই। সেই আলোকে নির্ঘুম জেগে থাকা মানুষের একজন বলা চলে। আসমানের শশীর আলো আমায় ছাপিয়ে যায় আর আমার বিষণ্ণতা সেই শশীকে ঘিরে আলাদা অবয়ব গড়ে। আমার অপেক্ষা কিংবা তার আশাবাদ দুটই প্রভাবিত করে আমাদের চারপাশ।

আমরা দুজনই একা। চাঁদের পাশে কখনো কখনো শুকতারা এসে সঙ্গ দেয়,আর আমাকেও এমনি একজন সঙ্গ দেয় যার শর্তের ভড়ে আমি প্রায় নুহ্য। শর্ত ভাঙ্গার ভয়ে আমি মর্ত্য সুখ ত্যাগ করে একাকী রাত জাগি, সেই শুকতারা শশীকে কোন শর্ত জুড়ে দিয়েছে কি না খুব জানতে ইচ্ছে করে। শশীর বুকে একটি বালুক বিন্দু তাকে প্রভাবিত করে কি না আমার জানা নেই, তবে আমার সেই বিন্দু আমাকে অনেকখানি প্রভাবিত করে। বিন্দু! ভার্সিটির দ্বিতীয় দিনে প্রথম তাকে দেখা।

গহীন কালো দুটি চোখ। এই চোখ যে কারো চোখের ঘুম হরণ করতে পারে তা আমার জানা ছিল না। জানলে সেই নয়নে নয়ন ফেলে আসতাম না কোনদিন। সেদিন ওকে দেখার পরে বারেবারে চমকে উঠেছিল ভেতরটা। অনুরক্ত হওয়ার সৃতি আমার ছিল না, সেই প্রথম।

হারানোর ভয় আমাকে ততক্ষনে করেছে দুশ্চিন্তাগ্রস্থ। সারি সারি গাছে ঢাকা কালো পিচের সরু পথে তার চলে যাওয়া দেখেও পুলকিত আমি। প্রথম দেখায় আমার আকাশ সব নীল হারালো! কিছুদিনের মাঝেই বিন্দু হয়ে উঠে আমাদের বন্ধুসভার একজন। ভাবতে পারিনি এত সহজে এতটা ওর নিকট কোন এক বন্ধু হয়ে আত্মপ্রকাশ করতে পারবো। হ্যাঁ আমরা ততদিনে ভালো বন্ধু।

ভয় ছিল ওকে জমাট বাঁধা কথাগুলো বলতে, যদি বন্ধু হারাই? ওর ভেতরের কষ্ট জানার সুযোগ হয়েছে এই বন্ধুতা থেকেই। একসময় কোন এক সম্পর্কে জড়িয়ে ও নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছে। বন্ধু ছারা অবিশ্বস্ত কোন সম্পর্কের জালে জড়াতে চায় না। আর ওর বন্ধুত্বকে সম্মান জানাতে আমার জমাট কথারা প্রায় মুষড়ে যায়। তবুও মাঝে মাঝে ইচ্ছে জাগে, স্নিগ্ধ প্রহর কিংবা রাতে, তারে বলি আমার কথা, যদিবা পাই একটু ব্যাথা।

নিজের সাথে হেরে যাই বারেবার। বলা হয়নি তাকে, বলতে পারিনি। এরই মাঝে পেরিয়ে যায় একটি বছর। হাজার বছরসম একটি দিন আর পেরিয়ে গেলো একটি বছর! ভাবতেই অবাক লাগতো। বন্ধুসভা থেকে ছিটকে যায় বিন্দু তবে কিছু একটার টানে আমি রয়ে যাই তার পাশে, দুজনের বিচরন মুক্তমনে সবুজ ঘাসে।

কখনো তিনচাকার ধীরযানে আবার কখনো একলা হেটে পথের পানে। এতটা কাছে থেকেও যে শব্দগুলো কখনো নিজেকে প্রকাশ করতে পারেনি তারা হয়ত ততদিনে নিজেদের প্রকাশের উপযোগিতা হারিয়েছে। ইচ্ছে হতো তাকিয়ে চোখে, ঠোঁট মিলিয়ে তাহার ঠোঁটে, কিছুটা সময় নীরবতা, ভবসাগরে গভীরতা। ইচ্ছেগুলো ইচ্ছে হয়েই থেকে যায়। কল্পনায় ইচ্ছেগুলো মিলিয়ে নেয়ার মাঝেই অন্তর্নিহিত সুখ খুঁজে বেড়াতাম আমি।

একদিন সাহারাসম সাহস সঞ্চার করে বিন্দুকে প্রশ্ন দিলাম যে কেউ যদি আসতে চায় নতুন সাজে, নিয়ে রক্তিম কৃষ্ণচূড়া হাতের ভাজে, গোলাপ কিংবা কদম ফুল, বাসবে ভালো ভাঙবে ভুল? বিন্দু বেশ কিছুক্ষন নীরবতার পরে, দূরে দৃষ্টি মেলে ধরে;বললো আমায়, সৃতিগুলো লাগাম ছারা, টুকরোগুলো কি লাগবে জোড়া? তখন আমি জড়িয়ে ধরে চিৎকার করে বলতে পারিনি, হ্যাঁ হ্যাঁ আমি টুকরোগুলো সাজাবো আমার ফ্রেমে, রোজ রোজ মুছে দেব ফ্রেমের ধূলো ভালোবাসার আদরে। আমি বলতে পারিনি বন্ধুত্বের স্বার্থে। ভালোবাসা নাইবা পেলাম, বন্ধু হয়েই রয়ে গেলাম। বেশ কিছুদিন পরে বিন্দুই একদিন বলে বসলো, যদি এমন কাউকে পাই, নতুন করে বাঁধব স্বপ্ন নতুন করে চাই। বিন্দু আরো শর্ত বলেছিল, এই যেমন সেই ছেলেকে বয়সের ব্যাবধানে এগিয়ে থাকতে হবে, ক্যাম্পাসের কারো সাথে সম্পর্কের জালে জড়াবে না, ছেলেকে ওর পছন্দের হতে হবে আর ফ্যামিলি ম্যাচ করবে না।

বিন্দুর শর্ত আমার ইচ্ছেগুলোতে বিষ ঢেলেছিল। ধীরে ধীরে নির্জীব হতে থাকা ইচ্ছেরা কখনো কখনো মাথা জাগিয়ে উঠতে চাইতো। গোলাপের সব লাল শুকিয়ে যেতে থাকে, শুষ্ক গোলাপ ঠায় দাঁড়িয়ে থাকে মনভ্রোমরের অপেক্ষায়। দেয়ালের পুরনো ক্যালেন্ডার সরিয়ে নতুন একটি এসে জায়গা করে নেয়। আমি থেকে যাই সেই পুরনো কষ্টচাপা প্রেমিক হয়ে।

এক সেকেন্ডে কয়টি মুহূর্ত? এভাবে হিসেব করে কোটি সুখকর মুহূর্তের হিসেব কষে বড্ড ক্লান্ত আমি, আর ফলাফলে হতাশ। ভালোবাসি তারে বলিতে পারিনা, তব ভালোবেসে হারাতে চাহিনা। ভালোবাসলে হারাতে হবে, এ কেমন শর্ত? মনমাজারে বৃষ্টি ঝরে, তোমার ছাদে তোমার ঘরে, হাত বাড়ালে ধরতে পারো, অশ্রুসজল কান্না কারো। হাত বাড়িয়ে বৃষ্টি ধরে হাতের শুভ্র তালুতে নিয়ে খেলার শখ বিন্দুর কোনকালেই ছিলোনা হয়ত। আমি শুধুই ঝরে গেছি অঝোরে, ঝির ঝির ঝির।

বিন্দুর কাছে কখনো কিছুই গোপন করিনি, কিভাবে করি? সে যে আমার মনহরিণী! ঘুম ঘুম চোখে ওর স্বপ্ন দেখব বলে ঘুমের দিশা নেই। খুব অন্যরকম তাইনা? এরেই মাঝে একদিন কোন এক বন্ধুর জন্মদিনে আমন্ত্রিত আমরা দুজনে। শেষবেলায় বোতল ঘুরিয়ে ট্রুথ এন্ড ডেয়ার গেম আয়োজন। নিষ্ঠুর বোতলের সরু নল ঘুরতে ঘুরতে এতটা নির্দয় কেন হলো বুঝে উঠতে পারিনি। আমার দিকে তাকিয়ে আছে নল, এবার সত্য বলতেই হবে।

নির্মম কোন সত্য অপেক্ষা করছে আমার জন্যে। বন্ধু মহলের প্রশ্নের তীক্ষ্ণ ফলা কাউকে ভালোবাসি কি না? আমার হ্যাঁসূচক শব্দ বিন্দুর বদন শুস্ক করেছিল সেদিন। বিন্দুকে বাড়ি পৌঁছে দেয়ার কালে মায়াবী দৃষ্টি মেলে বিন্দু জানতে চায়,”কে সে?” আমি কেমনে বলি তারে, আমি যে তারই মায়াজালে। তার সেই শর্ত মাথায় রেখে একচিলতে আদ্র হাসিতে বলেছিলাম, তার কথা হবে আরেকদিন, যে বাজায় মনে প্রেমের বীণ। কিছুদিনের ব্যাবধ্যানে বিন্দু আমার থেকে একটু একটু সরে যাচ্ছিলো।

বুঝতে বাকি রইলো না কিসের দূরত্ব। কথার ভাজে চাপিয়ে দিলাম একটি কথা, “বিন্দু তুমিই সেই মেয়ে, প্রতিরাতে যে আমার নিদ্রা কাড়ে। “ বিন্দু হেসে বলেছি, “বন্ধুত্বই যথেষ্ট নয় কি? আর সম্পর্কে জড়াতে চাইনা ” আমি উত্তর জানতাম না। শুধু জানতাম বেবুঝ প্রেমিক আমি। বিন্দুকে নিয়ে আমার যত প্রেম যত ভালোবাসা, আমার জন্যে ঠিক ততটাই উদাসীনতা।

বিন্দুর সেই শর্তমতে আমি যোগ্য নই তাতে কি? ভালোবাসার গভীরতায় কম কিসে আমি? তবুও বন্ধু হয়ে পাশে থাকতে চাই, যদিবা জীবনে তারে না পাই। সব আবার আগের মতই চলছিল। সূর্য দিয়ে সকাল, চন্দ্র দিয়ে রাত। গুঞ্জন শুনে ছুটে গেলাম বিন্দুর কাছে। ক্যাম্পাস প্রাঙ্গনে কানাঘুষা বিন্দুর নতুন প্রণয় নিয়ে।

নাড়া দেয় বুকের গভীরে থেকে। ধরে রাখতে পারিনি নিজেকে। সরাসরি বিন্দুর কাছেই জানতে চাইলাম। বিন্দু হেসেই খুন, “ওহ! তোমাকে বলতেই ভুলে গিয়েছিলাম, ওর সাথে আমার অন্তর্জালে পরিচয়। “ ছেলেটা ক্যম্পাসের পরিচিত আমারও।

অপমান সইতে না পেরে হাহাকার নিয়ে চলেছি গোধূলি বেলায়। বিন্দু নিজেই তার দেয়া প্রতিটি শর্ত ভেঙ্গেছে। তাহলে আমার কি দোষ ছিল? এতটা পথ দুজনে একসাথে হাটার পরেও আমাকে কেন পেছনে ফেলে চলে যাবে ও? তারপরে কেটে যায় কয়েকমাস। বিন্দুর সাথে তেমন দেখাই হয়নি। আমি আশায় থাকতাম ও হয়ত দেখা দেবে কিন্তু সবই ধূল বালি ছাই পাশ।

অপেক্ষা কিংবা প্রতিক্ষা শব্দ দিয়ে আমাকে এভাবে বদলে দেবে বুঝে উঠিনি। এতটা দিন পাশাপাশি থাকায় অভাববোধটা হঠাত করেই গ্রাস করে নেয় আমাকে। বিন্দুর হয়ত আমার প্রতি সেই খেয়াল ছিল না, তার প্রয়জনে যতটা পাশে থেকেছি বিনিময়ে কিছু চাইনি কিন্তু এমন কিছু পাবো তাও নেহায়েত ভাবিনি। সারাবেলায় ভাবনা জুড়ে থাকতো, যেটুক পেয়েছি সেই কি যথেস্ট নয়? একদিন জানতে পারলাম সেই ছেলের সাথেও সম্পর্ক বিচ্ছেদে গেছে বিন্দু। পুনরায় যখন আমার আছে এসেছিল বন্ধুত্বের হিসেব চুকাতে আমি ফিরিয়ে দিতে পারিনি।

আবারো শুরু হয় আমাদের পথ। ঠিক যেন পুরনো বন্ধুই রয়ে গেছি আমরা। মাঝের কিছুদিনের কথা দুজনের কেউই আনতে চাইতাম না। চলছে, চলুকনা। অধ্যয়নের পর্ব প্রায় শেষ করার পথে তখন আমরা।

ঠিক আগের মত করেই একসময় বিন্দু আবার যোগাযোগ বন্ধ করে দিলো। হঠাত এমন হওয়াতে পুনরায় ভরকে গেলাম। আবারো শর্ত ভেঙ্গেছে ও। যারে ভেবে রাত দিন হই সারা, সে মোরে বারেবারে করে দিশেহারা। শেষটায় এসে আবার সব এলোমেলো হয়ে যাবে ভাবিনি।

এলোমেলো শব্দটা খুব বেশী এলোমেলো। শেষটায় ভেবে পাইনা কি করে একটি মেয়ে এতটা খেলতে পারে? ভালোবাসার পূর্ণতা নাইবা দিলে, তবে কেন বন্ধুত্বকেও ছোট করে দিলে? কতবার, কতবার চেয়েছি সরে দাড়াতে কিন্তু পারিনি। ওর আবেশ, ওর মায়া, ওর বন্ধনে আমি আটকা পড়ে আছি। নিজের স্বত্বাকে ভুলতে বসেছি। আমি আজো অপেক্ষায় আছি, হ্যাঁ আমি অপেক্ষায় আছি, অপেক্ষায় আছি তুমি আসবে।

শুনেছে হারিয়ে গেলে সেই হারানো ভালোবাসা নাকি কথা বলে। আমার ভালোবাসাও তবে কথা বলবে। একদিন তোমাকে তাড়িয়ে বেড়াবে। বুঝতে পারবে কতটা আপন ছিলাম। আমি শতাব্দি থেকে শতাব্দি এমনি নির্ঘুম অপেক্ষায় থাকব তোমার ফিরে আসার অপেক্ষায়।

ভুল ভাঙ্গানোর ভোরে দুজনে হারাবো ভুল থেকে দূরে। ঘোর অন্ধকারে দুজনে আবার আলোর মশাল তুলে ধরবো। স্নিগ্ধ কাশফুল কিংবা সবুজ ঘাস মাড়িয়ে হেটে যাব আবার হেটে যাব সীমাহীন পথের পানে হাতে রেখে হাত, আর চোখে রেখে চোখ। জানিনা, কখনো সত্যি হবে কি না, কিন্তু আমি স্বপ্ন দেখে যাব। তোমায় নিয়ে একান্ত নিজের কিছু স্বপ্ন, শুধুই নিজের।

আমি আজো আশায় থাকি, একদিন তুই আমার হবি। উৎসর্গঃ প্রিয় বন্ধু শশী হিমুকে। ভার্চুয়াল জীবনে যে ক’জন ভালো বন্ধু পেয়েছি শশী তাদের অন্যতম। কষ্ট চেপে হাসিখুশি থেকে সবাইকে আনন্দ দিয়ে যায়। নিজেকে বুঝতে দেয়না কখনো।

গল্পের প্লট শশীর দেয়া। কেন জানিনা, হঠাত একদিন আমাকে একটা গল্পের প্লট ধরিয়ে দিলো। সময়ের অভাবে লেখা হয়নি অনেকদিন, বন্ধুত্বের টানেই হয়ত লিখে ফেলেছি। কেমন হয়েছে জানি না। যতটা সময় নিয়েছি ততটা ভাবের প্রকাশ হয়ত করতে পারিনি।

তবে অন্যসব গল্প থেকে এই গল্পে যথেষ্ট আপনভাবে কেয়ার নিয়েছি। ভালো থাকুক সকল শশী, ফিরে আসুক শশীর বুকের বিন্দুরা।  ।


এর পর.....

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.