আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

আজ চিনি আপার বিয়ে (মাঝারি আকারের গল্প)

বিশ্বের নিপীরিত মানুষের শত্রু একটাই এবং তদের ধরন একই, এরা রয়েছে অনেক দূরে। এই শত্রুরা রয়েছে যেখানে থেকে পুঁজিবাদী এলিটদের জন্ম, যেখান থেকে এরা সরকার প্রধানদের ব্যাবহার করে তাদের শক্তি প্রেরণ করে, আর ঐ সরকাররা তাদের তাঁবেদারি করে লাভবান হয়। যারা রহস্য পত্রিকা নিয়মিত পরেন, তারা হয়ত চিনি আপাকে চিনতে পারবেন। নব্বইয়ের দশকে চিনি আপা শিরনামে একটি ছোট গল্প বেরিয়ে ছিলো, তখন গল্পটা পাঠক হৃদয়ে বেশ সাড়া ফেলে দেয়। কি সৌভাগ্য(!), আমার গল্পটা পড়ার সুযোগ হয়েছিলো, একে-তো বয়স কম তার ওপরে গল্পটা ছিলো বেশ রসালো, যদিও আমার বয়স রস বোঝার জন্য যথেষ্ঠ হয়ে ছিলোনা।

গল্পটা আমার কাছে আধুনিক ভাষায় জটিলস্‌ লেগেছিলো। আমি ভাবতাম ইশ্‌রে আমার’ও যদি ওরকম একটা আপা থাকত। কিন্তু সে গুরে বালি। কৈশোরের শেষ ছুঁই-ছুঁই করছিলো, স্বপ্নের চিনি আপা’ত দূরে থাক কপালে একটা মর্জিনা, সখিনা’ও যুটোতে পারলাম না। কিন্তু সবই নসিব, কখন কি থেকে যে কি হয়ে গেলো আমিও ঠাওর করতে পারলাম না।

পাশের বাসায় ভাড়া এলেন চিনি আপারা, তারা মানে তিনি আর তার পরিবার, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলায় অনার্স শেষ করেছেন। বাবা-মা তার জন্য সু-পুত্রের(!) খোঁজ করছে। কবে কোন ভূড়িওয়ালা আধ দামড়া সরকারি কর্মচারির গলায় ঝুলিয়ে দেবেন বলা যায়না। অবশ্য এ সবই উরা-ধুরা খবর। কিন্তু আমরা যারা পাড়ার একমাত্র চায়ের দোকানের পেঁছনে লোকচক্ষুর আড়ালে দাঁড়িয়ে যে জনিস টানলে ছোট হয়, সে জিনিসে সুখটান মারি তাদের কাছে ব্যাপারটায় নাক না গলিয়ে থাকতে পারি না।

তাকে আমি প্রথম দেখি আমার এস. এস. সি শেষ পরীক্ষার দিন। সেদিন অন্যা কোথাও না গিয়ে আমি বাড়ি ফিরছিলাম, বাড়ির ভেতরে ঢুকবো ঠিক এমন সময় তিনি ব্যালকনি এলেন ভেঁজা কাঁপর মেলে দেবার জন্য, আমি দেখতে পেলাম তার চুল গুলো ভেঁজা, চুল কোমর পর্যন্ত নেমে এসেছে। ভেঁজা চুলের পনিতে গায়ের সালোয়ারটা কিয়দাংশ ভিঁজে উঠেছে। আমি দরজার দোরগোড়ায় দাড়িয়ে পরলাম। তিনি আমার দিকে ঘুরলেন, তার সৌন্দর্য্যের বর্ণনা দিয়ে তাকে আমি ছোট করবনা।

কিন্তু তার গায়ের রঙের বর্ণনা না দিলে গল্পটা অপূর্ণ থেকে যাবে। আমরা সেই রঙ প্রতি বছর মাত্র এক-আধবার দেখার সুযোগ পাই। তার গায়ের রঙ ঠিক দুর্গা প্রতিমার মত, সবসময় অপরূপ এক রূপে চকচক করতে থাকে। একদিন চিনি আপার বাবা আমাকে রাস্তায় দেখতে পেয়ে তার বাড়িতে পাঠালেন সদাই পৌছে দেবার জন্য। আমি বাজারের ব্যাগটা তার হাত থেকে নিয়ে তার বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম।

চিনি আপাদের বাড়ির সামনে এসে কলিং বেলে চাপ দিলাম। কছুক্ষণ পর দরজা খুললেন চিনি আপা, ‘কি চাস্‌?’, আমি ঢোঁক গিললাম ‘চাচা বাজার পাঠিয়েছেন। ’ এক মুহুর্ত তিনি আমার দিকে তাকিয়ে থাকলেন। গ্রীক প্রেম দেবীর দুষ্টপুত্র কিউপিড বোধহয় এই সময় আমার অন্তরে তার অদৃশ্য সেই তীরটি ছুড়লো যার আঘাতে প্যারিস, রোমিও আহত হয়েছিলো হেলেন আর জুলিয়েটের প্রতি। আমি তো নগন্য ইস্‌কুল ছাত্র মাত্র, আমি কিভাবে সেই তীরের আঘাত থেকে বাঁচবো পাঠকই বলুন।

‘ভেতরে আয়। ’ ‘না থাক, আমার একটু কাজ আছে। ’ ‘তোদের কি কাজ থাকতে পারে আমি খুব ভালো করেই জানি। ’ ‘না না সত্যিই আমার কাজ আছে। ’ ‘কি কাজ চায়ের দোকানের পেছনে দাঁড়িয়ে সিগারেট ফুঁকবি আর আমার জানালার দিকে তাকিয়ে থাকবি, এইত?’ আমি বুঝলাম এই আপার নিশ্চয় কোন উদ্দেশ্য আছে তা না হলে আমাকে এতো করে ধরবেন কেন? সে যাইহোক আমি তাদের বাড়িতে ঢুকলাম।

আমাকে তিনি চা দিলেন, আমি তাকে বললাম আমি চা খাই না, তিনি বললেন ‘তোকে খেতে হবে না তুই পান কর। ’ ‘আপা আপনার নাম কি?’ ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞাসা করলাম আমি। ‘মিষ্টি...’ ‘মিষ্টি? এটা আবার কেমন নাম? আমি আপনাকে চিনি আপা বলে ডাকবো। ’ তিনি কোন কথা বললেন না। সে-ই শুরু।

তার পরের গল্পটা আর দশটা গল্পের মত। ধীরে ধীরে আমি চিনি আপার আরও কাছে আসতে শুরু করি। বাকিটা নির্মলেন্দু গুনের ভাষাতেই বলি? আমার শুধু ইচ্ছে করে সঙ্গে বসে থাকি হটাৎ করে তোমার গায়ে গোপনে হাত রাখি রাখতে রাখতে সাহস হবে সাহস থেকে প্রেম বুঝবে আমি শিকরগুলো কিভাবে ছিরলেম। কিন্তু আমি যে অতি নগণ্য, আমার কি আর সাহসী কাজ সাজে? চিনি আপা আর আমার সম্পর্ক তখন আমাদের পাড়ায় খ্যাতির মধ্যগগণে, কিন্তু সব কিছু অমুলে বদলে গেলো। সেদিন তিনি তার ঘর অন্ধকার করে বসে ছিলেন, আমি ঘরের আলো জালালাম, দেখলাম তিনি কাদছেন।

তাকে প্রশ্ন করলাম তার কি হয়েছে। কিন্তু তিনি কান্না ভেজা পাথরের মত চুপ করে শুয়ে থাকলেন। তাকে বিভিন্ন ভাবে সান্তনা দেবার চেষ্টা করলাম। কিন্তু আমি আবারও ব্যার্থ হলাম। তার কান্না দেখে যখন আমারও কান্না আসল তখন তিনি থামলেন, আমাকে প্রশ্ন করলেন ‘তুই কি কাটা ঘায়ে তোর চিনির ছিটা দিতে আসছিস।

’ নাক ও চোখের পানি মুছে তাকে বললাম ‘বয়স কম তাই বলতে পারি না, কিন্তু ভাগাভাগি করতে তো পারি। ’ তিনি কি বুঝলেন কে জানে আমাকে বললেন, বাবা-মা নাকি তার বিয়ে ঠিক করে ফেলেছেন, যার সাথে করেছেন সে নাকি ছেলে না; একজন লোক। মরে যাবেন কিন্তু ঐ লোকের সাথে তিনি বিয়ে করবেন না। আমি ভাবলাম তাকে আমি বলি চলেন তাহলে আমরা পালিয়ে যায়। কিন্তু আমি কি তা বলতে পারি? পারি না কারন আমি অতি নগন্য একজন।

তার নাকি নাগর আছে, আর তার সাথেই নাকি তিনি বিয়ে করতে চান। কাজ দিলেন, একটা চিরকূট সেই প্রেমিক প্রবরের কাছে পৌছে দিতে হবে আমাকে। আমি তাই করলাম, তার প্রেমিক প্রবরটিকে দেখে আমার মনে হল আমার দেবীর জন্য ইনি একজন রাজপুত্র। তিনিও আমাকে একটা চিঠি দিলেন চিনি আপার কাছে পৌছে দিতে। আমি ‘মাইনকা চিপায় ফাঁইসা’ গেছি এখন তো আমাকে ওটায় করতে হবে যা আমাকে করতে বলা হবে।

চিনি আপার আমিও একজন অ-ঘোষিত প্রেমিক। আমি তার জন্য যে কাজ করছি তা না করার জন্য আমার মন বার বার চাপ দিচ্ছিলো। কিন্তু আমি তাকে এতটায় ভালোবেসে ফেলেছিলাম তার অবাধ্য হতে পারিনি। প্রথম প্রেম ভাঙ্গার থেকেও বেশি কষ্ট পাচ্ছিলাম। তখন বাংলাদেশের গুনী-মানী ছ্যাঁকা খাওয়া শিল্পী আসিফের গান গুলো হটাৎ করেই ভালো লাগতে শুরু করে।

মনে হতে থাকে পরাজয়, বিচ্ছেদ, ব্যার্থতা, দুঃখ এসবই আমার নিত্য সঙ্গি, পৃথিবী আমার জন্য না, আমি পৃথিবীর জন্য না, সময় নামের অদৃশ্য বস্তুটি আমাকে ল্যাং মেরে ফেলে দিয়েছে কাদামাটিতে, সেখান থেকে মুক্তির উদ্দেশ্যে হাতের কাছে খড়-কুটো যা পাচ্ছি তার ওপরে ভর করে বেঁচে থাকার চেষ্টা করছি, কিন্তু ঐ যে আমি নগণ্য। চিনি আপার রাজপুত্রের শেষ চিঠিটা যখন তার হাতে দিলাম তখন তিনি সেটা আমার সামনেই পড়লেন, চিঠি যখন শেষ করলেন তখন তার মুখ প্রচন্ড কঠিন হয়ে উঠলো। আমি তাকে কিছুই জিজ্ঞাসা করলাম না, কারন কিছু কিছু কথা আছে যা কখনই মুখফুটে বলতে হয় না। আচরণে বুঝে নিতে হয়। *** আজ চিনি আপার বিয়ে।

সেই লোকটর সাথে। তার বিয়ে ধুম-ধাম করে করা হচ্ছে না। কাজী ডেকে বিয়ে দেওয়া হচ্ছে। বর পক্ষ থেকে এসেছে তিন জন। আর বাড়ির চার জন সদস্য, এই যা।

আমি যখন চিনি আপার ঘরে ঢুকলাম তখন খালাম্মা (চিনি আপার মা) ঘর থেকে বের হলেন। তাকে বেশ হাসি-খুশি দেখাল। চিনি আপার ঘরটা সেদিনের মত অন্ধকার। আমাকে দেখে তিনি বললেন- ‘আমাকে সুন্দর লাগছে তাই নারে? তিনি হেঁসে উঠলেন, আমি তাকে দেখতে পাচ্ছিনা শুধু তার হাঁসি শুনতে পাচ্ছি, হাঁসিটা আমার কাছে অপার্থিব লাগলো। যেন কোন দেবী অসুর বধ করে প্রতিশোধের হাঁসি হাসছে।

‘আপনি এই বিয়েতে খুশি চিনি আপা। ’ ‘হ্যাঁ... হা...হা... হা...’ হাঁসি এক সময় কান্নায় রুপ নিলো। তিনি ঢলে পরলেন। আমি তাকে ধরে ফেললাম, আমার কাঁধে ভর দিয়ে তিনি দাঁড়িয়ে আছেন, তার ঠোট আমার ঠোটের থেকে ইঞ্চি কয়েক দূরে। তার শরীর-পদ্মের গন্ধ আমার নাকে এসে লাগলো।

এক মুহুর্তের জন্য আমার হার্ট পাম্প করার কথা ভুলে গেলো, আমি কিছু করি নি, কিন্তু তার আমিয় সুধা আমি পান করলাম মাত্র। কতক্ষন জানি না। তিনি একসময় বললেন ‘আমি বিষ খেয়েছি। ’ আমার মাথায় বিদ্যুৎ পরলেও আমি অতটা চমকে উঠতাম না যতটা তার কথা শুনে হয়েছি। তাকে মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হল।

তিনি বাচলেন না। আমাকে লাইফ সাপোর্টে রাখা হয়েছিলো, কাজেই আমি বেঁচে আছি। আর বেঁচে আমি না থাকলে আজ এই গল্পটা বলতে পারতাম না। এখন আর চিনি আপারা আত্মহত্যা করেন না, কারন এক সময়ে এই দেশের বতোক-বতোকীরা (কপোত-কপোতীরা) পালিয়ে গিয়ে বিয়ে করত। ছয় (!) মাস পর ফিরে এসে বাবা-মা’কে বলে বাবা এই তোমার নাতী বা নাতনী।

বাবা-মা’রা তখন বাধ্য হয়ে খুশি হয়ে মেনে নিতেন। আজ অবস্থা ভিন্ন। আজ তারা বলে বাবা এ অমুক, মা ও তমুক। বাবা-মা’রা অমুক তমুক আর তমুক অমুক হবার আগে অমুক আর তমুকের বিয়ে করিয়ে দেন। কিন্তু চিনি আপারা আমাদের মত নগন্যের মনে বেঁচে থাকে অনন্ত কাল।

--- সমাপ্ত--- ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।