আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

কৃষ্ণ বিবর

তবু সে তো স্বপ্ন নয়, সব-চেয়ে সত্য মোর, সেই মৃত্যুঞ্জয় ১ রানা কি জানি লিখছিল। হঠাৎ খেয়াল করল পঞ্চাশ পঞ্চান্নর এক মহিলা ঘরে ঢুকে পড়েছেন। গায়ের রঙ শ্যামলা । উচ্চতা বড় জোর পাঁচ ফুট। খুবই সাধারণ সাজগোজ।

একটা একরঙা শাড়ি। রানার চোখ ওঠাতে দেখে জিজ্ঞেস করলেনঃ - আপনি রানা? - জ্বি। আমাকে খুঁজছেন? - হ্যাঁ। কিন্তু এর পরে আর কোনো কথা নেই বেশ কিছুক্ষণ। রানা অপেক্ষা করে আবার নিজের কাজে মন দিল।

এবার মহিলা মুখ খললেন। - আপনার ভালো নাম তো রাশিদুল হাসান, তাই না? - জ্বি। রানা আবার চোখ তুলল। - আমার কাছে কোনো প্রয়োজন আছে নিশ্চয়ই। বলতে পারেন, কুন্ঠার দরকার নেই।

মহিলা মুখ খুললেন এবার। - আমি মিসেস আনিসা আলী, আমার স্বামী আর আমি ফরিদপুর শহরে থাকি। উনি সেখানে ব্যবসা করেন। আপনি কি আমাদের নাম কারো কাছে শুনেছেন? রানা ভ্রুকুটি করে কিছুক্ষণ চিন্তা করল। কিন্তু না, তার মনে পড়ল না।

- সরি, মনে পড়ছে না। মহিলার মুখ অল্পক্ষণের জন্য একটু ম্লান হলো। কিন্তু সামলে নিলেন। - না, মানে অনেকের কাছেই আপনার নাম শুনেছি। আপনি নাকি বড় বিজ্ঞানী, কেম্ব্রিজে কি জানি নতুন আবিষ্কার করে দেশের অনেক নাম করেছেন।

এদিকে এসেছিলাম, ভাবলাম, একবার একনজর দেখে যাই। রানা হাসল। সে এমন বিশেষ কিছু আবিষ্কার করে নি। কিন্তু যেহেতু রানা সেখানে স্টিফেন হকিং-এর ছাত্র ছিল, তার এক সাংবাদিক বন্ধু বেশ ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে তার কাজের বর্ণনা দিয়ে একটা পুরো পাতা ভরে দিয়েছিল সব চেয়ে জনপ্রিয় পত্রিকাটিতে। অনেকের চোখেই সেটা পড়েছে।

অল্প বয়সী কিছু ছেলে-মেয়ে আগে এরকম দেখা করেছে। কিন্তু এই বয়সের কেউ না। - কি যে বলেন, সাংবাদিকরা দিনকে রাত রাতকে দিন করতে পারেন, এবং হরদম করেন। আসলে আমি এখনো ছাত্রই বলা ভালো। বোঝার চেষ্টা করছি।

তা আপনিও কি এস্ট্রফিজিক্সে ইন্টারেস্টেড? মহিলা আঁতকে উঠলেন। - বলেন কি। আমি আর্টসের লোক। তাও বি, এ পাস করেই বিয়ে হয়ে লেখাপড়া শেষ। তবে ছোটবেলায় সায়েন্স পড়তে বেশ মজাই লাগত।

বিশেষ করে আবিষ্কারের গল্পগুলো। আচ্ছা, কেম্ব্রিজে নিউটন যে গাছের আপেল মাথায় পড়ায় মাধ্যাকর্ষণ আবিষ্কার করেছিলেন, ওটাতো এখন আর নেই, তাই না? এবার রানার বেশ হাসি পেল। - না, এত শতাব্দী কি আর কোন আপেল গাছ থাকে? তা ছাড়া সেই গল্পটা নিউটনের এক সাংবাদিক বন্ধুর বানানো। আসলে কাগজে কলমে অনেক ডেটা এনালিসিস করে অনেক বছরের পরিশ্রমে নিউটন সেই ফর্মুলা পেয়েছিলেন। আপনাকে আরেক গল্প বলি, এক ভারতীয় পত্রিকায় পড়েছিলাম।

এক টুরিস্ট গাইড এক দল বিদেশীকে নিয়ে মথুরা দেখাচ্ছেন। এক পুরনো গাছের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় গাইড বললেন ঃ এই গাছটার তলেই শ্রীকৃষ্ণ রাধার জন্য বাঁশী বাজাতেন। দলে এক ভারতীয় ছিল । সে রাগ করে হিন্দীতে গাইডকে সতর্ক করে দিয়েছিল এই সব নন্সেন্স বিদেশীদেরকে না বলতে। আপনি কি স্লামডগ মিলিওনেয়ার দেখেছেন? সেখানেও পিচ্চি গাইডগুলো তাজমহল নিয়ে কি সব বানানো গল্প বলে টুরিস্টদেরকে ধোকা দিত।

-হ্যাঁ দেখেছি। বেশ মজার। আসলে মানুষ বোধ হয় জীবনে মাঝে মাঝে একটু অস্বাভাবিকত্ব খোঁজে। অবাস্তব হলেও। না হলে জীবন বোধ হয় পানসে হয়ে যায়।

মহিলার সেলফোনে হঠাৎ একটা কল এলো। - না, না, আমি এই তো নিউ মার্কেটের কাছে। এখনই আসছি। বলেই উঠে পড়লেন। - সরি, আপনার কাজে ডিস্টার্ব করলাম ।

যাই, হয়তো আবার দেখা হবে। রানা কিছুক্ষণ কাজে মন দিতে পারল না। আনিসা আলীর ব্যবহারে কিছুটা অস্বাভাবিকত্ব ছিল কিনা ভেবে বুঝতে পারলো না। ২ দিন সাতেক পড়ে হঠাৎ এক ভদ্রলোকের আগমন। বছর ষাটেক।

ছ ফিট কয়েক ইঞ্চি হবেন। শ্যামলা রঙ রোদে পুড়ে আরো কালো। কিন্তু সাঙ্ঘাতিক ভালো সুঠাম শরীর। চুল আর ছোট দাড়ি কাঁচাপাকা। এঁর কোন কুন্ঠা নেই।

ধপ করে চেয়ারে বসে পড়লেন। সামনেরটায় না, পাশেরটায়। - আপনি ডঃ রাশিদুল হাসান? - জ্বি। আপনাকে কোথাও দেখেছি কি? উনি হেসে উঠলেন। - মনে হয় না।

তাহলে তো আমিও আপনাকে দেখে থাকতাম। আর সেটা আমার মনে থাকত নিশ্চয়ই। আমার মনে হয় আজই আমাদের প্রথম দেখা। আপনি হকিং-এর ছাত্র ছিলেন না? একটু দীর্ঘশ্বাস নিল রানা। অনেকেই এই কথা দিয়ে শুরু করে।

অনেকে এখানেই থেমে যায়। - জ্বি, হকিং অফিশিয়ালি আমার সুপারভাইজার ছিলেন, অবশ্য আরেকজনের সাথেই আমার বেশি সময় কাটত। - তা ঠিক, উনি তো কম্পিউটার ছাড়া কথা বলতে পারেন না, কমিউনিকেট করা অনেক সমস্যা। তবু কি আশ্চর্য মনোবল। এই শরীর নিয়েও এত বছর তাঁর ফীল্ডে একজন হিরো হয়ে আছেন।

- জ্বি, ওনার মেধার চেয়ে এই মানসিক বলটাই অনেকের কাছে বড় বিস্ময়। এত উইটি লোক খুবই বিরল । একটা মজার গল্প বলি । যখন হকিং অক্সফোর্ডে আন্ডারগ্র্যাড ছিলেন, তখন খুব পাজি ছিলেন, শরীরে তখনো ব্যাধির চিহ্ন নেই। যেখানে সেখানে ঘুরে বদকাজ করে বেড়াতেন, শিক্ষকরা তাঁকে মোটেই পছন্দ করতেন না।

শেষ পরীক্ষার পরে দেখা গেল নম্বর প্রথম আর দ্বিতীয় শ্রেণীর প্রান্তিক সীমায়। অক্সফোর্ডের নিয়ম ছিল এই সব মার্জিনাল ক্ষেত্রে একটা বিশেষ মৌখিক পরীক্ষা নিয়ে ক্লাস নির্ধারণ করা হয়। পরীক্ষকরা তাঁকে জিজ্ঞেস করলেন - তুমি কী আশা কর, প্রথম শ্রেণী, না দ্বিতীয়। হকিং বললেন - আশা করার কিছু নেই। আমি যদি দ্বিতীয় শ্রেনী পাই তাহলে এখানেই অক্সফোর্ডে থেকে যাবো, আর প্রথম পেলে কেম্ব্রিজে চলে যাবো।

সুতরাং আমি জানি আপনারা আমাকে প্রথম শ্রেণীই দেবেন। - হা, হা, আমাদের দেশেও অবশ্য ফাজিল টাইপের ছাত্র দেখা যায়। ভদ্রলোক হাসলেন। কিন্তু বেশ পরিমিত হাসি। - তা ঠিক, তবে ইংল্যান্ডে মেধাবী ফাজিল লোক একেবারেই দেখা যায় না।

আমি কখনো দেখি নি। আপনার কি জ্যোতির্বিদ্যায় আগ্রহ আছে? - নাহ, আমি ব্যবসায়ী। - যে গল্পটা আমি বললাম হকিংকে নিয়ে, এটাও কিন্তু বানানো। আসলে পাশ করে হকিং অক্সফোর্ডেই এস্ট্রনোমিকাল ডেটা নিয়ে কাজ করেছেন কিছুদিন, তার পরে বিরক্ত হয়ে কেম্ব্রিজে গিয়ে তাত্ত্বিক জ্যোতির্বিদ্যা নিয়ে গবেষণা শুরু করেছিলেন। রানা খেয়াল করলো ভদ্রলোক কথার ফাঁকে ফাঁকে তার দৃষ্টির আপাত অগোচরে তাকে আপাদমস্তক খেয়াল করছেন।

সেই সুযোগটা ভালো করে দেয়ার জন্য সে ইচ্ছে করেই সামনের কাগজের দিকে তাকিয়ে কথা বলছিল। -আমি ব্যবসায়ী। আমার এক ভাই বিদেশে, আরেক ভাই আর্মি ইঞ্জিনিয়ার। দেশের সব পারিবারিক সম্পত্তি আমাকেই দেখতে হয়। বাবা বেশ কিছু রেখে গিয়েছিলেন, তাই এই কাজে অনেক সময় চলে যায়।

তা ছাড়াও কিছু সমাজ সেবার কাজ আছে। একটা কলেজ প্রতিষ্ঠা করেছি। আমাদের শহরে একটা ক্যান্সার হাসপাতাল তৈরী হচ্ছে, যার পেছনে আমাকে কাজ করতে হচ্ছে। রানার একটু সন্দেহ হলো। - আপনি কি কোন রাজনৈতিক দলের সাথে যুক্ত? ভদ্রলোক চমকে উঠলেন।

- না, না। তবে সব দলেই আমার কিছু ভালো বন্ধু আছে। আমার কোন রাজনৈতিক ক্ষমতার খায়েশ নেই, তাই সবাই আমার সাহায্য চায়, এবং নেয়ও, যেখানে সম্ভব। নিজের আরো অনেক কাজের ফিরিস্তি দিলেন তিনি। শেষ দিকে অবশ্য রানা তেমন মনোযোগ দিতে পারলো না।

সামনের কাজের কাগজেও না। মনটা উড়ু উড়ু হয়ে গেল। রানা চিরদিন শহরে বড় হয়েছে। তাদের গ্রামের সব সম্পত্তি তাদের চাচা আর ফুপুরা দখল করে নিয়েছে। নানা বাড়ির সম্পত্তি নানী ওয়াকফ করে দিয়েছেন।

তারা খুব বিরাট ধনী ছিল না, কিন্তু স্বচ্ছল ছিল। গ্রামের বাড়ি থাকলে মাঝে মাঝে যাওয়া যেত। গ্রামের বাতাসে অনেক অক্সিজেন, প্রাণ ভরে শ্বাস নেয়া যায়, এখনো। এই শহরে গতির মধ্যেও কি স্থবির জীবন। মাঝে মাঝে দম আটকে আসে।

ভদ্রলোক আবার কেম্ব্রিজের কথায় ফিরে গেলেন। কেমন শহর, রানা কোথায় থাকত, বাঙালী বন্ধু ছিল কি না, তার বাসা সিল্ভার স্ট্রিটে তার বিভাগ কত দূরে ছিল। হকিং কোথায় থাকত, কিভাবে চলাফেরা করত, এই সব অনেক প্রশ্ন। রানা বেশি বিরক্ত হলো না। - আমি ওয়েস্ট রোডে থাকতাম, হকিংও কাছাকাছি, প্রায়ই দেখা হতো পথে।

আবহাওয়া ভালো থাকলে নিজেই ইলেক্ট্রিক হুইলচেয়ারে বসে অফিসে যেতেন। বিদেশে আজকাল অনেক দোকানেও হুইলচেয়ার নিয়ে ঢোকার ব্যবস্থা আছে। এমনকি বাসে ওঠারও। হঠাৎ ভদ্রলোক জিজ্ঞেস করলেন- আচ্ছা হকিং-এর কি কোন সন্তান আছে? - হ্যাঁ, তিন ছেলে-মেয়ে। - তাই? কিন্তু এ অবস্থায় কিভাবে তা সম্ভব।

রানা এবার শব্দ করেই হাসল। - তাঁর প্রথম বিয়ের সময় অসুখ ধরা পড়ে নি। কেম্ব্রিজে যাওয়ার পরে আস্তে আস্তে সিম্পটম দেখা যায়। বাচ্চা অসুখ বেড়ে যাওয়ার আগেই হয়ে যায়। পরে দুজনের ডিভোর্স হয়ে যায়।

এর বেশ কিছুদিন পরে তাঁর সার্বক্ষণিক নার্সের সাথে বিয়ে হয়। সেটাও টেকে নি, অযত্নের অভিযোগে। ভদ্রলোককে এখন খানিকটা চিন্তিত মনে হলো। - আমি ভেবেছিলাম প্যারালিসিস হলেও হয়তো কখনো কখনো মানুষের কোন কোন মৌলিক ক্ষমতা থেকে যেতে পারে। রানা এবার চোখ তুলে ভদ্রলোকের দিকে তাকিয়ে তার মুখ দেখল।

কেমন যেন বিষন্ন মনে হলো তাঁকে। খুব ঠান্ডামাথায় আস্তে আস্তে রানা বলল। - মানুষের মাথায় মোটর নিউরনগুলো মোটামুটি শারীরিক অবস্থানের সাথে সঙ্গতি রেখেই আছে। স্পাইনাল কর্ডের বিভিন্ন অংশ দিয়েও দূরত্ব অনুসারেই বেরিয়েছে। তাই ক্ষতি হলে পুরো এলাকার হয়ে যায়।

- যাই, আপনার অনেক সময় নিলাম। হয়তো আবার দেখা হবে। ভদ্রলোক কেমন যেন একটা ঘোরের মধ্যে আনমনে হাঁটতে হাঁটতে চলে গেলেন। ৩ একদিন রিনি এলো। - কেমন আছিস? রিনি ভালো করে রানার মুখের দিকে চাইল, রানাও হাসিমুখে ওর দিকে তাকাল।

রানার চেয়ে এক বছরের বড় খালাতো বোন রিনি এখন সুখী গৃহিনী। বড়লোক স্বামী। বছরের অর্ধেক এদেশে, অর্ধেক অন্য কোথাও। - ভালোই তো। কোন সমস্যা নেই।

তোর খবর কি? - দেখতে পাচ্ছিস না? মোটা হয়ে যাচ্ছি। এখনই একটু প্রেশার হয়ে গেছে। আজকাল সাবধানে খাই। তা তোর কি আসলেই ঢাকায় বসে কোন কাজ হচ্ছে? কথা বলার লোক পাস? - না, এখানে তেমন কেউ নেই। তবে ইন্টারনেটের সুবিধা এই যে, চ্যাটে বা ইমেইলে সবার সাথেই আলাপ করা যায়।

- ম্যাথেম্যাটিকাল সিম্বল কিভাবে দেখাস? - ওটারও স্টান্ডার্ড প্র্যাক্টিস আছে সংক্ষিপ্ত সিম্বল দিয়ে। বিষয়টা জানা থাকলে তেমন অসুবিধা হয় না। তবে বেশি থাকলে সফটওয়্যার ইউজ করি। ম্যাথেম্যাটিকা বলে একটা চমৎকার প্যাকেজ় আছে। ক্যালকুলেশনও করা যায়, আবার হুবহু সংকেত দিয়ে যা খুশী লেখা যায়।

মনে হলো না রিনি এ সব কথা শুনতে এসেছে। - আর সিঙ্গাপুরে যাবি না? রানা হাসল। - নাহ, এখন আর প্ল্যান নেই। কয়েক বছর পরে যেতে পারি। দু বছর পরে একটা কনফারেন্স হবে, ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটিতে, সেখানে যেতে পারি।

- ফাইনাল ডেসিশন? তুই তো আবার সবাইকে নিজের চাইতে বোকা মনে করিস। জিজ্ঞেস করাটাও মনে হয় অন্যায়। রানা একটু লজ্জার ভান করল। - কি যে সব কমপ্লেক্স তোদের। এর সাথে বোকা চালাকের কিছু নেই।

কঠিনেরে ভালোবাসিলাম, সে কখনো করে না বঞ্চনা। ভালো আছি। রিনি রানার কথা কখনোই মন দিয়ে শোনে না। এখনো মনে হলো অন্য কি ভাবছে। - রেবা কি এখনো আসে মাঝে মাঝে? - আসে।

- শেষ কবে এসেছে? - এগারো দিন আগে। - ও তো লেখাপড়া ড্রপ করেছে, শুনলাম। এ বিষয়টা মনে হলেই রানার মন খারাপ হয়ে যায়। কতগুলো অপদার্থ লোক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হয়েছে দলবাজি করে। আজব সব নিয়ম নিজেরাই বানায়, যার সাথে পৃথিবীর কোন দেশের নিয়মের মিল নেই।

এতে কার কার জীবন নষ্ট হয়ে গেল, তাতে কারো কিছু আসে যায় না। রেবা এই লোকগুলোর অবিমৃষ্যকারিতার শিকার। রানা আর শুনতে চায় না। -শুনলাম ওর বাবা পাত্র খুঁজছে। পেয়ে যাবে সহজেই।

দেখলেই যে কোন পাত্র মজে যাবে। বলেই রিনি রানার চোখের দিকে তাকালো । রি-একশন খুঁজছে সে। ও দেখতে চায় রানার মধ্যে এখনো কিছু আবেগ বাকি আছে কি না। - কি জানি।

আমার মনে হয় ও ভালো ঘর সংসার করতে পারবে। রিনি চলে গেল। ৪ এর চার দিন পরেই রেবা এলো। ওর নিজের নির্ধারিত চেয়ারে বসল। টেবিলে ধূলো দেখে আগের মতই ভ্রূ ওঠালো।

তারপরে আলনা থেকে ন্যাকড়া এনে টেবিল মুছল। রানার কাছে এসে অন্য সব বারের মতই নিজের ওড়না দিয়ে কপালের ঘাম মুছে দিল। রানা তার গায়ের সৌরভ পাচ্ছিল। রানার নিঃশ্বাস দ্রুত হয়ে যাচ্ছিল। অতি কষ্টে সংবরণ করল।

রেবা তা লক্ষ্য করল। আবার চেয়ারে গিয়ে বসল। - আচ্ছা, আব্বা কি তোমার কাছে এসেছিলেন? - হ্যাঁ, উনি আমাকে হকিং সম্বন্ধে অনেক প্রশ্ন করলেন। তোমার মা তার আগে এসেছিলেন। দুজনই আমাকে ভালো করে দেখলেন।

- সেই সময় তুমি সুবোধ বালকের মত নিশ্চল বসেছিলে? - না তো, অনেক কিছু লেখালিখি করেছি তাঁদের উপস্থিতিতে। অনেক গল্প করলাম। - তোমার সব মিথ্যা গল্পগুলো। - আমি অবশ্য বলে দেই, কোন গল্পটা মিথ্যা। - জানি।

এটা তোমার ট্রিক। মানুষের আস্থা অর্জনের। যাতে পরে আসল মিথ্যা বললেও কেউ ধরতে না পারে। - তোমার কাছে আমি সব সময়ই ধরা পড়ে যাই। - কিন্তু তাতে তোমার লজ্জা হয় না।

তোমার ধারণা তুমিই সব ভালো বোঝ। তোমার কোন ব্যাপারে অন্যের কোন সিদ্ধান্ত নেবার অধিকার নেই। তুমি মিথ্যা চাপিয়ে দিলেও সবাই তা বিশ্বাস করুক না করুক, মেনে নিতে হবে। - কি মুশকিল, আমি কি মিথ্যা বললাম। রেবা টেবিলের নিচে রানার পায়ে একটা লাথি মারল।

পা'টা সঙ্গে সঙ্গে উঠল, তারপর নামল। -এটা রিফ্লেক্স একশন। এর কোন সিগ্নিফিকেন্স নেই। - আমি যখন ওড়না দিয়ে তোমার কপাল ছুঁই তোমার সারা শরীরের সাড়াই অনুভব করি। সব রিফ্লেকস একশন নয়, আর হলেই বা কি ? তুমি হকিং না।

তোমার শুধু পা ভেঙ্গেছে মাত্র। আস্তে আস্তে ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু তুমি চিকিৎসা করাচ্ছ না। আর ভালো না হলেই বা কি? এটা একটা বিরাট খুঁত হলো? রানা কিছু বলতে পারল না। অনেক কথা কেমন যেন গলায় আটকে রইল।

রেবাও চুপ করে আধ ঘন্টা বসে রইল। তারপর আবার রানার কাছে এল, কিন্তু ওকে আর স্পর্শ করল না। চলে গেল। ৫ আজ রেবার বাবা আর রেবা এসেছে। রেবার গায়ে সেই পোশাক যা ও সেই দিন পরেছিল যে দিন ঘটনাটা ঘটেছিল।

রানার কেম্ব্রিজ থেকে ফেরার ন' মাস পরে। রানা ছিল চার তলার বারান্দায়। রেবা এক বান্ধবীর সাথে পাশের বিল্ডিং থেকে আসছিল। রানাদেরদের বিল্ডিং-এ না ঢুকে ও রাস্তার বাঁক দিয়ে পরীক্ষার হলের দিকে চলে যাচ্ছিল। ওর প্রস্তুতি ভালো ছিল না।

পরীক্ষা ড্রপ করতে পারে এ রকম একটা আশংকা রানার ছিল। সকালেই রানা মোবাইলের দ্বিতীয় সিম থেকে একটা কল দিয়েছিল, যার নম্বর ওর জানা ছিল না। কিছুই বলে নি , শুধু বাপ্পার "পরী, তুমি হাসবে মেঘের ভাঁজে" লাইনটা শুনিয়েই বন্ধ করে দিয়েছিল। ও "কে বলছেন, কে বলছেন" বলে চেঁচাচ্ছিল লাইন কাটা পর্যন্ত। ওকে ওপর থেকে এত সুন্দর দেখাচ্ছিল যে রানার মনে হচ্ছিল 'পরী' শব্দটা ওর জন্যই তৈরী হয়েছিল।

রানার চোখ কিছুতেই ওকে ছাড়তে চাইছিল না, তাই অজানতেই কখন জানি বাঁক নেয়ার পরে রানা বারান্দার ওপরে বেশি ঝুঁকে পড়েছিল। তারপরে কি হয়েছিল রানার আর মনে নেই। এক মাস ঢাকায় হাসপাতালে ছিল। পায়ের হাড় আর মেরুদন্ড ভেঙে গিয়েছিল। ঢাকা, সিঙ্গাপুর দু জায়গাতে চিকিৎসা হলো ।

দুটো হাঁটুই খুব খারাপ ভেঙেছিল, জোড় লাগার পরেও হাঁটতে পারত না, তাই হুইল চেয়ারেই বেশিরভাগ সময় কাটায়। আর মেরুদন্ডের আঘাতটা বেশ কিছু সেরে যাওয়ার পরেও কেমন একটা অবশ ভাব রয়ে গেল পায়ে। রেবা রোজ আসত। কিন্তু রানা আস্তে আস্তে রূঢ় ব্যবহার শুরু করল। ওকে আহত করত।

ওর মন আস্তে আস্তে ভেঙ্গে গেল। লেখাপড়া পুরো গোল্লায় গেল। আজ আলী সাহেব কেমন সংকোচ নিয়ে বসলেন। রেবার চোখে কোন ভাবলেশ নেই। আলী সাহেব একটু চুপ থেকে বললেন।

- রেবার বিয়েটা ঠিক করে ফেললাম। পাত্র খুব ভালো পেলাম। বিদেশ থেকে ফিরে মোবাইল কোম্পানীতে অনেক বেতনে চাকরী করছে। রানা রেবার দিকে তাকিয়ে হাসল। -কংগ্র্যাচুলেশনস।

রেবা আলী সাহেবেকে বলল। - এবার তুমি যাও। আমি আসছি। আলী সাহেব বিয়ের কার্ডটা রানাকে দিয়ে বললেন। -অবশ্যই আসবেন।

হুইল চেয়ার ওঠাতে কোন অসুবিধা হবে না ওখানে। তিনি চলে যাওয়ার পরে রেবা আবার ন্যাকড়া দিয়ে রানার টেবিলটা মুছল। তারপর কাছে এসে ওড়না দিয়ে রানার কপালটা। তারপরে চেয়ারে আর না বসেই বলল। - আমার বাবা-মার তোমাকে খুব পছন্দ হয়েছিল, তোমাকে দেখার পরেও।

কিন্তু আমি তাঁদের বোঝালাম তুমি আমাকে কোনদিন বিয়ে করবে না। আমার বিয়ে না হলে তুমি এই অভিনয় করেই যাবে, সিঙ্গাপুরে আর যাবে না, ট্রিটমেন্ট শেষ করবে না। আমি ফেল করে লেখাপড়া ছেড়েছি। তুমি পার্ফেকশনিস্ট, একটু খুঁতএর জন্যই তুমি নিজেকে আমার পাত্র হিসেবে ফেল মার্ক দিয়ে বসে আছ। - না, তা না।

আমি বাস্তববাদী, আইডিয়ালিস্ট নই, সবার মধ্যেই খুঁত আছে। - তাহলে কি ? সেদিন কেন তুমি পড়ে গিয়েছিলে আমি তো জানি। আমার মনে হয় তোমার মনে সেজন্য আমার ওপর অবচেতন রাগ তৈরী হয়ে আছে। - মনে হয় না। - তা হলে সেদিন পড়ার পর তোমার ব্রেইনেও গোলমাল হয়ে গেছে, তুমি টের পাও নি এখনো।

- হা, হা, সিনেমার মতো! যে দিন আমি পড়ে গিয়েছিলাম, আমার মনে হচ্চছিল আমি একটা ব্ল্যাক হোলের ভেতরে ঢুকে যাচ্ছি, যা থেকে আর বেরুনো যায় না। হকিং বলেছেন কোয়ান্টাম রেডিয়েশনে ব্ল্যাক হোল থেকেও সব কিছু ক্রমে ক্রমে বের হয়ে যায়। এটাই হকিং-এর সব চেয়ে বড় আবিষ্কার। কিন্তু আমি হকিং-এর সাথে এ ব্যাপারে একমত হতে পারি নি। তাঁকে বলেছিলাম মাধ্যাকর্ষণের কোয়ান্টাম তত্ত্ব আবিষ্কারের আগে এই সব জগাখিচুরী প্রেডিকশনের অর্থ হয় না।

হকিং আমার ওপর খুব রাগ করেছিলেন। কোয়ান্টাম তত্ত্বে একই জিনিস অনেক অবস্থার মিশ্রণ হিসেবে থাকতে পারে। তুমি তোমার দেয়া সবগুলো কারণ মিশিয়ে একটা জটিল অজুহাত তৈরী করে নিতে পারো। আরো অন্য অনেক সম্ভাব্য কারণ যোগ করে নিতে পারো। একটা রোমান্টিক কারণ দিই।

তোমাকে বিয়ে করলে আমার কাজ শিকেয় উঠত, সারাক্ষণ তোমার মুখের দিকেই তাকিয়ে থাকতাম। রেবা প্রথমে মুখে রাগ দেখালো তারপরে ফিক করে হেসে ফেলল। - তা হলে বলবে না। - যদি কোনদিন নোবেল প্রাইজ পাই তাহলে একটা আত্মজীবনী লিখে উৎসর্গপত্রে লিখে দেব। - খবরদার, তাহলে আমার স্বামী আর তোমার বউ আমাদেরকে তালাক দিয়ে বসতে পারে।

আসলেই তোমাকে বিয়ে করার অর্থ হয় না, তুমি তোমার সব চিন্তা আমার সাথে শেয়ার না করলে বিয়ে করে লাভ কি? - অবশেষে উত্তর পেয়ে গেছ। দেরি হচ্ছে দেখে আলী সাহেব দরজার ওপারে মুখ দেখালেন। রানা অতি কষ্টে হুইল চেয়ারটা লাথি মেরে সরিয়ে উঠে দাঁড়াল। দুজন রানার দিকে অবাক চোখে তাকিয়ে রইল। ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।