আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

চিকিৎসক যখন Formula 1 এর দারস্থ!

শিরোনাম দেখলে ধাক্কা লাগারই কথা। Reader’s Digest এ পড়ে সাথে সাথেই মনে হল আমরা যারা সাধারন জনগন এবং যারা চিকিৎসা সেবার সাথে জড়িত – সবারই এটা জানা উচিৎ। গল্প, হ্যাঁ গল্পই বলা যায়, এই গল্পটার শুরু লন্ডনের দি গ্রেট ওরমণ্ড স্ট্রিট হাসপাতালে। ওখানের দু’জন ডাক্তার এই গল্পের রচয়িতা, তাদের একজন ডঃ এলান গোল্ডম্যান, যিনি ICU এর ডাক্তার এবং অপরজন হার্ট সার্জন প্রফেসর মারটিন এলিয়ট। Pit-Stop এবং ICU এর ভিতর সম্পর্ক আবিষ্কার! কোন এক রবিবারের প্রথম সকালে তাঁদের দু’জনের ডাক পড়ল একটি জরুরি হার্ট ট্রান্সপ্ল্যান্টের জন্য, কারন একটি ‘Fresh Heart’ পাওয়া গিয়েছে; আর, সেই কারনেই সময় নষ্ট করার মত সময়ই নেই।

ভীষণ শক্ত কাজটা ডঃ ইলিয়ট ১২টা ঘণ্টা সময় নিয়ে সেরে ফেললেন। তারপর যথারীতি ICU তে হস্তান্তর করে দিলেন। ICU তে রোগীকে দেওয়ার পর দুই ডাক্তার - ডঃ গোল্ডম্যান আর প্রফেসর এলিয়ট – অবসরে বসে টিভিতে খুব প্রিয় Car Race উপভোগ করছিলেন, আরও স্পষ্ট করে বললে বলা যায় Formula 1 উপভোগ করছিলেন; car race এর জগতে যা সবচে’ মর্যাদাবান প্রতিযোগিতা। যেখানে গাড়ির অসম্ভব গতি এবং সেইসাথে চালকসহ পুরো দলের অসামান্য দক্ষতার সরাসরি পরীক্ষা চলে। যারা টিভিতে এই প্রতিযোগিতা দেখেছেন, তাঁরা লক্ষ্য করেছেন কয়েক Lap দেবার পরই চালক এক জায়গায় থামে, যাকে Pit-Stop বলে এবং পুরো ২০ জনের একটা দল চাকা বদল, তেল ভরা থেকে শুরু করে অন্যান্য জরুরি কাজগুলোও সেরে ফেলে এবং ওই দু’জন ডাক্তার অবাক বিস্ময়ে দেখলেন এই পুরো কাজটি ঐ দলটি শেষ করছে – প্রতিবারই মাত্র ৭ সেকেন্ডে! কোন ভুল ছাড়া! পরস্পর তাকালেন, ডঃ ইলিয়ট ডঃ গোল্ডম্যানকে বললেন, “এরকম আমরা কেন করি না!” Formula 1 এর এক ম্যানেজারের সাথে সাক্ষাত এবং কিছু গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নের মুখোমুখিঃ তাঁরা দুজনই অনুধাবন করলেন, ডাক্তাররা অনেক বছর প্রশিক্ষণ নেন কী করে অপারেশন করতে বা ICU তে যত্ন নিতে হয় কিন্তু Operation Theatre থেকে ICU তে হস্তান্তর – এই সবচে’ ঝুঁকিপূর্ণ কাজটার উপরে কারোরই কোন প্রশিক্ষণ নাই! আর ব্যাপারটি আরও বেশি ঝুঁকিপূর্ণ যখন তা দীর্ঘ এবং জটিল operation এর পর হস্তান্তরের বিষয় হয়, তখন অনেক সময়ই বড় ধরনের ভুল হয়ে যায়; যে ভুলের ফল ভীষণ মারাত্মক।

সুতরাং তাঁরা ঠিক করলেন ঐ pit-stop থেকেই শিখে নিতে হবে। এক সূত্র ধরে তাঁরা পৌঁছালেন Formula 1 এর এক টিম ম্যানেজার ডেভ রায়ানের কাছে। ডেভ কিছু গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন করলেন তাঁদের Operation Theatre থেকে ICU তে হস্তান্তরের উপর একটা ভিডিও দেখে– •OT থেকে ICU তে হস্তান্তরের সময় এতো বেশি শব্দ বা চিৎকার-চেঁচামেচি হল কেন? •ওখানে যারা আছেন তাঁরা একজন আরেকজনের সাথে ঝগড়া করার মত করছেন কেন? •তাঁরা জায়গা নিয়ে কাজ করছেন না কেন? আর কি করবেন তাঁর একটা ফর্দ করেই বা নিচ্ছেন না কেন? ডঃ ইলিয়ট এবং গোল্ডম্যান দুজনই বুঝলেন – কাজ হবে। অতঃপর একজন শিল্প মনোবিজ্ঞানীর নিয়োগদান! তারপর তাঁরা একজন Industrial Psychologist –ই নিয়োগ দিয়ে ফেললেন – ডঃ ক্যান ক্যাচপোল - যে ভীষণ মানসিক চাপে মানুষের ব্যবহার কেমন হবে – সে বিষয়ে একজন বিশেষজ্ঞ। ডঃ ক্যাচপোলের পূর্ব অভিজ্ঞতা ছিল বিমানে কাজ করার আর তাই সে যারপর নাই বিস্মিত হলেন যখন দেখলেন কতখানি অগ্রহণযোগ্য পদ্ধতিতে স্বাস্থ্যকর্মীরা কাজ করেন এই স্বাস্থ্য বিভাগে! ক্যাচপোল বললেন – ঝুঁকিপূর্ণ শিল্পে ভুল শতকরা ০.০০১ ভাগ আর চিকিৎসাতে তা ১০%।

একটা বিমানে শত শত মানুষ, প্রযুক্তি, বিস্ফোরক, জ্বালানি থাকে, ব্যস্ত বিমান বন্দরগুলোতে প্রতি মিনিটে প্লেন ওঠানামা করে কিন্তু দুর্ঘটনার সংখ্যা নগণ্য; এখন যদি চিকিৎসা বিভাগের ভুলের হিসাবটা এখানে মিলাই তবে প্রতি ১০ টা ফ্লাইটের একটা বিমান সমুদ্রে পড়বে অর্থাৎ দুর্ঘটনার শিকার হবে। ২০০৪ এ Ferrari ‘র টেকনিক্যাল ম্যানেজার স্টেপনি’র সাথে সাক্ষাৎঃ ২০০৪ এর শুরুর দিকে গোল্ডম্যান, ক্যাচপোল, ইলিয়ট আরেকজন ICU এর বিশেষজ্ঞ ডাক্তার নিক পিগট কে সঙ্গে নিয়ে ইটালির মারানেলতে গেলেন এবং Ferrari’র তৎকালীন টেকনিকাল ম্যানেজার নিগেল স্টেপনি’র সাথে দেখা করলেন। এই দলটি স্টেপনিকে আবার Operation Theatre থেকে ICU তে হস্তান্তরের একটা ভিডিও দেখালেন। স্টেপনি বিস্মিত হয়ে প্রশ্ন করলেন – এই কাজটার পুরো দায়িত্বে কে ছিলেন! গোল্ডম্যানের উত্তরে সন্তুষ্ট না হয়ে আরও কিছু প্রশ ছুড়ে দিলেন – • কাজটা যারা করলেন তাঁরা কি আগে থেকে ধারনা পেয়েছিলেন তাঁদের কি করতে হবে? • তাদের কাছে কাজের কোন ফর্দ ছিল যে কখন কোনটা করতে হবে? • তাঁরা কি এই কাজের উপর (সত্যিকারের রোগী ব্যতিরিকে) কখনো মহড়া দিয়েছে? স্বভাবতই প্রতিটার উত্তরই ছিল ‘না’ বোধক। স্টেপনি বললেন – দেখুন, কাজটা এমন না যে অনেকজন খুব দক্ষ মানুষের সমাবেশ ঘটালাম আর তাতেই কাজটা বেরিয়ে গেল; ব্যাপারটি একদমই দলগত – যেন সবাই একটা দলের হয়ে কাজ করছে।

চিকিৎসকদের এবার Formula 1, Pit-Stop আর Ferrari’র ‘শিক্ষা’’র সাথে Operation Theatre কে মিলিয়ে নেবার পালাঃ গোল্ডম্যান, ক্যাচপোল, এলিয়ট – দের দল বুঝতে পারলেন, ইংল্যান্ড ফিরলেন। ফিরে ক্যাচপোল Formula 1 এর pit-stop কে খুব গভিরভাবে অনুসরন করে Operation Theatre থেকে ICU তে হস্তান্তরের বিষয়টি আবার লক্ষ্য করলেন আর বিস্মিত হলেন কী ভীষণ অনিয়ম সবখানে! কর্মীরা মূল জিনিসটাই অনেক সময় ভুলে যাচ্ছে! কখনো রোগীর জীবনকে বহনযোগ্য ব্যাটারির উপর ছেড়ে দিচ্ছে যার শক্তি যেকোনো সময়েই ফুরিয়ে যেতে পারে। এমনকি কোনো যন্ত্র সাময়িক কাজ না করলে বা বিগড়ে গেলে কি করতে হবে এ ব্যাপারে মেডিকাল টিমটির কোন ধারনাই নেই অথচ pit-stop এর প্রতিটা কর্মী জানে তাকে কখন কি করতে হবে – এমনকি যদি একটা নাটবল্টু হঠাৎ ছুঁটে চলে যায় অন্যখানে তবে ওটার আরেকটা তাঁর কাছে থাকবে এবং সেটাও তাঁর প্যান্টের ডান পকেটে! এইবার লেগে গেলেন তাঁরা পুরো কাজের একটা নকশা করতে, ঠিক pit-stop কে সামনে রেখে যার প্রতিটা পদক্ষেপ পুঙ্খানুপুঙ্খ অনুসরন করা হবে প্রতিটা Operation এর সময়। ১। Anesthetist অন্তত আধাঘণ্টা আগে ICU কে বলবে যে রোগী হস্তান্তর করতে যাচ্ছে।

২। যে নার্স রোগীকে প্রহন করবে সে আগে থেকেই ঠিক করবে রোগী কোথায় থাকবে এবং সেইসাথে একজন ICU ডাক্তারকেও তৈরি রাখবে। ৩। ICU ডাক্তার এরপরই রোগীর পরিবারকে জানাতে পারবে রোগীর অবস্থা সম্পর্কে। তাঁরা মিলে একটা diagram-ও তৈরি করলেন যেখানে দেখান হল রোগীর কোন পাশে কে থাকবে এবং কার কি কাজ হবে যেখানে নিশ্চিত থাকবে, শৃঙ্খলা আর কঠিন নিয়মানুবর্তিতা।

আরও নিশ্ছিদ্র করার আয়োজনঃ প্রায় এক বছর পর ২০০৫ এ নতুন নিয়মে যখন ক্যাচপোল ২৭টি Operation পর্যবেক্ষণ করে ফেলেছেন, দেখলেন ভুলের পরিমান অর্ধেকে নেমে এসেছে – অর্থাৎ জীবন বেঁচে যাচ্ছে যার জন্য মানুষ তাঁদের কাছে অর্থাৎ চিকিৎসকদের কাছে ছোটেন। পরবর্তীতে তাঁরা Diagram টিতে আরও কিছু ধাপ সংযোজন করলেন এবং এর ফলে দলের প্রতিটা সদস্য তারপর থেকে একটা Headphone ব্যবহার করা শুরু করল এবং যেটা একটি টেপরেকর্ডারের সাথে যুক্ত যেখানে সমস্ত নির্দেশাবলী পূর্ব থেকে রেকর্ডকৃত – সারবক্তব্য হল পুরো প্রক্রিয়াটিকে নিঃছিদ্র করার সব আয়োজনই তাঁরা করলেন। এভাবে মা-বাবা আর প্রিয়জনের মুখে হাসি ফুটিয়ে চললেন তাদের সন্তানদের আর কাছের মানুষদের কে সুস্থ করে এবং এইভাবেই প্রতি Operation থেকে পুরস্কার মিলতে লাগল ডঃ গোল্ডম্যান-ইলিয়টদের। এরপর তাঁরা নিমন্ত্রণ পেতে লাগলেন অন্যান্য দেশ থেকে যেখানে তাঁদের অভিজ্ঞতা ভাগাভাগি করতে হলো। গোল্ডম্যান-ইলিয়ট এতেই থেমে গেলেন না।

এই চিকিৎসকদ্বয় আরও চাইলেন খুব ঝুঁকিপূর্ণ অন্যান্য Industry থেকেও আরো কিছু শিখে নিতে যা স্বাস্থ্যসেবায় প্রয়োগ করা যাবে – যেমন NASA বা NAVY থেকে! অর্থাৎ এই চিকিৎসকদ্বয়ের চেষ্টা চলতেই থাকলো...। আমরাও তো চাই... লন্ডনের দি গ্রেট ওরমণ্ড স্ট্রিট হাসপাতালের গল্পটা এখানে শেষ অথবা শুরু। হরহামেশা আমরা আমাদের চিকিৎসক আর স্বাস্থ্যখাত নিয়ে এতো মনখারাপ করা কাহিনী শুনি যে লন্ডনের এই গল্প রুপকথাই মনে হয়। তবু মানুষ আশাতেই বাস করতে চায়। আমাদের দেশের যে কোন একটা হাসপাতাল বা কোন একজন চিকিৎসক নিয়ে এমন একটা গল্প আমরাও লিখতে চাই।

এই মহতি পেশা পারে একজন মানুষকে অন্য এক উচ্চতায় নিয়ে যেতে। কেননা মানুষকে ভালবাসার অসম্ভব ক্ষমতা দিয়েছেন আমাদেরকে সৃষ্টিকর্তা। সেই ক্ষমতাতেই সম্ভব সব বাধাকে জয় করে এগিয়ে যাওয়া, ইতিহাস রচনার। ।

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     বুকমার্ক হয়েছে বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.