আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

ঈদ তাড়ানো

ঈদ নিয়ে আমার কোন ভাল স্মৃতি আছে বলে মনে পরেনা। যতবারই ঈদ স্মৃতি ভাবি ততবারই কিছু মন ঘোলা করা হিজিবিজি বৃস্টিপড়া ব্যপার মনে পরে । তাই নিজের মতন করে নিজের জীবন যখন শুরু করলাম দেশান্তরে তখন ঈদকে বিসর্জন দেবার পূর্ণ স্বাধীনতা খুশি মনেই নিয়ে ফেললাম। দেরিতে হলেও বুঝেছি নিজের মনটাকে খুশি রাখাটাই সবচাইতে ইম্পর্টেন্ট, নিজের মনটা খুশি থাকলেই মাত্র অন্যকে খুশি করা সম্ভব। নিজে সুখি হলেই শুধু অন্যকে সুখি করা সম্ভব।

তাই ১ যুগ আগে যখন ভিন্ন ভাবে জীবন শুরু তখন সব মন খারাপ করা ব্যাপার গুলো জীবন থেকে ঝেটিয়ে বিদেয় করার ডিসিশনটা নিয়ে ফেললাম। তখন থেকেই আমার জীবনে ঈদ নেই... যেন ...আহা কি আনন্দ আকাশে বাতাসে...ঈদের জন্য শপিং নেই.....ঈদের রান্নার ঝামেলা নেই.....সাত সকালে উঠে নতুন কাপড় পরা নেই.......বাড়ি বাড়ি গিয়ে টায়ার্ড হয়ে খাওয়া নেই, বাবা/মা'র সাথে সাথে সৌজন্য সাক্ষাতের জন্য লিস্ট ধরে চাচা/ মামা/ খালা/ মালা/ টালা /পালা /জ্বালা.......দের বাড়ি যওয়া নেই। স্বাধীন দেশের স্বাধীন মানুষ ঢাকায় থাকতে ঈদের দিন আমারই মতন আরেক ছন্নছাড়াকে ধরে দুজন রিকশা চড়ে যেখানে খুশি সেখানে ঘুড়ে বেড়াতাম রিকসা চড়ে ঈদ তাড়াতাম । রিকশা চড়ে উত্তরা থেকে পুরানো ঢাকার নিরব পর্যন্ত সব জায়গাতেই যাওয়া হয়েছে। তবে সমস্যা একটাই হতো তা হলো খাবারের দোকান গুলো বন্ধ থাকে ঈদের সময় খালি পেটে তো আর শুধু ঘোরাঘুরি চলে না।

তাই খাবারে দোকানের খোঁজে আরো কিছুটা ঘোরাঘরিও হয়ে যেত দু একটা দোকান খোলা পাওয়া যেত অবশেষে....আর অগত্যা নাই পাওয়া গেলে সে আমাকে তার বন্ধুর বাসায় নিয়ে যেত আর বন্ধুর মাকে বলত, "খালাম্মা দেখেনত এই ফকিরনিটাকে আসার সময় রাস্তায় কুড়িয়ে পেলাম, ক'দিন নাকি খানাপিনা কিছু পেটে পরেনি একে একটু ভিক্ষা দেন তো"। আর খালাম্মা আদরে গদগদ হয়ে আমাকে জরিয়ে ধরতেন । আমার বেশির ভাগ বন্ধুদের চাইতে তাদের মায়েদের সাথে আমার বেশি ভাব ছিল সব সময়। এমনও সময় গেছে যখন বন্ধুর বাড়িতে গেছি বন্ধুর সাথে দেখাই হয়নি তবে তার মা'র সাথে বসে সারাদিন আড্ডা দিয়ে বাড়ি ফিরেছি। আর এই মা'রা আমাকে নানান মজার মজার জিনিস রান্না করে ফোন দিতেন আড্ডা মারতে যাবার জন্য "আজ মাসকলাই এর ডাল রেধেছি তুমি আসছ তো?" "আরে এচড় রেঁধে তোমার জন্য বসে আছি জলদি একটা রিকসা নিয়ে চলে এসো তো" অথাবা "চিঙড়ি দিয়ে এত গুলো লতি রাঁধলাম কই কখন আসছ?" - এমন সব ফোন পেতাম সব সময়।

আর আমিও খালাম্মার মিস্টি মেয়ে হয়ে চলে যেতাম আদর খেতে তাই বন্ধু ভাগ্য চাইতে বন্ধু-বাবা/মা ভাগ্য আমার বেশি ছিল । যাই হোক এবার আসল কথায় ফেরত আসি। সিংগাপুরে থাকতে ঈদে পাবলিক ছুটি দেয়া হতো। তাই ঈদটা পুরো পুরি ভুলে যাওয়া যেত না, যদিও ঈদ লিটল ইন্ডিয়া আর মালেয় ভিলেজের আশেপাশেই শুধু বোঝা যেত....তাই ঈদের সময় আমি ওপাড়াতে পাও মাড়াতাম না। আগের দিন রাতে বন্ধুদের সাথে আড্ডা দেয়া চলত সকাল অবদি তার পর ম্যাকডোনাল্ডে বা কফিশপে ব্রেক্কি সেরে বাড়ি ফিরে বিকেল পর্যন্ত ঘুম দিতাম।

ঘুম থেকে উঠতাম কোন বন্ধুর ফোনে বাইরে লাঞ্চ করবার জন্য বা কোন মুভি দেখবার প্লান নিয়ে...। আলসে আমি ধীরে সুস্থে উঠে গা ছেড়ে দিয়ে বাইরে যেতাম। অথবা পুরো ঈদের ছুটিতে বন্ধুরা মিলে সিংগাপুরের বাইরে চলে যেতাম বেড়াতে .....কখনও পেনাং বা কখনও টিওমান আইল্যান্ড অথবা খুব কাছের পুলা উবিন বা ইন্দোনেশিয়ার বিনটান আইল্যান্ড! সিংগাপুরে থাকবার এই তো মজা, কম সময়ে কম খরচে অনেক কিছু করার অনেক জায়গায় যাওয়ার সুযোগ থাকে। ব্রিসবেনে আসবার পরে আমার প্রথম ঈদ। বন্ধু করবি বারবার করে বলে দিল ঈদের ওর সাথে থাকতে হবে, সারাদিন একসাথে ঈদ করব।

বললাম আমিতো ঈদ করিনা অনেক দিন। সে কোন কথাই শোনে না তার সাথেই এবার ঈদ করতেই হবে আরো সব বাঙালী যাদের কিছুটা চিনি এখানে সবাই বলল তারা সবাই ঈদ করেব, আমি মনে মনে বলি ঈদ ফিদের মধ্যে আমি নাই । ভাবলাম এখানে তো পাবলিক হলিডে নেই, ঈদ করবে কি করে এরা বলছে ঠিকই ঈদ করবে আসলে কিন্তু করতে পারবে না ছুটি তো আর নেই । নিজেকে ঈদের হাত থেকে বাচাবার নানান পায়তারা আর সান্তনা মনে মনে । এদিকে আমার এক বন্ধু বাংলাদেশ থেকে মেসেজ করে বলল আমি যেন লাল জামা পরে এবার ঈদ করি, সারাদিন যেন লাল জামা পড়ে ঘুড়ে বেড়াই।

শুনেই বললাম ওকাজ আমাকে দিয়ে হবার নয়। তবুও সে জোড় করে বললো ওর কথা শুনতে। কথা দিতে পারলাম না শুনব বলে তবে একেবারে ইগনোরও করিনাই কারন সে আমার খুবই ভাল বন্ধু, যার সাথে আমি যা খুশি তাই করতে পারি, রাগ হলে মারতে পারি, খুশি হলে Hug করতে পারি সুখে দুঃখে সে আমার পাশে সবসময়। ঈদের আগের দিন রাতে করবীর ফোন পেয়ে টনক নড়ল.....এবার তো আর ছাড়া নেেই। মনকে বোঝাই নিশ্চই ভাল লাগবে একটা দিনেরই তো ব্যাপার! যাবো বলে কথা দিলাম।

ঠিক হলো ক্লিফ আমাকে সকালে নামিয়ে দেবে অফিসে যাবার আগে কারন ক্লিফের কাজ আছে অফিসে, দুপুরে সে আবার আমাদের সাথে যোগ দেবে। পরদিন সকাল সাড়ে ছ'টায় মেজাজ খারাপ করে করবির চোদ্দগুষ্টি উদ্ধার করতে করতে রেডি হচ্ছিলাম। I am not at all a morning person সকালে আমার ঘুমভাঙা মন সহজ হতে কিছুটা সময় লাগে। তাই চোখ মেলে তাকিয়েই হাত পা ছুড়ে রেডি হওয়া আমার জন্য খুবই কঠিন ব্যপার । ক্লিফ আমাকে দেখে বলে " You don't look too Happy"।

শুধু বললাম "Don't talk to me now"। আমার বন্ধুটিকেও মেসেজ করলাম " I hate you because you asked me to celebrate Eid and i am gonna kill you if this doesn't turn into a good day today " যখন করবির বড়ি পৌছালাম ও তখন ঈদের নামাজে। বাইরে একটু অপেক্ষা করতেই ওরা চলে এলো নামাজ শেষ করে। এর পর আর ঘুরে তাকাতে হয়নি। কোনদিক দিয়ে যে দিন বয়ে যেতে থাকল নিজেই বুঝতে পারলাম না।

করবির হাতের রান্নার কথা একটু না বলললেই নয় এখানে। এই মেয়ে বাংলাদেশের দোকানের চাইতেও ভাল কালোজাম আর কাচাগোল্লা বানায়। চিকেন বিড়িয়ানির কথা তো আগেই একবার বলেছি। আরো সে বানালো সাসলিক আর শিক কাবাব। তার সাথে আরো কত কত আইটেম.........।

এখন বললে আবারও মুখে পানি চলে আসবে । ওর বাড়ি গিয়ে আরো অনেক বাংগালীর সাথেও পরিচয় হলো। একজন ব্লগারের দেখাও পেলাম। আড্ডাবাজীতে দিন চলতে থাকলো আর তার সাথে একটু পর পর খাওয়া । ক্লিফ এলো দুপুরে।

সে এত খাওয়া আর এত মানুষ একসাথে দেখেতো অবাক । আমরা করবির বন্ধু লোপা ও রনির বাড়ি গেলাম ওখানে থেকে, সেখানেও একই অবস্থা আড্ডা আর খাওয়া। অনেক নতুন আর চমৎকার সব বাংগালী ব্রিসবেন বাসির সাথে পরিচয় হলো, সবাই আজ ছুটি নিয়েছেন কাজ থেকে, ভাল লাগলো ব্যাপারটা জেনে, সবাই ঈদকে এতটা ভালবাসে তার জন্য কাজ থেকে ছুটি পর্যন্ত নিয়ে ফেলেছেন। লোপা আর রনি তাদের বন্ধুদের সাথেও পরিচয় করিয়ে দিল, চমৎকার এই দম্পতি! লোপার হাতের রসমালাই এর তো তুলনা নেই। এই হলো ক্লিফের প্রথম ঈদ দেখা, সে খুবই মজা পেল এত গুলো বাংগালীর একসাথে হয়ে এত খাওয়াদাওয়া আর গলা ছেড়ে চিৎকার নামের আড্ডা দেখে ।

মজা করে সবার সাথে সেও আড্ডা মারলো । মনে ও মুখে করবিকে বারবার ধন্যবাদ দিলাম। ও না যেতে বললে বা যাবার জন্য জোর না করলে দিনটা হয়ত অন্য সব দিনের মতন এটা সেটা করেই কাটতো, ওর ওখানে গিয়ে ঈদের আমেজে দিনটা সত্যই খুব ভাল কাটল। না গেলে আসলেই অনেক কিছু মিস করতাম আমার জীবনেও অনেক গুলো বছর পরে ঈদের বাতাস লাগলো.... তবে এবারের স্মৃতি টা অনেকদিন ভাল লাগা হয়ে থাকবে, ভালবাসা হয়ে থাকবে। ধন্যবাদ করবিকে আর ধন্যবাদ আমার বন্ধুকে ।


এর পর.....

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।