আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

আমি যোগাযোগ মন্ত্রীর পদত্যাগ চাই না, আমি যোগাযোগ মন্ত্রীর পদত্যাগ চাই ।

আমি সত্যের এবং সুন্দরের পুজারী। কজন মানুষের সাথে হাসিমুখে মিষ্টি ভাষায় যারা কথা বলে তাদের প্রতি আমার অপরিসীম শ্রদ্ধা । আর যারা নিজেদের অনেক বড় ভাবে, তাদের প্রতি আমার রয়েছে করুণা । বেশি কিছু বলব না, শুধুমাত্র ইন্টার্নশিপের ৩ টা ঘটনাই যথেষ্ট মনে হচ্ছে। ঘটনা ১ ঃ ক্যাজুয়াল্টিতে একটি ব্যতিক্রমী ১৫-২০ মিনিট।

আমি ক্যাজুয়ালটিতে কর্মরত, এক সন্ধ্যায় আযানের সাথে সাথে আমাদের ঢাকা মেডিকেল কলেজ ওয়ার্ড ৩২ ব্যস্ত হয়ে উঠল। টেবিলে থাকা ৭/৮ জন ডাক্তার মুহূর্তে ব্যস্ত হয়ে উঠলেন, নার্স, ওয়ার্ড বয় সবাই। কারণ একি সাথে কয়েকটা কেস এসে গেছে। এবং সবগুলাই সড়কদুর্ঘটনার কেস। নাহ এদের কথা কেউ জানে না।

কারণ এরা খুব সাধারন ব্যক্তি, এদের কথা মিডিয়াতে আসে না, কোন মন্ত্রী এদের দেখতে আসে না। এরা কোন রাজনৈতিক দলের কর্মী ও না, তাই এদের জন্য কেউ রক্তের ব্যবস্থা বা ঔষধ কিনার মত লোক ও নেই, এদের জন্য আছে শুধু হাস্পাতালের কসাই ডাক্তার রা ( আমরা ) আর নার্স রা। যাই হোক, একজন রোগীর কথা আমি জীবনে ভুলতে পারব না, যার কাছে আমি গিয়েছিলাম, আমি এত স্তম্ভিত হয়েছিলাম , সে একজন সি এন জি ড্রাইভার, রাস্তায় সে মনে হয় সি এন জি নেয়ার জন্য তাড়াতাড়ি ট্রিপ মারতে গেছিল, কিন্তু সড়ক দুর্ঘটনার পরে সে যখন হাসপাতালে আমাদের সামনের ট্রলিতে একা শুয়ে আছে, তার ঠোঁট ২ টা শক্ত করে একে অপরকে চিপে ধরে ব্যথা থামানোর ব্যর্থ চেষ্টা করতেছে আর ২ চোখে পানি ও নেই , আছে অবিশ্বাস, তার ট্রলিতে তার শরীরের পাশে তার দুর্ঘটনায় ডান বাহুর মাঝখান থেকে কেটে যাওয়া বাকি হাতটুকু কে যেন সযত্নে রেখে দিয়েছে। তার কোন ব্লাড গ্রুপ করা নাই, সাথে নাই কোন আত্মীয় স্বজন। সাথে কিছু ভাল মানুষ এসেছেন, যাদের জন্য আসলে দেশ চলতেছে এখনো।

ঘটনা ২ ঃ নিউরো সার্জারীতে ভয়ংকর এবং ঋদয়বিদারক আধাঘন্টা সেদিন শুক্রবার। প্লান ছিল আমি আর মিলা ( পরবর্তীকালে আমার স্ত্রী ) ঐদিন কোথাও ঘুরতে বের হব। কিন্তু ডিউটি করতে বাধ্য হই। ( ডিউটি করার কোন ইচ্ছা ছিল না, কারণ ঐ ওয়ার্ডে ডাক্তার রা নিরাপদে কাজ করতে পারতেন না ) যাই হোক, সকাল থেকে রোগীরা আসছেন। আমি আর একজন সিনিয়র ভাইয়া ( একটি বিশেষ রাজনৈতিক দলের কর্মী ও বটে ) প্রতি ১০ মিনিটে গড়ে ১২ টা করে রোগী সামলাচ্ছি।

যাই হোক, একটু পরে ভাইয়া বললেন, আমি একটু খাওয়া দাওয়া করে আসি। আমি কিছুটা বিরক্ত হলেও বললাম , ঠিক আছে , যান। যাই হোক হঠাত কয়েকটা ভর্তি রোগীর দেখভাল করতে করতে , শুনি চিতকার, কান্না কাটি, এরপর কমপক্ষে ২৫-৩০ জনের একটা দল এসে ঢুকলেন, আমি কিছুটা চিন্তিত হলাম, কারণ রোগীর চিকিতসা করতে আমি রাজি, কিন্তু উত্তেজিত আত্মীয়স্বজনের হাতে মার খেতে আমি প্রস্তুত না। সেক্ষেত্রে আমি চলে যাব। যাই হোক রোগীকে বিছানায় শোয়াতে বলে আমি তাড়াতাড়ী প্রয়োজনীয় জিনিস নিয়ে আসলাম।

কিন্তু কোথায় রোগী ! এতো ফুটফুটে একটা শিশু, মাত্র ৩-সাড়ে ৩ বছরের একটা মেয়ে। দেখে তো একদম সুস্থ মনে হচ্ছে। চারিদিকে ওদের আত্মীয়স্বজন যা বললেন, তাতে (আমার মত কঠিন ঋদয় কসাই) ও বিচলিত হয়ে উঠল। বাচ্চাটাকে খুব তাড়াতাড়ি পরীক্ষা করতে করতে বুঝতে পারলাম, ২ মেয়েকে নিয়ে বাবা মা রিক্সা করে যাচ্ছিলেন, কোথায় জানি বেড়াতে, সারা সপ্তাহের কাজ শেষে সপরিবারে বেরিয়েছিলেন আনন্দ করতে কিন্তু শুক্রবার সকালের জ্যামহীন নগরীর সৌন্দর্য উপভোগ করতে করতেই হয়ত একটা বাস (বা গাড়ী ঠিক মনে নাই), উনাদের রিক্সাকে দুমড়ে মুচড়ে দিয়ে যায়। ঘটনাস্থলে মারা যান বাচ্চাদের মা।

আহত হন পিতা। আর বড় মেয়েকে অর্থোপেডিক্স এ ভর্তি করা হয়েছে। আর ছোট মেয়ের ডাক্তার আমি। যাই হোক, আমার তো বিচলিত হলে হবে না। আমি তো কসাই, এসব কেস কত দেখি , কিন্তু একি ! আমি তো বাচ্চাকে পরীক্ষা করে আতংকিত হলাম যে ও হয়ত বেঁচে নাই, খুব দ্রুত আমি ওই অবস্থাতেই বাচ্চাটিকে মুখে মুখ লাগিয়ে এবং বারংবার ঋদয়ে চাপ দিয়ে তাকে বাঁচানোর চেষ্টা করে অক্সিজেন দিতে বললাম।

হাসপাতালের ব্রাদার নার্স যে যেভাবে পারে সাহায্য করার চেষ্টা চালিয়ে গেলেন। কিন্তু আল্লাহ যাকে ডাক দিয়েছেন, আমাদের সাধ্য কি তার ঋদস্পন্দন ফিরিয়ে আনার। যাই হোক , আমরা ব্যর্থ হলাম, আমি চোখের জল ধরে রাখতে পারলাম না। অন্য দিকে তাকিয়ে মুছে ফেললাম, কারণ কোন দুর্বলতা আমি দেখাতে পারি না। বাচ্চার বাবার দিলে তাকানোর সাহস আমি পাচ্ছিলাম না।

বাচ্চার নানা সম্ভবত, উনি আমাকে বললেন, '' ডাক্তার সাহেব, আপনি যে চেষ্টা করলেন, আপনাকে ধন্যবাদ, আমাদের ভাগ্য এটা। আল্লাহ যাকে নিয়ে গেছেন সেখানে আমাদের কিছুই করার নাই। '' আমাকে ও মেনে নিতে হল। উনি বললেন, '' ওদের মা আপনাদের মর্গে পড়ে আছেন, ছোট বোন মৃত আপনি বললেন, আর বড় মেয়েটা যে অর্থোপেডিক্স এ ওর মা কে বোন কে খুঁজতেছে, আমি ওদের কি জবাব দেব ?'' উনাদের স্বান্তনা দেয়ার ভাষা আমার জানা ছিল না, মুহূর্তেই আরেকজন রোগীকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে যেতে হল। আর বাচ্চার বাবাকে দেখে যেমন লেগেছিল, সেটা মনে করে আমি আরেকবার শিহরিত হলাম এই লিখা লিখতে লিখতে।

ঘটনা ৩ ঃ মেডিসিন বিভাগ ঃ সারাদিনের ডিউটি শেষে আমি হলে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছি। দুপুরে খেয়ে একটা ঘুম দিব। রাতে আবার আসতে হবে, আগামীকাল সকালেও ডিউটি। সকাল থেকে মোটামুটি বেশ অল্প রোগী ভর্তি হয়েছে, সম্ভবত রাতটা খুব কঠিন যাবে, হয়ত প্রচুর রোগী আসবেন। যাই হোক, ব্যাগটা কাঁধে নিয়ে বের হতে গিয়েই বাধা।

ট্রলিতে করে আনা হয়েছে ২৮-৩২ বছরের এক যুবক কে। যুবক অচেতন। প্রাথমিক পরীক্ষার পরে আমরা বুঝতে পারলাম রোগী জ্ঞান হারালেও ভাইটাল সাইন ঠিক ই আছে। কিন্তু আমরা কেই তার হিস্টরি নিতে আগ্রহী হলাম না। কিন্তু এরপরেও ঐদিন আমাকে নিতে হল সি এ আইয়ার নির্দেশে।

কি আর করা। নাইট ডিউটি শুরু হওয়ার আধা ঘন্টা পর আসব। এমন ভাবতে ভাবতে গেলাম তার কাছে। কিন্তু কি আশ্চর্য, জানতে পারলাম, বাসের সীট থেকে অজ্ঞান অবস্থায় তাকে উদ্ধার করা হয়েছে। এরপর তার কাছ থেকে সব কিছু , মানিব্যাগ, মোবাইল সব নিয়ে যাওয়া হয়েছে।

তাকে নিয়ে এসেছেন ২ জন পুলিশ। তারা আমাকে কেস বুঝিয়ে দিয়ে চলে যাচ্ছেন, আমি তাদের বললাম, আপনারা উনাকে নিয়ে আসছেন, ভাল, কিন্তু এখন আপনারা কার দায়িত্বে ওকে দিয়ে যাচ্ছেন ? উনারা বললেন, আপনার দায়িত্বে। আমি বললাম, আমার তো ডিউটি শেষ, আমি কেন থাকব ? উনারা বললেন দেখেন ভাই, এটা তো আমাদের কাজ না, তারপরেও করলাম, আমি বললাম, যে ঠিক আছে, আপ্নারা ভাল করছেন, কিন্তু উনার জন্য যেসব ঔষধ আনতে হবে, তা উনার কোন আপন জন না থাকলে কে আনবে ? আমরা যে ওষধের ব্যবস্থা করব, যা সরকারী সাপ্লাই আছে আমরা দিব , যা নাই ? কিন্তু উনারা দায়িত্ব নিতে অপারগ হলেন। আমি তাকে ছেড়ে যেতে পারলাম না। তার হিস্টরি লিখে তাকে একটা জায়গায় শোয়ানোর ব্যবস্থা করে, কিছু প্রয়োজনীয় ঔষধ এর ব্যবস্থা করে, পরবর্তী শিফটের ডাক্তার , নার্স দের দায়িত্ব বুঝিয়ে দিয়ে বললাম যে আমি রাতের শিফটে আসছি।

জ্ঞান ফিরে পেলে যেন আত্মীয়দের জানানোর ব্যবস্থা করানো হয়। এই ৩ টা ঘটনাই আমার ইন্টার্নশীপের সময়কার। আমাদের কাছে প্রত্যেক্টা মানুষ ছিলেন আলাদা। প্রত্যেক্টা মানুষ এর গল্প আলাদা। কিন্তু প্রত্যেক্টা জীবন ই ছিল গুরুত্বপূর্ন।

আমি এই ৩ টা ঘটনার কথা বললাম নিচের কথাগুলা বলার জন্য। আমি কেন যোগাযোগ মন্ত্রীর পদত্যাগে র ব্যাপারে উদাসীন ! কারণ শুধুমাত্র উনার পদত্যাগে এসমস্ত ঘটনার শেষ না। আমি মনে করি, নিচের উদ্যোগ গুলা সরকার এবং বিরোধী দল সবার মিলিত উদ্যোগে ২০ বছর মেয়াদী চিন্তা করার এখন ই সময় । ১) মেট্রো রেল ছাড়া শুধুমাত্র বাসের সংখ্যা বাড়িয়ে এসব দুর্ঘটনার সংখ্যা বাড়ানোই হবে শুধু। কাজেই মেট্রো রেলের ব্যবস্থা করতে হবে।

মেট্রো রেল এর ব্যবস্থা করা বেশ কঠিন। আর আরো কঠিন এটাকে মেইন্টেইন করা , বিদ্যুত ব্যবস্থার কন্টিনিউয়াস ফ্লো নিশ্চিত করতে না পারলে এটা ১ম দিনেই অচল হবে। এটাই একমাত্র সমাধান বলে আমি মনে করি, কোন ২ বা ৩ নম্বর নেই, আর এটা শুধুমাত্র যোগাযোগ মন্ত্রনালয়ের উপরে বর্তায় না। ২০ বছর ব্যাপী যারাই সরকারে আসবে তাদের সবার উপর বর্তায় । এজন্য অর্থ, বিদ্যুত এবং নিরাপত্তা ৩ টাই নিশ্চিত করতে হবে।

যদি আমাকে সরকারের লোক জন বলে টাকা নাই। আমি বলব, অনেক উপায় আছে যেমনঃ সরকারের পক্ষ থেকে ৩০০ ট্যাক্সমুক্ত গাড়ী এনে সেটাকে বিক্রি করে গাড়ীপ্রতিতে যে লাভ হয় তা কোষাগারে জমা করুন, ৩০০* ৩০ লাখ কত হয় ??? আপনারা বিদেশ সফরে যখন যান, তখন ১০০ জনের বিরাট দল নিয়ে যান, ২০ জনের নিয়ে যান, এবার দেখুন কত জমে। মিটিং মিছিল, ব্যানার, তোরণ এবং প্রতিটা সেমিনারে যেভাবে খাওয়া নষ্ট করেন,এসব না করে জমান দেখি। যেসব সাংসদ সংসদে আসবেন না, তাদের ওয়ার্নিং এর পরেও না আসলে এবার তাদের বেতন জমা করুন কোষাগারে। হয় তারা আসবেন না হলে কোষাগারে টাকা জমা হবে।

জনগন থেকে ট্যক্স নিন, কিন্তু তাদের সেভাবে সুবিধা ও দিতে হবে। এগুলা খালি যোগাযোগ মন্ত্রনালয়ের কাজ না। আমি কেন যোগাযোগমন্ত্রীর পদত্যাগ চাই ??? আমি ও চাই কারণ, উনি একটা দায়িত্বপূর্ণ পদে থেকে দায়িত্বের বরখেলাপ ই শুধু করেন নাই, উনি জাতিকে মিথ্যা কথা বলেছেন, , মানুষের মৃত্যুর পরে হাসি দিয়ে ফালতু কথা বলেছেন এবং মানুষকে মিথ্যা আশা দিয়েছেন ফ্লাইওভার আর মেট্রোরেল এর কথা বলে। আমরা আশা করি না। ৫ বছরে দেশ পালটে যাবে।

কিন্তু এটাও আশা করি না যে, কিছুটা উন্নতি হওয়ার থেকে বরং অবনতি হবে আর এ ব্যাপারে দায়িত্বশীলরা দায়িত্বহীন কথা বলবে। ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।