আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

গল্প: অশরীরী

বাংলার মাটি বাংলার জল, বাংলার বায়ু, বাংলার ফল, পুন্য হউক, পুন্য হউক, পুন্য হউক, হে ভগবান। বাংলার ঘর, বাংলার হাট, বাংলার বন, বাংলার মাঠ, পুর্ন হউক, পূর্ন হউক, পূর্ন হ্‌উক, হে ভগবান। রবীন্দ্রনাথ আজও অনেক রাতে ঘুম ভেঙে গেল মুর্তজার। পাশের ঘরে কারা কথা বলছে। পুরুষ কন্ঠও রয়েছে ।

মনের ভুল? গতকালও অনেক রাতে ঘুম ভাঙার পর এমনই পুরুষকন্ঠের আওয়াজ শুনেছিল মুর্তজা। বিছানা ছেড়ে উঠে পাশের ঘরে আলো জ্বালিয়ে কাউকে দেখতে পায়নি। বিছানায় মেয়েদের নিয়ে ঘুমিয়ে ছিল রাশেদা । তাহলে কে কথা বলল ? পুরুষ কন্ঠে? আমার মনের ভুল? খানিকটা বিভ্রান্ত বোধ করেছিল মুর্তজা । ...এই মুহূর্তে পাশের ঘরে এসে আলো জ্বালায় মুর্তজা ।

গীতি আর মুন্নীকে জড়িয়ে ধরে শুয়ে আছে রাশেদা। ঘরে আর কেউ নেই। অথচ স্পষ্ট পুরুষের কন্ঠ শুনতে পেলাম। মনে হল মেয়েরা বায়না করছে। ‘বাবা,’ ‘বাবা’ করে কাউকে ডাকছে।

কিন্তু, তা কেন হবে? দীর্ঘশ্বাস ফেলে আলো নিভিয়ে দিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে যায় মুর্তজা। আজ আর ঘুম হবে না। সিগারেট ধরালো । তারপর ঘরের আলো নিভিয়ে দেয়। ঘর অন্ধকারে ডুবে যায়।

ক্লান্ত শরীরে চেয়ারে বসে । এখন কত রাত কে জানে। জানালার বাইরে আমগাছ। তার পাতায় ঝিরঝির বৃষ্টির শব্দ । অন্ধকারে সিগারেট টানে মুর্তজা।

ভিতরে বিষাদ টের পায়। আমার কি হেলুসিনেশন হচ্ছে? কিন্তু কেন? আমি কি আজও শাহিনাকে ভুলতে পারি নি? শাহিনার শোক কি আমায় মানসিকভাবে বিপর্যস্ত করে তুলেছে? সে জন্যই কি আমার হেলুসিনেশন হচ্ছে? ... মুর্তজার মৃত স্ত্রীর মুখটি অন্ধকারে ভাসে। মুর্তজার বুক চিরে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে । মাস তিনেক আগে এই মফস্বল শহরে বদলী হয়ে এসেছে মুর্তজা । এক সপ্তাহও কাটেনি - শাহিনা মারা গেল।

হার্টে মাইনর সমস্যা ছিল, সেটিই কী কারণে প্রকট হয়ে উঠল। শাহিনার মৃত্যুর পর অচেনা শহরে মাস দুয়েক তীব্র শোকে কেটেছিল মুর্তজার। বিয়ের দশ বছর পরও শাহিনার বাচ্চাকাচ্চা হয়নি। এই নিয়ে দুজনের মনেই দুঃখ ছিল, তবে তারা সুখি ছিল। শাহিনার অবর্তমানে নিঃসঙ্গতা কি রকম তীব্র হয়ে উঠতে পারে সেটি চল্লিশ বছর বয়েসে পৌঁছে হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছিল মুর্তজা ।

মুর্তজা যখন আকন্ঠ শোকে ডুবে ছিল, ঠিক তখনই অনেকটা আকস্মিকভাবেই রাশেদার মামা আজিজুল হকের সঙ্গে পরিচয় হয়ে গেল । মুর্তজার কাজটা ইনকাম ট্যাক্স সংক্রান্ত । এই পেশায় নানারকম মানুষের সঙ্গে পরিচয় হয়। আজিজুল হক স্থানীয় বাশিন্দা। বৃদ্ধ।

বয়স ষাটের মতো । এককালে পরিবহন ব্যবসা করতেন । বিপত্নিক । অফিসে চা খেতে খেতে আজিজুল হক এসবই বলছিলেন। কথাবর্তায় দুজনের সম্পর্ক কিছুটা ঘনিষ্ট হয়ে ওঠে।

এক শুক্রবার বিকেলে ড. কাজী আলাউদ্দীন সড়কে বাড়ি গিয়েছিল মুর্তজা। গাছগাছালিতে ঘেরা হলদে রঙের দোতলা বাড়ি। আজিজুল হক বললেন, আমার একটাই ছেলে, বুঝলেন। বহুদিন হল মধ্যপ্রাচ্য প্রবাসী। ফিরোজ কুয়েত থাকে।

মাঝে মাঝে দেশে আসে। আমার ছেলে আর ফিরবে না। আমার এক ভাগ্নিকে মানুষ করেছি। রাশেদা ... মুর্তজা চুপচাপ শুনে যায়। মানুষের সঙ্গে কথা বললে মনের ভার লাঘব হয়।

আজিজুল হক বললেন, রাশেদার বিয়ে দিয়েছিলাম। কিন্তু ... বিয়ের ১০ বছর পর বিধবা হল রাশেদা। কি হয়েছিল? মুর্তজা খানিকটা কৌতূহলী হয়ে ওঠে। আজিজুল হক দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, কার অ্যাক্সিডেন্ট। ২০১০ সালের ১০ সেপ্টেম্বর।

ওরা শিবপুর যাচ্ছিল। রাশেদা আর ওর মেয়ে দুটি বাঁচলেও ইমতিয়াজ, মানে, রাশেদার স্বামী বাঁচল না। অনেক ক্ষণ স্তব্দ হয়ে বসেছিল মুর্তজা । আজিজুল হক-এর ক্যান্সার হয়েছিল। রাশেদাকে বিয়ে করার জন্য আজিজুল হক মুর্তজা কে অনুরোধ করেছিলেন।

মুর্তজা রাজি হয়েছিল। নিঃসঙ্গতা ও শোক তীব্র হয়ে উঠছিল। তাছাড়া রাশেদার মেয়ে দুটিও ফুটফুটে। আর যাই থাক, এরা সঙ্গে থাকলে নিঃসঙ্গতা তো ঘুচবে। রাশেদার বড় মেয়েটির নাম গীতি; বয়স ৭; ছোটটির নাম মুন্নী; বয়স ৬ ।

রাশেদা শ্যামলা হলেও বেশ সুন্দরী। ৩৫/ ৩৬ এর মতো বয়স। ড. কাজী আলাউদ্দীন সড়কেই একটা কিন্ডারগার্ডেন স্কুলে পড়ায়। গীতি ও মুন্নি ওদের মায়ের স্কুলেই পড়ে। বিয়ের দু সপ্তাহ পর আজিজুল হক মারা যান।

মৃত্যুর আগে তিনি মুর্তজাকে অনুরোধ করে বলেন: তোমরা বাবা আমার বাড়িতেই থাক। ইমতিয়াজও থাকত। ফিরোজ তো আর দেশে ফিরবে বলে মনে হয় না। ফাঁকা বাড়ি দেখলে যদি কেউ দখল-টখল হয়ে গেলে। এত শখের বাড়ি।

মুর্তজা রাজি হয়। মৃত্যুর পর রাশেদা ওর মামাতো ফিরোজকে বাবার মৃত্যুর খবর জানায়। একবার দেশে ফেরার অনুরোধ করে। বিয়ের পর মুর্তজার সঙ্গে চমৎকার মানিয়ে গেল রাশেদা। তবে রাশেদার শরীর অস্বাভাবিক শীতল মনে হল ।

মুর্তজা এর আগেও দু-একজন মেয়ের সঙ্গে ঘনিষ্ট হয়েছে। স্ত্রী শাহিনা ছাড়াও বিয়ের আগে সিরাজগঞ্জে থাকার সময় আফরোজা নামে একটি তরুণীর সঙ্গে প্রেম ছিল মুর্তজার । রাশেদার শীতলতা তাকে বিস্মিত করে। মুর্তজা অন্ধকারে সিগারেট টানে। জানালার বাইরে ঝিরঝির বৃষ্টি।

পর পর বেশ কটা রাত পাশের ঘরে পুরুষের গলার আওয়াজ শুনে ঘুম ভেঙে গেল। কেন? মুর্তজা দীর্ঘশ্বাস ফেলে। শাহিনার মুখটি মনে পড়ে। ওকে কি ভোলা গেল না? রাশেদা আর মেয়ে দুটিও সান্নিধ্যেও শাহিনার শোক কাটল না? আশ্চর্য!মানুষের মন এমনই বিচিত্র। মুর্তজা দীর্ঘশ্বাস ফেলে।

অন্ধকারে সিগারেট টানে। ঝিরঝির বৃষ্টির শব্দ শোনে ... কয়েক দিন ছেড়ে ছেড়ে বৃষ্টির পর দিনটা আজ ঝকঝকে উজ্জ্বল। সকালে অফিসে ছিল মুর্তজা। একজন ক্লায়েন্টের আসার কথা। জিল্লুর রহমান।

ভদ্রলোক নিউজিল্যান্ড থাকেন। মাসখানেকের জন্য দেশে এসেছেন। ইনকাম ট্যাক্সসহ অন্যান্য বিষয় সেটল করবেন । এই শহরে বেশ কিছু সম্পত্তি আছে। ভদ্রলোক আজ সকালে ফোন করলেন।

বললেন, হঠাৎ অসুস্থ বোধ করছি। আপনি একবার আমার এখানে আসতে পারলে ভালো হয়। বলে ঠিকানা দিলেন। অফিস থেকে বেরিয়ে রিকশা নিল মুর্তজা। জিল্লুর রহমান-এর বাড়ি শহরের খানিকটা বাইরে।

জায়গাটার নাম ঋষিপাড়া। ওদিকেই শশ্মান। আর নদীর ধার ঘেঁষে রেললাইন চলে গেছে। ছবির মতো বাড়ি। কালো লোহার গেট।

পাশে রেইনট্রি গাছ। গেটের বাঁ পাশে লেখা: ‘মমতাজ ভিলা’। বাড়ির পিছনে মাঠ। তারপর রেললাইন। কাউকে দেখা গেল না।

গেটটা খোলা। ঠেলে ভিতরে ঢুকে পড়ে মুর্তজা। ছোট্ট বাগান। বেশ গোছানো। নানা রকম ফুলের গাছ ছাড়াও সূর্যমুখির ঝাড় রয়েছে।

ডান পাশে চৌবাচ্চা। পদ্ম ফুটে রয়েছে। রঙিন মাছও আছে বলে মনে হল। চৌবাচ্চা ঘেঁষে মার্বেল পাথরের একটি পরী। এক তলা বাড়ি।

ছাদে লাল টালি। পিছনে বিশাল কামরাঙা গাছ। একটা বেলগাছ চোখে পড়ে। এক তলার বারান্দায় গ্রিল ঘেরা । গ্রিলে মানিপ্ল্যাট ।

ঝলমলে রোদে একজন বৃদ্ধ বেতের চেয়ারে বসে খবরের কাগজ পড়ছিলেন। ইনিই সম্ভবত জিল্লুর রহমান । বয়স ষাটের কাছাকাছি বলে মনে হল। মাথায় টুপি। বেশ ফরসা চেহারা।

পাকা দাড়ি। চোখে কালো ফ্রেমের চশমা। মুর্তজা সালাম দেয়। বৃদ্ধ পত্রিকা গুটিয়ে বললেন, আসুন আসুন। আমিই জিল্লুর রহমান।

বসুন। মুর্তজা বসল। পিছনের কামরাঙা গাছে অনেক পাখি ডাকছিল। টিয়া সম্ভবত। জিল্লুর রহমান বললেন, আমিই যেতাম।

হঠাৎই হাঁটুর ব্যথা ... তা ছাড়া আমার কনস্টিপেশনের সমস্যাও আছে। ঠিক আছে। বলে মুর্তজা ফাইলপত্র খুলে । বেশ কিছু ক্ষণ কাটল অফিসিয়াল কথাবার্তা বলে । একজন বৃদ্ধা এলেন।

পরনে সাদা শাড়ি । বেশ অভিজাত চেহারা। ফরসা। চোখে কালো ফ্রেমের চশমা। মাথার চুলে মেহেদির রং।

বৃদ্ধার হাতে একটা ট্রে। তাতে চা আর একটা প্লেট। প্লেটে নোনতা বিসকিট। বৃদ্ধা বারান্দায় আসতেই মুর্তজা আঁষটে গন্ধ পেল । কেমন পুরনো গন্ধ।

বদ্ধ ঘরে অনেক দিন পরে ঢুকলে যেমন গন্ধ পাওয়া যায়- ঠিক তেমন গন্ধ। বৃদ্ধা ট্রে রেখে চলে গেলেন। কাজ প্রায় শেষ। জিল্লুর রহমান জিজ্ঞেস করলেন, আপনাকে এর আগে দেখিনি। কোথায় থাকেন? ড. কাজী আলাউদ্দীন সড়ক।

মুর্তজা বলল। জিল্লুর রহমান মাথা নেড়ে বললেন, ও, আচ্ছা। ড. কাজী আলাউদ্দীন সড়ক। তা আপনি কি আজিজুল হক সাহেব কে কি চেনেন? রূপম ট্রান্সপোর্টের মালিক? ড. কাজী আলাউদ্দীন সড়কেই থাকেন। আমি তাঁর ভাগ্নিকেই বিয়ে করেছি।

লাজুক কন্ঠে বলল মুর্তজা। কাকে? চমশার ভিতরে বৃদ্ধের চোখ বিস্ফারিত হয়ে উঠল। কি ব্যাপার? মুর্তজা অবাক হল। বৃদ্ধ এত চমকে উঠলেন কেন? মুর্তজা বলল, আজিজুল হক সাহেবের ভাগ্নি। রাশেদা।

আপনি কি রাশেদাকে চেনেন? ড. কাজী আলাউদ্দীন সড়কেই একটা কিন্ডারগার্ডেন স্কুলে পড়ায়। বৃদ্ধ মনে হল ধাক্কা খেলেন। বললেন, হ্যাঁ, আমি রাশেদাকে চিনতাম । রাশেদার মামা আজিজুল হক আমার বন্ধু। আপনি রাশেদার স্বামী ... কিন্তু তা কি করে হয়? মানে? মুর্তজার ভ্রুঁ কুঁচকে ওঠে।

রাশেদা তো কার অ্যাক্সিডেন্টে মারা গেছে। জিল্লুর রহমান ফ্যাঁসফ্যাসে কন্ঠে বললেন। মুর্তজা হাঁফ ছেড়ে বাঁচল। মাথা নেড়ে বলল, না, রাশেদা কার অ্যাক্সিডেন্টে মারা যায় নি। আপনি ভুল শুনেছেন।

কার অ্যাক্সিডেন্টে মারা গেছে রাশেদার এক্স হ্যাজব্যান্ড। জিল্লুর রহমান দৃঢ় কন্ঠে বললেন, না। রাশেদাও মারা গেছে। ওর মেয়ে দুটিও মারা গেছে। মুর্তজা শীত বোধ করে।

কিছুটা কর্কস স্বরে বলল, কি যা তা বলছেন আপনি! মুর্তজার কথার জবাব না -দিয় বৃদ্ধ ‘মমতাজ!’ ‘মমতাজ!’ বলে গলা চড়িয়ে ডাকলেন। সেই বৃদ্ধা এলেন। হাতে একটা গ্লাস। বেলের সরবত মনে হল। গ্লাসটা স্বামীকে দিলেন।

বৃদ্ধা বারান্দায় আসতেই সেই আঁষটে গন্ধটা পেল মুর্তজা। তাছাড়া বৃদ্ধার চোখে দৃষ্টিও কেমন শীতল। শোন কি বলছে ইনি। বেলের সরবত এক চুমুকে শেষ করে জিল্লুর রহমান বললেন। কি বলছেন? বৃদ্ধা শীতল চোখে মুর্তজার দিকে তাকালেন।

বলছেন, ইনি নাকি আজিজুল হক সাহেবের ভাগ্নি জামাই। বৃদ্ধা মাথা নেড়ে বললেন, না। তা কি করে হয়। রাশেদা মারা গেছে। ওর স্বামীও মারা গেছে।

মুর্তজা বলল, রাশেদা মারা যায় নি। ওর হ্যাজব্যান্ড মারা গেছে। রাশেদার সঙ্গে আমার বিয়ে হয়েছে। বৃদ্ধা বললেন, নাঃ, ওরা সবাই মারা গেছে। কার অ্যাক্সিডেন্টে।

তার আগে আমরা নিউজিল্যান্ড থেকে দেশে ফিরে এলাম। ২০১০ সালের ১০ সেপ্টেম্বর। মুর্তজা বলল, হ্যাঁ। তারিখ ঠিকই আছে। তবে আপনার ভুল হচ্ছে না তো? কথাটা বলল বটে তবে জোর পেল না।

তার মাথার ভিতরে কুয়াশা ছড়িয়ে পড়ছিল। পা দুটো দূর্বল ঠেকছিল। বৃদ্ধা বললেন, ভুল হবে কেন? আজিজুল হক সাহেবের ছেলে ফিরোজ আমার ছোট ছেলে মাসুমের বন্ধু। ছেলেবেলায় ওরা একসঙ্গে কত খেলে বেরিয়েছে। মুর্তজার শরীর কেঁপে উঠল।

মুহূর্তেই ঘেমে গেল। উঠে দাঁড়াল। তারপর কখন উঠে দাঁড়িয়ে বাগানে নেমে দ্রুত গেট পেরিয়ে ফাঁকা রাস্তায় হাঁটতে থাকে । একটা রিকশা দেখে ‘ড. কাজী আলাউদ্দীন সড়ক’ বলে উঠে পড়ল। সারা শরীর কাঁপছিল।

জিল্লুর রহমান আর বৃদ্ধার কথা সত্য হলে রাশেদা, গীতি, মুন্নী- ওরা বেঁচে নেই। ওরা তাহলে অশরীরী? সব কেমন মিলে যাচ্ছে। রাতে শোনা পুরুষকন্ঠ কার? রাশেদা স্বামী ইমতিয়াজের? তাছাড়া রাশেদার শরীর অস্বাভাবিক শীতল মনে হয় । গীতি ও মুন্নীকেও কেমন শীতল মনে হয়। কোলে নিয়ে আদর করা সময় ব্যাপারটা টের পেয়েছিল মুর্তজা।

ওদের চোখের দৃষ্টিও কেমন শীতল। আর কিছুটা যান্ত্রিক। বাড়ির সামনে যখন সে রিকশা থেকে নামল, ততক্ষণে দুপুর গড়িয়ে গিয়েছে। রাশেদা কি ফিরেছে? ওর মর্নিং শিফট। ফেরার কথা।

বাড়ির সামনে একটা মাইক্রোবাস। সাদা রঙের । ড্রাইভার দেখা গেল না। মাইক্রোটা ‘রেন্ট আ কার’- এর মনে হল। কে এল? দোতলায় উঠে বেল বাজাল মুর্তজা।

দরজা খুলল ঝর্না। শ্যামলা মতন এই মেয়েটি এ বাড়িতে কাজ করে। বয়স আঠারো উনিশ। মুর্তজা জিগ্যেস করে, তোর মামী আর বাচ্চারা স্কুল থেকে ফিরছে? হ। বলে হাসল ঝর্না।

খটকা লাগে। ঝর্নার তো হাসার কথা না। মুর্তজা পা বাড়ায়। ঝর্না সরে যায়। বসার ঘরে কেউ নেই ।

বসার ঘরটা বেশ বড়। একপাশের দেয়ালে আজিজুল হক-এর একটা ছবি টাঙানো । বৃদ্ধ উপহাস করছেন। ওপাশে খাওয়ার ঘর। মাঝখানে পর্দা।

ওপাশ থেকে কথাবার্তার আওয়াজ । পুরুষকন্ঠ শোনা গেল। আমাকে পুতুল কিনে দেবে? মুন্নীর কন্ঠ। বেশ দেব। পুরুষকন্ঠ বলল।

মুর্তজার শরীর জমে যায়। পর্দা সরিয়ে দেখে মুর্তজা দেখল খাবার টেবিলে রাশেদা আর গীতি মুন্নী বসে। আর একজন অচেনা পুরুষ। কালো। গাট্টাগোট্টা চেহারা।

ভরাট মুখ। মাথায় টুপি। রাশেদা ইমতিয়াজের ছবি দেখিয়েছিল। তার সঙ্গে মিল নেই। কে এ? রাশেদা বলল, ওহ্, তুমি! এসো।

পরিচয় করিয়ে দিই। ইনি ফিরোজ ভাই। আমার মামাতো ভাই। কুয়েত থেকে আজই এসেছেন। ‘আরে, ব্রাদার’ বলে ফিরোজ উঠে মুর্তজাকে জড়িয়ে ধরল।

আতরের পায় মুর্তজা । তোমার শরীর খারাপ? রাশেদা জিগ্যেস করে। না। বলে মাথা নাড়ে মুর্তজা। তাহলে ? এত ঘামছ কেন? আমি আমি আমার এক ক্লায়েন্টে কাছ থেকে এলাম ...মুর্তজা ফ্যাঁসফ্যাসে কন্ঠে বলে ।

তো ? ফিরোজ জিগ্যেস করে। তিনি ...তিনি .... বললেন ...ওই অ্যাক্সিডেন্টে রাশেদার এক্স হ্যাজব্যান্ড না। সবাই মারা গেছে। কি যা তা বলছ? রাশেদা প্রায় চিৎকার করে ওঠে। মুর্তজা বলল, জিল্লুর রহমান সাহেব তো তাই বললেন।

ফিরোজ বলল, জিল্লুর রহমান সাহেব মানে ... বুঝেছি ... আপনি কি ঋষিপাড়া গিয়েছিলে? বলতে বলতে ফিরোজের মুখ কেমন অস্বাভাবিক হয়ে ওঠে। হ্যাঁ। আমি এখন ওখান থেকেই এলাম মুর্তজা বলল। ফিরোজ বলল, ঋষিপাড়ার জিল্লুর আঙ্কেল আমার বাবার বন্ধু। জিল্লুর আঙ্কেল ছোট ছেলে মাসুম আমার বন্ধু।

ওদের খুব ভালো করেই চিনতাম। চিনতাম মানে? মুর্তজা। ফিরোজ বলে, চিনতাম মানে ... বছর দশেক আগে মাসুম নিউজিল্যান্ড চলে যায়। তারপর মা-বাবাকে নিয়ে যায়। আমার সঙ্গে টেলিফোনে যোগাযোগ ছিল।

দু-বছর আগে কার অ্যাক্সিডেন্টে ওরা সবাই মারা গেছে। মানে জিল্লুর আঙ্কেলও ... মুর্তজার নিঃশ্বাস আটকে। ফিরোজ বলল, চল। ঋষিপাড়া। ওখানে গেলেই ব্যাপারটা ক্লিয়ার হবে।

ওরা দ্রুত নীচে নেমে এল। রোদ মুছে যাচ্ছে। দিনটা মেঘলা হয়ে উঠছে। ফিরোজকে দেখে ড্রাইভার কোত্থেকে বেরিয়ে এল । হলুদ টি-শার্ট পরা অল্প বয়েসি ছেলে।

মাইক্রে তে উঠে বসল। ড্রাইভার ব্যাক করে। ফিরোজ বুঝিয়ে বলে কোথায় যেতে হবে। মাইক্রোবাসে কাঁপা কাঁপা হাতে সিগারেট ধরালো মুর্তজা। সব কিছু অবিশ্বাস্য ঠেকছে।

মাথা কাজ করছে না। গতকাল দুপুরে জিল্লুর রহমান ফোন করেছিলেন । বললেন, নিউজিল্যান্ড থাকি। মাঝেমাঝে দেশের টানে আসি। এ শহরে ঘরবাড়ি, বিষয়সম্পত্তি রয়েছে ।

কাল সকালে আপনার অফিসে এসে কাগজপত্র আপটুডেট করে নেব। বৃদ্ধ কেন ফোন করলেন? লোকজন ট্যাক্সের ব্যাপার সাধারণত এড়িয়ে চলে যখন ... এখন ফিরোজ বলছে, জিল্লুর রহমান নিউজিল্যান্ডে সপরিবারে কার অ্যাক্সিডেন্টে মারা গেছেন। কার কথা সত্য? মমতাজ ভিলার সামনে মাইক্রো থামল। ঝিরঝির বৃষ্টি পড়তে শুরু করেছে। চারিদিকে কেমন অন্ধকার ঘনিয়ে এসেছে ।

মাটি কাঁপিয়ে একটা ট্রেন যাচ্ছে। বাড়ির পিছনে রেললাইন চলে গেছে নদীর ধার দিয়ে শশ্মান ঘেঁষে। মাইক্রো থেকে নেমে মুর্তজা চমকে ওঠে। সকাল বেলায় ছবির মতো বাড়িটা উধাও। তার বদলে লোহার কালো গেট ভাঙা।

দেয়ালে ‘মমতাজ ভিলা’ লেখাটাও ভাঙা। অপরিস্কার। গেটের পাশে রেইনট্রি গাছটাও চোখে পড়ল না। ওরা ভিতরে ঢুকল। ভিতরে আজ সকালে দেখা বাগানটি শূন্যে মিলিয়ে গেছে।

দেখলে অবশ্য বোঝা যায় যে এককালে বাগান ছিল। একতলা বাড়িটাও পুরনো । দেখলে বোঝা যায় কেউ থাকে না। পরিত্যক্ত বাড়ি। পিছনের কামরাঙা আর বেলগাছ চোখে পড়ল না।

একতলার বারান্দায় গ্রিল নেই। বাঁ পাশ থেকে একটা কালো মতন লোক বেরিয়ে এল। মাথায় ছাতা। লোকটা মাঝবয়েসি। পরনে লুঙ্গি আর গেঞ্জি।

টুপি মাথায় । মুখ ভরতি কাঁচাপাকা দাড়ি। দারোয়ান মনে হল। আজ সকালে একে দেখিনি। তখন এ কোথায় ছিল? লোকটার মুখ খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে থাকে মুর্তজা।

ফিরোজ জিগ্যেস করে, কি মনির মিঞা কেমন আছ? মনির মিঞা হাসল। বলল, আছি ভালা। আপনি ভালা নি? হ্যাঁ। আমি ভালো। আমাকে চিনতে পারছ? হ।

বলে মাথা ঝাঁকাল মনির মিঞা । এখন এ বাড়িতে কে থাকে? ফিরোজ জিগ্যেস করে। কে আর থাকব? সব তো মইরা গেল। আমিই আছি কেবল মউতের অপেক্ষায় । বলে উদাস দৃষ্টিতে চারপাশে তাকালো মনির মিঞা ।

মুর্তজা ঘামছিল। সেই আঁষটে গন্ধটা পায়। মনির মিঞা চোখের দিকে তাকায়। কেমন নিষ্প্রাণ শীতল দৃষ্টি। মুর্তজার পাশে এসে দাঁড়ায় রাশেদা ।

তারপর মুর্তজার হাত তুলে নেয়। মুর্তজা রাশেদার ঘামে ভেজা শীতল হাতের স্পর্শে কেঁপে ওঠে ... ।

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.