আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

হুমায়ুন আহমেদ, 'মন্দ্রসপ্তক এবং আমি!

আজকে বলছি বলে ঘটনা নতুন এমনটা ভাবার কোন কারণ নাই। ঘটনা মেলা আগের, ২০-২২ বছর আগের তো হবেই। আগেও একবার বলেছি। তখন আব্বার চাকরির-সুবাদে খুলনায় থাকতাম। ঈদ করতে খুলনা থেকে যেতাম ফেনী।

সে এক দীর্ঘ যাত্রা। নতুন একটা ট্রেন চালু হয়েছিল। খুলনা থেকে ফরিদপুর হয়ে ঢাকা পেরিয়ে ফেনী যেতে হয়। মাঝে আবার পার হতে হয় ফেরী। যেহেতু ট্রেন অনেক লম্বা, তাই ট্রেন আর ফেরী পার হতে পারেনা।

আমরা ফেরী পার হয়ে নদীর ঐ পাড়ে যেয়ে আরেকটা ট্রেনে করে ফেনী যাই। ট্রেন এর নাম দূর্দান্ত ছিলো, আজকে মনে করতে পারছিনা। ট্রেন যাত্রার একটা অবশ্যম্ভবী মজা হচ্ছে পত্রিকার হকাররা কিছু গোয়েন্দা বই ফেরি করে বিক্রি করে, সেগুলো কিনে পড়তে পারা। আমার পছন্দ ছিলো নীহাররঞ্জন গুপ্তের কিরিটি রায়ের গোয়েন্দা কাহিনী। ট্রেনে উঠেই ৩-৪ টা কিনে পড়তে শুরু করা, বই ভর্তি রহস্য উত্তেজনা।

। একেকটা বইয়ের দাম ছিলো ২০-২৫ টাকা করে। তখন আমাদের জন্য অনেক টাকা। বাবাকে বলতে দ্বিধা হতো। তবু বলতাম, বাবাও কখনো না করেননি।

যাই হোক, ট্রেন যাত্রা শেষের দিকে। ঘন্টা ২ বাকি হয়ত। আমাদের সামনের সীটে এক ভদ্রলোক বসে আছেন, তার হাতে একটা বড়দের বই। তিনি বোধহয় বইটা পড়ে শেষ করে ফেলেছেন। আমার দিকে তাকাচ্ছেন, তারপর বলেই ফেললেন যে আমরা একজন আরেকজন এর বই চেঞ্জ করে পড়তে পারি।

আমার ইচ্ছা ছিলো না বড়দের বই পড়ার কিন্তু যেহেতু আমার বই পড়া শেষ, অগত্যা রাজি হয়ে গেলাম। অদ্ভুত একটা বই। বইয়ের শুরুতেই এক ভদ্রলোকের দাঁত মাজার ঘটনা, সে কিনা আবার অন্যের ব্রাশ দিয়ে দাঁত মেজে ফেলেছে! বিরক্তিকর কিন্তু কেন যেন মজা লেগে গেলো! পরের দিকে আরো ইন্টারেস্টিং এক ভদ্রলোক তার স্ত্রীকে গভীর রাতে বিবস্ত্র হয়ে খাবার পানি আনতে বলে, ব্যাপার স্যাপার চিন্তা করে কিশোর বয়সে মাথা আউলা। এর মধ্যেই বইয়ের কেন্দ্রীয় চরিত্র রাত-বিরাতে ঘর থেকে বের হয়ে চলে যায়, বৃষ্টি বিলাসিতা করে, রোদকে বানিয়ে ফেলে অদ্ভুত মেঘ-মালা। দ্রুত বই পড়ে শেষ করার চেষ্টা করেও স্টেশন এ পোঁছাবার আগে বইটা শেষ করতে পারলাম না।

১২-১৫ পেইজ বাকি থাকলো। গভীর শোক নিয়ে ট্রেন থেকে নামলাম। আবিশ্বাস্য সেই বই পড়া শেষ করতে পারলাম না। দূর্বোধ্য নাম বলে বইটার নামটাও মনে রাখতে পারলাম না। তখন আমি ক্লাস এইট কিংবা সিক্স এ পড়ি।

লেখকের নামটা মনে রাখতে পেরেছিলাম - হুমায়ুন আহমেদ। তারপর সেই লেখকের অনেক বই গোগ্রাসে পড়েছি, কিন্তু ওই বইটার সন্ধান আর পাইনি। বহুবছর পর হঠাৎ একদিন সেই বইটা আমার হাতে আসল, বইয়ের নাম 'মন্দ্রসপ্তক'। আমার অবাক হবার ক্ষমতা অত্যন্ত সীমিত। অবাক হবার মধ্যে যে অপার আনন্দ সেটা আমি খুব বেশি পাইনা।

তারমধ্যেও জীবনে অবাক হবার কিছু বিরল সুযোগ আমাকে করে দিয়েছেন এই হুমায়ুন আহমেদ। সম্ভবত বঙ্গবন্ধুর পর বাঙ্গালী জাতিকে সবচে বেশি প্রভাবিত করবার ক্ষমতা নিয়েও জন্মেছিলেন হুমায়ুন আহমেদ। ভয়াবহ মহান ব্যক্তিদেরও কিছু ভয়াবহ ভুল করে যেতে হয়ে না হলে ইতিহাসে তাদের স্থান খুব ম্যারম্যারা হয়ে যায়। যেমন বঙ্গবন্ধু ভুল করেছিলেন জিয়াউর রহমান, খন্দকার মোশতাক এদের বিশ্বাস করে। তেমনি কথার জাদুকরের ভুল তার ২টি অত্যন্ত নিকৃষ্ট মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক উপন্যাস - জোতস্না ও জননীর গল্প এবং আরেকটি তার শেষ বই যেটা আমি নিশ্চিত তিনি পুরোটা লিখে যেতে পারেননি।

হুমায়ুন আহমেদ তার মুক্তিযুদ্ধের উপন্যাসগুলো যদি ঠিক-ঠাক করে লিখে যেতে পারতেন, তাহলে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস পরিপূর্ণ হয়ে যেতো। ১৯৭১ এর শেষদিকে যখন বর্তমান বি। এন। পি অর্থাৎ তৎকালীন জামাত শিবির গোলাম আযম, মুজাহিদ এর মাধ্যমে বুদ্ধিজীবী নিধন করছে, সেই সময়টারই কাছাকাছি সময়ে হুমায়ুন আহমেদ সৃষ্টি করছিলেন তার অবিশ্বাস্য কিছু উপন্যাস যেমন নন্দিত নরকে। সৃষ্টিকর্তা কারও জায়গা খালি রাখেন না।

আমি নিশ্চিত হুমায়ুন আহমেদ এর প্রথম মৃত্যুবার্ষিকির আগের দিন আমি যখন এই লেখাটা লিখছি, তখন বাংলাদেশের কোথাও না কোথাও হুমায়ুন আহমেদ এর চাইতেও একজন শক্তিশালী লেখক তার প্রথম লেখাটা লিখছে। সেই অভিষেকের অপেক্ষায় থাকা লেখককে শুভেচ্ছা জানিয়ে স্মরণ করি আমার প্রিয় লেখক হুমায়ুন আহমেদকে যিনি না লিখলে আজকের আমার 'আমি' হয়ে ওঠা হতো না। যার মৃত্যুতে আমার মতো অজস্র বাঙ্গালীর জীবন আগের চাইতে অনেক কম রঙ্গিন হয়েছে। হুমায়ুন আহমেদ এর প্রথম মৃত্যুবার্ষিকির প্রাক্কালে তাকে স্মরণ করি। এই লোকটার মৃত্যুর পরপর তার প্রিয় মানুষদের কি কষ্টটাই না আমরা দিয়েছি, কি অপমানটাই না করেছি! হুমায়ুন আহমেদ, তাঁর ৬ সন্তান, স্ত্রী শাওন-পরিজন সবার জীবন-মৃত্য আনন্দময় হোক।

আগামীকাল হুমায়ুন আহমেদ এর মৃত্যুবার্ষিকিতে 'মেঘ ভেঙ্গে বৃষ্টি নামুক, সেই বৃষ্টির জলে ধুয়ে যাক চোখের জল'। শামীম আহমেদ। ১৮ জুলাই, ২০১৩, ঢাকা। ।

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে ১৩ বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।