আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

যখন তারেক মাসুদ ও মিশুক মুনীরের সমাধির দিকে তাকাবো

যখন তারেক মাসুদ ও মিশুক মুনীরের সমাধির দিকে তাকাবো ফকির ইলিয়াস ====================================== মিশুক মুনীর আর নেই। নেই তারেক মাসুদও। দুজনেই এখন আমাদের কাছে স্মৃতি। তারেক মাসুদ একসময় যুক্তরাষ্ট্রে ছিলেন। মিশুক মুনীরও ছিলেন কানাডায়।

দুজনেই দেশে ফিরে গিয়েছিলেন। কেন গিয়েছিলেন? সেই প্রশ্নটি আমি বারবার করি। তারা তো বিদেশে থাকলে ভালোই করতেন। কেন গেলেন দেশে? গিয়েছিলেন এই দেশকে কিছু দেবার জন্য। দেশের মানুষের মননকে শাণিত করবার জন্য।

দেশের প্রজন্মকে আলোর উজ্জ্বল পথ দেখাবার জন্য। কিন্তু কী পেলেন তারা? প্রাণ দিতে হলো। চলে যেতে হলো চিরতরে। গত কদিন থেকে আমি বিষয়টি যতোবার ভাবছি, ততোবারই প্রশ্নবাণে বিদ্ধ হচ্ছি। এই দেশ, এই মাটি তাদেরকে এভাবে হত্যা করতে পারলো? তারেক মাসুদ ক্যাথরিনকে সঙ্গে নিয়ে বাংলাদেশে গিয়েছিলেন।

আর আমরা আসছিলাম আমেরিকায়। আমেরিকান ক্যাথরিন যাচ্ছিলেন বাংলাদেশে! ভাবতে অবাক লেগেছিল সেদিন। সেই ক্যাথরিন আজ তার প্রিয়তম তারেককে হারিয়ে অসহায়। এই সেই বাংলাদেশ, যেখানে সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছেন সাবেক অর্থমন্ত্রী সাইফুর রহমান। আমরা কি তা ভুলে গেলাম! না গেলে এই দেশের মহাসড়কগুলোর উন্নয়ন করতে প্রধানমন্ত্রীকে ‘বিশেষ আদেশ’ জারি করতে হয় কেন? কী করছেন আমাদের মাননীয় যোগাযোগমন্ত্রী? আমরা দেখছি বাক-বিতন্ডা লেগে গেছে রীতিমতো।

যোগাযোগমন্ত্রী বলেছেন, অর্থমন্ত্রী টাকা দিচ্ছেন না। আর অর্থমন্ত্রী ঐ দিনই অন্য সেমিনারে বলেছেন, যোগাযোগ মন্ত্রণালয় তাদের পরিকল্পনা অনুযায়ী কাজ করছে না। এটা কেমন ‘উদোর পিন্ডি বুধোর ঘাড়ে’ চাপাবার চেষ্টা? আমরা সেই গ্রাম্য মোড়লদের বচসা আর কতো শুনবো? আমরা তো ডিজিটাল বাংলাদেশের কথা বলছি। এই কি আমাদের ডিজিটাল আচরণ? অর্থমন্ত্রী স্পষ্ট বলে দিয়েছেন, অর্থের অভাবে সড়ক সংস্কার করা যাচ্ছে না, যোগাযোগমন্ত্রীর এ বক্তব্য ঠিক নয়। আসলে অর্থ বরাদ্দ থাকলেও কাজ করেনি যোগাযোগ মন্ত্রণালয়।

প্রায় একই অভিমত ব্যক্ত করা হয়েছে, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে উচ্চপর্যায়ের বৈঠকেও। যোগাযোগমন্ত্রী কয়েক দিন ধরে অভিযোগ করছিলেন, অর্থ মন্ত্রণালয় প্রয়োজনীয় অর্থ ছাড় করছে না বলে রাস্তাঘাটের মেরামত কাজ করা যাচ্ছে না। অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত এ বক্তব্যের সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করে বলেন, যোগাযোগমন্ত্রী না বুঝেই এসব কথা বলেছেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ঈদের আগেই দ্রুততম সময়ের মধ্যে রাস্তা-ঘাট যানবাহন চলাচলের উপযোগী করার নির্দেশ দিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রী ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেছেন, ‘বরাদ্দ করা অর্থ আগে খরচ করেন।

প্রয়োজনে আরো অর্থ সরকার দেবে। ’ রাস্তা সংস্কারের জন্য যতো টাকা প্রয়োজন, তা দ্রুত ছাড় করার জন্য তিনি অর্থ মন্ত্রণালয়কে নির্দেশ দিয়েছেন। যোগাযোগমন্ত্রী দুটো কথা বলেছেন যা হতবাক করেছে দেশবাসীকে। প্রথম কথাটি হলো, ‘বৃষ্টির মধ্যে তো কাজ করতে সমস্যা হয়। উন্নয়নকাজের জন্য রোদ ও খরা লাগে।

’ জানতে চাওয়া হলো- যখন রোদ ছিল, তখন সংস্কারকাজ করেননি কেন? যোগাযোগমন্ত্রীর জবাব, ‘তখন তো রাস্তা-ঘাট এতো খারাপ ছিল না। বৃষ্টির জন্য এই সমস্যা হয়েছে। ’ কী সব ফাঁকা বুলি বলছেন ডিজিটাল সরকারের যোগাযোগমন্ত্রী ! এটা কিসের লক্ষণ! তিনি কি কোনো বিশেষ মহলের পারপাস সার্ভ করছেন! যারা সরকারকে কুপোকাৎ করতে চায়! দুই. খবর বেরিয়েছে, ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়কে বাস চলাচল বন্ধ রয়েছে কদিন থেকে। ফরিদপুর-আলফাডাঙ্গা সড়কেও একই অবস্থা। এখন ঢাকা-রাজশাহী মহাসড়কের হাটিকুমরুল-বনপাড়া এবং বরিশাল-ভোলা-লক্ষ্মীপুর পথেও যান চলাচল বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়েছে।

তাছাড়াও ঢাকা-সিলেট মহাসড়ক, ঢাকা-কুমিল্লা মহাসড়কেও খানা-খন্দের সঙ্গে যুদ্ধ করছে মানুষ। দেখার কেউ নেই। সড়ক দুর্ঘটনার অন্যতম আরেকটি কারণ, লাইসেন্সবিহীন ‘হ্যান্ডেলম্যান ড্রাইভার’ অথবা গাড়ি চালানো না শিখেই ড্রাইভার হয়ে মাঠে নামা চালকরা। অথচ আমরা জানি বাংলাদেশে সড়ক নিরাপত্তা কাউন্সিল রয়েছে। আছে সড়ক দুর্ঘটনা প্রতিরোধবিষয়ক সেলও।

এগুলো যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের অধীন। কিন্তু একের পর এক দুর্ঘটনা ঘটলেও এই প্রতিষ্ঠানগুলো নিষ্ক্রিয়। সরকারও নির্বিকার। রাষ্ট্রপক্ষ তথা সরকারি হিসাবে বছরে গড়ে তিন হাজারের বেশি লোক সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যায়। বেসরকারি হিসাবে এই সংখ্যা ১২ থেকে ২০ হাজার।

খবরে জানা যাচ্ছে, সড়ক নিরাপত্তা কাউন্সিলে সরকারি কর্মকর্তা, নাগরিক সমাজের প্রতিনিধি, মালিক-শ্রমিক প্রতিনিধি আছেন। একাধিক সদস্য বিভিন্ন মিডিয়াকে জানিয়েছেন, সর্বশেষ বৈঠকে নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিদের ডাকাই হয়নি। বাংলাদেশে সড়ক নিয়ন্ত্রণ করে, সড়ক পরিবহন শ্রমিক ইউনিয়ন। এদের নেতা কে? সরকারি দল ও বিরোধী দলের কিছু সিনিয়র নেতা আছেন যারা শ্রমিক নিয়ন্ত্রণ করেন। এরাই দেশে নিজ নিজ সরকারের সময়ে হাজার হাজার ভূয়া ‘ড্রাইভার’ বানাবার কসরত করেন।

আজ দাবি উঠেছে, বন্দুকের লাইসেন্সের মতো ড্রাইভিং লাইসেন্সেও কড়াকড়ি করা হোক। কারণ একটি গুলি একজন লোক খুন করে। আর একজন বাস বা ট্রাক ড্রাইভার শত শত যাত্রীর জীবন বিপন্ন করে। এই যুক্তিটি সরকারি মহল কিভাবে নেবেন? সেদিন টিভির প্রতিবেদনে দেখলাম, ভাঙা বাসগুলোকে রং করে রাস্তায় নামানো হচ্ছে। ভেতরের ইঞ্জিনের অবস্থা কি? তা কে দেখবে? না, বাংলাদেশে তা দেখার লোক নেই ।

অনেক কিছুই দেখার লোক নেই। তারপরও আমাদের ‘সুশীল সমাজ’ সরকারি-বেসরকারি ইফতার মাহফিলে গিয়ে নিজের ধোপ-দুরস্ত’ চেহারা দেখান। সরকারের, বিরোধী দলের গুণকীর্তন করেন। নেতাকে উপরে তোলেন, নেতাকে নীচে নামান! এই যে বিবেকের বিসর্জন তারা দিচ্ছেন, এর শেষ কোথায়? আমরা আর কতোজন তারেক- মিশুক হারালে বুঝবো এই নগরে এখন আর গুণীদের লাশ রাখার জায়গা নেই! আর কত শব বহন করে গিয়ে দাঁড়াবো শহীদ মিনারে? দুজন গুণীর মৃত্যুর মধ্য দিয়ে সরকারি ওপর মহল নড়ে চড়ে বসছে, আমরা দেখছি। কিন্তু তা কতোদিন স্থায়ী হবে? এদিকে, দেশের সড়ক ব্যবস্থার আশঙ্কাজনক অবস্থা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন দেশের উচ্চ আদালত।

তারা বলেছেন, মন্ত্রীদের সমন্বয়হীনতার দায়িত্ব দেশের জনগণ নিতে পারে না। বর্তমান সরকারের অন্যতম দুই শরিক নেতা রাশেদ খান মেনন ও হাসানুল হক ইনুও সরকারের ব্যর্থতার কথা বলছেন প্রকাশ্যে। এসব কীসের আলামত? সরকারের ভেতরের কাঠামো ভেঙে পড়লেই আদালত কিংবা সরকারের অন্দরের নেতারা তেমনটি বলতে পারেন। হাসানুল হক ইনু স্পষ্ট বলেছেন, প্রধানমন্ত্রীকে, যোগাযোগ মন্ত্রণালয়কে তাগিদ দিতে হবে কেন? কথাটি খুবই যৌক্তিক। আমরা জানি এই সেই যোগাযোগ মন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেন, যাকে আগের বারেও আওয়ামী লীগের সরকারের সময়ে ব্যর্থ বলে দেশবাসী জেনেছিল।

তার পরিণামও মানুষ ভুলে যায়নি। হাঁ, মন্ত্রীরা না পারলে বিদায় নেবেন। সেটাই নিয়ম। বাংলাদেশে মন্ত্রীরা জগদ্দল পাথরের মতো ক্ষমতায় বসে থাকেন। কেন থাকেন? কেন ব্যর্থ মন্ত্রীদের সরাতে সরকার এতো গড়িমসি করছে? আমরা অতীতে দেখেছি, বাংলাদেশের গ্রামীন জনপদের মানুষ বেড়িবাঁধ দিয়ে বন্যা আটকে দিয়েছেন ।

স্বেচ্ছাশ্রম দিয়ে দেশের রাস্তা, ব্রিজ বানিয়ে দিয়েছেন। এসব মানুষেরা, মন্ত্রীদের চাইতেও দেশকে বেশি ভালোবাসেন। প্রয়োজনে ডাক দিলে আজো প্রতি এলাকার মানুষ কোদাল হাতে নিজ নিজ এলাকার মহাসড়কে স্বেচ্ছাশ্রম দেবেন। সরকারকে বলি, আপনারা সমন্বয় সাধন করুন। দেখবেন মানুষ কোদাল হাতে সড়কে নেমে এসেছে।

কিন্তু পিচ-গালা তো সরকারকে দিতে হবে। সরকারের মন্ত্রী-হোমড়া-চোমড়ারা যদি পিচ-গালা বেচে খায়, জনগণ তাহলে দাঁড়াবে কোথায়? এমন অবস্থা চলতে থাকলে, বিরোধী দলই মূলত আন্দোলনকে জোরদার করার সুযোগ ও সাহস পাবে। এ কথাটি বর্তমান প্রধানমন্ত্রীকে মনে রাখা দরকার। মিশুক মুনীর অন্তিম শয়ানে শায়িত হয়েছেন। তারেক মাসুদকে ফরিদপুরের ভাঙ্গায় তার গ্রামের বাড়িতে সমাহিত করা হয়েছে।

আমি টিভিতে দেখেছি, সেই শেষ অন্তর্যাত্রায় খুব নির্বাক তাকিয়ে আছেন ক্যাথরিন মাসুদ। তারেক মাসুদের মাটির সমাধি ফুলে ফুলে ঢেকে গেছে। ক্যাথরিন খুবই মর্মাহত চোখে তাকিয়েই আছেন। আমি জানি, তারেক-মিশুকের দেহ মাটিতে মিশে যাবে। কিন্তু তাদের মহান কাজগুলোর জন্য তাঁরা বেঁচে থাকবেন অনন্তকাল।

আমি জানি, আমরা যখন তাঁদের সমাধির দিকে তাকাবো, তখন আমাদের বুক কাঁপবেই। আমরা বার বার নির্বাক হবোই। কারণ আমরা তাদেরকে স্বাভাবিক মৃত্যুর গ্যারান্টি দিতে পারিনি। অথচ এই দুজন কৃতী মানুষ সুখ-ঐশ্বর্য ছেড়ে দেশমাতৃকাকে তাদের মেধা দেবার জন্যই ছুটে গিয়েছিলেন। যারা রাষ্ট্রক্ষমতায় আছেন, তাদেরকে আবারো সবিনয়ে বলি, ঐ সমাধিগুলো দেখে কি আপনাদের বুক কাঁপছে না, কাঁপবে না? ---------------------------------------------------------------------------- দৈনিক ভোরের কাগজ / ঢাকা / ২০ আগস্ট ২০১১ শনিবার ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।