আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

সড়ক যোগাযোগ ভেঙে পড়ছে

ইসলামের পথে থাকতে চেষ্টা করি...। সড়ক বিভাগের প্রকল্পে দুর্নীতি হয়—এমন অভিযোগে ২০০৮ সালে ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়ক মেরামত প্রকল্পে অর্থ দিতে অপারগতা জানিয়েছিল বিশ্বব্যাংক। সম্প্রতি সরকার নিজস্ব অর্থায়নে সড়কটি চার লেন করার প্রকল্প হাতে নেয়। কিন্তু ঠিকাদার নিয়োগে অনিয়মের কারণে এর একটি বড় অংশের কাজ বন্ধ হয়ে গেছে। এক দশক ধরে বড় ধরনের মেরামত না হওয়ায় সড়কে যত্রতত্র গর্ত আর তাতে পানি জমে মহাসড়কটি এখন চলাচলের অনুপযোগী।

সর্বশেষ গত বুধবার থেকে এই মহাসড়কে দূরপাল্লার যাত্রীবাহী যান চলাচলও বন্ধ হয়ে গেছে। মেরামতের অভাবে প্রায় একই অবস্থা ঢাকা-টাঙ্গাইল ও মির্জাপুর থেকে বঙ্গবন্ধু সেতু পর্যন্ত সড়ক, কুমিল্লা-ব্রাহ্মণবাড়িয়া সড়ক, ঢাকা-রাজশাহী মহাসড়কের বনপাড়া-হাটিকুমরুল অংশ ও যশোর-খুলনা মহাসড়ক। ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের সীতাকুণ্ড অংশের অবস্থাও বেশ নাজুক। সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তর (সওজ) সূত্র জানায়, এখনই মেরামত না করলে যেকোনো সময় এসব সড়কেও যান চলাচল বন্ধ হয়ে যেতে পারে। ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়ক বন্ধ হয়ে যাওয়ায় ঢাকার সঙ্গে গাজীপুর, শেরপুর, জামালপুর, ময়মনসিংহ, নেত্রকোনা, কিশোরগঞ্জ জেলার সঙ্গে সড়ক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে।

সওজ কর্মকর্তারাই বলছেন, দেশে বড় ধরনের বন্যা হলে সড়ক বন্ধ হয়, তবে সেটাও সাময়িক। কিন্তু বেহাল অবস্থার কারণে কোনো জাতীয় মহাসড়ক এভাবে বন্ধ হয়ে যাওয়ার নজির নেই। বাস বন্ধ থাকায় ঢাকা-ময়মনসিংহ ও ঢাকা-জামালপুর পথের ট্রেনগুলোতে যাত্রীদের উপচে পড়া ভিড়। মালবাহী যান চলাচলে বিঘ্ন ঘটায় নিত্যপণ্যের সরবরাহ কমে গেছে বলে জানিয়েছেন ওই পথ ব্যবহারকারী ব্যবসায়ীরা। ময়মনসিংহ চেম্বারের পরিচালক শংকর সাহা বলেন, দু-এক দিনের মধ্যে অবস্থার উন্নতি না হলে শহরে পণ্যের সংকট হতে পারে।

ঢাকা সড়ক পরিবহন সমিতির সাধারণ সম্পাদক ও ঢাকা-ময়মনসিংহ পথে চলাচলকারী এনা পরিবহনের স্বত্বাধিকারী খোন্দকার এনায়েত উল্লাহ প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা অপারগ হয়ে বাস বন্ধ করে দিয়েছি। কোটি টাকা দামের বাস এ পথে চালিয়ে ধ্বংস করার অর্থ নেই। মানুষের জানমালের ঝুঁকি তো আমরা নিতে পারি না। আমাদের আকুতি সরকারের কানে পৌঁছায় না। ’ মেরামতের অভাবে মহাসড়কের গাজীপুর অংশের চৌরাস্তা, মাওনা, শ্রীপুর, জাতীয় উদ্যানের ১ নম্বর গেট, বিমানবাহিনী গেট, চন্দ্রাবাজার ও ময়মনসিংহের ভালুকা অংশের সিড স্টোর বাজার, ভালুকা বাজারসহ অন্তত ৫০টি স্থানে বিশাল এলাকাজুড়ে গর্তের সৃষ্টি হয়েছে।

সরেজমিনে দেখা গেছে, এসব গর্তে বৃষ্টির কারণে হাঁটুপানি জমে আছে। যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের সচিব মোজাম্মেল হক খান গতকাল বৃহস্পতিবার রাতে ফোনে প্রথম আলোকে বলেন, তিনি গতকাল মহাসড়কটি পরিদর্শন করেছেন। এটি চলাচলের উপযোগী করার জন্য গর্ত ভরাট করার নির্দেশ দিয়েছেন, আর পুরোপুরি মেরামত হবে চার লেন প্রকল্পের অধীনে। চার লেনে ঠিকাদার নিয়োগের অনিয়ম বিষয়ে সচিব বলেন, দু-এক দিনের মধ্যে এই সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে। সারা দেশে মহাসড়কের বেহাল অবস্থা সম্পর্কে তিনি বলেন, বরাদ্দ কম বলে পারা যাচ্ছে না।

সওজের প্রকল্পে দুর্নীতি হয় বলে বরাদ্দ দেওয়া হয় না—এমন আলোচনা সম্পর্কে তিনি কিছু বলতে চাননি। ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়ক প্রকল্পে দুর্নীতি: এই মহাসড়কটি চার লেনে উন্নীত করা প্রকল্পের দরপত্র জালিয়াতির কারণে গাজীপুর অংশের ৩০ দশমিক ২৫ কিলোমিটার বাস্তবায়ন অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। সওজ সূত্র জানায়, গাজীপুর চৌরাস্তা থেকে ময়মনসিংহ পর্যন্ত মহাসড়কটির ৮৭ কিলোমিটার চার লেন করার লক্ষ্যে ৯০৫ কোটি টাকার প্রকল্প নেয় সরকার। গত জানুয়ারি মাসে চার প্যাকেজে (চার ভাগে) ঠিকাদারও নিয়োগ করা হয়। কিন্তু জয়দেবপুর থেকে মাওনা পর্যন্ত ৩০ দশমিক ২৫ কিলোমিটার অংশের দরপত্র-প্রক্রিয়ায় জালিয়াতির প্রমাণ পেলে কাজ বন্ধ হয়ে যায়।

এই অংশের জন্য ঠিকাদার নিয়োগ করা হয়েছিল চীনের হেবাই রোড অ্যান্ড ব্রিজ গ্রুপ কোম্পানি লিমিটেড (এইচআরবিসি) এবং বাংলাদেশের ইন্ট্রাকো বিডিকে। সওজ সূত্র জানায়, চুক্তি সইয়ের পর চীনা কোম্পানি এইচআরবিসি যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ে চিঠি দিয়ে জানিয়ে দেয়, তারা এই দরপত্রে অংশ নেয়নি। এরপর গত জুন মাসে যোগাযোগ মন্ত্রণালয় তদন্ত করে জানতে পারে, ইন্ট্রাকো চীনা কোম্পানির কাগজপত্র জাল করে জমা দিয়েছিল। যোগাযোগ মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে চুক্তি সই অনুষ্ঠানে যোগাযোগমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেন, মন্ত্রণালয়ের সচিব ও সওজের প্রধান প্রকৌশলী উপস্থিত ছিলেন, তবে চীনা প্রতিষ্ঠান এইচআরবিসির কোনো প্রতিনিধি ছিলেন না। সওজের এক কর্মকর্তা বলেন, যে প্রতিষ্ঠানের ৭০ ভাগ বিনিয়োগের কথা বলা হয়েছে, চুক্তি সই অনুষ্ঠানে সেই প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধি ছাড়া চুক্তি সই করা হয়েছে কীভাবে, তা বোধগম্য নয়।

তদন্ত করে প্রমাণ পাওয়ার পর ইন্ট্রাকোর সঙ্গে চুক্তি বাতিল, তাদের জমা দেওয়া ব্যাংক গ্যারান্টি কেটে রাখা এবং তাদের কালো তালিকাভুক্ত করার কথা বলেছিলেন যোগাযোগমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেন। তবে এখন পর্যন্ত চুক্তিই বাতিল হয়নি। তাই কাজও হচ্ছে না। সওজের একটি সূত্র জানায়, যোগাযোগ মন্ত্রণালয় ও সংস্থার কর্মকর্তাদের যোগসাজশেই ইন্ট্রাকো জালিয়াতি করার সাহস পেয়েছে। মোটা অঙ্কের কমিশন নেওয়ার কারণে ইন্ট্রাকোর বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া যাচ্ছে না।

গাজীপুরের মাওনা থেকে ত্রিশালের রায়মণি পর্যন্ত ২৯ দশমিক ৬০ কিলোমিটার চার লেন করার ঠিকাদার নিয়োগ দেওয়া হয়েছে এমবিইসি-পিবিএলকে (যৌথ)। তাদের সঙ্গে চুক্তি হয় প্রায় ২৮৪ কোটি টাকার। রায়মণি থেকে ময়মনসিংহ পর্যন্ত বাকি ২৭ দশমিক ৩৩ কিলোমিটারের কাজ পেয়েছে এসইএল-টিওএমএ (যৌথ)। তাদের সঙ্গে চুক্তি হয় ২৬৬ কোটি টাকার। সরেজমিনে দেখা গেছে, মাওনা থেকে ময়মনসিংহ অংশের বিভিন্ন স্থানে ঠিকাদারেরা সড়কের পাশের গাছ কাটা ও পাশে মাটিভরাটের কাজ করছে।

তবে মেরামতের কোনো উদ্যোগ নেই। সারা দেশে কোথায় কত কিলোমিটার সড়ক খারাপ: সওজ থেকে পাওয়া তথ্য ও আমাদের প্রতিনিধিরা সরেজমিনে ঘুরে জানান, ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কের ১২২ কিলোমিটারের পুরোটাই চলাচলের অনুপযোগী। এলেঙ্গা-মির্জাপুর ও মির্জাপুর-টাঙ্গাইল শহর পর্যন্ত প্রায় ১২০ কিলোমিটার সড়কে বড় বড় গর্তের সৃষ্টি হয়েছে। ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের সীতাকুণ্ডের সলিমপুর থেকে বড় দারোগার হাট পর্যন্ত প্রায় ৪০ কিলোমিটার রাস্তা খানাখন্দে ভরা। যশোর-খুলনা মহাসড়কের প্রায় ৬০ কিলোমিটারে একটু পর পর গর্তের কারণে এবড়োথেবড়ো।

খুলনা-সাতক্ষীরা মহাসড়কের প্রায় দুই কিলোমিটার পানিতে ডুবে গেছে। এই সড়কের প্রায় ৬০ কিলোমিটার পথ ব্যবহারের অনুপযোগী হয়ে পড়েছে। তালা-পাইকগাছা সড়কের ১০ কিলোমিটার দু-তিন ফুট পানির নিচে। ওই সড়ক দিয়ে এখন নৌকা চলাচল করে। সওজ ২০১০-১১ অর্থবছরে মহাসড়ক মেরামতের যে হিসাব করা হয়েছে তাতে বলা হয়, সারা দেশে অন্তত ৭০০ কিলোমিটার সড়ক জরুরি ভিত্তিতে মেরামত করতে হবে।

কিন্তু সওজ এসব সড়ক মেরামত করেনি। এখন টানা বর্ষণের কারণে এই মহাসড়কগুলোর অবস্থা আরও খারাপ হয়েছে। রাস্তার দুরবস্থার কারণে মহাসড়কেও যানজট তৈরি হচ্ছে আর দুর্ভোগের শিকার হচ্ছে মানুষ। ভাঙাচোরা সড়ক: সওজের অধীন জাতীয় মহাসড়ক, আঞ্চলিক মহাসড়ক ও জেলা সড়ক মিলে ১৮ হাজার কিলোমিটার পাকা সড়ক আছে। সওজের মহাসড়ক উন্নয়ন ও ব্যবস্থাপনা (এইচডিএম) সার্কেল সংস্থার অধীন সড়ক-মহাসড়কের দুরবস্থা এবং কোথায় কীভাবে মেরামত করতে হবে, সে বিষয়ে প্রতিবেদন প্রকাশ করে।

চলতি বছর এই বিভাগ সড়ক-মহাসড়কের দুরবস্থার তথ্য সংগ্রহ করেছে। তবে এখনো প্রতিবেদন তৈরি করেনি। তবে তথ্য সংগ্রহের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র জানায়, এবারের চিত্র ভয়াবহ। গতবার গড়ে ৪৫ শতাংশ রাস্তা খারাপ ছিল। এবার তা ৬৫-৮০ শতাংশে পৌঁছাবে।

এইচডিএম সার্কেলের গত ২০১০-১১ অর্থবছরের প্রতিবেদনে মেরামত করা দরকার, এমন সড়কের পরিমাণ উল্লেখ করা হয় প্রায় আট হাজার কিলোমিটার। ভাঙা এসব সড়ক মেরামতে গত অর্থবছরে বরাদ্দ চাওয়া হয় তিন হাজার ৩০০ কোটি টাকা। কিন্তু পায় ৬০০ কোটি টাকা। এইচডিএম সার্কেল সূত্র জানায়, অন্য সময় আঞ্চলিক মহাসড়ক ও জেলা সড়ক খারাপ থাকে। কিন্তু মেরামত না হওয়ায় এবার জাতীয় মহাসড়কের অবস্থাও বেহাল।

সারা দেশে জাতীয় মহাসড়ক আছে তিন হাজার ৪৯২ কিলোমিটার। গত বছরের হিসাবে এর মধ্যে ৭০০ কিলোমিটারে গভীর খানাখন্দ বলে উল্লেখ করা হয়। এবার এখনো হিসাব হয়নি, তবে সারা দেশের ৭০-৮০ ভাগ জাতীয় মহাসড়কই জরুরি ভিত্তিতে মেরামত দরকার বলে এইচডিএম সূত্র জানায়। ১৪০০ কোটি টাকার প্রকল্প হ-য-ব-র-ল: ‘দেশের ৬১ শতাংশ সড়ক বেহাল’ শিরোনামে প্রথম আলোতে প্রতিবেদন প্রকাশের পর গত মার্চ মাসে সওজের এক হাজার ৪০০ কোটি টাকার একটি প্রকল্প অনুমোদন দেয় সরকার। এই প্রকল্পের অধীনে সারা দেশের চার হাজার ৪৫৪ কিলোমিটার সড়ক-মহাসড়ক মেরামতের কথা ছিল।

দেড় বছরের মধ্যে প্রকল্প বাস্তবায়নের কথা। তবে গত পাঁচ মাসে এই প্রকল্পের অধীন উল্লেখ করার মতো কোনো কাজই হয়নি। সওজ সূত্র জানায়, এই প্রকল্পের জন্য গত অর্থবছরে বরাদ্দ ছিল ৫৭ কোটি টাকা। বর্তমান অর্থবছরে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে ৫০ কোটি টাকা। ফলে এই প্রকল্প বাস্তবায়ন অনিশ্চিত হয়ে গেছে।

যোগাযোগমন্ত্রী অর্থমন্ত্রীকে চিঠি দিয়ে সড়ক মেরামতে অর্থ ছাড়ের অনুরোধ জানিয়েছেন। যোগাযোগ মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, সওজের প্রকল্পে অর্থ ছাড় করার বিষয়ে অর্থ মন্ত্রণালয়ের কিছুটা অনীহা আছে। কারণ, এর আগে দুর্নীতির অভিযোগে বিশ্বব্যাংকের প্রকল্পের অর্থ ফেরত গেছে। সওজের বর্তমান প্রধান প্রকৌশলী শাহাবুদ্দিন বিলুপ্ত সত্য ও জবাবদিহিতা কমিশনে দুর্নীতির কথা স্বীকার করে জরিমানা দিয়ে মার্জনা পান। তাঁর বিরুদ্ধে ঢাকা বাইপাস সড়ক প্রকল্প ও মেঘনা-গোমতী সেতুর মেরামত ও রক্ষণাবেক্ষণকারী প্রতিষ্ঠান নিয়োগসহ নানা অনিয়মের অভিযোগে বেশ কয়েকটি বিভাগীয় মামলা হয়।

সূত্র জানায়, রক্ষণাবেক্ষণ খাতে সরকারি টাকা নয়ছয়ের অভিযোগ সওজ কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে। প্রধান প্রকৌশলীর বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ থাকায় আশঙ্কা আরও বেড়েছে। ফলে অর্থ ছাড়ে গড়িমসি করা হচ্ছে বলে মন্ত্রণালয়ে আলোচনা আছে। Click This Link ।

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।