আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

সেই ছেলেটা - এই ছেলেটা

আজ একটা গল্প শুনাব। ঠিক যেন শেষ বিকাল এর মত # ৮৯ * ইয়েস স্যার। # তোর নাম কি রে? * স্যার , নাদিম। # পুরো নাম বল * হাসান আল মামুন নাদিম। # আজকেই তো প্রথম আসলি রে ক্লাসে।

ক্লাসে আসতে কি পোকা কামড়ায়? * স্যার আমি আজকেই ভর্তি হলাম। আমাকে না বলে আমার সেকশনে ছাত্র ভর্তি করালো??? কত টাকা ঘুস দিয়ে ভর্তি করালো??? # দাঁড়িয়ে থাক। ছেলেটা চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকলো। আমাদের ক্লাস টীচার ফেরদৌস স্যার রোল কল করে চললেন। মারাত্তক সিরিয়াস মানুষ তিনি।

ভাবটা এমন, যেন দুনিয়ার সব চালাকি তিনি বুঝেন। ছাত্ররা তাকে ডাকতো ফেদু। নিজের মাথার পিছনে লম্বা বাবড়ি রেখে ছেলেপেলেদের বড় চুল কাচি দিয়ে কেটে দিতেও দ্বিধা হতনা তার। সিলেট থেকে নাদিমের বাবা বগুড়ায় ট্রান্সফার হয়ে আসার পর, তাকে বগুড়ার পুলিশ লাইন্স স্কুলে ভর্তি করে দেয়া হল। আজ তার নতুন স্কুলের প্রথম দিন।

প্রথম দিন এরকম একটা ওয়েলকাম পাবে , এমনটি আশা করেনি। স্যারের রোল কল করা শেষ হল। নাদিমের সাথে আরো কয়েকজন দাঁড়িয়ে আছে । কিছু ছাত্রছাত্রী দাঁড়িয়ে আছে ক্লাসের গেটের বাইরে, এরা লেট পার্টি। প্রতিদিন লেটে আসে আর পানিশমেন্ট পায়।

তাদের জন্য এটা খেলার মত। আরো কিছু ছাত্র কান ধরে ক্লাসের এক কোনে নিল ডাউন হয়ে আছে। এরা দুষ্ট গ্রুপ। রোল কলের মধ্যে ডিসটার্ব করার কারনে তাদের এই অবস্থা। স্যার প্রথমে নিলডাউন হয়ে থাকা ছাত্রদের স্পেশাল বেত দিয়ে কিছু উত্তম মধ্যম দিলেন ।

তারপর এক এক করে বেতের বাড়ি দিয়ে ক্লাসে ঢুকালের লেট লাইনারদের। এরপরে তিনি ফিরলেন নাদিম এর দিকে। নাদিমের মুখে ভয়ের লেশ মাত্র নেই, তার চেয়ে বিস্ময় বেশী। স্যার গলা উচু করে বললেন, প্রথমদিন ঔষধ দিয়ে দিবো। আর কোনদিন ক্লাস মিস হবেনা।

স্যারের হাতে মার খেতে হল নাদিমকে। স্যার কখনোই আস্তে মারতেন না। আওয়াজ কম হলেও মাইর গুলো মাশআল্লাহ । মাইর খেয়ে নাদিম চুপ করে বসে রইলো। পানিশমেন্ট দিতে দিতেই ক্লাস শেষ।

দুই ক্লাসের ভেতর যেটুকু সময় ক্লাসে টীচার থাকেনা, ওই টাইমটা ক্লাসের বস(:p) হইলো ক্লাস ক্যপ্টেন। সেই সময় ক্লাস ক্যপ্টেন ছিলাম আমি। সেদিনই নাদিমের সাথে প্রথম পরিচয়। ক্লাসে নতুন কোন ষ্টুডেন্ট আসলে একেক শ্রেনীর ছাত্রের একেক রকম কৌতুহল হয়। ছেলেটা অনেক ভালো ষ্টুডেন্ট নাতো? ছেলেটা খারাপ না ভালো? ছেলেটার সাথে বন্ধুত্ত করা যাবে কিনা? ছেলেটা কাদের সাথে মিশবে এসব নানান চিন্তায় থাকে ক্লাসের আগের ষ্টুডেন্টরা।

আমি বরাবরই প্রথম সারির ষ্টুডেন্ট ছিলাম। আর নাদিমকে দেখে আমার ভয় হয়নি। হাবাগোবা মার্কা চেহারা । তার চেহারায় মনে হয় লেখা আছে , " আমি একটা আস্ত ছাগল !! " :p । যাইহোক ।

আমি তাকে কখনোই পাত্তা দিতাম না। স্কুলে থাকতো ব্যক বেঞ্চার ছেলেপেলেদের সাথে। এর মধ্যে আমাদের এস এস সি পরিক্ষা হল। আমরা অনেকেই এ+ পেলাম। নাদিমও পেল।

সে কম্পিউটার কিনে নিল। এ সুবাদে আমার সাথে তার ভালো সম্পর্ক হল। ভালো সম্পর্ক হওয়ার আরো একটি কারন হল নাদিম এর মা। তার মা আর আমার মা এর মধ্যে অনেক ভালো সম্পর্ক ছিল। নাদিম মাঝে মাঝে আমার কাছ থেকে লেটেষ্ট সফটওয়ারের ডিস্ক নিয়ে যেত।

আর আমি তার কাছ থেকে গান নিতাম । নাদিমকে সিডি দেয়া মানে হল, ডিক্স যমুনা নদীতে ফেলে দেয়া। ওই ডিস্ক ফেরত পাওয়া কঠিন (অবশ্য আমিও তার কিছু ডিস্ক নিয়ে গায়েব করে ফেলেছি :p শোধবোধ) । কলেজ লাইফেও আমাদের সম্পর্ক সিডি এক্সচেঞ্জ এর মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। কিন্তু আসলে বুঝতেই পারিনি যে ছেলেটার সাথে আমার আসলেই অনেক ভালো বন্ধুত্ত হয়ে গিয়েছে।

বুঝলাম তখন, যখন নাদিম আর তারপরিবার একেবারে ঢাকা চলে গেল। এইচ এস সি পরীক্ষার পর পরেই নাদিমরা চয়ে যায়। সেদিন আমরা দুইজন একসাথে ছবি তুললাম। ততদিনে তার নাম ফেসবুক নাদিম হয়ে গেছে। হয়ত অনেকদিন দেখা হবেনা, কিন্তু ফেসবুকে যোগাযোগ হবে।

তার কয়েকদিন পরের ঘটনা। এস এস সি পরিক্ষার রেজাল্ট হল। আর আমার রেজাল্ট বিপর্যয়। (রেজাল্টটা না হয় নাই লিখলাম :p) । সিদ্ধান্ত নিলাম, ঢাকাতে প্রাইভেট ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হব।

চলে এলাম ঢাকায়। তারপর একদিন, নাদিমকে অনলাইনে পেলাম ফেসবুকে। তাকে বললাম, বাংলামটর এরিয়াতে আছি। সে অবাক! আরে ! আমি তো দিলু রোডে থাকি। আমি বললাম আজকে চলে আয়।

নাদিম আসলো। আমরা আশেপাশে ঘুরলাম। এরপর প্রায়ই আমরা ঘুরতে বের হতাম। একদিন মগবাজার রেললাইনের উপর বসে আছি। আমি বললাম , যায়গাটা জোস! নাদিম বললো , হুম, এখানে পোলাপাইনেরা আইসা সিগারেট খাই।

তুই সিগারেট খাস!!!! [আমি সত্যি অনেক অবাক হলাম । ] নিজের টাকা দিয়ে খাইনা তো। কেও খাওয়ালে খাই। ওইটাও বাদ দে। হুম বলে চুপ করে রইলো।

নাদিমের ইচ্ছা ছিলো শাহাজালালে ভর্তি হবে, কিন্তু চান্স পেলনা। ততদিনে আমার নর্থসাউথে ক্লাস শুরু হয়ে গেছে। নাদিম সিদ্ধান্ত নিল, নর্থসাউথেই ভর্তি হবে। পরের সেমিষ্টারে পরিক্ষা দেয়ার প্রস্তুতি নিতে লাগলো। আর আমাদের বিকালের এক্সপ্লোর ঢাকা অভিযানও চলতে লাগলো।

এমন একদিনের কথা। আমরা মগবাজারের চাংপাই রেষ্টুরেন্টের সামনে দিয়ে হেটে বাসায় যাচ্ছি, নাদিম আমাকে বললো , "দোস্ত ভালোবাসা অনেক মিষ্টি তাইনা?" আমি বললাম, হ্যা যতদিন ঝামেলা হবেনা, ততদিন মিষ্টি লাগবে। সেদিন থেকে একটা ব্যপার খেয়াল করলাম, যখনি নাদিম কে দেখি তার হাতে তার ফোনটা থাকে, আর সে কি যেন টাইপ করে। একদিন জিজ্ঞেস করলাম , আর সেদিন জানতে পারলাম একটা মেয়ের কথা, মেয়েটার সাথে তার পরিচয় ঢাকায় এসে। ভি এন সি তে পড়ে।

এর চেয়ে বেশী জানতে চাইতাম না। নাদিম ভার্সিটিতে ভর্তি হল। প্রতিদিন একসাথে বাসে ঝুলতে ঝুলতে ভার্সিটিতে যেতাম আর আসতাম। আর ছুটির দিনে ঘুরে বেড়াতাম। হটাত খেয়াল করা শুরু করলাম, নাদিম কেন যেন খাপছাড়া।

মাঝে মাঝেই অনেক মন খারাপ থাকে , আর আনমনে এস এম এস করে চলে মেয়েটাকে। জিজ্ঞেস করলে বলে , কিছুনা। আরো একটা জিনিস খেয়াল করলাম, ছেলেটা নিজের পকেটের টাকায় সিগেরেট খেতে শুরু করছে। আমরা প্রতিদিন আসার সময় বেইলী রোড ঘুরে বাসায় ফিরতাম এ আশা যদি একবার নাদিমের মেয়েটার সাথে দেখা হয়ে যায়। এভাবেই আমাদের দিন কাটতে লাগলো।

আর দিন দিন দেখলাম ছেলেটার এস এম এস করার আর সিগেরেট খাওয়ার রেট বাড়তে লাগলো। থার্ড সেমিষ্টারে আমি চলে এলাম বসুন্ধারায়, আর নাদিম হয়ে গেল একলা। সারাদিন ঘুমায় আর ডাউনোলোড করে। আরেকটা নতুন ভুতে পাইছে, কার্টুন দেখা। :@ ঘন্টার পর ঘন্টা বসে জাপানী উদ্ভট কার্টুন দেখে।

আর আমার সাথে দেখা হয় ভার্সিটিতে। তার সিগেরেট খাওয়ার মাত্রা অনেক বেশী হয়ে গেছে। আমি তার সাথে লাষ্ট যে এক ঘন্টা ছিলাম তার মধ্যে ৪ টা গোল্ডলিফ একটা বেন্সন শেষ। যখন একা থাকে কার্টুন দেখে, আর মোবাইল নিয়ে শুধু এস এম এস করে। দাড়ি কাটেনা।

ছেলেটাকে দেখলেই মনটা খারাপ হয়ে যায়। আমি আমার আগের বন্ধুকে ফেরত চাই। যে স্মোকিং করেনা। এস এম এস এক্সচেঞ্জ করে মাথা খারাপ করেনা। আর স্পেশালী, আজাইরা ফাউল কার্টুন দেখেনা।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।