আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

হাঙ্গেরি—দানিয়ুব মুক্তার দেশে

শ্রদ্ধা আর মমতাই তোমাকে জয়ী করতে পারে; তুমি তোমার জ্ঞান প্রয়োগ কর। কৃষ্ণসাগরের উত্তরপূর্বে স্তেপের উচ্চভূমি থেকে ধেয়ে আসে তারা, ক্ষীপ্র অশ্বের খুড়ের আঘাতে ধুলির ঝড় উঠিয়ে, ভয়ালদর্শন ধনুক থেকে বৃষ্টির মতো তীর ছুঁড়তে ছুঁড়তে। উরাল নদী থেকে রাইন অববাহিকা, বাল্টিক সাগর থেকে দানিয়ুব, এশিয়া-ইউরোপের সুবিশাল ভূখণ্ড পদানত হয় তাদের, পথে পথে পড়ে থাকে নির্মম ধ্বংসযজ্ঞের ছাপ। কনস্ট্যান্টিনোপলের দেয়াল ভেদ করে, বলকানের জনপদ ছাড়িয়ে, রোমের দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে তারা—পবিত্র রোমান সাম্রাজ্যের ধ্বংস সময়ের ব্যাপার মাত্র। পোপ প্রথম লিও দূত পাঠান তাদের সম্রাটের কাছে, রক্তযজ্ঞ শুরু হওয়ার আগে একান্তে কিছু কথা বলতে চান তিনি।

রোমের দেয়ালের বাইরে দাঁড়িয়ে কী কথা বলেছিলেন পোপ লিও, কেউ জানে না, কিন্তু শকদের(Scythian) সম্রাট, অ্যাটিলা—অ্যাটিলা দ্য হান (?–৪৫৩ খ্রি.), পশ্চিমা ইতিহাসবিদগণ যাকে স্রষ্টার চাবুক (Scourge of God) হিসেবেই অভিহিত করেন, ঘুরিয়ে নেয় তার অশ্বের মুখ, বেঁচে যায় পবিত্র রোমান সাম্রাজ্য। এর অনতিকাল পরেই মারা যায় অ্যাটিলা। শিল্পীর চোখে অ্যাটিলা হান সাম্রাজ্যের জার্মান গোত্রগুলোর প্রতিশোধ নেবার পালা এবার, শুরু হয় হান-জার্মান রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ। দানিয়ুব নদীর কার্পাথিয়ান অববাহিকার পূর্ব তীরের হান বসতিগুলো পাহারা দিতে থাকে যেকেলি গোত্র, আর অ্যাটিলার পুত্রগণ চালিয়ে যেতে থাকে হান সাম্রাজ্যের শত্রুদের বিরুদ্ধে একের পর এক যুদ্ধ। অ্যটিলার কনিষ্ট পূত্র সাবা ফিরে যায় পূর্ব দিকে, কথা দেয় যেকেলিদের—শক্তি সংগ্রহ করে শীঘ্রই ফিরে আসবে সে, রক্ষা করবে তার হান ভাইদের, প্রাণপণে তারা যেন টিকিয়ে রাখে হান দেয়ালগুলো।

সাবা তার প্রতিশ্রুতি রক্ষা করেছিল। এমনকি আকাশের তারকারাজিদের মধ্যে সাবা তার পূর্বপুরুষদের সাথে মিলিত হবার বহু যুগ পরও অদম্য হান সেনারা বার বার ফিরে আসে ওপারের জগত থেকে, আকাশগঙ্গার তারকাখচিত পথ ধরে, হাঙ্গেরিয়ানরা যাকে বলে হাদাক উৎযা, যোদ্ধাদের পথ। শিল্পীর চোখে, আকাশগঙ্গার পথ ধরে যুগে যুগে হানদের আগমন অ্যাটিলার মৃত্যুর সাড়ে চারশ বছর পর পূর্ব দিক থেকে সাতটি ভয়ঙ্কর গোত্র আসে দানিয়ুব অববাহিকায়, তাদের যুবরাজ আরপাদের (Árpád, আনু. ৮৪৫–আনু. ৯০৭ খ্রি.) নেতৃত্বে। এদের আগমন ঘটে এমন এক স্বপ্নের হাত ধরে, যা অবলোকন করেছিলেন ইমেস, আরপাদের দাদী, বহু বছর আগে। পবিত্র তুরুল পাখি আসে ইমেসের স্বপ্নে, ইমেসের শরীর থেকে বইতে থাকে স্ফটিকস্বচ্ছ এক জলের ধারা, সে ধারা বইতে থাকে পশ্চিমে, বড় হয় ধারা, এক সময় তা পরিণত হয় বিশাল এক স্রোতস্বিনীতে।

তোমার গর্ভ জন্ম দেবে এক রাজবংশের, হানদের হৃত গৌরব পুনরুদ্ধার করবে তারা, যাদের আবাস হবে পশ্চিমে, একদা যেখানে ছিল অ্যাটিলার রাজধানী—গোত্রের জ্ঞানীপুরুষেরা ব্যক্ত করে স্বপ্নের বেদ। আরপাদের গোত্রসমূহ, নিজেদের যারা বলে মাদিয়ার (Magyar), এভাবেই নিশ্চিত করে হানদের সাথে তাদের রক্তসম্পর্ক, এবং সেই ভবিষ্যদ্বাণী, মাদিয়ার গোষ্ঠি একদিন পুনর্দখল করবে তাদের পিতৃপুরুষের ভূমি, অ্যাটিলার সুবিশাল হান সাম্রাজ্যের যথার্থ উত্তরসূরী হিসেবে। শিল্পীর চোখে, কার্পাথিয়ান অববাহিকায় আরপাদের নেতৃত্বে মাদিয়ার তথা হাঙ্গেরীয়দের সাতটি গোত্রের আগমন কিন্তু এসবই কিংবদন্তি আর পুরাণের কথা! বাস করে ইউরোপের কেন্দ্রস্থলে, অথচ ঠিক ইউরোপিয়ানদের মতো নয় তারা। কথা বলে জটিল অনন্য এক ভাষায়, পার্শ্ববর্তী দেশগুলোর ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষার সাথে যা মেলে না মোটেও, যার কিছুটা মিল পাওয়া যায় সুদূর বাল্টিক তীরের ফিনল্যান্ড ও এস্তোনিয়া এবং নরওয়ের উত্তরে সামী গোত্রের ভাষার সাথে। কেবল ভাষাগত মিল দেখে ইতিহাসবিদগণ বলেন, আরপাদের পূর্বপুরুষগণ বাস করত দক্ষিণ উরাল পর্বতের পাদদেশে, সেখান থেকেই এসেছে তারা; কিন্তু তাদের কিংবদন্তি ও পুরাণ বলে, তারাও বিশ্বাস করে, তাদের পূর্বপুরুষেরা এসেছে এশিয়ার শকভূমি (Scythia) থেকে, এবং হয়তো মেসোপটেমিয়া (Iraq) থেকে পার্থিয়া (Iran) হয়ে।

ইতিহাস পুরাণ রেখে একটু হাঁটা যাক: বুদাপেস্ট (Budapest) বুদা, অবুদা ও পেস্ট—তিনটি শহর মিলে বুদাপেস্ট, আজকের হাঙ্গেরির রাজধানী। পশ্চিম তীরে নির্জন পাহাড়ী পৌরাণিক বুদা, পূর্ব তীরে তুলনামূলক আধূনিক ব্যস্ত পেস্ট, মাঝখানে প্রবাহমান স্নিগ্ধ দানিয়ুব। মানুষ আদর করে বুদাপেস্টকে ডাকে দানিয়ুবের মুক্তা—রাতের ঝলমলে আলোয় শান্ত নদীর দিকে তাকালে কথাটি সত্যিই মনে হয়। আহ্, বুড়িগঙ্গা, আহ্‌ ঢাকা! বুদা শহরে ঢোকার মুখের সুড়ঙ্গ সুড়ঙ্গের বাম পাশে ছোট্ট একটি গাছের গোড়া হচ্ছে হাঙ্গেরির শূন্য বিন্দু—দেশের সকল পথ এখানে এসে মিলিত হয়, রোমে নয়। এখান থেকেই হাঙ্গেরির বিভিন্ন স্থানের দূরত্ব পরিমাপ করা হয়।

সুড়ঙ্গের উপরে পাহাড়ের উঁচুতে দালানটি হাঙ্গেরির রাষ্ট্রপতির ভবন, শান্দর পালোটা (Sándor palota)। ১৮০৬ সালে নির্মিত এ ভবনটি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ধ্বংস হয়ে যায়, পরে ২০০২ সালে নতুন করে নির্মাণ করা হয়। সুড়ঙ্গের বাম পাশ থেকে রজ্জুরেলে (funicular) চড়ে কিংবা সিঁড়ি ধরে পাহাড়ে উঠা যায়, আবার সুড়ঙ্গের উল্টোপ্রান্ত থেকে সরাসরিও আসা যায়। তবে রজ্জুরেল ভ্রমণের আলাদা আকর্ষণ রয়েছে। বামপাশে উড়ন্ত যে পাখিটি দেখা যাচ্ছে, তার নাম কী? জেলেদের বেষ্টনী (Fisherman's Bastion) দানিয়ুব ও পেস্ট শহরের সবচেয়ে সুন্দর দৃশ্য দেখতে চাইলে পর্যটকদের জন্য বুদাতীরবর্তী জেলেদের বেষ্টনীতে যাওয়া অবশ্য কর্তব্য।

সুড়ঙ্গের ডান দিকে, রাষ্ট্রপতি ভবনের উল্টো দিকে অনতিদূরে এ চত্বরটি অবস্থিত। এটিও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে প্রায় ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল, পরে সংস্কার করা হয়। মধ্যযুগে এ পাড়ের জেলেরা বুদার দেয়ালগুলোকে রক্ষা করত, তাদের সম্মানার্থে চত্বরটির এরূপ নামকরণ। চত্বরটিতে মোট ৭টি গম্বুজ রয়েছে, যার প্রতিটি আরপাদের নেতৃত্বে বসতি গড়া মাদিয়ারদের ৭টি গোত্রের একেকটিকে নির্দেশ করে। দরবেশ সম্রাট ইস্তবান (Stephen I of Hungary) জেলেদের বেষ্টনীতে ঢোকার মুখেই দাঁড়িয়ে আছেন সম্রাট ইস্তবান (আনু. ৯৬৭—১০৩৮ খ্রি.), আরপাদের পৌত্র, হাঙ্গেরি সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা।

পোপের আশীর্বাদপুষ্ট পবিত্র মুকুট পরিধান করে সিংহাসনে আরোহণ করেন তিনি, তাঁর সময়েই হাঙ্গেরিতে খ্রিস্টধর্মের প্রসার ঘটে। ইস্তবানের পবিত্র মুকুট পরিধান করাকে হাঙ্গেরিবাসীগণ বিশ্বাস করে অ্যাটিলাকে দেয়া পোপের প্রতিশ্রুতির বাস্তবায়ন: আজকে যদি রোমকে ধ্বংস না করে ফিরে যাও তুমি, তোমার বংশধরদের মস্তকে শোভা পাবে একদিন পবিত্র মুকুট। ম্যাথিয়াস গির্জা (Matthias Church) ইস্তবানের মূর্তির ঠিক সামনেই 'চার্চ অব আওয়ার লেডি' ভবন, সাধারণভাবে ম্যাথিয়াস গির্জা নামে পরিচিত। জনশ্রুতি আছে, ইস্তবান এটি প্রথম নির্মাণ করেন, যদিও ত্রয়োদশ শতকের পূর্বে এখানে গির্জার অস্তিত্মের প্রমাণ পাওয়া যায় না। পঞ্চদশ শতকের জনপ্রিয় সম্রাট ম্যাথিয়াস এর ব্যাপক সংস্কার সাধন করেন, তাই বর্তমানে এটি তাঁর নামে পরিচিত।

শৃঙ্খল সেতু (Chain Bridge ) সুড়ঙ্গের ঠিক উল্টো দিকে, বুদা ও পেস্টের সংযোগকারী প্রথম সেতু, ১৮৪৯ খ্রিস্টাব্দে উন্মুক্ত হয়। পরে অবশ্য আরো ৮টি সেতু নির্মিত হয়, কিন্তু হাঙ্গেরিতে এর মর্যাদা অনন্য। বিকেলের দানিয়ুব শৃঙ্খল সেতুর বুদা প্রান্ত থেকে তোলা। বাম পাশে পেস্টের তীরে হাঙ্গেরির সংসদভবন দেখা যায়। ইস্তবান ব্যাসিলিকা (St. Stephen's Basilica) পেস্ট শহরে ১৯০৫ খ্রিস্টাব্দে নির্মিত এ ভবনটি হাঙ্গেরির সবচেয়ে জনপ্রিয় গির্জা।

উচ্চতায় এটি হাঙ্গেরির সংসদভবনের সমান, যা পার্থিব ও আধ্যাত্মিক চিন্তার সমান গুরুত্ব নির্দেশ করে। এর ভেতরে ন্যায়বিচারের প্রতীক হিসেবে সম্রাট ইস্তবানের মমিকৃত ডান কব্জিটি সংরক্ষিত। বীরদের চত্বর (Hősök tere) দানিয়ুব থেকে কয়েক কিলোমিটার দূরে পেস্ট শহরে অবস্থিত হাঙ্গেরির জাতীয় চত্বর। 'আরপাদের নেত্বত্বে মাদিয়ারদের আগমনের সহস্র বর্ষ' উদযাপনকালে, ১৮৯৬ খ্রিস্টাব্দে এটি নির্মিত হয়। সামনের উঁচু কলামটিতে ফেরেশতা গ্যাব্রিয়েল ইস্তবানের পবিত্র মুকুট ধরে রেখেছেন।

কিংবদন্তি বলে, ইস্তবানের স্বপ্নে গ্যাব্রিয়েল দেখা দিয়ে তাঁকে মুকুট উৎসর্গ করেন। গ্যাব্রিয়েলের নীচে আরপাদের নেতৃত্বে মাদিয়ার গোত্রসমূহের নেতাগণ অশ্বপৃষ্ঠে আসীন। পেছনে, বামে ও ডানে বৃত্তচাপের মধ্যে হাঙ্গেরির জাতীয় বীর ও বিখ্যাত সম্রাটগণ। রাতের দানিয়ুব পেস্ট তীরে একটি জলযান থেকে তোলা, শৃঙ্খল সেতুর একাংশ, দুর্গ জেলা এবং ম্যাথিয়াস গির্জার একটি গম্বুজ। দুর্গ জেলা (Castle Hill/District) বুদা সুড়ঙ্গের উপরে দুপাশে বিস্তৃত, এককালে হাঙ্গেরির প্রধান দুর্গ হিসেবে কাজ করত।

পেছন দিকে রোমান আমলের ধ্বংসাবশেষ রয়েছে। হাঙ্গেরি রোমান সাম্রাজ্যের পূর্ব সীমা হিসেবে বহু বছর খ্যাত ছিল, তখন এর নাম ছিল প্যানোনিয়া। বর্তমানে এখানে রয়েছে জাতীয় শিল্পভবন, জাতীয় গ্রন্থাগার, ঐতিহাসিক জাদুঘর, রাষ্ট্রপ্রধানের ভবন। ভবনে ঢোকার মুখেই পাহাড়া দিচ্ছে পূর্বে দেখা সেই তুরুল পাখিটি, তার থাবায় চকচকে তলোয়ার। হাঙ্গেরির সবচেয়ে জনপ্রিয় পাখি তুরুল, জাতীয়তাবাদের প্রতীক।

ম্যাথিয়াস ঝর্ণা বিশাল এলাকা নিয়ে দুর্গ শহর, দেখার আছে অনেক কিছু। ফেরার পথে একটি স্থাপত্য আর কিংবদন্তি মন খারাপ করে দিল খুব। তরুণ ম্যাথিয়াস, হাঙ্গেরির সবচেয়ে জনপ্রিয় সম্রাট, বের হয়েছেন গোপন মৃগয়ায়, সঙ্গে পারিষদবর্গ, সৈন্য-সামন্ত। রাজার সামনে হঠাৎ পড়ে যায় গাঁয়ের কৃষকের মেয়ে, সেপ ইলোনকা। মেয়েটি ভালোবেসে ফেলে তরুণ সম্রাটকে, কিন্তু যখন বুঝতে পারে অপরিচিত এ যুবক আসলে তাদেরই রাজা, গভীর কষ্টে ভেঙে যায় তার বুক—এ মিলন যে হবার নয়।

ভগ্ন হৃদয়েই মারা যায় একদিন অভাগী মেয়েটি। ঝর্ণার উঁচুতে মৃত হরিণের উপর দাঁড়িয়ে রাজা, নীচে ডানপাশে আলো-আঁধারিতে সেপ ইলোনকা। ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।