আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

নষ্ট শিক্ষকঃ ইমদাদুল হক মিলন

ভিকারুননিসা নূন স্কুলের বসুন্ধরা শাখার পাঁচজন শিক্ষক মিলে একটা কোচিং সেন্টার করেছেন। স্কুলের কাছে একটি ফ্ল্যাটে কোচিং সেন্টার। পরিমল স্যারের কোচিং সেন্টার নামেই পরিচিত। পরিমলের পুরো নাম পরিমল জয়ধর। তিনি বাংলার শিক্ষক।

মে মাস থেকে একজন ছাত্রী তাঁদের ওখানে কোচিং করতে যায়। কয়েক দিন আগে একদিন মেয়েটি একটু দেরি করে গেছে। পরিমল তাকে বললেন, 'দেরি করে এসেছ, কোনো অসুবিধা নেই। অপেক্ষা করো, আমি তোমার পড়াটা করিয়ে দিচ্ছি। ' অন্য ছাত্রীরা চলে যাওয়ার পর পরিমল দরজা বন্ধ করে দেন।

মেয়েটি কিছু বুঝে ওঠার আগেই তার মুখ বেঁধে ফেলেন। মেয়েটি হাত-পা ছোড়াছুড়ি শুরু করলে ওড়না দিয়ে তার দুহাত বেঁধে ফেলেন। গায়ের জামা-কাপড় খুলে তার ছবি তোলেন, তারপর চালান পাশবিক নির্যাতন। মেয়েটিকে ভয় দেখান, এই ঘটনা কাউকে জানালে ইন্টারনেটে তার ছবি ছেড়ে দেওয়া হবে। ১৭ জুন পরিমল এই কাণ্ড করলেন।

১৯ জুন ছাত্রীটি তার সহপাঠীদের ঘটনা জানায়। ২১ জুন শাখাপ্রধানকেও ঘটনা জানায় ছাত্রী। তিনি আশ্বাস দেন, বিষয়টি দেখবেন। তার পরও পরিমল স্কুলে ক্লাস নিতে এলে ক্লাস টেনের সব ছাত্রী ২৮ জুন লিখিতভাবে বিষয়টি অধ্যক্ষকে জানায়। তত দিনে ঘটনা জানাজানি হয়ে গেছে।

ছাত্রীর পরিবার মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে গেছে। বাবা গেছেন অসুস্থ হয়ে। মেয়েটিকে নিয়ে গভীর দুশ্চিন্তায় পড়েছে তার পরিবার। ইতিমধ্যে পরিমলের বিরুদ্ধে বাড্ডা থানায় নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে মামলা হয়। গোয়েন্দা পুলিশ পরিমলকে গ্রেপ্তার করে পাঁচ দিনের রিমান্ডে নিয়েছে।

দেশের মানুষ এই ঘটনা জেনেছে খবরের কাগজের মাধ্যমে, টিভি চ্যানেলগুলোর মাধ্যমে। ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজ পরিচালনা পর্ষদের সভাপতি বিখ্যাত রাজনীতিক ও সাংসদ রাশেদ খান মেনন। নির্যাতিতা ছাত্রীটি তার নির্যাতনের পুরো ঘটনা বর্ণনা করে মেনন সাহেবকে লিখেছে, 'ব্যাপারটা আপনার সুবিবেচনায় এনে আমার ওপর পরিমল স্যার যে বর্বরোচিত, অমানবিক, অনৈতিক, ঘৃণিত ও পাশবিক আচরণ করেছেন, তার দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি ও বিচারের দাবি জানাচ্ছি। ' ছাত্রীটি তার পরিবারকে এই ঘটনা জানানোর আগে স্কুলের অধ্যক্ষ ও শাখাপ্রধানকে জানিয়েছিল। ছাত্রীটিকে তারা থানা ও মিডিয়ার কাছে মুখ খুলতে নিষেধ করেছিল।

এমনকি ছাত্রীর মা ও বোনকেও নাকি অধ্যক্ষ ফোন করে ছাত্রীর পরিচয় প্রকাশ না করার পরামর্শ দেন। আমার দুই মেয়ে ভিকারুননিসায় পড়ত। বড় মেয়ে এখন এমবিএ করছে, ছোটটি ইন্টারমিডিয়েট দিল, ভিকারুননিসা থেকেই। নব্বইয়ের দশকের শুরুর দিকে বড় মেয়েকে যেদিন ভিকারুননিসার মূল শাখায় ক্লাস ওয়ানে ভর্তি করালাম, সেই দিনটি আমার জীবনের একটি স্মরণীয় দিন। আমি খুবই গৌরব বোধ করেছিলাম, আমার মেয়ে ভিকারুননিসায় ভর্তি হয়েছে।

বহু জায়গায় অহংকার করে বলতাম, আমার মেয়ে ভিকারুননিসার ছাত্রী। থাকি গেণ্ডারিয়ায়, লেখক হিসেবে দাঁড়ানোর প্রাণান্তকর চেষ্টা করছি। অতিকষ্টে জীবন চলে, তাও স্কুটারে করে, রিকশায় করে মেয়েকে নিয়ে সিদ্ধেশ্বরীতে আসতাম। কখনো আমি, কখনো আমার স্ত্রী। এমনও হয়েছে, মেয়েকে স্কুলে দিয়ে আমি চ্যানেল আইয়ের অফিসে ফরিদুর রেজা সাগরের রুমে বসে থেকেছি, মেয়ের ছুটি হয়েছে তাকে নিয়ে গেণ্ডারিয়ায় ফিরেছি।

কখনো বসে থেকেছি আফজাল ও আরেফিনের বিজ্ঞাপনী প্রতিষ্ঠান 'মাত্রা'য়। তারপর মেয়েদের স্কুলের সুবিধার জন্য মগবাজারের এমন এক জায়গায় চলে এলাম, যেখান থেকে হেঁটে পাঁচ মিনিটে মেয়েরা স্কুলে যেতে পারে। ভিকারুননিসা বাংলাদেশের একটি সেরা ও অভিজাত স্কুল। শুরু থেকেই অত্যন্ত সুনামের সঙ্গে পরিচালিত হয়ে আসছে স্কুলটি। একসময় হামিদা আলী ছিলেন অধ্যক্ষ।

তাঁর কর্মদক্ষতা ও পরিচালনক্ষমতায় স্কুলটি শ্রেষ্ঠ থেকে শ্রেষ্ঠতর হয়ে উঠেছিল। যেকোনো অভিভাবক তাঁর কন্যাসন্তান নিয়ে স্বপ্ন দেখতেন, কন্যাটি যেন তাঁর ভিকারুননিসায় পড়তে পারে। আমার বড় মেয়েকে ভর্তি করানোর পর বিখ্যাত অভিনেতা হুমায়ুন ফরীদি বলেছিলেন, 'মেয়ের লেখাপড়া নিয়ে তোকে আর পেছন ফিরে তাকাতে হবে না। ' সত্যি আমাকে আর তাকাতে হয়নি। দিনে দিনে বেশ কয়েকটি শাখা হলো ভিকারুননিসার।

দক্ষ শিক্ষকদের পরিচালনায় স্কুলটি তার সুনাম ধরে রাখল, বৃদ্ধি করতে লাগল। এসএসসি, এইচএসসির ফলের ক্ষেত্রে দেশের প্রথম দু-তিনটি স্কুলের মধ্যে থাকে প্রতিবছরই। এ বছরও ফল আগের মতোই। ফলের ক্ষেত্রে পুরো সুনামই ভিকারুননিসা ধরে রেখেছে। সেই স্কুলে ঘটল এ রকম ঘটনা? এই ঘটনায় সারা দেশ কেঁপে উঠেছে।

অভিভাবকরা আতঙ্কিত হয়েছেন, ক্ষুব্ধ হয়েছেন, প্রতিবাদে ফেটে পড়ে রাস্তায় নেমেছেন। নির্যাতিত ছাত্রীটির পিতামহ অনেক অভিযোগের সঙ্গে গভীর দুঃখ নিয়ে বলেছেন, 'ভিকারুননিসা নূন স্কুলের মতো অভিজাত ও নিরাপদ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যদি শিক্ষকের কাছে ছাত্রী ধর্ষিত হয়, তাহলে আমরা অভিভাবকরা কোথায় যাব?' ঘটনা জানাজানি হওয়ার পর স্কুল কর্তৃপক্ষ নড়েচড়ে বসেছে। আরো কয়েকজন শিক্ষকের ব্যাপারেও ব্যবস্থা নিয়েছে। প্রশ্ন হচ্ছে, এত দিন তারা কী করেছে? এই একটি ঘটনার মধ্য দিয়ে বোঝা যায় যে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটিতে এই ধরনের সমস্যা ছিল। কর্তৃপক্ষ সচেতন হয়নি কেন? কর্তৃপক্ষের কী জানা ছিল না মেয়েদের একটি স্কুলে এ ধরনের বিষয়ের প্রতি তীক্ষ্ন নজর রাখা প্রয়োজন? কর্তৃপক্ষ সচেতন হলে কি এ ধরনের ঘটনা ঘটে? শিক্ষকদের আমরা জানি মানুষ গড়ার শিল্পী হিসেবে।

সেই শিল্পীদের কেউ কেউ এতটা জঘন্য ও ঘৃণিত হয়ে উঠেছেন! প্রায়ই এই ধরনের সংবাদ আজকাল আমাদের চোখে পড়ছে। দেশের কোনো কোনো বিশ্ববিদ্যালয়েও ঘটতে শুনছি ছাত্রী নির্যাতনের ঘটনা, স্কুল-কলেজ-মাদ্রাসায় ঘটছে একই ঘটনা। যে শিক্ষকরা আলোর পথ দেখাবেন, সেই শিক্ষকরাই বিষিয়ে তুলছেন কারো কারো জীবন। এই যে ছাত্রীটির ক্ষেত্রে ঘটনাটি ঘটল, ছাত্রীটিকে যে সারাটা জীবন বয়ে বেড়াতে হবে এই ভয়ংকর স্মৃতি ও বেদনা, তার জীবনের আনন্দকে যে পুরোপুরি হত্যা করলেন শিক্ষকের আড়ালে লুকিয়ে থাকা একটি পশু, এই দায়ভার কী করে বইবে মেয়েটি? শিক্ষকরাও কেউ কেউ কেন এভাবে নষ্ট হয়ে গেলেন? আমরা এখন কার কাছে যাব, কোথায় যাব? কে দেখাবে আলোর পথ? আমাদের কালের কণ্ঠের 'শুভসংঘ' বিভাগে 'শিক্ষক ফোরাম' নামের একটি সংগঠন আছে। দেশের সব শিক্ষককে একত্র করে তাঁদের মাধ্যমে দেশের মানুষকে শুভ কাজে সম্পৃক্ত করার চেষ্টা পত্রিকাটির জন্মলগ্ন থেকেই আমরা করে আসছি।

কারণ আমরা বিশ্বাস করি, শিক্ষকরাই মানুষ তৈরি করেন, শিক্ষকরাই জাতিকে নিয়ে যান আলোর পথে। পরিমলের মতো দু-চারজন নষ্ট শিক্ষকের জন্য সমগ্র শিক্ষকসমাজের ওপর মানুষের বিশ্বাস নষ্ট হবে না, আমরা তা বিশ্বাস করি। আমরা বিশ্বাস করি, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পরিচালনা পর্ষদ ও প্রধানরা সচেতন হলে, ব্যক্তিস্বার্থের কথা না ভেবে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের স্বার্থের কথা ভাবলে, ছাত্রছাত্রীদের নিরাপত্তার কথা ভাবলে এই ধরনের নষ্ট ঘটনা আর ঘটবে না। সবশেষে পরিমল জয়ধর নামের শিক্ষকটির (!) উদ্দেশে শুধু একটি কথাই বলতে চাই, ছিঃ, পরিমল ছিঃ। ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।