আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

শেখ হাসিনার ভালোর পসরা---------

বিগত ২৭ জুন ২০১১ তারিখে ‘ভালোর পসরা’ নামে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার একটি রচনা একইসঙ্গে ঢাকার বেশ কয়েকটি প্রথম সারির বাংলা সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয়েছে। একইসঙ্গে এই ধরনের কোনো রচনা সাধারণত প্রকাশিত হয়ে থাকে কোনো বিশেষ দিবস উদযাপন উপলক্ষে সরকারি বিজ্ঞাপন হিসেবে। ওপরে উল্লিখিত রচনাটি কোনো সরকারি বিজ্ঞাপন না হলেও অনেকগুলো পত্রিকায় এটি একইসঙ্গে ছাপার কারণ এটি পত্রিকাগুলোতে পাঠানো হয়েছে সরাসরি প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে। এদিক দিয়ে রচনাটিকে বলা চলে বিনাপয়সায় প্রকাশিত এক ধরনের বিজ্ঞাপন। ক্ষমতায় থাকার সুবিধা অনেক! শেখ হাসিনা অবশ্যই একজন সুলেখিকা।

কিন্তু ‘ভালোর পসরা’ রচনাটি তিনি যেভাবে শুরু করেছেন ‘ভালো চাই, ভালো ভালো নেবেন গো ভালো? আরও ভালো’ এর মধ্যে হাল্কা রসিকতার ভঙ্গিতে যে অশ্লীলতাটুকু আছে সেটা এতে না থাকলেই একজন প্রধানমন্ত্রীর পক্ষে মানানসই হতো। কিন্তু এ নিয়ে কিছু বলে বিশেষ লাভ আছে মনে হয় না, কারণ এটা তাঁর নিজস্ব স্টাইলের ব্যাপার! এই রচনার মূল বিষয় দুটি। প্রথমত. নিজের সরকারের আমলে তিনি যেসব কাজ করেছেন তার একটা তালিকা প্রদান করা। দ্বিতীয় বিষয়টি হলো, তিনি যতই ভালো কাজ করে যান এক শ্রেণীর লোকের কাছে তার কোনো স্বীকৃতি নেই। উপরন্তু এরা তাঁর ও তাঁর দলের সব রকম ভালো কাজেরই নিন্দুক।

এঁদের সম্পর্কে তিনি বলছেন, ‘লেখালেখি, মধ্য রাতের টেলিভিশনে টক শো, গোল টেবিল, লম্বা টেবিল, চৌকো টেবিল, সেমিনার কোথায় নেই তারা? বোঝা যায় এসব লেখালেখি ও আলোচনাতে হাসিনার বেশ অসুবিধা হচ্ছে, স্বাভাবিকভাবে বিরক্তিও হচ্ছে। এই বিরক্তি প্রকাশ করতে গিয়ে তিনি বলছেন, ‘তাদের এই কথার ফুলঝুরি কি সবসময় অব্যাহত থাকে?’ সব সরকারের আমলে? না, তা শোনা যায় না। যেমন ধরুন সামরিক সরকারগুলোর সময় তাদের কলমের কালি বা রিফিল থাকে না। কলম চলে না। মুখে কথা থাকে না।

’ (সমকাল, যুগান্তর, সকালের খবর, কালের কন্ঠ ইত্যাদি ২৭.৬.২০১১) এটা কি ঠিক? আওয়ামী-বাকশালী শাসন আমলে মাত্র চারটি সরকারি ও সরকার সমর্থিত পত্রিকা ছাড়া সব পত্রপত্রিকা নিষিদ্ধ থাকায় ও সভা-সমিতি, মিছিল, রাজনৈতিক সংগঠন ইত্যাদির ওপর নিষেধাজ্ঞা থাকার সময় ছাড়া অন্য কোনো সরকারের আমলে সরকারের বিরুদ্ধে লেখালেখি, প্রকাশ্য আলোচনা ইত্যাদি বন্ধ থেকেছে? এটা ঠিক যে, অনেক মতলববাজ লোক সে সময় লেখালেখি করেননি বা কথাবার্তা বলেননি। কিন্তু কেউই সেটা করেননি এটা সত্যের এক মহা অপলাপ ছাড়া আর কী? হতে পারে এই অপলাপ ইচ্ছাকৃত অথবা হতে পারে অজ্ঞতার কারণে। কিন্তু যা সত্য নয় তার উচ্চারণ যে কোনো কারণেই হোক, সত্যের অপলাপ ও মিথ্যার প্রচার ছাড়া আর কী? এখানে অবশ্য এটা বলা দরকার যে, ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের পরবর্তী সময়ে যারা সুযোগ থাকা সত্ত্বেও সামরিক সরকারের বিরুদ্ধে কিছু বলেননি তাদের মধ্যে প্রথম সারিতে ছিলেন আওয়ামী-বাকশালী নেতৃবৃন্দ, বড় ছোট মাঝারি সব স্তরের নেতৃবৃন্দ। ১৫ আগস্ট শেখ মুজিবকে অতি নিষ্ঠুরভাবে সামরিক বাহিনীর মধ্যে অবস্থিত কিছু মার্কিন সাম্রাজ্যবাদী এজেন্ট ও দুষ্টপ্রকৃতির অফিসার সপরিবারে হত্যা করলেও মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষ শক্তি ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে ঢাকা অথবা দেশের অন্যত্র কোনো মিছিল বের করতে, ইস্তাহার দিতে, দেয়ালে চিকা মারতে অথবা অন্য কোনো উপায়ে সামান্য প্রতিবাদ পর্যন্ত করতে দেখা যায়নি। দুই-এক জায়গায় ছোটখাটোভাবে সে রকম কিছু যদি হয়েও থাকে তার কোনো প্রভাব কোথাও ছিল না।

এদিক দিয়ে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বকে চরম কাপুরুষ এবং নিজেদের নেতা ও দলের প্রতি বেঈমান ছাড়া আর কিছু বলা যায় না। শুধু সপরিবারে শেখ মুজিবের হত্যাকাণ্ডই নয়, জেলের অভ্যন্তরে আওয়ামী লীগের চার শীর্ষ নেতার নিষ্ঠুর হত্যাকাণ্ডের পরও আওয়ামী লীগ নেতৃত্বের এই নীরবতা ছিল বিস্ময়কর। সামরিক শাসনের সময় কেউ কোনো সময় মুখ খোলেনি; একথা বলার সময় একজন দায়িত্বশীল ব্যক্তি, বিশেষ করে প্রধানমন্ত্রীর পক্ষে তাঁর নিজের দলের উপরোক্ত কাপুরুষতা, সুবিধাবাদ ইত্যাদির কথা স্মরণ রেখেই অন্যদের সমালোচনা করা উচিত। শেখ মুজিবের হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে তাঁর দলের বেঈমানদেরই সম্পর্ক ছিল। এই ক্রাইমের ক্ষেত্রে সামরিক বাহিনী ও মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থার রাজনৈতিক যোগাযোগ ছিল একমাত্র আওয়ামী লীগেরই নেতৃত্বের একটি অংশের সঙ্গে।

শেখ মুজিবের হত্যাকাণ্ডের পর তাঁর লাশ তাঁর বাসভবনে সিঁড়ির ওপর পড়ে থাকার সময়েই জেলে নিহত চার নেতা ছাড়া শেখ মুজিবের নেতৃত্বাধীন তত্কালীন আওয়ামী-বাকশালী সরকারের সব মন্ত্রীই খোন্দকার মোশতাকের মন্ত্রিসভায় শপথগ্রহণ করে বিশ্বের ইতিহাসে বড় ধরনের রাজনৈতিক বেঈমানি ও কেলেঙ্কারির যে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিলেন একথা শেখ হাসিনা নিজেইবা কীভাবে বিস্মৃত হতে পারেন? তিনি যখন অন্যদের সমালোচনা করেন তখন কেন তিনি নিজেদের দলের এ ধরনের অপকর্ম ও কেলেঙ্কারির বিষয় আড়াল করার চেষ্টা করেন? কিন্তু তিনি যতই এসব আড়াল করার চেষ্টা করেন, ঐতিহাসিক তথ্য ও সত্য চিরকাল আড়ালে থাকার জিনিস নয়। সামরিক সরকারগুলোর সময়, বিএনপির সরকারের সময় এবং আওয়ামী লীগ সরকারের সময় এমন লেখক ও রাজনৈতিক লোকদের দুর্ভিক্ষ থাকেনি যাঁদের ‘কলমে কালি থাকেনি’, অথবা ‘কলমে রিফিল থাকেনি’। তাঁদের কলমে কালি ও রিফিল ঠিকই থেকেছে এবং তারা এইসব সরকারের সমালোচনা থেকে বিরত থাকেননি। তথ্যের ব্যাপারে বেপরোয়া না থেকে তথ্য সন্ধান করলেই তাঁর এই বক্তব্যের অসারতা তিনি সহজেই উপলব্ধি করতে পারবেন। আসলে শেখ হাসিনা ও খালেদা জিয়া উভয়েই একে অন্যকে নিজের অবিসংবাদী প্রতিদ্বন্দ্বী ও শত্রু হিসেবে মাথার মধ্যে টার্গেট করে রাখায় তাঁদের বৃত্তের বাইরে যে অন্য কোনো শক্তি ও ব্যক্তিবর্গের অস্তিত্ব আছে এটা চিন্তায় ধারণ করার ক্ষমতা তাঁদের নেই।

যেহেতু শেখ হাসিনা একজন লব্ধপ্রতিষ্ঠ লেখিকা, পণ্ডিত ও বক্তা হিসেবে খালেদা জিয়ার থেকে অধিকতর প্রবল ও প্রতিভাধর এ কারণে তাঁর কথাবার্তার মধ্যেই এই বৃত্তবদ্ধতা বেশি করে পাওয়া যায়। তিনি ধরেই নেন যে, তাঁর ও তাঁর সরকারের সমালোচকরা সবাই বিএনপির লোক, অথবা বিএনপির সমর্থক!! তাঁদের শ্রেণীর বাইরে দেশে অন্য কোনো শ্রেণীর লোক ও সেই শ্রেণীর স্বার্থের প্রতিনিধিত্বকারী এমন রাজনৈতিক দল ও লেখক আছেন যাঁরা আওয়ামী লীগের প্রবল সমালোচক হলেও যে বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী বা শাসক শ্রেণীর অন্য কোনো দলের ধামা ধরেন না; এই বাস্তব চিন্তার ক্ষমতা মনে হয় প্রধানমন্ত্রী হাসিনার নেই। ‘ভালোর পসরা’ শীর্ষক রচনাটিতে আসলে শেখ হাসিনার নিজেরও উদ্দেশ্য হলো নিজের ভালোর পসরা সাজিয়ে তা বিক্রির ব্যবস্থা। তাঁর এইসব ভালোর মধ্যে তিনি উল্লেখ করেছেন পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তি চুক্তি। আসলে ওই শান্তি চুক্তির কৃতিত্ব শেখ হাসিনার নয়।

ভারত সরকার নিজের স্বার্থে হাসিনাকে দিয়ে এই চুক্তি করিয়েছিল। ত্রিপুরায় পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির মূল ঘাঁটি থাকায় ওই অঞ্চলে ভারত-বাংলাদেশ সীমান্ত দিয়ে তাদের যাতায়াত ছিল। সীমান্তের মধ্যে অনেক ফাঁকফোকর ছিল। সেগুলো দিয়ে উলফা, মিজো ইত্যাদি ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সরকারবিরোধী দলগুলোর লোকজনও বাংলাদেশে প্রবেশ করত। এতে ভারতের অসুবিধা হচ্ছিল।

তারা এই সীমান্ত সিল করে দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। কিন্তু বাংলাদেশের জনসংহতি সমিতির ঘাঁটি সেখানে থাকায় সীমান্ত সিল করা, যাতায়াত বন্ধ করা সম্ভব ছিল না। এজন্য ভারত সরকার স্থির করে ত্রিপুরায় জনসংহতি সমিতির ঘাঁটি বন্ধ করে তাদের বাংলাদেশে পাঠিয়ে দিতে। এই মূল কারণেই পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তি চুক্তি হয়েছিল। সেই চুক্তির দ্বারা পার্বত্য চট্টগ্রামের সংখ্যালঘু জাতিগুলোর কোনো লাভ হয়নি।

লাভ হয়েছে সন্তু লারমা ও তাঁর কিছু ঘনিষ্ঠ লোকের। তাঁরা গদিনসীন হয়ে অনেক হালুয়া-রুটি খাচ্ছেন। কিন্তু হালুয়া-রুটি খাওয়া সত্ত্বেও পার্বত্য চট্টগ্রামের জনগণের কোনো লাভ এর ফলে না হওয়ায়, চুক্তি কার্যকর না হওয়ায় তিনি মাঝে মাঝে সরকারের বিরুদ্ধে ক্ষোভ প্রকাশ করে বিবৃতি দিচ্ছেন ও সভাসমিতিতে বক্তৃতা করছেন। এর থেকেই বোঝা যাচ্ছে, ১৯৯৭ সালে চুক্তি সই হলেও চুক্তি এখন পর্যন্ত কার্যকর হয়নি। এর ফলে সন্তু লারমা গদিনসীন হয়ে হালুয়া-রুটি খাচ্ছেন এবং শেখ হাসিনা এই শান্তি চুক্তি দেখিয়ে নোবেল পুরস্কারের জন্য ইউরোপ-আমেরিকায় জোর তদবির করছেন।

না করবেনইবা কেন? মুহাম্মদ ইউনূস শান্তির জন্য কোনো কাজ না করে সাম্রাজ্যবাদীদের কৃপায় ও তাদের দাবার ঘুঁটি হিসেবে যদি শান্তির জন্য নোবেল পুরস্কার পেতে পারেন তাহলে ভুয়ো চরিত্রসম্পন্ন হলেও পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তি চুক্তি করে হাসিনাইবা শান্তিতে নোবেল পুরস্কার পাওয়ার অযোগ্য হবেন কেন? তবে সাম্রাজ্যবাদীদের খেদমতের জায়গাটা তিনি কতখানি পাকা করতে পারেন এবং তাঁকে এর জন্য তারা কতখানি যোগ্য মনে করেন এর ওপরই নির্ভর করবে তাঁর ভাগ্যে শান্তিতে নোবেল পুরস্কারের শিকে ছেঁড়া। শেখ মুজিবুর রহমানকে ‘জাতির পিতা’ আখ্যা দিয়ে বাংলাদেশের জনগণের ঠিক কী লাভ বা উপকার হয়েছে জানা নেই। তবে এর দ্বারা শেখ মুজিব যাঁর বা যাঁদের আসল পিতা তাঁদের লাভের যে একটা ব্যাপার আছে এটা অস্বীকারের উপায় নেই। শেখ হাসিনা তাঁর নিজের সরকারের সময় ‘জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের পরিবারের সদস্যদের অর্থাত্, জীবিত দুই কন্যার নিরাপত্তা দেয়ার জন্য’ একটা আইন পার্লামেন্টে পাস করিয়েছিলেন। একথা তিনি তাঁর আলোচ্য রচনাটিতেই বলেছেন।

এখানে উল্লিখিত ‘নিরাপত্তার’ উদ্দেশ্যে শেখ মুজিবের দুই কন্যার জন্য বাসভবন সরকারিভাবে বরাদ্দের ব্যবস্থাও হয়েছিল। শেখ রেহানাকে ধানমন্ডির একটি বাড়ি দেয়া হলেও শেখ হাসিনা তাঁর মন্ত্রিসভাকে দিয়ে নিজের জন্য বরাদ্দ করেছিলেন খোদ গণভবন, যা ব্যবহৃত হয়ে আসছিল প্রধানমন্ত্রীর সরকারি ভবন হিসেবে। এ প্রসঙ্গে হাসিনা তাঁর রচনায় বলছেন, ‘আমার নামে ছড়ানো হয় আমি গণভবন এক টাকা দিয়ে কিনে নিয়েছি। কেউ কি কোনো প্রমাণ দেখাতে পেরেছিল? পারেনি। ’ একথা বলে মনে হয় হাসিনা এক বিরাট ধর্মযুদ্ধে জয়লাভ করেছেন! এক টাকা দিয়ে গণভবন কেনার কোনো প্রমাণ কারও কাছে নেই, কারণ তাঁর মন্ত্রিসভায় তাঁর জন্য গণভবন বরাদ্দের প্রস্তাব গৃহীত হওয়ার পরই এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে চারদিকে ব্যাপক বিক্ষোভ সৃষ্টি হয়।

এমনিতেই তাঁর সরকার ও দলের জনপ্রিয়তা তখন ছিল শোচনীয় অবস্থায়, তার ওপর জনগণের এই শতকোটি টাকার সম্পত্তি এভাবে নিজেদের মন্ত্রিসভায় প্রস্তাব পাস করে আত্মসাতের চেষ্টায় তাঁর নিজের দল আওয়ামী লীগের মধ্যেও ব্যাপক বিক্ষোভ দেখা দেয়। অন্য কারণ বাদ দিয়েও হাসিনা যদি নির্বাচনের সময় গণভবন দখল করে সেখানে বাস করতেন তাহলে তাঁদের দলের পক্ষে বিশ-পঁচিশটি আসন পাওয়া পর্যন্ত দুঃসাধ্য হতো। সেই পরিস্থিতিতে প্রবল আওয়ামী লীগ সমর্থক দৈনিক জনকণ্ঠের সম্পাদকীয় বিভাগ থেকে আমার সঙ্গে যোগাযোগ করে অনুরোধ জানানো হয় যাতে তাঁদের পত্রিকায় আমি হাসিনা কর্তৃক গণভবন আত্মসাত্ চেষ্টার বিরুদ্ধে লিখি। তাঁদের সেই অনুরোধে অবাক হয়ে আমি বললাম, আপনাদের পত্রিকা আওয়ামী লীগ সমর্থক নয়? আপনারা তো জানেন জনগণের সম্পত্তি এভাবে যে কেউই আত্মসাত্ করতে চেষ্টা করলে আমি কী লিখব। তাহলে জনকণ্ঠে আপনারা আমার লেখা ছাপবেন কীভাবে? আমি অবাক হয়ে তাঁদের কাছে শুনলাম, ‘আপনি এ বিষয়ে কী লিখবেন এটা আমরা খুব ভালোভাবেই জানি এবং জেনেশুনেই আপনাকে আমরা এ অনুরোধ করছি।

আপনি যা ইচ্ছা ও যেভাবে ইচ্ছা লিখুন। ’ জনকণ্ঠের জন্মলগ্ন থেকেই আমি তাতে লিখতাম। হঠাত্ করে পত্রিকাটি চরম আওয়ামী লীগ সমর্থক হয়ে ওঠার জন্য লেখা বাদ দিই। এখন তাদের অনুরোধে আমি আবার একবার লিখলাম। আমার লেখার একটা প্রভাব যে জনমতের ওপর পড়েনি, এটা আমি বলব না।

হাসিনার গণভবন ত্যাগ না করার সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে চারদিকে তো বিক্ষোভ শুরু হলোই, এমনকি আওয়ামী লীগের মধ্যেও এর প্রবল বিরোধিতা হলো আসন্ন নির্বাচনে বিশেষ করে এর কারণেই ভরাডুবির আশঙ্কা থেকে। সেই অবস্থায় শেষ পর্যন্ত শেখ হাসিনা গণভবন ছাড়তে বাধ্য হলেন। এটাই হলো এ ব্যাপারে সত্য ঘটনা। এর জন্য হাসিনা গণভবন এক টাকায় কিনেছিলেন কি-না, তার প্রমাণের কোনো প্রয়োজন তো নেই-ই, এমনকি প্রাসঙ্গিকতাও নেই! এটা ঠিক যে, বিএনপির ২০০১-০৬ সালের সরকারের সময় হাওয়া ভবন থেকে গ্রাম্য মোড়লী কায়দায় অনেক দুর্নীতি করা হয়েছিল। সেসব দুর্নীতি মানুষ হতে দেখেছিল চোখের সামনে।

কিন্তু আওয়ামী লীগ দুর্নীতিবাজ হিসেবে অনেক চালাক। তাদের শীর্ষ নেতৃত্ব দুর্নীতি করে থাকেন হাওয়াই পদ্ধতিতে, অনেক বেশি চালাকির সঙ্গে। এজন্য তাদের দুর্নীতির প্রমাণ পাওয়া দুঃসাধ্য, প্রায় অসম্ভব। কিন্তু দুর্নীতির প্রমাণ পাওয়া অসম্ভব হলেও দুর্নীতি মিথ্যা হয় না। আওয়ামী লীগের লোকদেরও সব দুর্নীতি যে চালাকির সঙ্গে করা হয় এমন নয়।

তাদের মধ্যে চোর-দুর্নীতিবাজের অভাব নেই। মাত্র কয়েকদিন আগেই শেখ হাসিনা নিজে জাতীয় সংসদের মেঝের ওপর দাঁড়িয়ে জাতীয় পার্টিসহ তাঁর দলের সংসদ সদস্যদের লক্ষ্য করে বলেছেন, তাদের প্রত্যেককে প্রতি মাসে নয় হাজার করে টাকা এলাকায় অফিসের জন্য দেয়া হলেও তারা সে টাকা খরচ না করে পকেটে রাখেন। এর থেকে স্পষ্টভাষায় চোরকে চোর আর কীভাবে বলা যায়? বিএনপি, জাতীয় পার্টি, জামায়াতে ইসলামীর লোকরা দুর্নীতিবাজ। কিন্তু আওয়ামী লীগের মহাজোটভুক্ত লোকরা বিশেষত, আওয়ামী লীগের লোকরাও যে সাধু নয়, চরম দুর্নীতিবাজ এটা তো শেখ হাসিনার উপরোক্ত বক্তব্য থেকেই বোঝা যায়। যারা নির্ধারিত কিছু কাজের জন্য প্রতি মাসে পাওয়া সামান্য নয় হাজার টাকা নিয়মিতভাবে পকেটস্থ করছেন তারা নিজেদের দল ক্ষমতায় থাকার সময় দুর্নীতি না করে বসে বসে তসবি গুনছেন একথা কে বিশ্বাস করবে? শেখ হাসিনার ‘ভালোর পসরা’য় তিনি নিজে যা লিখেছেন তার সবকিছু নিয়ে আলোচনার সুযোগ এখানে নেই।

লেখা এমনিতেই বড় হয়ে যাচ্ছে। তবে আর দুই-একটি বিষয়ের উল্লেখ প্রয়োজন। তিনি বলেছেন, ‘দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে রাখতে সক্ষম হয়েছি। ’ দেশের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে কারও এমন কথা বলা একেবারেই ঠিক নয় যা কেউ বিশ্বাস করে না এবং যিনি একথা বলছেন তিনিও বিশ্বাস করতে পারেন না। এই বক্তব্য হাস্যকর হলেও একে হাস্যকর বললে উচিতমত বলা হয় না।

এ হলো জনগণের জীবন নিয়ে ছিনিমিনি খেলার শামিল। সব রকম দ্রব্য ও সেবার (যাতায়াত, চিকিত্সা ইত্যাদি) মূল্য বৃদ্ধিতে চারদিকে যেখানে গরিব মানুষ, মধ্যবিত্ত জনগণের নাভিশ্বাস উঠছে, তাদের জীবন বিপর্যস্ত ও বিপন্ন হচ্ছে, সেখানে প্রধানমন্ত্রীর সুখাসনে বসে শেখ হাসিনা বলছেন তারা মূল্যবৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণে রাখতে সক্ষম হয়েছেন!! তারা বাংলাদেশের মানুষকে কী মনে করেন? দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি কার্যত নিয়ন্ত্রণ না করে এসব কথা বলার পরও কি জনগণ পরবর্তী নির্বাচনে আওয়ামী লীগের ভোটের বাক্স ভর্তি করবে? তিনি বলেছেন, তার সরকার ‘কোনো ঘটনা ঘটলে অপরাধী যে-ই হোক, সরকার সঙ্গে সঙ্গে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিচ্ছে। ’ এর থেকে বড় মিথ্যা আর কী হতে পারে! র্যাব-পুলিশ নিয়মিতভাবে নিরীহ লোকদের হত্যা করলেও তার কোনোটিরই আজ পর্যন্ত বিচার হয়নি। কেউ তার জন্য শাস্তি পায়নি। তাদের ছাত্রলীগের কর্মীরা এখন দেশের অন্যতম সন্ত্রাসী জঙ্গি বাহিনী।

তাদের অসংখ্য অপরাধের কি শাস্তি হচ্ছে? যাদের হাসিনা নিজেই চোর হিসেবে প্রকাশ্যে চিহ্নিত করছেন তাদের জন্য কি শাস্তির ব্যবস্থা হচ্ছে? কাজেই অপরাধী যে দলেরই হোক, তার শাস্তি হচ্ছে, এসব বস্তাপচা কথা শুনতে শুনতে মানুষের এমন অবস্থা হয়েছে যে, যারা এসব কথা বলবে জনগণ তাদের বিরুদ্ধে আরও বেশি বিরক্ত হবে, তাদের থেকে মুখ ফিরিয়ে নেবে। বাস্তবত হচ্ছেও তা-ই। শেষ করার আগে শ্রমিকদের সম্পর্কে হাসিনা যা বলেছেন, সেটা উল্লেখ করা দরকার। তিনি মাসে ১৫০০ টাকা থেকে ৩০০০ টাকা মজুরি বৃদ্ধির কথা বলে নিজেদের সরকার ও গার্মেন্ট মালিকরা কত মহত্ ও শ্রমিকবন্ধু এটা দেখাতে চেয়েছেন। এ প্রসঙ্গে মনে রাখা দরকার, একমাত্র আমাদের দেশেই গার্মেন্ট শ্রমিকদের কারখানায় আগুনে পুড়িয়ে মারার ব্যবস্থা আছে।

এভাবে নিহত শত শত গার্মেন্ট শ্রমিককে আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জাতীয় পার্টি কোনো সরকারই দীর্ঘদিন কোনো ক্ষতিপূরণ দেয়নি। শ্রমিকদের নিরাপত্তার উপযুক্ত ব্যবস্থা এখনও হয়নি। তারা জাতির জনকের কন্যা না হতে পারে কিন্তু তাদের জীবনের নিরাপত্তার প্রয়োজন আছে। মজুরি বৃদ্ধির কথা বলা হয়েছে। তিন হাজার টাকার এখন কী মূল্য? এই টাকায় একটি খুব ছোট সংসারও বর্তমান অবস্থায় কীভাবে চলতে পারে? কাজেই গার্মেন্ট শ্রমিকরা দীর্ঘদিন পর তুচ্ছ বেতন বৃদ্ধির পরও মূল্যবৃদ্ধির কারণে আগের থেকে ভালো অবস্থায় নেই।

এ নিয়ে আলোচনা এখানে নিষ্প্রয়োজন। এ প্রসঙ্গে এখানে বলা দরকার, শ্রমিকদের এভাবে জীবন্মৃত অবস্থায় রাখলেও বিএনপি, ফখরুদ্দীন সরকার ও আওয়ামী লীগ সরকার বিগত ছয় বছরের শাসন আমলে গার্মেন্ট মালিকদের এক লাখ কোটি টাকারও বেশি শুল্কছাড় সুবিধা দিয়েছে। (কালের কণ্ঠ ২২.৬.২০১১) এটা হলো এ বছর বাংলাদেশের বাজেটের মোট পরিমাণের দুই-তৃতীয়াংশ!!! পাঁচটি খাতে এই বিশাল আকারে যারা মালিকদের এই ভর্তুকি দিয়েছে তারা জনগণের, শ্রমিকদের বন্ধু না শত্রু? তারা কি দেশের বন্ধু না শত্রু? শেখ হাসিনা ঠিকই বলেছেন, ‘ব্যবসায়ীরা এত শান্তিতে কোনোদিন ব্যবসা করতে পারেনি। ’ এই সত্যকে চ্যালেঞ্জ করার সামান্য ক্ষমতাও আমাদের নেই। ১৯৭২ সাল থেকে বাংলাদেশে ব্যবসায়ীদের শাসনের যে প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে, তারই পরিণত চেহারা আমরা এখন দেখছি।

বাংলাদেশ এখন কোনো ধরনের জনপ্রতিনিধিদের দ্বারা নয়, পুরোপুরিভাবে সাম্রাজ্যবাদকবলিত ব্যবসায়ীদের দ্বারাই শাসিত হচ্ছে। শাসক শ্রেণীর প্রত্যেকটি দল, তাঁদের জাতীয় সংসদ, তাঁদের সরকার, তাঁদের আমলাতন্ত্র, তাঁদের বিভিন্ন ধরনের বাহিনী সবকিছুই এখন ব্যবসায়ী শ্রেণীর অন্তর্গত। বাংলাদেশ এখন ব্যবসায়ীদের স্বর্গরাজ্য! এই স্বর্গরাজ্যের প্রধানমন্ত্রীই হলেন শেখ হাসিনা। ২৯.৬.২০১১ ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।