আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

এবং হুমায়ূন আহমেদের তিন কন্যা

১৯৭৬ সালে হলিক্রস কলেজে ভর্তিপ্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। ভর্তিপ্রক্রিয়া এখনকার মতো নয়। প্রতিটি কলেজ নিজ নিজ পদ্ধতিতে যাচাই-বাছাই করে শিক্ষার্থীদের ভর্তি করত। হলিক্রস কলেজে তখন লিখিত এবং পরে সামনাসামনি প্রার্থীদের (সাক্ষাৎকার) দেখে চূড়ান্ত তালিকা করা হতো।
তেমনই এক সাক্ষাৎকারে প্রার্থীরা এসেছে।

একজন প্রার্থী এল। সুন্দর, ফুটফুটে। কাগজপত্র দেখে বোঝা গেল সে বিবাহিত। বিজ্ঞানের প্রার্থী। সিস্টার যোসেফ মেরী আমাকে বললেন, ‘ইট উইল বি সো টাফ ফর আ ম্যারিড গার্ল টু স্টাডি ইন সায়েন্স আনলেস সি আ রিয়েল সাপোর্ট ফ্রম হার ফ্যামিলি।


আমার কিন্তু খুব ভালো লেগে গেল। কী সুন্দর মুখখানা! কাগজপত্র সব ঠিকঠাক। নম্বর ঠিক আছে। পরীক্ষায়ও ভালো করেছে। শুধু বিবাহিত বলে পড়ার সুযোগ পাবে না!
প্রার্থীকে বললাম, তোমার গার্ডিয়ানকে আনা সম্ভব কি না।

কারণ, বিজ্ঞানে পড়তে গেলে তাঁদের অনেক সহযোগিতা দরকার—প্র্যাকটিক্যাল আছে। অনেক সময় কলেজে দিতে হবে। তাঁরা কি তাকে সহযোগিতা করবেন?
প্রার্থী জানাল, কাল তার গার্ডিয়ানকে নিয়ে আসবে। পরদিন যে গার্ডিয়ানকে প্রার্থী আমাদের সামনে নিয়ে এল, তাঁকে দেখে তো আমি অবাক। তিনি আর কেউ নন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগের তরুণ শিক্ষক হুমায়ূন আহমেদ।


সামনাসামনি না দেখলেও এই উদীয়মান লেখক আমার খুব পরিচিত, তাঁর রচনার মাধ্যমে।
১৯৭৩ সালে আমাদের বিয়ে হয়। আমার স্বামীর ছোট ভাই জীবন রায় (বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রের মিসিসিপি বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগের শিক্ষক) বিয়েতে একটা বই উপহার দিয়েছিল—নন্দিত নরকে। আজও বইটা আমাদের বইয়ের তাকে বিশেষ উপহার হিসেবে সুরক্ষিত আছে। আমার স্বামীও তাঁর সমসাময়িক।

সেই সময় হুমায়ূন আহমেদের শঙ্খনীল কারাগার ও তোমাদের জন্য ভালোবাসা প্রকাশিত হয়েছে, আরও হচ্ছে।
আমার প্রিয় লেখককে নিয়ে ভর্তিপ্রার্থী গুলতেকিন এসেছে হলক্রিস কলেজে ভর্তির জন্য। সিস্টার তো আমার মনের অবস্থা বুঝতে পারছেন না। উনি ওনার মতো প্রশ্ন করে যাচ্ছেন। হুমায়ূন আহমেদ সিস্টারকে বোঝালেন, উনি নিজেও একজন শিক্ষক এবং নারী শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে খুবই সচেতন।

স্ত্রী গুলতেকিনকে পড়ার সব রকম সহযোগিতা তিনি করবেন। সিস্টার যখন বুঝতে পারলেন, হুমায়ূন আহমেদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, তিনি মহাখুশি। গুলতেকিন হলিক্রস কলেজের বিজ্ঞান বিভাগের ছাত্রী হয়ে গেল।
এরপর শুরু হলো আরেক অধ্যায়। কয়েক বছরের ব্যবধানে ওদের তিন কন্যা হলিক্রস স্কুলের ক্লাসরুমে, চত্বরে, মাঠে ঘোরাফেরা, দৌড়াদৌড়ি শুরু করল—নোভা, শিলা, বিপাশা।


সময়ের সিঁড়ি পেরিয়ে একের পর এক তিন কন্যা হলো তাদের মায়ের কলেজ হলিক্রস কলেজের শিক্ষার্থী। কী সুন্দর নোভা! বুদ্ধিমতী, খুবই চুপচাপ, শান্তশিষ্ট, চোখে-মুখে সারল্য, বিজ্ঞান বিভাগের অত্যন্ত মেধাবী ছাত্রী।
শিলা প্রাণচাঞ্চল্যে ভরা, মানবিক বিভাগের শিক্ষার্থী। দৌড়ে এসেছে—‘মিস, আমি কম্বিনেশনে অঙ্ক নিতে চাই, পারব কি না?’ মানবিক বিভাগের ছাত্রীদের জন্য গণিত নিতে হলে বেশ কঠিন একটা রুটিন তৈরি করতে হয়। কালেভদ্রে দু-একজন গণিত নেয়।

খুব খুশি হয়েই সে সুযোগ দেওয়া হলো শিলাকে। খুব ভালো ফল করে অর্থনীতি নিয়ে পরে পড়াশোনা করল।
২০০০ সাল। হলিক্রস কলেজের রজতজয়ন্তী। সাজ সাজ রব পড়ে গেছে।

নাচ, গান, নাটক, সেমিনার, প্রার্থনা—এক বিরাট মিলনমেলা অনুষ্ঠিত হলো। রবিঠাকুরের যোগাযোগ, নায়িকা হলো শিলা। কী চমৎকার অভিনয়! মিলনমেলায় এল গুলতেকিন, নোভা ও ছোট বিপাশা। আমরা সবাই মিলে কত ছবি তুললাম, কত কথা, কত হাসি। তখন তো জানতাম না, এত হাসি, এত আনন্দের গভীরে ওদের অন্তরে অনেক আছে ব্যথা, কষ্ট।


অপরূপা সুন্দর হচ্ছে বিপাশা। হাসিখুশি, প্রাণচাঞ্চল্যে ভরা। দেখতে দেখতে তিন কন্যা কলেজের গণ্ডি পেরিয়ে বৃহত্তর বিশ্বের দরবারে পৌঁছাল। রেখে গেল হলিক্রস স্কুল, কলেজে অনেক স্মৃতি।
লেখক: অধ্যক্ষ, মারটিন লুথার কলেজ।

সোর্স: http://www.prothom-alo.com     দেখা হয়েছে বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।