আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

পাঁচ বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণা ২৮ শতাংশ শিক্ষকের পড়ানো মানসম্মত নয়

আমি খুবই সাধারণ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) অর্থায়নে পাঁচটি বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিচালিত একটি গবেষণা বলছে, দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের অন্তত ২৮ শতাংশের শিক্ষা দেওয়ার মান নিচু। এর মধ্যে ১৬ ভাগ অত্যন্ত নিচু মানের। ৭২ ভাগের মান খারাপ নয়, তার মধ্যে ৩০ শতাংশ খুব ভালো, ১৫ শতাংশ মোটামুটি মানের। গবেষণায় প্রয়োজনীয় ২০টি গুণ শিক্ষকদের মধ্যে কতটুকু বিদ্যমান, তা যাচাই করা হয়েছে। এ ক্ষেত্রে শিক্ষার্থীদের মতামত নেওয়া হয়েছে।

ওই গবেষণার তথ্য অনুসারে, গবেষণাভুক্ত শিক্ষকদের মাত্র ২০ শতাংশ শিক্ষক ভালোভাবে গবেষণার সঙ্গে যুক্ত আছেন। আর ১৩ শতাংশ শিক্ষক কোনো ধরনের গবেষণায় যুক্ত নন। বাকি ৬৭ শতাংশ কম-বেশি গবেষণার সঙ্গে যুক্ত। তবে শিক্ষাসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের বক্তব্য, এ ক্ষেত্রে বরাদ্দ খুবই কম, এ কারণে গবেষণা কমছে। ইউজিসিও তাদের সর্বশেষ প্রতিবেদনে এ কথা স্বীকার করেছে।

বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের পাঠদানের মান নিয়ে ঢাকা, রাজশাহী, চট্টগ্রাম, খুলনা ও বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে ২৫০ জন শিক্ষকের ওপর পরিচালিত গবেষণায় এসব তথ্য পাওয়া গেছে। ইউজিসির হিসাবে এই পাঁচটি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকের সংখ্যা চার হাজার ৮৩৭ জন। ইউজিসির উচ্চশিক্ষার মানোন্নয়ন প্রকল্পের পরামর্শক ও বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মোজাহার আলী গবেষণাটি পরিচালনা করেন। গত মার্চে উচ্চশিক্ষাবিষয়ক এক সেমিনারে গবেষণা প্রতিবেদনটি উপস্থাপন করা হয়। এ গবেষণায় বাস্তব চিত্র ফুটে উঠেছে বলে মনে করেন ইউজিসির সাবেক চেয়ারম্যান নজরুল ইসলাম।

তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমাদের মতো দেশে এটি হতে পারে। তবে এটি কাঙ্ক্ষিত নয় বরং হতাশাজনক। হওয়া উচিত ছিল বেশির ভাগ শিক্ষক খুব ভালো এবং ভালো গবেষণা করেন। ’ তিনি বলেন, এ অবস্থা উত্তরণে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ, ইউজিসি, সরকার—সবারই দায়িত্ব আছে। শিক্ষকদের জন্য সুযোগ-সুবিধা বাড়াতে হবে।

তেমনই শিক্ষকেরা তাঁদের দায়িত্ব পালন করছেন কি না, সেটি তদারক করতে হবে। শিক্ষক নিয়োগ হতে হবে উচ্চমানের। তিনি বলেন, শিক্ষকতা অন্য পেশার মতো নয়। যাঁরা শিক্ষকতা ও গবেষণা করার জন্য মানসিকভাবে প্রস্তুত, ভালো ছাত্র ও শিক্ষকতার প্রতি নিবেদিত, তাঁদের শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দিতে হবে। না হলে সুযোগ-সুবিধা বাড়ালেও খুব বেশি লাভ হবে না।

তিনি শিক্ষকদের জন্য প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা এবং সব শিক্ষকের পিএইচডি করার সুযোগ তৈরি করার কথা বলেন। শিক্ষাসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের প্রধান কাজ পাঠদান ও গবেষণার মাধ্যমে নতুন জ্ঞান সৃষ্টি। এ দুটি ক্ষেত্রে উন্নতি শিক্ষার মানোন্নয়ন করে। দলীয় বিবেচনায় নিয়োগ, বাড়তি রোজগারের চেষ্টা এবং কিছু ক্ষেত্রে সুযোগ ও প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা না থাকায় পাঠদান ও গবেষণাক্ষেত্রে শিক্ষকদের আগ্রহ কমছে। ইউজিসির সর্বশেষ প্রতিবেদন (২০০৯) বলছে, দেশের কোনো বিশ্ববিদ্যালয়েরই উচ্চশিক্ষা ও গবেষণা মান আন্তর্জাতিক বা আঞ্চলিক পর্যায়ে ভালো অবস্থানে নেই।

গত এক দশকে বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা বাড়লেও শিক্ষার মান বাড়েনি বলে প্রতিবেদনে মত প্রকাশ করা হয়। প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু শিক্ষক অনিয়ন্ত্রিত ও অপরিকল্পিতভাবে অন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে খণ্ডকালীন শিক্ষকতা বা বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে পরামর্শকের কাজ করছেন। যে কারণে নিজের বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা কার্যক্রম অনেকাংশে ব্যাহত হচ্ছে। শিক্ষাবিদেরা বলছেন, এ অবস্থা উত্তরণে শিক্ষকদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা, পর্যাপ্ত বেতন ও জবাবদিহি নিশ্চিত করা এবং শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। নিয়োগের ক্ষেত্রে মেধার পাশাপাশি তাঁদের শিক্ষাদান ক্ষমতা ও মূল্যায়নের ব্যবস্থা করতে হবে।

বর্তমান অবস্থার কারণ ব্যাখ্যা করে অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, সুযোগ বাড়ার কারণে স্বাধীনতার পর পর বড় ধরনের মেধা পাচার হয়েছে। অনেক শিক্ষক চলে গেছেন দেশ ছেড়ে। অনেকে আর ফিরে আসেননি। অনেক ভালো ছাত্র দেশের বাইরে চলে গেছে। এ ছাড়া শিক্ষকদের অর্থের প্রতিযোগিতায় চলে যেতে হচ্ছে।

এ জন্য শুধু শিক্ষকদেরই দায়ী করা যাবে না, পড়ালেখার প্রতি শিক্ষার্থীদেরও আগ্রহ কমছে। যোগাযোগ করা হলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক প্রথম আলোকে বলেন, বেশির ভাগ শিক্ষক ভালো, এটি আশার দিক। নিচু মানের যেসব শিক্ষক আছেন, তাঁদের প্রশিক্ষণ দিয়ে গ্রহণযোগ্য পর্যায়ে নিয়ে আসতে হবে। আর নিয়োগ দেওয়ার ক্ষেত্রে অত্যন্ত সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। মেধা ও যোগ্যতার ভিত্তিতে শিক্ষক নিয়োগ দিতে হবে।

নিয়োগ দেওয়ার ক্ষেত্রে শিক্ষকদের শিক্ষাদান ক্ষমতা যাচাইয়ের ব্যবস্থা করার পরামর্শ দেন তিনি। পাঁচ বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিচালিত গবেষণা: গবেষণাটির পরিচালক মোজাহার আলী প্রথম আলোকে বলেন, বিশ্ববিদ্যালয় ইউজিসির অর্থায়নে করা গবেষণাটি মূলত গুণগত জরিপ। তিনি শিক্ষকদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করার ওপর জোর দেন। গবেষণায় প্রয়োজনীয় ২০টি গুণ শিক্ষকদের মধ্যে কতটুকু বিদ্যমান, তা যাচাই করতে প্রতিটি গুণের জন্য মোট নম্বর দেওয়া হয় পাঁচ। গবেষকের মতে, এ ক্ষেত্রে প্রতিটি গুণের জন্য গড়ে চার নম্বর পাওয়া স্বাভাবিক।

কিন্তু শিক্ষার্থীদের মূল্যায়নে দেখা গেছে, মাত্র সাতটি ক্ষেত্রে শিক্ষকেরা চারের বেশি নম্বর পেয়েছেন। মোট ১০০ নম্বরের মধ্যে ৯০-৯৯ (খুব ভালো) নম্বর পেয়েছেন ৩০ শতাংশ শিক্ষক। ৩০-এর নিচে পেয়েছেন ১ দশমিক ২ ভাগ শিক্ষক। ৮০ থেকে ৮৯ (ভালো) পেয়েছেন ২৭ ভাগ এবং ৭০-৭৯ নম্বর (মোটামুটি) পেয়েছেন ১৫ ভাগ, ৬০-৬৯ পেয়েছেন ১২ ভাগ শিক্ষক এবং ২০-৫৯ নম্বর (খুব খারাপ) পেয়েছেন ১৬ ভাগ। গবেষণায় দেখা গেছে, বেশির ভাগ শিক্ষকের তাঁর নিজের পড়ানোর বিষয়ে ভালো দখল আছে।

কিন্তু সে অনুযায়ী শিক্ষার্থীদের কাছে বিষয়টি সহজভাবে উপস্থাপন করতে পারেন না। বেশির ভাগ শিক্ষক ক্লাসের বাইরে শিক্ষার্থীদের আলোচনার সুযোগ দেন না। শিক্ষার্থীদের পরামর্শ দেওয়া, পর্যবেক্ষণ করা ও প্রভাবিত করার ক্ষমতাও তাঁদের কম। শিক্ষার্থীদের সঙ্গে বন্ধুসুলভ আচরণ, দিকনির্দেশনা দেওয়া ও শিক্ষার্থীদের আদর্শ শিক্ষক হওয়ার ক্ষেত্রেও তাঁরা পিছিয়ে। এসব ক্ষেত্রে পাঁচের মধ্যে শিক্ষকেরা গড়ে ৩ দশমিক ৭০-এর কম নম্বর পেয়েছেন।

এ ছাড়া সহজ করে পড়ানো, ভালো উদাহরণ দেওয়া, শ্রেণীকক্ষ প্রাণবন্ত করে রাখা, শিক্ষার্থীদের মূল্যায়ন করার ক্ষেত্রে নিরপেক্ষ থাকা, শিক্ষার্থীদের প্রশ্নের উত্তর দেওয়া ও প্রশ্ন করতে উৎসাহিত করার ক্ষেত্রেও শিক্ষকেরা পিছিয়ে। পাঁচের মধ্যে শিক্ষকেরা এসব ক্ষেত্রে শিক্ষার্থীদের মূল্যায়নে ৩ দমশিক ৮০-এর কম পেয়েছেন। যেসব ক্ষেত্রে শিক্ষকেরা চারের ওপর নম্বর পেয়েছেন, সেগুলোর মধ্যে আছে ভালো কণ্ঠস্বর, শ্রেণীকক্ষে নিয়ন্ত্রণ, সিলেবাস অনুযায়ী সহজবোধ্য প্রশ্নপত্র প্রণয়ন, সৎ ও মার্জিত থাকা, পেশার প্রতি আন্তরিকতা ও মর্যাদার প্রতি সজাগ দৃষ্টি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক এম এম আকাশও মনে করেন, ওই গবেষণায় বাস্তবতা ফুটে উঠেছে। তিনি গবেষণা কম হওয়ার জন্য পর্যাপ্ত টাকা ও সুযোগের অভাবকে দায়ী করেন।

আর কিছু শিক্ষকের ক্লাসে অনীহার বিষয়ে তিনি বলেন, প্রথমে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের পর্যাপ্ত বেতনের ব্যবস্থা করতে হবে। সে সঙ্গে তাঁদের পর্যাপ্ত জবাবদিহিও নিশ্চিত করতে হবে। সেটা হলো শিক্ষার্থীদের মূল্যায়ন। এ মূল্যায়ন, গবেষণা ও প্রকাশনার ভিত্তিতে তাঁদের পদোন্নতি দিতে হবে। গবেষণায় আগ্রহ নেই: গত বছর প্রথম আলোর অনুসন্ধানে দেখা যায়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ৩৮টি গবেষণা কেন্দ্রের মধ্যে অন্তত ১৫টিতে ২০০৮-০৯ শিক্ষাবর্ষে কোনো মৌলিক গবেষণা হয়নি।

এর মধ্যে কয়েকটি কেন্দ্র আছে, যেগুলোতে কখনোই কোনো মৌলিক গবেষণা হয়নি। টিচিং পারফরমেন্স অব দ্য ফ্যাকাল্টিস অব পাবলিক ইউনিভার্সিটিস ইন বাংলাদেশ শীর্ষক গবেষণায় দেখা যায়, বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৩ শতাংশ শিক্ষক কোনো ধরনের গবেষণায় যুক্ত নন। কিছু ক্ষেত্রে গবেষণা করেন ৩৪ ভাগ শিক্ষক। সীমিত পর্যায়ে গবেষণা করেন ৩৩ ভাগ শিক্ষক। আর মাত্র ২০ ভাগ শিক্ষক ভালোভাবে গবেষণার সঙ্গে যুক্ত আছেন।

শিক্ষকদের গবেষণার বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য আরেফিন সিদ্দিক বলেন, গবেষণার ক্ষেত্রে দুটি বিষয় দেখতে হবে। একটি শিক্ষকদের ব্যক্তিগত আগ্রহ, অন্যটি আর্থিক সুযোগ-সুবিধা। উপাচার্য বলেন, প্রত্যাশিত আর্থিক সুযোগ-সুবিধা শিক্ষকেরা পান না। আবার এটাও ঠিক, ব্যক্তিগত আগ্রহও শিক্ষকদের কমে আসছে। নেই প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা: বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের প্রশিক্ষণের তেমন ব্যবস্থা নেই।

এখন শুধু বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে সীমিত পরিসরে শিক্ষকদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা আছে। গ্র্যাজুয়েট ট্রেনিং ইনস্টিটিউট নামে ওই প্রশিক্ষণ কেন্দ্রটি এফএও এবং ইউএনডিপির সহায়তায় ১৯৭৬ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়। কৃষিক্ষেত্রে কর্মরত কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণ দেওয়ার উদ্দেশে এটি প্রতিষ্ঠিত হয়। এটি মাঝে বেশ কিছু দিন বন্ধ ছিল। আবার চালু হয়ে তিন বছর ধরে তা চালু হয়েছে।

ইউজিসির অনুমোদনক্রমে এখন সেখানে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের নতুন নিয়োগ পাওয়া শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ দিয়ে থাকে। এ ছাড়া অন্য কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে এ ব্যবস্থা নেই। ইউজিসির চেয়ারম্যান এ কে আজাদ চৌধুরী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্য থাকাকালে এ বিশ্ববিদ্যালয়ে এ ধরনের একটি উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। কিন্তু তা বেশি দিন চলেনি। আজাদ চৌধুরী বলেন, চার বছর এটি চলেছিল।

ইউজিসির চেয়ারম্যান বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা নিজের বিষয়ে বিশেষজ্ঞ। তার পরও প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা যেতে পারে। কারণ শিক্ষকতা হচ্ছে ‘পারসুয়েসিভ কমিউনিকেশন’ (উদ্ধুদ্ধকরণ যোগাযোগ)। এ ধরনের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা থাকা ভালো। সূত্র: ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।