আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

কুট্টি-পরাণ ছোট গল্প

( এক ) -----"মামা-ভাগিনা যেখানে , ভয় নাই সেখানে, ------- মামা-ভাগিনা যেখানে, ভয় নাই সেখনে। --------" যতক্ষন না দাদুর খড়মের আওয়াজ আমাদের কানে আসত, ততক্ষন দুজনে গলা জড়াজড়ি করে, দুলে দুলে এভাবে পড়তে বসার মহড়া দিতাম। এটা ছিল আমাদের নিত্য নৈমিত্তিক ব্যাপার। এতে যে তখন আমাদের কি আনন্দ হত, আজ আর তা বলতে পারব না। গ্রামে, পাঠশালায়, বাড়ীতে আমাদের উপদ্রবে সকলে সর্বদা ছিল আতঙ্কিত।

কোথায় না ছিল আমাদের বিচরণ? খালে , বিলে, জলে, জঙ্গলে, মাঠে-ঘাটে সর্বত্র সর্বত্র আমরা সমান প্রতাপে বিরাজ করতাম। সারা দিনের সকলের সব নালিশ এসে জমা পড়ত দাদুর কাছে। দাদুও তক্কে-তক্কে থাকতেন কখন দুটোকে একসাথে পাবেন। ঠিক সন্ধ্যের সময় দুটোকে একসাথে বাগে পেতেন,--------ফলে পায়ের খড়ম মাটিতে না নেবে, কখন যে আমাদের পিঠে উঠবে, সেই অপেক্ষায় দম বন্ধ করে, মাথা নীচু করে থাকতাম। দম আটকে রাখলে শুনেছি, শরীরের ওপর ব্যাথা তেমন বসতে পারেনা।

যাইহোক, সে যাই করিনা কেন, ব্যাথা ঠিকই পেতাম। তবে এটাও আমাদের নিত্য-নৈমিত্তিক ব্যাপারে স্থান করে নিল। ( দুই ) আমার জ্ঞান হওয়া অবধি প্রথম যে , মানুষটিকে আমার সব চাইতে খারাপ লেগেছিল সে এই দাদু। এমন কাট-খোট্টা, রস-কষহীন, চশমখোর বুড়ো আমি জম্মে দেখিনি। চব্বিশ-ঘন্টা ঠ্যাং এর ওপর ঠ্যাং তুলে, সবার ওপর ছড়ি ঘোরানই ছিল ওনার কাজ।

বিশাল সম্পত্তির অধিকারী হয়ে শুধু জমিদারী মেজাজটাকেই সারা জীবন ধরে শান দিয়েছেন। পৃথিবী শুদ্ধু সব যেন ওনার প্রজা। স্ত্রী, পুত্র, আত্মীয়, বান্ধব, সবার সবার ওপর ওরকম রক্ত-চক্ষু করে ওনার যে কি সুখ হোত আমি ভেবে পেতাম না। কতদিন যে মনে মনে এই বুড়োটার মৃত্যু কামনা করেছি, তার ঠিক নেই। ----এইরকম বীর-বিক্রম, কঠোর প্রতাপ-শালী এক ব্যাক্তির সাথেই , আমার দিদা, যে নাকি তূলোর চাইতেও নরম, পাখীর চাইতেও ছোট্ট-------- আমার সব চাইতে আদরের একমাত্র দিদা, যে কি করে সারা জীবন ওনার সাথে সংসার করেছিলেন, আমার বুদ্ধিতে আসেনা।

আজ-কালকার দিন হলে নির্ঘাৎ খুনোখুনি হয়ে যেত। ( তিন ) যাইহোক, সে দৈব-রোষেই হোক আর দৈব-বশেই হোক, মাত্র তিন-মাস বয়স থেকেই আমার স্থান হয়েছিল সেখানে। কারণ আমার জন্মের পর পরই আমার মা প্রচন্ড অসুস্থ হয়ে পড়েন। আমি ছিলাম আমার মায়ের তৃতীয় সন্তান. আমার যখন মাত্র তিন-মাস বয়স, তখন থেকে আমার মায়ের পক্ষে আমাকে দেখাশোনা করা অসম্ভব হয়ে পড়ে। এদিগে, আমার তিন-মাস আগেই আমার ছোট মামার জন্ম।

তখনকার দিনে এটা কোন ব্যাপারই নয়। এরকম হামেশাই ঘটত। ফলে ঠিক হোল, আমাকে দিদার কাছেই পাঠিয়ে দেওয়া হোক। এটাও তখনকার দিনে কোন ব্যাপারই নয়। অতজন ভাই-বোনের মাঝে, দু-একটা ওরকম মামার বাড়ী, জ্যাঠার বাড়ীতেই মানুষ হয়ে যেত।

----সেই থেকে ছ-মাসের মামা আর তিন মাসের ভাগনা আমরা দিদার এক বুকের কাছে শুয়ে, এক বুকের দুধ খেয়ে বেড়ে উঠেছি। সম-বয়সী মামা-ভাগিনা আমরা ছিলাম বন্ধুর মত। দিদারও ছোট ছেলে আর এই নাতির ভেতরই ছিল যেন প্রান। কতদিন দেখেছি, দাদু যখন আমাদের পেটাত, দিদা দরজার আড়ালে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে চোখ মুছত। কিন্তু ওই পাষন্ডের কবল থেকে আমাদের উদ্ধার করে তা কার সাধ্যি? ----- যেই দাদু চলে যেত, অমনি দিদা, এক-বাটি তেল এনে, আমাদের দুজনের হাতে-পায়ে বেশ রগড়ে রগড়ে মালিশ করে দিত।

আর বারবার বলত,----------" আহারে আমার সোনার অঙ্গ কেমন লাল লাল হইয়া ফুইল্যা ফুইল্যা গেছে। ক্যান, ক্যান কথা শোনোস না? প্রেত্যেক, প্রেত্যেক-দিন ইরকম গরু ছাগলের মত পিটানি খাইতে তগো ভাল লাগে?---------" আমরাও কেমন জানি একটা বেহায়া টাইপের হয়ে গেছিলাম। আমাদের কেমন যেন একটা জেদ চেপে গেছিল। যতই মার খাই, ততই বেপরোয়া হয়ে উঠছিলাম। ( চার ) একদিনের একটা ঘটনার পরতো আমি আর কোনদিন ওনাকে দাদু বলেও ডাকিনি।

----- প্রতি-বছর মামা বাড়ীতে খুব ধূমধাম করে দূর্গা পূজা হোত। প্রচুর লোক ওই চার-দিন মামা-বাড়ীতে ইচ্ছেমত ভোগ পেত। আসলে বিশাল সম্পত্তি, কোন কিছুরতো অভাব ছিল না। তা সেদিনও, একের পর এক, সারি সারি পাত পেতে খেতে বসছে। বিশাল মাটির নিকোনো উঠান।

বারবার ভিজে-ভিজে পেছল হয়ে যাচ্ছে। অনেকের সাথে দিদাও পরিবেশনে লেগে গেছে। আর ওই বুড়ো, একটু দূরে বারান্দায় বসে, কোন ত্রুটি হয় কিনা সেদিকে নজর রাখছে। -------------এত তাড়া-হুড়োর মাঝে দিদা আচমকা পা পিছলে, হাতা-গামলা সব নিয়ে পড়ে যায়। দিদা এত ব্যাথা , এত লজ্জা, এত ভয় পেয়েছিল যে, উঠতেই পারছিল না।

আমরা সকলে মিলে তুলে ঘরে এনে শুইয়ে দিলাম। অথচ ওই বুড়ো? তুলে ধরাতো দূরের কথা, একটিবার কোথায় লেগেছে , তাও জিজ্ঞেস করল না। ----- পুরুষ?---- এই না হলে পুরুষকে মানায়? সার্থক-নামা পুরুষ! দয়া, মায়া, মমতা কিচ্ছুর প্রয়োজন নেই। সর্ব্বক্ষন, সর্ব্বক্ষন সকলকে শুধু চাবকে বেড়াও। ------------- (পাঁচ ) সম-বয়সী হওয়ায় আমি কখনও ওকে মামা বলে ডাকতাম না. এই ব্যাপারটাতেই ছিল দিদার মস্ত আপত্তি।

শুধু একটু ছোট-মামা ডাকার জন্য দিদা যে আমার কত বিদঘুটে, বিদঘুটে বায়না সহ্য করেছে তার ঠিক নেই। কিন্তু তা বললে হবে কি? আমি তাতে মোটেই রাজি ছিলাম না। আমার কথা একটাই, প্রায় আমার সমান, তবে কেন আমি ওকে মামা ডাকব? তার ওপর দেখতেও ছিল আমার চাইতে ছোট্ট-খাট্টো। সুতরাং কিছুতেই ওকে মামা ডাকা চলবে না। কিন্তু তাই বলে একেবারে নাম ধরে ডাকা? দিদার কাছে এটা ছিল ভীষণই লজ্জার।

রতনের পরিবর্তে, সামান্য সন্মান-সূচক একটা কিছু ডাকার জন্য দিদার সে-কি কাকুতি-মিনতি। সব শেষে দিদাই একদিন বলল, -" আচ্ছা পরাণ, রতনতো সকলের ছোট, তুই ওরে " কুট্টি-মামা " ডাকিস কেমুন। ভবি ভোলবার নয়। আমার তাতেও আপত্তি। মামা আমি ওকে কিছুতেই ডাকব না।

যাহোক, অবশেষে কাট-ছাঁট করে, শুধু কুট্টিতে এসেই রফা হোল। দিদা তাইতেই সই। এতদিনে বিরাট এক সমস্যার সমাধান হোল। সেই থেকে আমরা মানিক-জোড় সবার মুখে এক কথায়, এক সুরে, এক ডাকে -" কুট্টি-পরাণ "- -----একমাত্র ওই বুড়োর ঠ্যাঙ্গানি ছাড়া আমরা বেশ ভালই ছিলাম। আর সেও-তো দিন গেলে মাত্র একবার।

ও আমাদের অভ্যেস হয়ে গেছিল। কিন্তু আমাদের সেই আনন্দের দিনগুলোতে দেশে মোটেই শান্তি ছিলনা। দেশ ভাগাভাগি নিয়ে, তখন চারপাশে এক বিভীষিকা ছড়িয়ে পড়েছিল। ---আমার বাবা ছিলেন অত্যন্ত শান্তি-প্রিয় মানুষ এইসব গন্ডগোলের আঁচ পেয়েই, ভেতরে ভেতরে তাঁর এক হিতৈষীর সাথে, বাড়ী-ঘর বদলা বদলি করে, নদীয়ায় এক গন্ডগ্রামে বসতি স্থাপনের ব্যাবস্থা করেন। কারণ দেশের এই রকম পরিস্থিতে, চির-রুগ্না মা ও আমার আরও চার ভাই-বোনকে নিয়ে বাবা ওখানে থাকতে ঠিক ভরসা পান না আমার যখন বছর বার বয়স, তখন সবার সাথে আমাকেও এখানে নিয়ে এলেন।

এভাবেই এদেশের মাটিতে আমি উড়ে এসে জুড়ে বসলাম। তবে ওই এক-রোখা বুড়োকে কেউ নাড়াতে পারল না। একমাত্র কুট্টি ছাড়া, আমার অন্য মামাগুলোও ছিল ঠিক ওই বুড়োর মতই ঠ্যাঁটা। ------কুট্টি আর দিদাকে ছেড়ে আসতে, সেদিন যে আমার কি কষ্ট হয়েছিল, তা বোঝাতে পারব না। আজ পর্যন্ত আমার অভাবে, দিদার মত অমন কাতর হতে আমি আর কারুককে দেখিনি।

----এদেশে এসেছি, সব চাইতে আপন-জন, মা, বাবা, ভাই-বোন সকলকে কাছে পেয়েছি। ঘরে নতুন, বাইরে নতুন, সঙ্গী নতুন, সঙ্গা নতুন। এতসব নতুনের মাঝে আমি আমাকে হারিয়ে ফেলেছি। নিজেকে মানাতে মানাতে কবে কখন যে একটা সম্পূর্ণ আলাদা মানুষ হয়ে গেছি টেরই পাইনি। ( ছয় ) প্রথম প্রথম ঘন ঘন চিঠিতে যোগাযোগ রেখেছি।

ক্রমশঃ কমতে কমতে একদিন দিদার শেষ চিঠিও পেয়েছি। স্মৃতি আবছা হয়, তবু আলগা হয় না। আজ আবার এতদিন পর দিদা কি সত্যিই আমায় ধরা দেবে? শিশু মনের গভীরে লুকোন সেই সব ছবি, একে একে জীবন্ত হয়ে ফুটে ওঠে। -----প্রতিদিন সকালে আমাদের দুটোকে পড়তে বসিয়ে, দিদা এক কাপ চা আর ছোট্ট একটা চক্-চকে কাঁসার বাটিতে ফুলের মত সাদা খই নিয়ে, পাশটিতে এসে বসত। দিদার ওই কাপটা আমার খুব পছন্দ ছিল।

পাতলা ফিনফিনে, দুধের মত সাদা কাপে চা এর জন্য যেন এক গোলাপী আভা ঠিকরে বেরোত। ------------ ঠিক যেমন আমার দিদার ফর্সা চামড়া, রক্তের আভায় রেঙ্গে থাকে ঠিক তেমন। আমি অবাক হয়ে দিদার খাওয়া দেখতাম। আরতো কখনও দিদাকে খেতে দেখতাম না। শুধু সকলকে খাওয়াতেই দেখতাম।

কখন খায়? কত-টুকুই বা খায়? আমি কেন? কেউই বোধ-হয় জানত না। ওই কাপটাই ছিল, আমার ছেলে বেলার চোখে দিদার সৌখীনতার প্রথম নিদর্শন। পাতলা ছিপছিপে গড়ন, এলোমেলো, আগোছালো, কাল-কুচকুচে, তেল-চুকচুকে চুল। মাথা জড়িয়ে, কপাল ছাপিয়ে, লতি দুলিয়ে, পিঠে চেপে থাকত। আজ-কালকার দিন হলে অবশ্যই স্টেপকাট্ বলে চালিয়ে দেওয়া যেত।

সারাটা বেলা যেন একটা প্রজাপতির মত উড়ে-উড়ে, দুলে-দুলে, ঘুরে-ঘুরে সবার সেবা করে যেত। আমার আহ্লাদী মন দিদার জন্য কষ্ট পেত। আসলে তখনতো বুঝতে পারতাম না, আমাদের এসব পার্থিব সুখ-দুঃখ কিছুই যে দিদাকে স্পর্শ করে না। ( সাত ) এখন আমার ঘরে কত-রকম গান শোনার সরন্জ্ঞাম। রেডিও, টেপ-রেকর্ডার, টি,ভি, আরও কত কি? আর এফ,এম? সে তো আরও দুর্ধষ্য।

চব্বিশ ঘন্টাই কিছু না কিছু শুনিয়েই যাচ্ছে। অতি সামান্য লিখতে পড়তে জানা, দিদার সব চাইতে বড় শখ ছিল গান শোনা। কিন্তু সে কোথায় শুনবে? মাঝে মাঝে বাড়ীতে থাকলে দেখতাম, দুপুরে বাউল-ভিখিরি এলে, দাদুর ভয়ে, দিদা তাদের ধানের গোলার পেছনে নিয়ে যেত। তারপর তাদের হাতে একটা কাগজ-পেন্সিল ধরিয়ে দিয়ে, নিজে বসে বসে বিভোর হয়ে গান শুনত। আবার তাদের দিয়ে লিখিয়ে নিত।

বাউল জীবনে এরকম এক-নিষ্ঠা শ্রোতা বোধহয় তারা আর পায়নি। ----সবশেষে তাদের কিছু খাইয়ে চুপিচুপি ঘরে ফিরে আসত। আমি ছাড়া এসব কেউ লক্ষ্যই করত না। দিদার গলাটাও ছিল ভারী মিষ্টি। সব সময় কুনকুন করে গলায় সুর ভেঁজেই চলেছে।

আমি এসব খুব লক্ষ্য করতাম দেখে দিদা একদিন আমায় বলেছিল,-----------"পরাণ, তোর মত আমারে, এ সংসারে কেউ এত ভালবাসে না-রে। দেখিস, আমি মইরা তোর ঘরে আবার জন্ম নিমু। তুই তখন আমারে অনেক পড়া-লিখা আর অনেক গান শিখাবি কেমুন। ---------" ---বহির্জগৎ ছিন্ন, গ্রাম্য, অশিক্ষিত, দলিত, অবহেলিত এক মহিলার সূদূর প্রসারী কামনা আজ আমায় জাগিয়ে দিল, নাড়িয়ে দিল। ------------- আজ, আমি, প্রথম কন্যার জনক হলাম।

----------- ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।