আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

"এক নাবিকের রক্ত আমার দেহে"

কিছুদিন আগে বাবা আমাকে ফোন করে জানালেন, তিনি মেলা থেকে দুটি ঘুড়ি কিনে এনেছেন। প্রথমে শুনে অবাক হইনি কারণ বাসায় ৫/৬ বছর বয়সের আমার আদরের ভাগ্নে আছে, বাবা হয়ত ওর জন্যেই কিনে থাকবেন। কিন্তু অবাক হলাম যখন তিনি জানালেন দুটি ঘুড়িই তিনি আমার জন্যে কিনেছেন। মনে মনে কিছুক্ষন হাসলাম, তখন বাবাকে কিছুটা খামখেয়ালও মনে হলো। পরে তিনি নিজেই তার খামখেয়ালীপনার শেষ টানলেন।

জানালেন, বহুদিন পর অষ্টমির মেলাতে গিয়েছিলেন, সেখানে হরেক রকম জিনিসের সাথে আকাশে উড়ানোর ঘুড়িও বিক্রি হচ্ছিলো, যাদের এখন শৈশব চলছে এমন অনেক শিশু কিশোর ভিড় জমিয়ে আছে ঘুড়িওয়ালার ঝুপরির সামনে, ঘুড়ি কিনছে, আকাশে উড়াচ্ছে। এসব দেখে বাবার অন্তরে টান পড়লো তার ছেলেটির কথা মনে করে যে কিনা ১৭/১৮ বছর আগে এমনি এক কিশোর ছিল এবং যেকোন মেলায় তার এক নম্বরের বায়না ছিল ঘুড়ি কেনা। ছোটবেলায় কতযে ঘুড়ি উড়িয়েছি, স্কুলে যাবার আগে, স্কুল থেকে ফিরে কাজ একটাই, ঘুড়ি উড়ানো। নিজে কখনো ঘুড়ি বানাতে পারতাম না, তাই যে ভালো ঘুড়ি বানাতে পারত তার সাথেই আমার সবচেয়ে বেশি খাতির ছিলো। বাবা দেখতেন, কখনো বাধা দিতেন না।

অনেকদিন পর আকাশে রঙ বেরঙ্গের ঘুড়ি আর বাচ্চা ছেলেদের ছুটাছুটি দেখে স্মৃতিকাতর হয়ে পড়েছিলেন বাবা। তাই তিনি নিজে ঘুড়ি কিনলেন, তার মাঝবয়েসী ছেলের জন্য নয়, সেই বড় না হওয়া কিশোরের জন্য। আমার বাবা, পেশায় একজন নাবিক। সমুদ্রগামি জাহাজে করে ঘুরে বেড়ান সারা পৃথিবী, আজ এই বন্দর তো কাল অই বন্দর। এই পেশাগত কারণে বাবাকে ছোটবেলা থেকে খুব একটা কাছে পাইনি।

একবছর দেশে থাকলে একবছর জাহাজে থাকেন। শিশু কাল থেকেই এভাবে বাবার অনুপস্থিতি আমার মাঝে বিশাল প্রভাব ফেলে। ছোটবেলাতে দেখতাম বাবা কোথায় যেন চলে যেতেন, তারপর শুধু তার লিখা চিঠি আসতো। পাতলা খামের মধ্যে আমার জন্য সবসময় একটা চিঠি থাকতই। চিঠির বর্ননায় পড়তাম সাগরে বাবার নাবিকি জীবন, উত্তাল সাগর আর সুন্দর দেশের কতকথা।

"সারেঙ বউ" ছবির সারেঙ ফারুক যেভাবে জাহাজের কর্ম শেষে বাড়ি ফিরেছিলো, ঠিক তেমন করেই বাবা দুহাতে নকশা করা বিদেশি ব্রিফকেস নিয়ে বাড়ি ফিরতেন নানান রকম জিনিস নিয়ে, জানিনা মনে মনে গাইতেন কিনা, "ওরে নীল দরিয়া আমায় দে রে দে ছাড়িয়া"। বাবার কাছেই শুনেছি, সাগরের টান নাকি অন্যরকম, সহজে ছাড়তে চায় না, ডাঙ্গায় থাকলে সেই সাগরের গর্জন সবসময় কানে বাজতে থাকে, সাগর নাকি দুহাত তুলে ডাকে। বাবা যখন দেশে ফিরতেন, জিদ ধরতাম, আর যেতে দিবনা। কিন্তু কাজের খাতিরে আর সাগরের টানে বাবাকে আটকাতে পারতাম না। প্রতিবারই যাবার সময় বাবা বলে যেতেন, এবার যেতে দাও তোমার জন্য অনেক খেলনা আনবো।

খেলনার লোভে বাবাকে ছেড়ে দিতাম। বাবা চলে যেতেন, তখনো হয়তো মনে মনে গাইতেন, "এই না পথ ধরিয়া আমি কতযে গেছি চলিয়া"। আমি পিছন থেকে এক দৃষ্টিতে বাবার চলে যাওয়া দেখতাম আর ভাবতাম এটাই হয়ত শেষ দেখা, কারণ সাগরেতো কত রকম বিপদ থাকতে পারে। ছোটসময় ভাবতাম হয়ত তিমি মাছ কিংবা হাঙ্গর জাহাজ উল্টিয়ে বাবাকে খেয়ে ফেলবে অথবা সাগরে ঝড় উঠবে তখন হয়ত কাউকেই আর বাচানো যাবে না। এজন্য বাবার কাছে সবসময় শুনতে চাইতাম সাগরের তিমি কত বড় কিংবা ঝড় এলে কী করে রক্ষা পায়।

বাবাও আমাকে নানারকম ভুলভাল কাহীনি বলে আস্বশ্ত করতেন। মনে পড়ে ২০০৪'র দিকে ভারত মহাসাগরের সুনামির কথা। তখন বাবা জাহাজে করেই শ্রীলংকার কাছাকাছি কোথাও ছিলেন। টিভি তে খবর দেখেতো আমাদের অবস্থা খারাপ। সমুদ্রে ঝড়, হাজার মানুষের মৃত্যু, কোন কিছু জানতে পারছিলাম না।

চিটাগঙ্গের অফিসে ফোন দিয়ে কিছুটা জানতে পেরেছিলাম যে সবাই নিরাপদে আছেন। তারপরেও কেন জানি মনে মানছিলো না। তারপর টানা ২৬ দিন পর বাবার ফোন। এই ২৬টা দিন যে কিভাবে পার করেছি একমাত্র সৃষ্টিকর্তাই জানেন। কলেজে পড়ার সময় একবার বাবার সাথে চিটাগং গিয়েছিলাম।

বাবা অফিসের কাজে আর আমি তার সাথে ঘুরতে। উঠেছিলাম নাবিকদের জন্য সরকারি আবাসন সী-ম্যান'স হোস্টেলে। সেখানে অনেক নাবিকের সাথে আমার পরিচয় হয়। বাবার সাথে ঘুরতে এসেছি শুনে সবাই আগ্রহ দেখিয়েই আমার সাথে গুল্প করতে থাকে। কেন জানি সবার চেয়ে আমার বাবাকেই বেশী সাহসী মনে হয়েছিলো, মনে হয়েছিল একজন সত্ত্যিকারের নাবিক।

বাবা আমাকে সমুদ্র দেখাতে নিয়ে গেলেন। এর আগে কখনো সমুদ্র দেখিনি। বাবার কাছে সারাজীবন সাগরের গল্পই শুনেছি। সেই সাগর দেখতে কেমন তা প্রথম দেখেই আমি একটা কথা বলেছিলাম, "সাগর এত বিশাল"। আমি, বাবা আর সাথে তার কয়েকজন কলিগ গিয়েছিলাম একসাথে।

বাবা আমাকে সাথে রাখলেন না, বললেন একা ঘুরে ঘুরে দেখতে। আমি কিছুক্ষন হেটে একটা বড় পাথরের উপর বসলাম যেখানে একটু পর পর ঢেউ এসে ধাক্কা দিচ্ছিলো। সাগরের গর্জন খুব কাছ থেকে শুনছিলাম। পাথরে বসে এক দৃষ্টিতে সাগরের দিকে তাকিয়ে থাকলাম, যে সাগরের বিশালতা বাবা বুকে ধারণ করে আছেন, সেই সাগরের কাছে আমার ঋণ স্বীকার করলাম। এদিকে বাবা আমাকে দূর থেকে খেয়াল করছিলেন আমি কি করি।

তিনি খেয়াল করলেন আমার চোখ থেকে পানি পড়ছে। তিনি আমার কাছে আসলেন, তারপর বললেন, "সাগরে চোখের জল ফেলতে নেই'। কিন্তু আমি জানি কত যে চোখের জল বাবার চোখ থেকে গড়িয়ে সাগরের জলে মিশেছে সারাজীবনে। আমার চোখ থেকে ক'ফোটা জলতো সামান্যই। সেবার সাগর দেখা হয়েছিলো কিন্তু উত্তাল সাগরের যে উন্মাদনা তা উপভোগ করেছিলাম গতবছর শিক্ষাসফরে গিয়ে।

টেকনাফ থেকে সেন্টমার্টিন সমুদ্র ভ্রমন। মাঝ দরিয়ায় গিয়ে তখন কেমন জানি আপ্লুত হয়ে পড়েছিলাম। বাবা বলেছিলেন, একেবারে সাগরের মাঝামাঝি যেয়ে যেন তাকে ফোন দেই। আমি অবশ্য একটু পর পরই মা আর বাবাকে ফোন দিচ্ছিলাম। মাঝ দরিয়ায় যেয়ে যেখান থেকে কোন কিনারা দেখা যায় না, বাবার সাথে যখন কথা বলছিলাম, বাবা বললেন "বল দেখি তোমার সাহস বেড়েছে কিনা?" আমি টের পেলাম সত্যিকার অর্থেই আমার সাহস বেড়ে গিয়েছে।

সাগরের মহিমাই এমন। বিশালতার কাছ থেকেও অনেক কিছু পাওয়ার আছে, শেখার আছে। ছেড়া দ্বীপ থেকে ট্রলারে করে ফিরছি। ততক্ষনে জোয়ারের ঢেউ এসে গেছে। সাগরের উতাল পাতাল ঢেউএ মনে হচ্ছিল যেন বাতাসে ভেসে ভেসে যাচ্ছি।

তখনো আমি যেন একটু বেশিই আপ্লুত হয়েছিলাম। নিমিশেই চোখের জল বেয়ে পড়ছিলো। কান্না চাপাতে পারেনি বাবার কথা মনে করে। এক নাবিকের রক্ত আমার দেহে। সাগর আমার অনেক চেনা, অনেক আপন।

ট্যুর থেকে ফিরে বাবা মা কে বলেছিলাম আমি নাবিক হতে চাই। বাবা শুধু মুচকি হাসলেন আর মা কাকুতি মিনতি শুরু করলেন। বললেন আর কিছুতেই তিনি তার আপনজনদের সাগরে ভাসতে দিবেন না। আপনজন সাগরে দিয়ে ঘরে বসে দিন কাটানো যে কি কষ্টের আমার মার চেয়ে ভালো আর কে জানে। বড় হয়েছি বলেইতো বাবার কাছে আর নয়।

স্কুল, কলেজ আর বিশ্ববিদ্যালয় জীবন বাড়ির বাইরে থেকেই মানুষ। যত দিন যাচ্ছে ততই যেন শিশুতে পরিণত হচ্ছি। প্রতিবেলার খোজখবর দিতে হয়। একমুহুর্ত অজানা হয়ে গেলে তিনি উত্তেজিত হয়ে যান। মনে পড়ে স্কুলে পড়ার সময়কার কথা।

আমি হোস্টেলে থাকি। বাবা তখন দেশে। নিয়মিত এসে দেখা করে যেতেন। আমাকে স্কুলে পৌঁছে দিয়ে বিল্ডিংয়ের আড়ালে লুকিয়ে থাকতেন, আমি কি করি তা দেখার জন্য। আমিও, বাবা যখন চলে যেতেন দরজার ফাক দিয়ে তার চলে যাওয়া দেখতাম যতক্ষন পর্যন্ত না তিনি অদৃশ্য হয়ে যেতেন।

যখন কোথা থেকে আসি বা কোথাও যাই বাবা সবসময় আগ বারিয়ে হ্যান্ডশেক করেন। বাবার সাথে হাত মিলাই। প্রতিবার হাত মেলানোর সময় মনে পড়ে বাবার বলা কথা। একদিন তার এই হাত দেখিয়ে বলেছিলেন, "দেখ এই হাত, কত শক্ত আর খসখসে, এই হাত দিয়ে পরিশ্রম করেই টাকা উপার্জন করি, তোমাকেও একদিন টাকা উপার্জন করতে হবে, তবে আমি চাই না তোমার হাত এমন শক্ত আর খসখসে হোক, মেধাই হবে তোমার উপার্জনের পথ"। মাঝে মাঝে নিজের হাতের দিকে তাকাই।

এই হাত আদৌ নরম থাকবে কিনা জানিনা। কয়েকদিন আগে বাবা ফোন করে বললেন একটা গুড নিউজ আছে। আমি ভাবলাম হটাৎ আবার কী করলেন তিনি। হাসিমুখে জানালেন তিনি ৭২ ঘন্টা যাবত ধূমপান থেকে বিরত আছেন। আমি হাসতে হাসতে খুন।

আমার বাবা অবশেষে ধূমপান ছাড়তে প্রচেষ্টা চালাচ্ছেন। এই ধূমপানের বেপারে একটা বিশেষ মহাত্য আমার আর বাবার মাঝে আছে। কারণ প্রায় তিন বছর আগেও আমি একজন ধূমপায়ী ছিলাম। মা জানতেন। তিনি অনেকবার চাপাচাপিও করেছিলেন ধূমপান ছাড়ার জন্য, কিন্তু ছাড়তে পারিনি।

একদিন কিভাবে যেন বাবা টের পেয়ে যান। তারপর বাবা আমার সাথে কথা বলা বন্ধ করে দিলেন, সেই সাথে নাওয়া খাওয়াও। বাবা নিজেও একজন ধূমপায়ী, তাই ভেবেছিলাম বেপারটা বাবা সহজ ভাবেই নিবেন। কিন্তু হলো প্রায় উল্টা। প্রায় দুইদিন কিছু খেলেন না।

আমি সাথে সাথে সিদ্ধান্ত নিলাম আর ধূমপান নয়। সেই থেকে এখন পর্যন্তও আমি আর সিগারেট হাতে নেই নি। কিন্তু বাবার শরীর দিন দিন খারাপ হয়ে যাচ্ছে ধূমপানের কারণে। মা অনুরোধ করেন যেয়ে বাবাকে ধূমপান না করার কথা বলতে, কিন্তু আমি কিছু বলি না। কারণ বাবা আমাকে নীজ মুখে কিছু বলেননি।

বাবার প্রতি ভালোবাসা থেকেই আমি ধূমপান ছেড়েছি। এখন তার যদি ছেলের প্রতি ভালোবাসা থাকে তাহলে নীজ থেকেই ধূমপান ছেড়ে দিবেন। এ আর এমন কি। আমি ছেড়েছি না। অবশেষে তিনি ধূমপান ছেড়েছেন।

জানি তিনি পারবেন। বাবার বয়স এখন ৫৮। প্রায় বলে থাকেন আমার সময়তো প্রায় শেষ। এসব শুনে খুব কষ্ট পাই। কিছু ভাবতে পারি না।

রাত গভীরে বালিসে মুখ চেপে কান্নাকাটি করি। বাবা ছাড়া শুন্য বাড়ি, শুন্য বারান্দা, শুন্য চেয়ার কিভাবে দেখব। তারপরেও একদিন না একদিন সবাইকেই চলে যেতে হবে। তবে চাই না তার কোন চাওয়া অপূর্ণ থাকুক। একদিন হয়ত কিছুই থাকবে না, বা তার অস্তিত্ব হয়ে আমি থাকব, থাকবে তার স্মৃতি, বলা কথা, সাগরের জলে জমা চোখের জল, আর খসখসে হাতের স্পর্শ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।