সকালের মিষ্টি রোদ বিছানার ওপরে পড়েছে। পর্দাটা আরও একটু ফাক করা থাকলে বোধহয় রোদটা ঠিক অনুর মুখের উপর গিয়ে পড়ত। কিন্তু যখন রোদ দেখল সে শত চেষ্টা করেও অনুর ঘুম ভাঙাতে পারবে না তখন সে হাল ছেড়ে দিল।
বোথহয় রোদ চুপিচুপি ফোনটাকে বলল, “বেজে ওঠ”। আর সঙ্গে সঙ্গে ফোন বেজে উঠল।
অনু আড়মোড়া ভেঙে ফোনটা তুলে কানের কাছে ধরল। “হ্যালো”
“বেঁচে আছ?”ওপাশ থেকে কর্কশ কণ্ঠে অনুর বাবার গলা শোনা গেল।
“কেন কি হয়েছে ?”
“এখন কটা বাজে জান? তোমার মাকে ফোন করে জানতে পারলাম তুমি নাকি এখনও ঘুমাচ্ছ। তাই বাসায় ফোন করলাম। “
“ঠিক আছে।
এখন তো উঠেছি। ফোনটা রাখ। আমার কোচিং আছে। “
“কোচিং!” বাবা তাচ্ছিল্যভরে বললেন। “কোচিং এ এখন গেলে তোমার স্যারকে পাবেনা।
সে এতক্ষনে কলেজে চলে গিয়েছে। তুমি বরং কলেজ যাও। “ বলে বাবা ফোন রেখে দিলেন।
অনু তার বাবার কথা যাচাই করার জন্য ঘড়ির দিকে তাকাল। ঠিক সাড়ে আটটা বাজে।
মানে এখন রেডি হয়ে যেতে যেতে কলেজ বাসও মিস হবে। তার চাইতে আরও একটু ঘুমালে ভাল হত। কিন্তু বাবাটা যে কি? ঘুমের বারোটা বাজিয়ে দিয়েছে।
অনু চা খেতে খেতে বারান্দায় বসল। আর চিন্তা করতে থাকল।
অনুর বাবা মা দুজনেই দেশের বাইরে থাকেন। অনু একটু বড় হওয়ার পর থেকে ওকে কাজের লোকের হাতে বড় হতে হয়েছে। মা বাবা বলে যে কোন জিনিস আছে সেটা অনু জানে না। এক ফোন ছাড়া টানা পাঁচ বছর অনুর সাথে তার বাবা নায়ের কোন মুখোমুখি হয়নি।
সেজন্য অনু বরাবরই তার মা বাবাকে অপছন্দ করে।
বেশি অপছন্দ করে তার বাবাকে। বাবা কখনই তার সাথে ভালভাবে কথঅ বলেন না। যে বাবা সকাল বেলা ফোন করে জানতে চায় তার মেয়ে বেঁচে আছে কিনা সে আর যাই হোক ভাল বাবা হতে পারেন না। মার কথা অনু চিন্তাও করতে চায়না। কিন্তু মার সাথে কথা বলতে অনুর ভাল লাগে।
টখন যে কিভাবে সে অন্তরের ঘৃনাটাকে দমন করে তা সে নিজেও জানে না। বাবা মা কখনও কখনও এসে অনুর সাথে দেখা করে যান। কিন্তু দুজন কখনও একসাথে আসেন না। অনু কখনও তার পরিবারকে এক ছাদের নিচে দেখেনি। এসব ভাবতে ভাবতে অনু দেখল দশটা বেজে গেছে।
ও চায়ের কাপটা রেখে গোসল করে নিল। সুন্দর একটা জামা পরে কাজের লোককে বলে বাইরে বার হল। এখন তার কোন গন্তব্য নাই। তাই এমনিই হাটতে হাটতে পার্ক পর্যন্ত গেল। পার্কে হঠাত তার চোখে পড়ল একটা ছোট বাচ্চা হাটার চেষ্টা করতে গিয়ে বারবার পড়ে যাচ্ছে আর তার বাবা কোনও কোনও বার তার মা তাকে সামলে নিচ্ছে।
এই ঘটনাটা অনু নিজের জীবনে দেখার চেষ্টা করল। কিন্তু ওর চোখে পড়ল ওর কাজের লোক ওকে হাটা শেখাচ্ছে কিংবা ও নিজেই হাটা শিখছে।
বাসায় ফিরে শুনল ওর জন্য একটা পার্সেল এসেছে। কার্ডটায় নাম দেখল ‘খুশি’। কার্ডটা সেভাবেই রেখে দিল।
কারন অনু জানে পার্সেলে কি আছে। অনুর সবচেয়ে ভাল বান্ধবী খুশি। স্কুল লাইফ থেকেই। কিন্তু এখন অনু সাইন্স নিয়ে পড়ছে আর খুশি আর্ট পড়ছে। ও ভীষন ভাল ছবি আঁকে।
অনু তার বাড়িতে একটা আর্ট গ্যালারি খুলেছে তার ৬০% ছবি খুশির আঁকা। খুশি প্রতি মাসে একটা করে ছবি পাঠায়। তাই অনু জানে এতেও কোন ছবি আছে। তাই তার তেমন কোন আগ্রহ ছিল না। পার্সেলটা পরবর্তি দুই দিনের জন্য যেমন ছিল তেমনই থাকল।
কেউ হাত দিল না। তৃতীয় দিন বাবার কাছ থেকে একটা ফোন আসল।
“অনু তুমি কলেজ কেন ফাঁকি দিচ্ছ?”
“তোমাকে কে বলেছে?”
“তোমার মা। “
“মা যা শোনে তা হল কাজের লোকের বলা কথা। সে কখনই চাক্ষুস প্রমান করতে পারবে না যে আমি কলেজ ফাঁকি দেই।
“
“তুমি খুবই অসভ্য হয়ে গেছ। তোমাকে আমাদের যেকোন একজনের কাছে থাকার ব্যবস্থা করব। এবং আজকেই। “বলেই বাবা ফোন রেখে দিল। অনুর এখন কিছুই ভাল লাগছে না।
ও কিছুতেই বাবা মার কাছে থাকবে না। সে অভ্যাস ওর নেই। বানাবেও না।
রাগ করে খুশির পাঠানো পার্সেলটা খুলে ফেলল। তারপর ছবিটার দিকে কিছুক্ষন স্তব্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকল।
একটা বাচ্চা। তার এক হাত বাবা আর এক হাত মা ধরে হাটতে শিখাচ্ছে। অনু বুঝতে লারল ওর চোখ জ্বালা করতে শুরু করেছে। ধীরে ধীরে চোখ দুটো ভিজতে আরম্ভ করল।
অনু আস্তে আস্তে উঠে বারানদায় গেল।
রাত হয়ে গেছে। এখন প্রায় ৯টা বাজে। অনুকে ঠিক এই মুহূর্তে কোন সিদ্ধান্ত নিতে হবে। তার এই জীবনটা আর ভাল লাগছে না। সে এত বড়লোকের ঘরে জন্মাতে চায়নি।
তার খুব ইচ্ছা করে ছোট্ট একটা ঘরে বাবা মাকে নিয়ে থাকবে। সবকিছু হবে ছিমছাম। কোন জটিলতা থাকবে না। বাবা যখন অফিস থেকে ফিরবে তখন হঠাত তাকে জড়িয়ে ধরে চমকে দেবে। মার কোলে মাথা রেখে অনেক গল্প করবে।
মাকে বলবে যে তার একজনকে পছন্দ হয়েছে। মা চোখ পাকিয়ে তাকাবে। কিছুক্ষন পর বুঝবে যে অনু মজা করছে। তখন মা ও অনুর সাথে খিলখিল করে হেসে উঠবে। বাবার কাছে এটা ওটার জন্য আবদার করবে।
বাবা আদর করে বলবে অনু যা চায় তাই হবে। অনুর জন্মদিনে ও ওর সব বন্ধুকে দাওয়াত দিবে। তখন আর কারো কাছে জবাবদিহি করতে হবে না যে তার বাবা মা কেন বাসায় নাই। কারন বাবা মা তো পাশেই দাড়িয়ে থেকে অনুর সাথে কেক কাটবে। অনু একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল।
এগুলো শুধু স্বপ্নেই সম্ভব। অনু অনেক্ষন চোখ বন্ধ করে থাকল।
হঠাত ইলেকট্রিসিটি চলে গেল। অনু ভাবল পার্ফেক্ট টাইমিং। সে একটা মোমবাতি জ্বালাল।
কাজের লোককে সেদিনের মত ছুটি দিয়ে দিল। তারপর ঘরে এসে বসল। মোমবাতিটার দিকে তাকাল। মোমের আলো এত নিষপ্রাণ। কিছুক্ষন তাকিয়ে থাকলে চোখ ধরে যায়।
অনু একটা কাগজ কলম নিয়ে আসল। যেকোন ভাল কাজ করার আগে তার উপর একটা নোট রেখে যাওয়া উচিত।
কাগজে সে লিখল “আমি অনু। আগে নাম ছিল অনামি। যার কোন নাম নেই।
জানি না কে নামটা দিয়েছিল। এটা আমার একটুও পছন্দ না। তাই আমি নাম পাল্টে ফেলেছি। এবার আমি আরেকটা কাজ করব। তার জন্য আমার একটুও খারাপ লাগছে না।
যদিও খারাপ লাগা উচিত মনে হয়। আমি আজকে এই পৃথিবী ছেড়ে চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। আত্মহত্যার প্লান আগে থেকে করা থাকে না। হঠাত করেই সিদ্ধান্ত নিতে হয়, এটা আমার এক বন্ধু বলেছিল। সে ও আত্মহত্যা করেছে।
তার কারন সে আর তার উপর চাপিয়ে দেওয়া বোঝা নিতে পারছিল না। তাকে পড়াশোনার পাশাপাশি বাসা সামলাতে হত। তার খুব অভাবের সংসার ছিল। কিন্তু আমার কারন আলাদা। আমি মুক্তি চাই।
আমার আর বাবা মাকে সহ্য হচ্ছেনা। তারা যা খূশি তা করছেন আমার সাথে। আর না। আমি তাদের আর সেই সুযোগ দিব না। আমি জানি আমি মরে গেলে তাদের হয়তো তেমন কোন দুঃখ হবে না।
হ্যা খুশির একটু কষ্ট হবে। তার প্রতি আমার অনেক ভালবাসা থাকল। সে যেন না কাঁদে। মা বাবা আমি তোমাদের ঘৃনা করতাম। এখনও সেটা একটুও কমেনি।
তোমরা আমাকে মানুষ মনে করনি। আমার জন্য তোমাদের ডিভোর্স আটকে আছে বলে সরি। এখন তোমরা যা খুশি তা করতে পারবে। আর কিছু না। আমার মত আরো অনেক অনু আছে।
একজন চলে গেলে তেমন কিছু হবে না। “
সার্জারি সিজারটা যখণ অনুর হাতের কব্জির শিরাকে ছিন্নভিন্ন করে দিচ্ছিল তখন অনুর চোখে পানি। তার হঠাত মার কথা মনে হল। মা বলত জীবন একটা রহস্য। অনুর জ্ঞান চলে যাচ্ছিল।
সে আর পারছে না। শেষবারের মত তার হাতে ধরা রক্তে ভেজা কাগজটা দেখল।
অনু মোমবাতিটা নিভিয়ে দিল। জীবন একটা রহস্য। অনুর কাছে এই মুহূর্তে সবচেয়ে বড় রহস্য হল অন্ধকার।
সে কিভাবে এই রহস্যের উন্মোচন করবে। এই রহস্য কি উন্মোচন করা যায়?
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।