আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

জন হুড এর পর্যবেক্ষ্ণণে সত্যজিত রায়

আমি পড়তে ও লিখতে ভালবাসি ১ একজন বিদেশীর চোখে বাংলা ছবির কারুশিল্পঃ জন্ম অস্ট্রেলিয়ায় হলেও তার মন পড়ে থাকে বাংলা উপন্যাসের পাতায়,বাংলা ছোট গল্পে, সত্যজিত,মৃণাল,ঋত্বিক,বুদ্ধদেবের কাব্যিক ফ্রেমে। জন ডব্লিও. হুড। নামটি বাংলাদেশীদের কাছে নতুন ঠেকলেও বাংলা ক্লাসিক ছবির/সিনেমার খোঁজ খবর যারা রাখেন তাদের কাছে তিনি অগ্রগণ্যদের থেকেও বেশি কিছু। জন্ম ১৯৪৪ সালে, মেলবোর্নে। পড়লেখা ভারতীয় দর্শন ও ইতিহাসের উপর।

ভারতীয়/বাংলা ক্লাসিক সিনেমার গুরুত্বপূর্ণ একজন তাত্ত্বিক তিনি। বই লিখেছেন মৃণাল সেন, বুদ্ধদেব দাসগুপ্ত,সত্যজিত রায় এর সিনেমার উপর। তার বিখ্যাত দুটি বই হল The essential mystery:Major filmmakers of Indian art cinema ও Beyond the world of apu: Films of Satyajit Ray. বাংলাদেশ ফিল্ম ইন্সটিউট(প্রখ্যাত চলচিচত্র পরিচালক তানভীর মোকাম্মেল এর পরিচালনায়) এর সৌজন্যে এই বছরই জন হুড এর দুটি ওয়ার্কশপ করার সৌভাগ্য আমার হয়েছে। প্রথমত বাংলাদেশ ফিল্ম ইন্সটিউট কে এই গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপের জন্য আন্তরিক অভিনন্দন। জন হুড এর ব্যাপারে বোঝাপড়াটা খুবি জরুরি কয়েকটা কারণেঃযেমন,একজন বিদেশীর চোখে বাংলা সিনেমা, একজন পশ্চিমার তত্বে বাংলা ও ভারতীয় সিনেমার ঐতিহাসিক গতিধারা, ও সত্যজিত এর সিনেমার বস্তুনিষ্ঠ সমালোচনা।

আলোচনা টা আকেবারে প্রাথমিক পর্যায় থেকে শুরু করি। অর্থাত,সত্যজিতকে তিনি কিভাবে দেখেছেন,তার বিশ্লেষণ দিয়ে শুরু করবো। জন হুড এর Beyond the world of apu: Films of Satyajit Ray বইটিতে ভূমিকায় বুদ্ধদেব দাসগুপ্ত বলেছেন, সত্যজিতের সাথে সাক্ষাত হলেই তার ব্যক্তিত্বে মুগ্ধ হয়ে সকলেই পক্ষপাতদুষ্ট হয়ে পড়তেন,এতে সত্যজিতের দোষের কিছু নেই,বরং তার গুণগূলোই ফুটে উঠে। তার মতে, আগের যে বইগুলো বা সমালোচনা সত্যজিতকে নিয়ে বেরিয়ছে,সেগুলো বস্তুনিষ্ঠ না হওয়ার অন্যতম কারণ এটি। অর্থাত লেখকের সাথে সত্যজিতের দেখা হয়েছিল।

খুব গুরুত্বপূর্ণ একটি পর্যবেক্ষণ। তাই, এই দিক থেকে জন হুড অত্যন্ত সৌভাগ্যবান একারণে যে, তার সংগে এই চলচিচত্রের কবির সাথে দেখা হয়নি। ফলস্বরূপ, জন হুড এর পক্ষে unbiased পর্যবেক্ষন করা সম্ভব হয়েছে বোধহয়। সত্যজিতকে নিয়ে এর আগে যে সমালোচনা গুলো হত, তা হয় অতি ভক্তিতে গদগদ অথবা বিদ্বষ্পূর্ণ প্রতিক্রিয়া। এর দুটি’ই কখনো কোন গ্রেট আর্টীস্ট এর কর্মের প্রতি সম্মান প্রদর্শন হতে পারেনা।

তাই জ.হু এর সত্যজিত নিয়ে আলোচনা,সত্যজিতের সিনামাটিক ও যথার্থ মূল্যায়নে জরুরী সংযোজন। আরেকটা দিক হল, সত্যজিত বাংলা সাহিত্যর প্রাণপুরুষ রবীন্দ্রনাথ,তারাশংকর,বিভুতিভুষন, ও আরো অনেক এর উপন্যাস বা ছোট গল্প থেকে সিনেমা বানিয়েছেন। দেখা যেত,ঐসব সিনেমার সমালোচনা আর সিনেমা সমালোচনায় থাকতোনা,হয়ে যেতো সাহিত্য নির্ভর ও সাহিত্যকে সত্যজিত কিভাবে অপভ্রষ্ট করেছেন তার দীর্ঘ নিন্দা বা স্তুতির ফিরিস্তি। এই ক্ষেত্রেই জ.হু এর আসল ভাংগন পুরোনো সমালোচনা কে। তার সাহিত্য adaptation গুলোর তিনি করলেন, সিনামাটিক মূল্যায়ন।

আমার এই লেখার রেফারেন্স মূলত জন হুড এর Beyond the world of apu: Films of Satyajit Ray বইটি। সত্যজিত এর সিনেমা বিশ্লেষণে তিনি তথাকথিত সায়েন্টিফিক কোন এপ্রোচ কে সরাসরি খারিজ করেছেন নিম্নোক্ত বক্তব্যেঃ “Cinema criticism is not a cut-and-dried science in which conclusions once reached becoma carved in stone” (Beyond the world of apu, J W Hood,page 1). এই বাক্যে তিনি ক্লাসিক/কালোত্তীর্ণ শিল্পের প্রতি সময়ে,প্রতি ঐতিহাসিক ক্রান্তিকালে পরিবর্তিত ও সময়োচিত ব্যাখ্যার জরুরত কেই হাতে আংগুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছেন। উপরোক্ত লাইনটি মূলত শিল্পের সামগ্রিক বিচারের যুক্তি। এর আরেকটি দিক তার ব্যক্তিগত,তা হল, তিনি তার ২০০০ সালে প্রকাশিত The essential mystery:Major filmmakers of Indian art cinema বইয়ে সত্যজিতের মূল্যায়ন কে অনেক সংযোজন-বিয়োজন করে পরবর্তী বইয়ে আরো শার্প এসেস্মেন্ট এ পৌছেছেন। সময়ের সাথে তার এই মূল্যায়ন এর যে পরিবর্তন, একে তিনি শিল্পের privilege ও obligation দুই ডাইমেনশনেই দেখছেন।

সত্যজিত এর সব সিনেমার মূল্যায়ন করতে গিয়ে জন হুড তাঁকে শেক্সপিয়রের সাথে তুলনা করলেন। শেক্সপিয়রের নাটক যেমনি খুব ভাল,ভাল,মোটামুটি,সাধারণ এই লেভেলে ভাগ করা যায়,তেমনি সত্যজিতের কাজও গুণগত/শৈল্পিক মানের বিচারে এভাবে ভাগ করা যায়। এই যে তার নানা মাত্রার কাজের নানাবিধ মূল্যায়ন এর মাঝখানে পথের পাঁচালী,অপরাজিত,চারুলতা-এসব সিনেমাকে কালোত্তীর্ণ শিল্প হিসেবে স্পশটত গণ্য করা যাচ্ছে,এটাই সত্যজিতের বিশালতাকে মহিমান্বিত করে বলে মনে করেন জন হুড। মূল কথা যা, তা হল,সত্যজিতকে সার্বিক দিক থেকে বুঝতে গেলে তাঁর সব সিনেমার যথার্থ মূল্যায়ন অবশ্যই জরুরী। এই জায়গাতে জন হুড সত্যজিত চলচিচত্র সমালোচক গোষ্ঠীকে নতুন দিক দেখালেন।

অর্থাত, “সত্যজিত মানেই পথের পাঁচালী”-এই ধারণকে ভাংলেন তিনি। সিনেমার মূল্যায়ন শুরুর আগে জন হুড কলকাতা/ভারতে সত্যজিত কেন্দ্রিক যে এক ধরনের ফেটিশিজম গড়ে উঠেছে-তা সম্পূর্ণ বোঝাপড়া ছাড়া,এই বক্তব্যকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন নিম্নোক্ত বক্তব্যগুলোতে- Satyajit Ray is one of a handful of established icons of the bangalis,along with the maverick nationalist leader Subhas C. Bose and India’s Renaissance man,Rabindranath Tagore, and one of the problems associated with iconic status is the difficulty of discerning between critical judgement and enthusiastic adoration. (Beyond the world of apu, J W Hood,page 2). শ্রেণীগত দিক দিয়ে কারা এই অন্ধ বোঝাপড়া কে পূজার পর্যায়ে নিয়ে যাচ্ছে, তাদের সম্পর্কে জন হুডের বক্তব্য- Nevertheless, there must be many among the bengali bhadralok, the educated middle class who consider themselves pillars of culture and the thinkers of India, who would know far more Bombay commercial films than films of Satyajit Ray, and yet be quick to defend him as one of their cultural giants. (Beyond the world of apu, J W Hood,page 2). সত্যজিতের ২৯ টি পূর্ণদৈর্ঘ্য বা feature film জন হুডের আলোচ্য বিষয় এই বইয়ে। তিনি ৯ ক্যাটাগরিতে ভাগ করেছেন তাঁর সিনেমাকে। তা হলঃ ১। অপু ট্রিলজী (পথের পাঁচালী,অপরাজিত,অপুর পৃথিবী) ২।

প্রথম দিককার পাঁচমিশালী (পরশ পাথর,জলসাঘর,অভিযান,কাপুরুষ ও মহাপুরুষ,চিড়িয়াখানা) ৩। শহুরে মধ্যবিত্ত সমাচার (কাঞ্চনজঙ্ঘা,মহানগর,নায়ক,অরণ্যের দিন রাত্রি) ৪। কলকাতা পট সমাচার (প্রতিদ্বন্দী,সীমাবদ্ধ,জন অরণ্য) ৫। ট্রিবিউট টু রবীন্দ্রনাথ (তিন কন্যা, চারুলতা,ঘ্রে বাইরে) ৬। এন্টি- সনাতনী হিন্দুত্ববাদী (দেবী,সদগতি) ৭।

ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট কেন্দ্রিক (শতরঞ্জী কা খিলাড়ী,অশনি সংকেত) ৮। কিশোর ক্লাসিক (গুপী গাইন বাঘা বাইন, হীরক রাজার দেশে,সোনার কেল্লা, জয় বাবা ফেলুনাথ) ৯। শেষ ত্রয়ী (গণশত্রু,শাখা প্রশাখা,আগন্তুক) অপু ট্রিলজী কে তিনি সত্যজিতের অন্যতম সেরা কর্ম বলে রেটিং করলেন। ২ নং ক্যাটাগরী সত্যজিতের কিছু অগোছালো কাজ। এই কাজ গুলো তার হাত পাকিয়েছে-বিষয় এবং বিষয়ী উভয় ক্ষেত্রেই।

এর সব সিনেমাই বিভিন্ন মাত্রার গল্প,প্রেক্ষাপট নিয়ে গড়ে উঠেছে। জন হুডের এ ব্যাপারে বক্তব্যঃ It was seem that Ray was trying to discover something different, a new path for his creativity, in the process mixing mediocrity with brilliance. Ray was not entirely successful with any of these works, yet in varying degress each one of them bears somewhere or other the mark of a master filmmaker. (Beyond the world of apu, J W Hood,page 5). চলবে... ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।