আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

আজ বিশ্ব শিশুশ্রম প্রতিরোধ দিবস।। অন্তত ঝুঁকিপূর্ণ শিশুশ্রম প্রতিরোধ করুন

চারপাশে আত্মমুগ্ধ আদিমতাবোধ, আর গ্রন্থিবদ্ধ চিন্তা; সেখান থেকে মুক্তির পথ খুঁজি... ''যে শিশু ভূমিষ্ঠ হল আজ রাতে তার মুখে খবর এসেছে সে পেয়েছে ছাড়পত্র এক, নতুন বিশ্বের দ্বারে তাই ব্যক্ত করে অধিকার জন্মমাত্র সুতীব্র চিৎকারে। খর্বদেহ নিঃসহায়, তবু তার মুষ্ঠিবদ্ধ হাত উত্তোলিত, উদ্ভাসিত কী এক দুর্বোধ্য প্রতিজ্ঞায়। '' (ছাড়পত্র) প্রতিটি শিশুই জন্মলাভ করে অধিকার নিয়ে। শিশু অধিকার নিয়ে কবি সুকান্ত ভট্টাচার্যের উপলদ্ধি আজ শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করতে হয়; তিনি সেই সব ব্যক্তিদের একজন যাঁরা তাঁদের সৃজনশীল চিন্তা, মেধা ও উদ্ভাবনী শক্তি দিয়ে পৃথিবীর মানুষ ও মানুষের জীবনযাত্রার সত্যকে দেখিয়ে দিয়ে গেছেন। শিশুকে শ্রমে নিয়োগ করানো একটি ঘৃণ্যতম কাজ।

যে কোন জাতির ভবিষ্যত কর্ণধার হচ্ছে শিশুরা, তাদের হাতেরই ছেড়ে যেতে হবে আমাদের দেশের সমৃদ্ধি, উন্নতির মহান ব্রত। কিন্তু তাদের সেই উত্তোলিত, উদ্ভাসিত প্রতিজ্ঞায় আমরা কোন প্রকার প্রণোদনা দিচ্ছি না। এ ব্যর্থতার দায় ভবিষ্যত আমাদের ঘারেই চাপাবে। যদিও আজ বিশ্ব সভ্যতা একুশ শতকে অবস্থান করছে, কিন্তু তবুও পৃথিবীর জনগোষ্ঠীর মাঝে রয়ে গেছে আদিমতার গন্ধ। এমন মুহুর্তে কিছু পশ্চাৎপদ স্বার্থবাদী প্রতিক্রিয়াশীল গোষ্ঠি এই পৃথিবীতে অরাজকতা সৃষ্টি করে রেখেছে বা রাখছে, তাদের কাছে মানবাধিকার, গণতন্ত্র, মূল্যবোধ এবং জীবন ও জীবিকার পূর্ণ নিরাপত্তা আজ বিপন্ন হতে বসেছে।

আজ বিশ্ব শিশুশ্রম প্রতিরোধ দিবস। সভ্যতার এই অবস্থানে দাঁড়িয়ে আমাদের লজ্জাজনক ব্যপার যে আমরা আজও আমাদের ভবিষ্যত বংশধর শিশুদের জন্য একটি সুন্দর পৃথিবী রেখে যেতে পারছি না। শিশুরা একটি পরিবার, সমাজ ও দেশ-জাতির মহামূল্যবান সম্পদ। এই শিশুদের সুশিক্ষা দিয়ে দেশের ভবিষ্যত সমৃদ্ধিকে নিশ্চিত করা সম্ভব। কিন্তু বাস্তবতা হলো আমাদের দেশে উল্লেখযোগ্য শিশুই তাদের নিজেদের ভবিষ্যতকে গড়ে তুলতে ব্যর্থ হয়, এটা যেন তাদের অনিবার্যতা।

তাদের বয়স ১০ থেকে ১৪ বছর হওয়ার সাথে সাথে তারা হয়ে পড়ে শ্রমিক। পরিবারের দারিদ্র তাদের বাধ্য করে শ্রমিক হতে। পরিবারের অর্থনৈতিক স্বচ্ছলতা নিয়ে আসতে তাদের কোন কোন ক্ষেত্রে ঝুঁকিপূর্ণ শ্রম দিতে হয়। এছাড়াও একটি ভয়ানক সমস্যা হলো শিশু নির্যাতন। শিশু নির্যাতনের শিকার হচ্ছে প্রতিনিয়ত, এমনকি পরিবার থেকেও নির্যাতনের শিকার হচ্ছে।

তারা নির্যাতনের কারণে বাধ্য হয়ে ঝুঁকিপূর্ণ কাজে, যৌন হয়রানি, শিশু পাচার, শোষণ বা শ্রমদাস ও শিশু পতিতা হিসেবে ব্যবহার হচ্ছে। শিশুদের উৎপাদনমুলক কাজে ব্যবহারে নিয়োগকারীরা উৎসাহিত হচ্ছে, কারণ শিশুশ্রমিক সস্তায় অর্থাৎ অর্ধেক পারিশ্রমিকের বিনিময়ে নিয়োগ করা সম্ভব হচ্ছে। এছাড়াও বিভিন্ন নির্যাতনের ভয় দেখিয়ে তাদের দিয়ে যে কোন কাজ করিয়ে নেয়া যায়। এক হিসেব অনুযায়ী, শুধুমাত্র ঢাকামহানগরীতেই প্রায় আড়াইলক্ষ মেয়ে শিশু শ্রমিক বাসাবাড়িতে পরিচারিকার কাজ করে। এদের মধ্যে ৯০ শতাংশ ৯ থেকে ১৬ বছর বয়সী।

বাসায় কর্মরত মেয়েরা সবার থেকে বিচ্ছিন্ন। চাকরিদাতা মনিব কর্তৃক বিভিন্ন ধরনের নির্যাতনের শিকার হয়। এসব নির্যাতনের মধ্যে রয়েছে সহিংসতা, যৌন নিপিড়ন ইত্যাদি। শিশুরা ঝুঁকিপূর্ণ শ্রমে নিযুক্ত হচ্ছে আরও অনেক ক্ষেত্রে, জাহাজভাঙা, বিড়ি শিল্প, ব্যটারী তৈরীর কারখানা, লেদ কারখানা, কাঁচ বা গ্লাস ফ্যাক্টরী, ইট-পাথর ভাঙা, মটরগাড়ি মেরামত, নির্মাণকাজ, পতিতা পল্লীতে বা যৌনকর্মীসহ ইউনিসেফের এক জরিপ অনুযায়ী ৪৭টি কাজে। জাহাজ ভাঙা শিল্পে প্রায় প্রতিদিনই কোন না কোন ছোট-বড় দুর্ঘটনা ঘটে, যার কারনে বছরে শত শত শ্রমিকের পঙ্গুত্ব বরণ করতে হয়।

বিড়ি তৈরীর কাজ শিশুদের জন্য মারাত্মক ঝুঁকিপূর্ণ। শিশুদের দিয়ে এই বিড়ি তৈরীর কাজ করালে তা ভয়াবহ পরিণাম ডেকে আনে। এক্ষেত্রে তাদের স্বাভাবিক স্বাস্থ্য নষ্ট হয়, তারা শ্বসকষ্ট, মাথা ও বুকে ব্যথা হয়, বমি বমি ভাব হয়, যক্ষা, হাঁপানী, নিউমোনিয়া, চর্মরোগ এমন কি মারাত্মক ক্যন্সারে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর মুখে পতিত হয়ে পরে। বর্তমান সারা বিশ্বের মতো বাংলাদেশের উদ্বেগজনক সমস্যা হলো শিশু ও নারী পাচার। বাংলাদেশে শিশু ও নারী পাচারের সঠিক সংখ্যা পাওয়া যায় না।

এই সব কাজে আন্তর্জাতিক শিশু ও নারী পাচারকারীরা জড়িত, তারা আন্তর্জাতিক থেকে দেশ এবং আঞ্চলিক পর্যায়ে বিভিন্ন ভাগে বিভক্ত। আঞ্চলিক দালাল চক্র বিভিন্নভাবে অভিভাবকসহ শিশু ও নারীকে বিভিন্ন প্রলোভন, টাকা, বিদেশে চাকরি দেয়ার নাম করে সংগ্রহ করে। এরা সীমান্ত দিয়ে ভারত, পাকিস্তানসহ মধ্যপ্রাচ্যে শিশু-নারী পাচার করে থাকে। এসব শিশু ভারত-পাকিস্তানসহ মধ্যপ্রাচ্যে শিশু পতিতা, উটের জকিসহ বিভিন্নভাবে ব্যবহার হয়, এমন কি তাদের অঙ্গপ্রত্যঙ্গও বিক্রি করা হয় বলে খবর পাওয়া গেছে। এসব ক্ষেত্রে নারী শিশুর সংখ্যাই বেশি।

বিভিন্ন সূত্রমতে ধারনা করা হয় যে, প্রতিমাসে বাংলাদেশ থেকে ২০০ থেকে ৫০০ জন নারী শিশু পাচার হয়। যাদের বয়স ১৩ থেকে ১৭ বছরের মধ্যে, এদের বেশীর ভাগই ভারত ও পাকিস্তানে শিশু পতিতা হিসেবে এবং পর্ণছবিতে ব্যবহার হয়। পরিশেষে বলা যায় যে, বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে হয়তো শিশুশ্রম পুরোপুরিভাবে বন্ধ করা সম্ভব নয়। কেননা, অনেক শিশুর জীবনে বেঁচে থাকার পূর্বশর্ত হচ্ছে শ্রম বিনিয়োগ করা, তার পারিবারিক অসচ্ছলতা তাকে বাধ্য হয়ে শ্রমিক করে তোলে। কিন্তু আমরা জানি প্রতিটা শিশু জন্মগ্রহণ করে স্বাভাবিক কিছু অধিকার নিয়ে।

এই অধিকারগুলি আইন দ্বারা রক্ষিত থাকার সত্তে¦ও আমরা আমাদের ভবিষ্যত প্রজন্মকে দিতে পারছি না সুন্দর একটি জীবনের স্বপ্ন। সুন্দরভাবে বিকাশের জন্য প্রতিটি শিশুর প্রয়োজন হয় পরিচর্যা ও আদোর ভালোবাসা। লেখাপড়া ও খেলাধুলা শিশুর জন্য একান্তভাবে জরুরী। যে শিশু এইসব থেকে বঞ্চিত হয়, যার শৈশব থেকে কেড়ে নেয়া হয় আনন্দমুখর দিনগুলিকে, তার নিকট থেকে এ সমাজ বঞ্চিত হবে বৃহৎ কোন কল্যাণের। আমরা আমাদের এই সম্পদকে যথাযোগ্যভবে গড়ে তোলার চেষ্টা যদি করি তবেই একদিন এ দেশে সোনার মানুষ জন্মাবে।

তাই আসুন শিশুশ্রম প্রতিরোধ করি, আসুন অন্তত শিশুদের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ শ্রমের বিপক্ষে দাঁড়াই।  ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।