আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

চাই সিংহাসন, সোনার মুকুট, তাই রাজনীতি?

শুচি সৈয়দ । । । । ।

। । । । ।

। । । । ।

। । । । ।

। । । । ।

। । । । ।

। । । । ।

। । । । ।

। । । । আমাদের দেশটা খুব ছোট, আর তার চাইতেও ছোট এদেশের রাজনীতিকরা।

কথাটার সত্যতা সম্পর্কে যে কোন সচেতন নাগরিকই দ্বিমত পোষণ করবেন না। ছোটবেলা থেকে রাজনীতিবিদদের ওপর শ্রদ্ধা পোষণ করে এসেছি অপরিসীম। তাদের আদর্শবাদিতা, আÍত্যাগ, কষ্ট সহিষ্ণুতা আর সাহস--অনুপ্রেরণা যোগাত। আ¯েত আ¯েত বড় হয়েছি আর আ¯েত আ¯েত সেই আদর্শস্থানীয়দের স্খলন-পতন দেখতে দেখতে বিতৃষ্ণ হয়ে উঠেছি। রাজনীতিকদের ওপর শৈশবের সেই প্রশ্নহীন শ্রদ্ধা হারিয়ে ফেলেছি।

তাদের ওপর শ্রদ্ধা কমে আসবার কারণেই অবাক হইনি দেশের দুই রাষ্ট্রপতি পদপ্রার্থী যখন নাগরিকত্বহীন জামাত নেতা গোলাম আযমের দোয়া চাইতে গিয়েছেন তখন। অবাক হবার অবকাশ নেই, কারণ যারা দোয়া চাইতে গিয়েছেন তারা রাজনীতির কেউ নন। দুঃখ পাবারও কিছু নেই কারণ তারা যে পেশা থেকে এসেছেন সে পেশা তাদেরকে জনবিচিছন্ন করে রাখে- তাদের নিরপেক্ষতা বজায় রাখার স্বার্থে। ঔপনিবেশিক আমলের সব চাইতে ঠাঁটবাট বজায় রাখা পেশাটি থেকে তারা এসেছেন একেবারে সম্পূর্ণ বিপরীত মের€তে। তারা ভুল করতেই পারেন, কারণ তাদের এলাকার বাইরে তারা পা বাড়িয়েছেন।

যে-যার নিজের ভূমিকায় যথার্থ, তার বাইরে বেমানান। তাই তাদের এই দৌড় ঝাঁপের দোষ দেখি না- তারা দোওয়া চাইতেই পারেন, এটা ব্যক্তিগত ব্যাপার তাদের। কিন্তু যখন তারা রাষ্ট্রপতি হবার স্বপ্নেবিভোর হয়ে দোওয়া চাইতে যান, কথা আসে তখনই। ক্ষোভ জাগে তখনই-- দুঃখ হয়, লজ্জা পাই, তখনি। একজন রাষ্ট্রপতি বলেছিলেন ‘আই উইল মেক পলিটিক্স ডিফিকালট’ হ্যাঁ, সত্যি সত্যি এদেশের রাজনীতি যে কি সাংঘাতিক ‘ডিফিকালট’ হয়ে গেছে তা আমাদের রাজনীতি অঙ্গনে দৃষ্টি না দিলে বোঝা যাবে না।

আমাদের রাজনীতিতে রাজনীতির বাইরের লোকজন প্রবেশ করে দুর্মর করে ফেলেছে রাজনীতির অঙ্গনকে। আর তারই সর্বশেষ উদাহরণ দোয়াপ্রার্থী রাষ্ট্রপতি পদপ্রার্থীদ্বয়। একজন রাষ্ট্রপতি রাজনীতির বাইরে থেকে এসে বলেছিলেন, রাজনীতিকে ‘ডিফিকালট’ করার কথা। এটা ছিলো তার সদম্ভ উক্তি কিন্তু আর যারা আছেন, যারা এই অঙ্গনে পা রাখছেন, বিচরণ করছেন-- তারা? তারা শুধু মুখে ঐ উক্তিটিই উŽচারণ না-করে তাদের কাজে-কর্মে আচার-আচারণে তার চাইতে দ্বিগুণ-চতুর্গুণ বেশি কলুষিত করছেন রাজনৈতিক অঙ্গনকে। এখানেই পার্থক্য।

কেউ সরবে, কেউ নীরবে--এভাবেই একযোগে একই কাজ করেন। একটি মোমবাতির দুই দিকে আগুন জ্বালালে যা হয় তাই ঘটছে আমাদের রাজনৈতিক আন্দোলনে। তাই যিনি তার পেশাগত জীবনে দক্ষতার পরিচয় দিয়ে এসেছেন তিনি যখন বিচার এবং বিবেচনাবোধ হারান-- তখন অফসোস জাগে। তাদের জীবনের লক্ষ্য কি? রঙ-চঙা সিংহাসন? রাষ্ট্রপতির পদটি? রাজমুকুট? রাজদণ্ড?-- কি চান তারা? কার কাছে? কার জন্য? ক্ষমা করবেন আব্রাহাম লিংকন, ক্ষমা করবেন। আমরা এক অদ্ভুত গণতান্ত্রিক দেশের নাগরিক।

আমাদের গণতন্ত্রের লতায়-পাতায় জড়িয়ে রয়েছে আটরশির অসংখ্য রশি। শর্ষিনার অজস্র শর্ষেদানা ছড়িয়ে এর পরতে পরতে। নাম গোত্রহীন ফকির-ফাকরায় কথা তো বলাই বাহুল্য। সব মিলিয়ে এতো জটিলতার আবর্ত যে তাকে বর্ণনা করাও দুরূহ। এদেশের গণতন্ত্র যে কার দ্বারা, কার জন্য, কাকে শাসনের করবার জন্য--তা সনাক্ত করা কঠিন।

না, জনাব আব্রাহাম লিংকন এখানে আপনার গণতন্ত্রের সংজ্ঞার কোন ঠাঁই নেই। ঠাঁই নাই, ঠাঁই নাই ছোট সে তরী--আপনাকে ঠাঁই দিলে ডুবে যাবে। সে তরীতে জনগণেরও জায়গা হয় না, গণতন্ত্রও ভারী-- তাই সাধ করে কে ডুবতে চাইবে বলুন? তৃতীয় বিশ্বের গণতন্ত্রের ধরণ-ধারণই আলাদা-- এ যুগে আপনি জন্মালে আমরা আলাদা আরেকটি সংজ্ঞা পেতে পারতাম হয়তো বা এই তৃতীয় বিশ্বের গণতন্ত্রের। তাই একযোগে এতগুলো প্রশ্ন শুনে ভড়কে যাবেন না। এতো অšতঃসারশূন্যতা উদ্বাহু নৃত্যে মাতিয়ে রেখেছে এদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনকে যে তা বলে শেষ করা যাবে না।

যে রাজনীতি সিংহাসনের স্বপ্নে বিচার-বিবেচনাবোধ বিসর্জন দিয়ে দৌড়-ঝাঁপে মাতে তার বর্ণনায় ভার নেবে কে? ঝড়-ফুঁক, দোয়া-তাবিজের এইসব প্রার্থীরা কার প্রার্থী? কেনই বা প্রার্থী? এই প্রার্থীরা নাগরিকত্বহীন একজন রাজনৈতিক নেতার কাছে প্রেসিডেন্ট হবার দোয়াপ্রার্থনা করে নিজেদেরকে ছিন্নমুল প্রমাণ করেছেন। সবই সম্ভব এই দেশে। পাগলের প্রলাপ হতে পারে নোবেল প্রাইজ পাবার উপযুক্ত সাহিত্য! ঘোড়ার আগে দৌঁড়াতে পারে গাড়ি। গণতন্ত্রেও না থাকতে পারে জনগণ। এ বছর ভোটে প্রতিক্রিয়াশীল রাজনৈতিক দল জামাত ১৮টি আসন পাবার কারণে যারা জনগণকে প্রতিক্রিয়াশীল ভারতীয় জুজু এবং বিসমিল¬াহআক্রাšত বলে নিন্দা জানিয়েছিল তারাই আবার তাদের রাষ্ট্রপতি পদপ্রার্থী প্রতিনিধিকে নাগরিকতাহীন ব্যক্তির কাছে দোয়া আনবার জন্য পাঠিয়ে তাদের সেই মূল্যায়নের ষোলকলাকেই পূর্ণ করতে সচেষ্ট।

আসলে যে প্রতিক্রিয়াশীল কে? তা বোঝা মুশকিল। তবে জনতা ভোট প্রয়োগে যে ভুল করেনি বরং নেতারাই যে তারচেয়ে বেশি ভুল করেছেন তাতে কোন সন্দেহ নেই। জনগণ প্রতিক্রিয়াশীল হয়ে যায়নি ভোট দিলেও- জনগণ যদি প্রতিক্রিয়াশীল হতো তাহলে এইধারায় প্রতিক্রিয়াশীলরাই যেত জিতে। তা তো জেতেনি। জনগণ সুচিšিতত রায়ে প্রতিক্রিয়াশীলদের ভালো অংশটুকুকেই কেবল নির্বাচন বা মূল্যায়ন করেছে।

জনগণের এই মূল্যায়ন যথার্থ কিন্তু যারা জনগণকে প্রতিক্রিয়াশীল আখ্যা দিয়েছেন তারাই দেখা যাচেছ আজ পুরো প্রতিক্রিয়াশীলতার বেদীমূলেই নিজেদের উৎসর্গ করেছে। ধিক, এই দোয়া প্রার্থনা। জানিনা আমরা আর কতদিন এইসব রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বদের ডিফিকালট রাজনীতির ডিফিকালট শিকার হবো অসহায়ভাবে। আর কতদিন জানিনা- গণতন্ত্রের চিনির ব¯তার পারমিটের নিচে চাপা পড়ে বিলীন হবে নূর হোসেনের আÍদান? আর কতদিন গণতন্ত্রের ঢেউটিনের বা¯িতলের নিচে নির্মমভাবে ¯িপষ্ট হবে ডা. মিলনের আÍোৎসর্গ? আর কতদিন ট্যাক্স-ফ্রি গাড়ির চাকায় দলিত হবে শহীদ তাজুলের আÍত্যাগ? আর কতদিন ত্রিশ লক্ষ শহীদ আর দু’লক্ষ মা বোনের ইজ্জতের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীনতার স্বপ্ন- দোয়া ভিক্ষা চাইবে স্বাধীনতা বিরোধিতার অপরাধে অপরাধী অভিযুক্ত নাগরিকত্ব হারানো ব্যক্তির কাছে? স্বাধীনতাকে কলংকিত করার জন্য এর চাইতে বড় অপরাধজনক কাজ আর কি থাকতে পারে? পাঠক, অবাক হইনি কিন্তু যন্ত্রণায়, বিবমিষায় ¯তব্ধবাক হয়েছি। ভেবেছিলাম বিষয়টি সাংঘাতিক নিন্দিত হবে কিন্তু না, তা হয়নি।

আর তা না হতে দেখেই ক্ষোভ জানাবার জন্যই বিষয়টিকে লেখায় উপজীব্য করলাম। ৩১ জন বুদ্ধিজীবী, ৬০ জন বুদ্ধিজীবী, ১১ জন বুদ্ধিজীবী এ ধরনের কিছু আজব বিবৃতি মাঝেমধ্যে পত্রপত্রিকায় আসে- এবারে তাও অনুপস্থিতি অর্থাৎ বাণিজ্যিক বুদ্ধিজীবীদের বুদ্ধি লোপ পেয়েছে খুব সম্ভবত কিংবা সম্ভবত তারা এক্ষণে অন্য বাণিজ্যে ব্যাপৃত। হয়তো এখন বিবৃতি না-দেওয়াটাই তাদের নয়া বাণিজ্যের জন্য উপযোগী পণ্য। তবুও ভরসা ছাত্রদের কিছু অংশ নিন্দা করেছে এই ঘটনার তবে তারাও সংখ্যায় কম। ছাত্র সমাজের যে সচেতন অংশ নিন্দাজ্ঞাপন করেছে তাদের সাধুবাদ কিন্তু যারা করেনি তাদের অবশ্যই ধিক্কার প্রাপ্য।

দোয়া যদি চাইতেই হয়, চাইতে হবে মানুষের কাছে। মানুষের জন্য রাজনীতির সেই আদর্শ ফিরে আসবে কবে? কবে আবার উজ্জীবিত হতে পারবো শ্রদ্ধায় রাজনীতিবিদদের প্রতি? রাজনীতির সেই আদর্শবাদিতা কবে ফিরে পাবো আমরা? ২২ আশ্বিন ১৩৯৮, ৮ অক্টোবর ১৯৯১ ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।