আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

মধুপুরের গড়ে মজুরদের হাতে গড়া স্কুল

আমার দেশ আমার সংস্কৃতি তাঁরা ১৭ জন। তাঁদের বয়স ১৫ থেকে ২৫-এর মধ্যে। কেউ রাবার বাগানের শ্রমিক, কেউ রিকশাভ্যানচালক, কেউ মাছ ধরেন, কেউ বা দিনমজুর। তাঁদের সবার বাড়ি টাঙ্গাইলের মধুপুর উপজেলার গড় এলাকার উত্তর অরণখোলা গ্রামে। এই ১৭ জনের কেউ স্কুলে পড়ার সুযোগ পাননি।

কারণ আর কিছুই নয়, নিত্য অভাব আর গ্রামে কোনো স্কুল না থাকা। যা দু-একটি স্কুল আছে, তা-ও দূরে, দু-তিন গ্রাম পেরিয়ে পাহাড়ি রাস্তার জল-কাদা ভেঙে গ্রামের ছেলেমেয়েরা স্কুলে যেতে চায় না। দু-চারজন কষ্ট স্বীকার করে দূরের স্কুলে ভর্তি হলেও দুর্গম পথের কারণে অল্প দিনেই লেখাপড়ার সমাপ্তি ঘটে তাদের। ২. মধুপুর উপজেলা সদর থেকে ১৭ কিলোমিটার উত্তর-পশ্চিমে প্রত্যন্ত পাহাড়ি এলাকায় উত্তর অরণখোলা গ্রামের অবস্থান। গ্রামের উত্তর দিকে বনাঞ্চল আর তিন দিকে বিল ও নদী।

এ গ্রাম থেকে সবচেয়ে কাছের প্রাথমিক বিদ্যালয়টি তিন কিলোমিটার দূরে ভুটিয়া গ্রামে। বৃষ্টি নামলে পাহাড়ি মাটির রাস্তায় শিশুরা তো দূরে থাক, বড়দেরও যাতায়াত করতে হিমশিম খেতে হয়। তাই এ গ্রাম থেকে কোনো শিশু ওই স্কুলে যায় না। গোটা গ্রামের কোনো ছেলেমেয়ে স্কুলে যায় না—এ বিষয়টি ভাবিয়ে তোলে পীরগাছা রাবার বাগানের শ্রমিক ফারুক আহমেদসহ আরও অনেককেই। কী করা যায়, তা নিয়ে ২০০৮ সালে ফারুক আলাপ করেন বন্ধু দিনমজুর সোহেল রানার সঙ্গে।

সোহেল রানাও ফারুকের মতো ছেলেমেয়েদের পড়াশোনা নিয়ে উদ্বিগ্ন। কিন্তু দুজনের পক্ষে এ সমস্যার সমাধান করা সম্ভব নয়। তাই তাঁরা অন্যান্য বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে আলাপ করেন বিষয়টি নিয়ে। অনেকেই সমর্থন দেন তাঁদের। পরে ১৭ জন একমত হন, তাঁরা গ্রামে একটি স্কুল প্রতিষ্ঠা করবেন।

কিন্তু টাকা দেবে কে? সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়, এই ১৭ জন তাঁদের আয়ের একটি অংশ বিদ্যালয়ের জন্য জমা করবেন। আর এই জমা করা অর্থ দিয়েই শুরু হবে স্বপ্নের স্কুলের। সিদ্ধান্তমতো রাবার বাগানের শ্রমিক ফারুক আহমেদ, দেলোয়ার হোসেন, আবদুল বারেক, শাহিনুল ইসলাম, লিটন মিয়া, আমজাদ হোসেন, জেলে (মাছ ধরে বিক্রি করেন) জুরান আলী, আব্বাছ আলী, আন্নাছ আলী, আমীর আলী, দিনমজুর মজনু মিয়া, মোতালেব মিয়া ও আনোয়ার হোসেন এবং সপ্তম শ্রেণীর ছাত্র রাসেল মিয়া ও ষষ্ঠ শ্রেণীর ছাত্র আলমগীর হোসেন তাদের আয়ের কিছু অংশ জমা দিতে থাকে স্কুল প্রতিষ্ঠার তহবিলে। ফারুক আহমেদ বলেন, ‘কয়েক হাজার টাকা জমা হওয়ার পরই আমরা বইখাতাসহ শিক্ষা-উপকরণ কিনে স্কুলের কার্যক্রম শুরু করি। ’ আমজাদ হোসেন তাঁর নিজের থাকার ঘর ছেড়ে দেন স্কুলের জন্য।

তিনি নিজে থাকার জন্য ওঠেন রান্নাঘরে। তাঁরা ১৭ জন বাড়ি বাড়ি ঘুরে শিক্ষার্থী সংগ্রহ শুরু করেন। ১৫০ জন শিক্ষার্থী নিয়ে ২০০৮ সালে তাঁদের স্বপ্নের স্কুলের যাত্রা শুরু হয়। ৩. স্কুল তো চালু হলো, কিন্তু পড়াবেন কারা? শিক্ষক নিয়োগে প্রয়োজন বেতন। ঠিক হলো, শুরুতে তাঁদের মধ্যে যাঁরা খানিকটা লেখাপড়া জানেন, তাঁরা শিক্ষক হিসেবে কাজ করবেন।

নবম শ্রেণী পাস রাবার বাগানের শ্রমিক ফারুক আহমেদকে দেওয়া হলো প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব। সহকারী শিক্ষকের দায়িত্ব পেলেন নবম শ্রেণী পাস আবদুল বারেক, সপ্তম শ্রেণীর ছাত্র রাসেল ও ষষ্ঠ শ্রেণীর ছাত্র আমজাদ হোসেন। বাকি সদস্যরা কাজ করবেন শিক্ষার্থী সংগ্রহ, তদারকি ও অর্থ সংগ্রহের। তাঁদের একজন আনোয়ার হোসেন বিভিন্ন হাটবাজারে খেলা দেখিয়ে (সার্কাস) স্কুলের জন্য তহবিল সংগ্রহে নামলেন। এ প্রসঙ্গে আনোয়ার হোসেনের কথা, ‘আমাদের এই উদ্যোগকে প্রথম দিকে সবাই বলত পাগলামি।

কিন্তু কিছুদিন যেতেই ভুল ভাঙল সবার। লোকজন বিশ্বাস করতে শুরু করল, আমাদের দিয়ে স্কুল করা সম্ভব। এরপর ছয়-সাত মাস আমজাদের বাড়িতে স্কুল চলার পর গ্রামের আবদুস সামাদ ও আলাউদ্দিন মিয়াসহ কয়েকজন স্কুলটির জন্য ৩৫ শতাংশ জমি দান করেন। ’ ৪. প্রথমবার ১৭ জনের আয়ে জমে ৭০ হাজার টাকা। এই টাকা দিয়ে ওঠে স্কুলের জন্য প্রথম দোচালা ঘর।

পরে সমন্বিত সেবা উন্নয়ন সংস্থা (সাস) থেকে এক লাখ টাকা ঋণ নিয়ে স্কুলের প্রত্যেক শিক্ষার্থীর জন্য তৈরি হয় স্কুল পোশাক ও স্কুলের অফিস ঘর, আসবাব। ফারুক আহমেদ বলেন, ‘আমরা ঋণ নিয়ে স্কুলের উন্নয়ন করেছি। আর ঋণের কিস্তির টাকা পরিশোধ করছি আমাদের সবার আয় থেকে। ’ ৬. বর্তমানে বেশ কটি শিফট চালু আছে স্কুলটিতে। প্রথম শিফটে শিশু, প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণীর ক্লাস হচ্ছে।

তৃতীয়, চতুর্থ ও পঞ্চম শ্রেণীর শিক্ষার্থীরা আসছে দ্বিতীয় শিফটে ক্লাস করতে। বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক আবুল কালাম আজাদ বলেন, ২০১০ সালের জানুয়ারি থেকে তিনি ও অন্য তিন শিক্ষিকা—শাহনাজ পারভীন, রেবেকা সুলতানা ও মমতা খাতুন সম্পূর্ণ বিনা বেতনে স্কুলটিতে পড়াচ্ছেন। তাঁদের আশা, স্কুলটি একদিন সরকারি রেজিস্ট্রেশন পাবে। তখন তাঁরাও বেতন পাবেন। ৭. উত্তর অরণখোলা গ্রামের প্রবীণ ব্যক্তি মো. আলাউদ্দিন বলেন, ‘স্কুলের অভাবে গ্রামে এত দিন লেখাপড়া হয়নি।

ঘরে ঘরে অশিক্ষিত মানুষ। এই স্কুল চালুর পর ঘরে ঘরে এখন ছাত্রছাত্রী হইছে। এই স্কুলে পইড়া গ্রামের পোলাপান একদিন মানুষ অইব। ’ স্কুলের অন্যতম উদ্যোক্তা শ্রমজীবী আমজাদ হোসেনের মা হাসনা বানু বলেন, ‘একসময় পোলার এই কাজকে পাগলামি মনে অইত। মন খারাপ লাগত যে কষ্টের টেহা পানিতে ফালাইতাছে।

কিন্তু এহন ভালো লাগে। ওরা গরিব অশিক্ষিত হইয়াও স্কুল করবার পারছে। ’ মধুপুর উপজেলার ভারপ্রাপ্ত প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা মো. আব্বাছ আলী বলেন, ‘প্রত্যন্ত পাহাড়ি এলাকায় এটি একটি ভালো উদ্যোগ। ওই এলাকায় শিক্ষা বিস্তারে শ্রমজীবী মানুষের প্রতিষ্ঠিত স্কুলটি ভূমিকা রাখছে। ’ আরেকটি স্বপ্ন উদ্যোক্তাদের পক্ষে ফারুক আহমেদ বলেন, ‘আমরা সবাই অশিক্ষিত।

স্কুলকে কীভাবে রেজিস্ট্রেশন করতে হয় জানি না। এই জটিল কাজ সমাধান করে দেওয়ার জন্য শিক্ষা বিভাগ উদ্যোগ নেবে, আমরা সেই আশায় বসে আছি। আমাদের স্বপ্ন, এই প্রতিষ্ঠানকে একদিন আমরা হাইস্কুলে উন্নীত করব। ’ সূত্রঃ প্রথম আলো (অন্য আলো) তারিখঃ ১০ জুন ২০১১। ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।