আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

এই সময়ে এই প্রান্তরে

কঙ্গোতে প্রাথমিক শিক্ষা আমাদের দেশের মত অবৈতনিক বা বাধ্যতামূলক নয় । নিজেদের নির্মিত স্কুল ছাড়াও সারাদেশে মিশনারীদের অনেক স্কুল রয়েছে যেখানে ক্যাথলিক ও প্রটেস্টাণ্ট অনুসারীরা আলাদা আলাদা স্কুলে পড়াশুনা করে । শিক্ষকদের বেতন এবং প্রয়োজনে জরাজীর্ন স্কুল সংস্কারের দায়ভার নিয়েই নিজ উদ্যোগে বাবা মা তাদের ছেলেমেয়েদের স্কুলে পাঠান । স্কুলের সম্পুর্ন সিলেবাস বেলজিয়ান শাসনকালে প্রণীত যেটি নিঃসন্দেহে ভাল মানের । কিন্তু গ্রামাঞ্চলের প্রায় সব স্কুলে পাঠ্য বই ছাড়াই পাঠদানের কাজ চলে ।

দরিদ্র অভিভাবকের পক্ষে স্কুলের ব্যয় মিটিয়ে বই পত্র কিনে দেয়া সম্ভব নয়। শিক্ষক মহোদয় ক্লাসে যা পড়াচ্ছেন তা খাতায় লিখে নিয়েই সন্তুষ্ট থাকে ওরা। আমি একবারই একজন মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের ছাত্রীর হাতে ফরাসী সাহিত্যের একটা পাঠ্যবই দেখেছিলাম। গ্রামের সচ্ছল আর শহরের মানুষদের সামর্থ্য থাকলেও কোন রকম টেনেটুনে চলছে আমাদের ক্যাম্পের পাশের হাই স্কুলটি। যুদ্ধ,দাঙ্গা,সংঘাত এতিম বানিয়ে গেছে এ স্কুলের প্রায় শখানেক শিক্ষার্থীকে আর স্কুলটি বহন করছে ধ্বংসের চিহ্ন।

আমি মাঝে মাঝে কলম বিতরন করে ওদের খুশির মাত্রাটা দেখি। ভালো ফলাফল করার চাপ, নিয়মের কড়াকড়ি, ফাঁকিবাজির অপচেষ্টা প্রতিরোধে মাথার উপর সদা প্রস্তুত সম্ভাব্য বেত্রাঘাতের হুমকিসহ নানাবিধ দাবড়ানির কারনে স্কুলে পড়ার সময় মনে মনে ভাবতাম ক্লাসে না যেতে পারলেই ভালো লাগবে । এখন আশেপাশের স্কুলে কিছির মিছির শুনে,ছুটাছুটি দেখে আবার স্কুলে পড়তে ইচ্ছে হয় ! উপনিবেশ সময়কার শিক্ষা ব্যবস্থা উপযুক্ত পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে মানহীন হয়ে যাচ্ছে। যে কোন মূল্যে এটা ধরে রাখা দরকার কুসংস্কার থেকে বের হয়ে আসার প্রয়োজনেও। অনগ্রসর গ্রাম বাংলার মানুষদের মতো এখানেও জাদুটোনায় গভীর বিশ্বাস রয়েছে সাধারণ মানুষের।

আমাদের ছোট হাসপাতালে স্থানীয় এক রোগী এসেছেন পঁচা বাম পা নিয়ে । কোনভাবেই তারা ইঞ্জেকশান নিতে রাজি হয়নি । বলল একে জাদু করা হয়েছে তাই ইঞ্জেকশান দিলেই মারা যাবে । পরদিন পায়ের ক্ষত নিয়ে এসে আরেক রোগী একই কথা বলল । প্রসঙ্গত দুইজনই অল্পবয়সী মেয়ে/মহিলা ।

তাদের সাথে সেখানে উপস্থিত অভিজ্ঞ অভিভাবক/স্বামী কোন এক অভব্য বালককে মনে মনে ‘ঝাঁটা মারি ছ্যামরা তোর মুখে’ বলে বিষয়টি আমাদেরকে বিস্তারিত জানালেন। মূল বক্তব্যটি হচ্ছে উঠতি বয়সি কোন দুষ্ট ছেলে তার পছন্দের মানুষের মনে জায়গা করে নিতে ব্যর্থ হয়ে তাবিজ কবজ বা জাদু করলে পায়ে এ ধরনের রোগ হয়। এরকম কু-বুদ্ধি ও অপকৌশলের শিকার হয়েছেন তারা । অনেকভাবে বুঝানোর চেষ্টা করলাম হয়ত কোথাও কাজ করার সময় পায়ে বিষাক্ত কিছু লেগেছে সেজন্য বড় ঘা বা ক্ষত সৃষ্টি হয়েছে । কিন্তু আমার কথা তাদের মনঃপুত হয়নি তাই নিরুপায় হয়েই আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞান আর প্রাচীন আমলের কুসংস্কারের অপূর্ব আপসের মাধ্যমে দরকারি কয়েকটা ইঞ্জেকশন ছাড়াই এক মারাত্মক রোগের চিকিৎসা দেয়া শুরু হল।

অতি প্রাকৃত ঘটনায় বিশ্বাস আমারও আছে কিন্তু এদের অসমর্থনীয় যুক্তিটিতে নয়। বৈচিত্র্যের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ( এই মিশনের আচরণ বিধির মূল থিমের শেষ অংশ ) থেকেই চিকিৎসকও মেনে নিলেন । মানুষের বিশ্বাস অনেক বড় ব্যাপার যা কখনো কখনো সংস্কৃতির কাছাকাছি চলে যায় । সেখান থেকে কাউকে সরানো সহজ কাজ নয় । আমার মতো উদ্যমহীন নির্বোধ লোকের কাজ তো নয়ই।

কম বেশি কুসংস্কার আমাদের মধ্যেও যে কাজ করে না তা নয় । কঙ্গোতে আসার পর অদ্ভুত বর্ণিল ও সুন্দরভাবে ডিজাইন করা প্রজাপতি প্রথম থেকেই আমার কাছে কেন জানি বর্জনীয় মনে হচ্ছিল। দূর হতে কাউকে দেখা আর মুগ্ধ এই চোখে চেয়ে থাকার সন্তুষ্টি আমরা কতো কিছুতেই তো পেয়ে থাকি। এ ক্ষেত্রেও তাই করলাম। তবে প্রজাপতি আশেপাশে উড়া আর গায়ে বসা নাকি রোমান্টিক ব্যাপার এটা আমার রুমমেট খুব জোর দিয়েই বলতেন।

কিছুদিন হল বুঝতে পেরেছেন প্রজাদের পতি না হলেও প্রজাদের কিঞ্চিত ক্ষতি করার ক্ষমতা রাখে দেখতে সুন্দর অথচ জংলী প্রজাপতিগুলো। কাপড় চোপড়ে বসে চুলকানির কিছু উপাদান রেখে উড়ে চলে যায় । একটা প্রজাপতিকে রুম থেকে বের করার আপ্রান চেষ্টা করছেন দেখে তাঁকে স্মরণ করিয়ে দিলাম রোমান্টিকতার কথা। তিনি বিরক্ত সুরে বলেন ‘আরে রোমান্টিকতার খ্যাতা পুড়ি ,ওসব কুসংস্কার’। এ ধরনের কুসংস্কারেরও সংস্কার অথবা মাইনাস ফর্মুলার প্রয়োজন রয়েছে !! জহিরুল কাইয়ুম গণতান্ত্রিক কঙ্গো প্রজাতন্ত্র থেকে ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।