আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

গুরুর জন্য শুভকামনা

আমার দেশ আমার সংস্কৃতি দিনক্ষণ মনে নেই। সম্ভবত ১৯৯৩ সাল হবে। ব্যান্ড সোলস তাদের ২০ বছর পূর্তি উদ্যাপন করবে। সেই অনুষ্ঠানে সংগীতে অবদানের জন্য পপসম্রাট আজম খানের হাতে একটি সম্মাননা তুলে দিতে চায় সোলস। বিষয়টি নিয়ে কথা বলতে শিল্পী তপন চৌধুরী যাবেন আজম খানের বাড়ি।

আমিও তপন চৌধুরীর সঙ্গী হই। এক সকালে কমলাপুরের জসীমউদ্দীন রোডে আমরা তাঁর বাড়িতে গিয়ে হাজির। এখন বাড়িটি দোতলা হলেও তখন বাড়িটি ছিল একতলা টিনশেড। আমার ধারণা ছিল, এত জনপ্রিয় একজন গায়ক, যিনি তরুণ প্রজন্মের কাছে ‘গুরু’ হিসেবে শ্রদ্ধার আসনে, তাঁর বাড়িটা হবে আলিশান, থাকবে আভিজাত্যের ছাপ। কিন্তু ওই বাড়িতে পা রাখতেই আমার ধারণা ভুল প্রমাণিত হলো।

ঘুপচি একটা ঘরে ছোট্ট একটা চকিতে কাঁথা মুড়ি দিয়ে তখন শুয়ে আছেন আমাদের গুরু আজম খান। মশারি আধা খোলা। তিনি উঠে বসলেন। তপনদা আমার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেন। বললেন, ‘ও গান লেখে।

’ তাঁর পা ছুঁয়ে সালাম করলাম আমি। কিছুটা সময় কাটল সেদিন গুরুর সঙ্গে। এরপর ওই বছরই দ্বিতীয় দফায় তাঁর বাড়িতে যাই, দৈনিক ভোরের কাগজ-এর ফিচার পাতা ‘মেলা’তে তাঁকে নিয়ে একটি ফিচার করার জন্য। বলতে ভালো লাগছে, ‘কেমন আছেন আজম খান’ শিরোনামে ওই লেখা দিয়েই আমার সাংবাদিকতার শুরু। আজ আবার সেই প্রশ্ন—কেমন আছেন আজম খান? উত্তরটা এখন সবারই জানা, তিনি এখন জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে।

২৭ মে, শুক্রবার দুপুরে হঠাৎই মুঠোফোনে ইমা খান (আজম খানের বড় মেয়ে) কাঁদতে কাঁদতে জানাল, স্কয়ার হাসপাতালে তার বাবাকে লাইফ সাপোর্ট দিয়ে রাখা হয়েছে। শুনে নিজের কানকে বিশ্বাস করাতে পারছিলাম না। ইমাকে বললাম, ‘তোমার সঙ্গে কখন শেষ কথা হয়েছে?’ ‘গতকাল। বাবা দুপুরে হঠাৎ আমাকে ডেকে বলল, “মা, আমার ঘড়িটা হাতে পরাইয়া দাও তো। ” আমি বললাম, ঘড়িটা কই? বাবা বলল, মতিনের ব্যাগে আছে।

ঘড়িটা নিলাম। কিন্তু হাতে কীভাবে পরাব! স্যালাইনের সুচ আর ব্যান্ডেজে হাত ঢাকা। বাবা তখন বলল, “তুমি বেডের স্ট্যান্ডে লাগাইয়া দাও”। ’ ইমা বলেই চলেছে, ‘আসলে বাবা সব সময় ঘড়ি দেখে চলতেন। খাওয়া, ঘুমানো, বাজারে যাওয়া, খেলাধুলা—সবকিছু।

কিন্তু ওইটাই যে বাবার সঙ্গে আমার শেষ কথা হবে, বুঝতে পারি নাই...’(কান্নায় ভেঙে পড়ল ইমা)। তাহলে কি আজম খানকে আমরা আর ফিরে পাব না? তিনি কি আর ‘আলাল দুলাল’ আর ‘পাপড়ি’র বোঝা না-বোঝার গল্প গানে গানে বলতে ফিরে আসবেন না আমাদের মাঝে? একটা বিষণ্নতার পাথর যেন চেপে বসল বুকে। স্মৃতিতে ডুবে যাই। মনে আছে, একদিন মুঠোফোনে তিনি আমাকে বললেন, ‘বুঝছো, আমার অ্যালবামটা শেষ করলাম। ’ জানতে চাইলাম, কবে, কোন প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান থেকে বের হবে? তাঁর কণ্ঠে তখন আক্ষেপের সুর।

বললেন, ‘কোনো কোম্পানি পাইতাছি না। এইভাবে নিজের গাঁটের পয়সা খরচ কইরা অ্যালবাম করার ইচ্ছা আর নেই। অনেক হইছে। শ্রোতাদের জন্য এইটাই আমার শেষ অ্যালবাম। ’ এরপর শুনলাম, প্রিয় ‘গুরু’ দেড় বছর ঘোরাঘুরি করেছেন।

অবশেষে প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান সংগীতা গুরুর নীল অ্যালবামটি বের করার উদ্যোগ নিয়েছে। দুঃখ করে তখন আজম খান আমাকে বলেছিলেন, ‘হয়তো আমাদের দিন শেষ। তাই এখন আর কেউ আগ্রহ দেখায় না। শেষ পর্যন্ত যে অ্যালবামটা বাইর হইতাছে, তাতেই আমি খুশি। ’ গত বছর ২৬ জুন যখন তাঁর মুখগহ্বরে ঝিল্লির ক্যানসার ধরা পড়ে, তখন তাঁর সুচিকিৎসার জন্য বিরাট অঙ্কের অর্থের প্রয়োজন হয়ে পড়ে।

ওই সময় কিছু সরকারি অনুদানসহ বেশ কজন সংস্কৃতিসেবী এবং কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের সহযোগিতা পাওয়া গিয়েছিল। তখন কেবলই মনে হয়েছিল, এ মানুষটির তো সচ্ছল থাকার কথা ছিল। তাঁর প্রাপ্তির ভান্ডারটি শূন্য থাকার কথা নয়। কিন্তু নির্মম হলেও সত্য, সরল জীবনযাপনে অভ্যস্ত মানুষটিকে তাঁর অনেক ভক্ত-শ্রোতা (অনুষ্ঠান আয়োজক) সব সময় ঠকিয়েই গেছে। গুরুকে ভুলিয়ে-ভালিয়ে গান গাইতে নিয়ে গেছে ঠিকই, কিন্তু তাঁকে ফিরতে হয়েছে শূন্য হাতে।

যে মানুষটি একজন প্রকৃত দেশপ্রেমিক, দেশের জন্য ১৯৭১ সালে যিনি হাতে তুলে নিয়েছিলেন অস্ত্র, দেশ স্বাধীন হওয়ার পর নিবেদিত হয়েছেন গানে, সেখানেও নিজেকে উজাড় করে দিয়েছেন, সেই মানুষটিকে কখনো ছাড়েনি দারিদ্র্য। যতটুকু তাঁর পাওয়ার কথা ছিল, তার সিকি ভাগও তিনি পাননি। খেলার মাঠেও ছিলেন সপ্রতিভ—কি ফুটবল, কি ক্রিকেট। এবারের বিশ্বকাপ ক্রিকেট নিয়ে তাঁর সেকি উত্তেজনা! একদিন ফোন করে বললেন, ‘তোমাদের স্পোর্টস রিপোর্টারদের কইয়ো তো, বাংলাদেশ দলের প্রথম একাদশে কেন শাহরিয়ার নাফিস নাই? তারে কেন নামাইতেছে না?’ কথাগুলো যখন তিনি বলছিলেন, তখন তাঁর কথা জড়িয়ে যাচ্ছিল। এত অসুস্থ তিনি, তার পরও দেশ নিয়ে তাঁর ভাবনার শেষ নেই।

স্বপ্নবান মানুষটি আমাকে দেওয়া তাঁর দীর্ঘ শেষ সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, কোনো এক অজপাড়াগাঁয়ে একটি স্কুল গড়ার স্বপ্ন দেখেন তিনি। ঘণ্টা বাজছে। খেতের আল বেয়ে বই-খাতা নিয়ে দৌড়ে আসছে ছোট ছেলেমেয়েরা। ওদের মায়া মায়া চোখে তিনি দেখছেন একটি নতুন বাংলাদেশ। এমন একজন স্বপ্নবান মানুষ আমাদের ছেড়ে চলে যাবেন।

এটাই পৃথিবীর নিয়ম। সূত্রঃ প্রথম আলো, আনন্দ, কবির বকুল। ০২-০৫-২০১১ ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।