আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

ওয়াদি-আল-জ্বীন

ভুত FM-এ জ্বীনের ঘটনা শুনেছেন? সহকর্মীর প্রশ্নে তাকালাম; Office-hour যদিও, ব্যস্ত, অফিসেই। সারাদিনে অর্ধেকেরও বেশী সময় আমরা অফিসেই থাকি। কাজের প্রচণ্ড চাপ জীবনটাকে ছোবড়া বানিয়ে দিলেও শুষ্ক-কাষ্ঠং এখনো করতে পারেনি। একসাথে এতটা সময় থাকতে থাকতে অফিসটাই আরেকটা পরিবার হয়ে গেছে। পারিবারিক সদস্যের মত এখানেও প্রচুর মজা করি, তর্ক করি; সবকিছুর পর আবার কাজ করি, পাশাপাশি, বছরের পর বছর।

আমার এই Colleague “ভুত FM”-এর দারুণ ভক্ত। ভুতে বিশ্বাস করেন কিনা নিশ্চিত নই, তবে ভয় দেখিয়ে যে খুব মজা পান- এটা নিশ্চিত। উনার পাল্লায় পড়ে ঘুম নষ্ট করে আমিও দু‘একবার ভুত FM শুনেছি। কিন্তু, গল্পগুলো এতটাই কাঁচা মনে হয়েছে- ভয় পাব কি, উল্টো বিরক্তি ধরে গেছে। যাহোক, ঘটনা হচ্ছে- মদিনার কাছাকাছি একটা জায়গা আছে যেখানে গাড়ি থামিয়ে Gear Neutral-এ রাখলে ওটা নিজে নিজেই মদিনার দিকে চলতে শুরু করে।

রাস্তা ওদিকটায় উঁচু, নিচু হলেও না হয় মানা যেত। উঁচু রাস্তায় গাড়ি যেখানে মদিনার বিপরীতে যাওয়ার কথা, সেখানে মদিনার দিকে যাওয়াটা একেবারেই আশ্চর্যের। তারচেয়েও আশ্চর্যের- গাড়ির পেছনে বড় বড় হাতের ছাপ। স্থানীয়রা বলেন– এসব জ্বীনের কাজ। জ্বীনের এলাকা, তাই ওরা গাড়ি ঠেলে মদিনার দিকে পাঠিয়ে দেয়।

শুনে হাসলাম। বললাম– চাপাবাজির তো দেখি কোন সীমা নেই! পাশের জন একবার হজ এবং সদ্য ওমরাহ করে ফিরেছেন, বললেন – চাপাবাজি না, ঘটনা সত্যি। তিনি গাড়ি নিয়ে সেখানে গিয়েছেন এবং দেখেছেন- থামা গাড়ির গতি বাড়তে বাড়তে ১২০ কিঃমিঃ/ঘণ্টা পর্যন্তও পৌঁছে যায়। তবে গাড়ির পেছনে কারো হাতের ছাপ তিনি দেখেননি। আরও বললেন, রাস্তা খুব বেশী উঁচু নয়।

তবে অদ্ভুত ব্যাপার- শুধু গাড়ি নয়, রাস্তায় কিছু রাখলেই তা নিচে না গিয়ে উপরের দিকেই চলে। একটা পানির বোতল রেখেছিলেন, সেটাও উপরের দিকে গড়িয়েছে। তাঁর কথায় সায় দিলেন আরেকজন, যিনি দু‘বার হজ করে এসেছেন। কথা শেষে আমি পুরো থ! এই দুই Colleague বানিয়ে বলবার মানুষ নন। আবার যা বলছেন – তাও বিশ্বাস করার মতো নয়।

না পেরে Net-এ ঢুকলাম। Google-এ “Madinah Miracles” লিখে Search দিলাম। কতগুলো ভিডিও পাওয়া গেল। দেখলাম– কথা ঠিক। তবু সন্দেহ না মেটায় আরও খুঁজলাম।

শেষমেষ পেলাম- যা খুঁজছিলাম। পড়ে দেখি– ব্যাপারটা নতুন কিছু নয়। অনেকেই, এমনকি অনেক বাংলাদেশীও এটা নিয়ে লিখেছেন, Post দিয়েছেন। দুটো TV Channel TV-তেও দেখিয়েছে। যারা জানেন, তাঁরা বিরক্ত হবেন জানি।

তবু আগ্রহীদের জন্য একটু বলি। “ওয়াদি-আল-জ্বীন” (অর্থাৎ “জ্বীনের উপত্যকা”) সৌদি-আরবে মদিনা মানওয়ারার পঁয়ত্রিশ কিঃমিঃ উত্তর–পশ্চিমে “আল-বায়দা” নামক উপত্যকায় অবস্থিত। এলাকাটি কালো উঁচু উঁচু পাহাড়ে ঘেরা। ২০০৯-১০ সালের দিকে সৌদি সরকার সেখানে দুইশ কিঃমিঃ-এর একটি রাস্তা তৈরির পরিকল্পনা করেন। কিন্তু ত্রিশ কিঃমিঃ পর্যন্ত কাজ করার পর সমস্যা শুরু হয়।

দেখা গেল– পিচ ঢালাই করার বড় বড় Roller, বন্ধ থাকলেও আস্তে আস্তে উপরের দিকে অর্থাৎ মদিনা শহরের দিকে নিজ থেকেই চলতে শুরু করেছে। পানির বোতল, এমনকি পানিও রাস্তায় ফেললে তা নিচে না গিয়ে উপরে যাওয়া শুরু করে। শেষপর্যন্ত শ্রমিকদের ভয়ের কারণে ওখানেই কাজ বন্ধ করে দেওয়া হয়। এটুক পর্যন্ত বেশ আগ্রহের। তবে কেউ যদি আরও বেশী আগ্রহী হন, তাহলে অবশ্যই Google Earth-এ যাবেন, “ওয়াদি-আল-জ্বীন” জায়গাটি খুঁজে বের করবেন।

দেখবেন- যেখান থেকে থেমে থাকা গাড়ি নিজে নিজেই মদিনার দিকে চলতে শুরু করে তা সমুদ্রতল থেকে ৯৪৮ মিটার উঁচু। এরপর মদিনার দিকে সাত কিঃমিঃ এগোলে দেখবেন- ঐ স্থান সমুদ্রতল থেকে ৬৩৮ মিটার উঁচু। অর্থাৎ, মাত্র সাত কিঃমিঃ ব্যবধানে রাস্তাটি মদিনার দিকে ৩১০ মিটার ঢালু। যেখান থেকে যাত্রা শুরু হয়েছিল, সেখানে মাত্র দুই ডিগ্রি হলেও, পুরো রাস্তা মদিনার দিকে গড়ে ১১.৫ ডিগ্রি ঢালু। কাজেই গাড়ি চলে ঢালুর দিকে, মাধ্যাকর্ষণের স্বাভাবিক নিয়মে।

অংকের জটিলতায় না গিয়েও বলা যায়- এই সাত কিঃমিঃ দূরত্বে যদি কোন বাধাই (যেমন ঘর্ষণজনিত বাধা, বাতাসের বাধা ইত্যাদি) না থাকতো, তাহলে গাড়ি বা যে কোন বস্তুই, তার ভর যাই হোক না কেন, স্থির অবস্থা থেকে মদিনার দিকে এই দূরত্বে যাওয়ার পর গতি বেড়ে ৫৯৪ কিঃমিঃ/ঘণ্টা হত। অতএব, ১২০ কিঃমিঃ/ঘণ্টা গতিতে ছুটে চলার মধ্যে আশ্চর্যের কিছু নেই। সব আসলে দেখার ভুল বা দৃষ্টি-বিভ্রম। “মরীচিকা” শব্দটার সাথে আমরা সবাই পরিচিত। আলোর প্রতিসরণের কারণে কিভাবে মরীচিকার সৃষ্টি হয় School-এ আমরা তা অনেকেই পড়েছি।

মরীচিকাও এক ধরণের দৃষ্টিবিভ্রম। কিন্তু এখন যা বলছি তা পুরোপুরি ভিন্ন। এ বিভ্রমের কারণ- দিগন্ত, অর্থাৎ যেখানে আকাশ এবং মাটি এক জায়গায় গিয়ে মিশেছে বলে মনে হয়। দিগন্তই কোন স্থানে দৃষ্টির Reference হিসেবে কাজ করে। যদি কোন কারণে দিগন্ত আংশিক বা পুরোপুরি দৃষ্টিসীমার বাইরে থেকে যায়, তাহলে আমরা উঁচু-নিচু গুলিয়ে ফেলি; স্বীকার হই দৃষ্টিবিভ্রমের।

ওয়াদি-আল-জ্বীন এলাকাটির উঁচু উঁচু পাহাড় দিগন্তকে সরিয়ে রাখে আমাদের দৃষ্টিসীমার বাইরে। তাই আমরা উঁচুকে নিচু আর নিচুকে উঁচু ভেবে স্বাভাবিক ঘটনাতেই অবাক হয়ে যাই। এই ধরণের স্থান শুধু যে সৌদি-আরবের মদিনাতেই আছে তা নয়, এরকম আছে পৃথিবীর আরও উনত্রিশটি দেশে। এক আমেরিকাতেই আছে তেইশটি, এমনকি আমাদের পাশের দেশ ভারতেও আছে দুইটি। এদের পোশাকি নাম Gravity Hill বা Magnetic Hill. বিস্তারিত Wikipedia-তেই আছে।

তবে যে কেউ চাইলে সেখানে গিয়ে Inclinometer দিয়ে মেপে নিজেই সত্য-মিথ্যা যাচাই করতে পারেন। জাপানী বিজ্ঞানী কোকিচি সুগিহারা (Kokichi Sugihara) এই ধরণের ঘটনার চাক্ষুষ প্রমাণ দেখিয়ে ২০১০ সালে জিতে নেন শ্রেষ্ঠ দৃষ্টি-বিভ্রমের আন্তর্জাতিক পুরষ্কারটি। তবে এসব খটমটে ব্যাখ্যার চেয়ে আমি মজা পেয়েছি, Post-গুলোর Comments পড়ে। কত চিন্তার মানুষ যে আছে- না জানলে ধারণা করা কঠিন! ছোট্ট একটা উদাহরণ দেই। এক Blog-এ সাব্বির আহমেদ নামে একজন Comment করেছেন (তাঁর বর্ণণা মতে তিনি Pakistan Atomic Energy Commission-এর একজন Deputy Chief Engineer), তিনি সেখানে গিয়েছেন এবং নিজে মেপে এই দৃষ্টিবিভ্রমের সত্যতা পেয়েছেন।

তারই একটু নিচে মাজিদ নামে আরেকজন তাঁর অকাট্য যুক্তি দেখিয়ে উপসংহার টেনেছেন এই বলে- এসব অতিপ্রাকৃত ব্যাপারে বিজ্ঞান এখনো একেবারেই প্রাথমিক পর্যায়ে আছে। যাহোক, সবকিছু জেনে সহকর্মীদের যখন বললাম– তাঁরা কোন তর্ক ছাড়াই সব মেনে নিলেন। কয়েকজন তো রীতিমতো Appreciate করলেন। বললেন - আমরা এত কম জানি! কথাটার মধ্যে খোঁচা ছিল, না দু:খ ছিল ধরতে পারিনি। তবু ভাবলাম- সত্যিই তো, আমরা এত কম জানি! ।

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।