আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

‘আমি হুকুম দিলে মুন্সীগঞ্জ ম্যাসাকার হয়ে যেতো’

নিজেকে জান এবং প্রকাশ কর!! মোহাম্মদ মহিউদ্দিন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের চিফ সিকিউরিটি অফিসার ছিলেন। বঙ্গবন্ধুর হাত ধরেই রাজনীতিতে আসেন। ছাত্রলীগের রাজনীতি থেকে শুরু করে তিনি এখন মুন্সীগঞ্জ জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি। একই পদে আছেন ২০ বছর ধরে।

এর আগে দু’বার ছিলেন সাধারণ সম্পাদক। দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনে নিজ জেলায় তিনি আলোচিত-সমালোচিত হয়েছেন বহুবার। তার রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ তারই সহোদর একই দলের নেতা। চরম বিরোধ দুই ভাইয়ের মধ্যে। এর জের ধরে খুন হন তাদের আরেক ভাইয়ের ছেলে।

গত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় শীর্ষ ৫০ দুর্নীতিবাজ প্রভাবশালীর তালিকায় ছিল তার নাম। আত্মগোপনে ছিলেন বহুদিন। জেলায় প্রভাব বিস্তার, বালুমহাল ইজারা, টেন্ডার দখলে তিনি এবং তার ছেলের বিরুদ্ধে আছে নানা অভিযোগ। তবে জেলাজুড়ে ব্যাপক জনপ্রিয়তাও আছে বঙ্গবন্ধুর সহচর প্রবীণ এই নেতার। সমপ্রতি শহরের নিজ বাসায় মানবজমিন-এর সঙ্গে একান্ত আলাপচারিতায় তিনি তুলে ধরেছেন তার দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনের অভিজ্ঞতা।

জবাব দেন তার বিরুদ্ধে আসা নানা অভিযোগের। বিএনপির পাঁচ বছর স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের ওপর অত্যাচার নির্যাতন আর তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় ২৩ বছরের সাজা মাথায় নিয়ে ফেরারী দিন কাটানোর বর্ণনা দিয়ে তিনি বলেন, সেই অত্যাচার নির্যাতনে জেলার নেতাকর্মীরা অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছিল। তাদের মুখে কোন ভাষা ছিল না। অত্যাচার নির্যাতন হলেও প্রতিবাদ করতে পর্যন্ত পারতো না। তারা প্রতিশোধ নেয়ার অপেক্ষায় ছিল।

গত নির্বাচনের পর আমি যখন এলাকায় ফিরি তখন লাখো মানুষ আমাকে সংবর্ধনা দেয়। এদিন শহর ছিল লোকারণ্য। মুন্সীগঞ্জে আমি এত লোকের আর সমাগম দেখিনি। তারা সবাই এসেছিল একটি ঘোষণা শুনতে- আমি হুকুম দেবো। বিএনপি আমলের অত্যাচার নির্যাতনের প্রতিশোধ নিতে।

কিন্তু আমি প্রতিশোধের ঘোষণা দেইনি। আমি হুকুম দিলে মুন্সীগঞ্জে ম্যাসাকার হয়ে যেতো। সেদিনের গণসংবর্ধনার বিষয়ে মহিউদ্দিন বলেন, আমি বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণ শুনেছি। তার আগের ও পরের ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী। বঙ্গবন্ধুকে সেদিন অনেকে চাপ দিয়েছিল ওইদিন স্বাধীনতার ঘোষণা দেয়ার।

কিন্তু তিনি তা করেননি। আমি মুন্সীগঞ্জে ফেরার পর এত মানুষ দেখে অভিভূত হয়ে যাই। মনে মনে ভাবি এত মানুষকে আমি কি বলবো? আল্লাহর কাছে দোয়া করি- ‘হে আল্লাহ আমাকে কথা বলার জ্ঞান দাও। ’ মঞ্চে দাঁড়িয়ে আমি বক্তব্য দেয়ার সময় উত্তেজিত মানুষকে শান্ত করার চেষ্টা করি। বক্তব্যের মাধ্যমে তাদের বুঝিয়েছি-আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার কারণ হলো বিএনপির অত্যাচার নির্যাতন।

তাদের অত্যাচার নির্যাতনের কারণে মানুষ আমাদের ভোট দিয়েছে। আল্লাহর পক্ষ থেকেও এটি একটি বিচার। তাই আমাদের প্রতিশোধ নেয়ার কোন চিন্তা করা যাবে না। কারও ওপর কোন অত্যাচার নির্যাতন করা যাবে না। তা করলে আগামী নির্বাচনে এর বিচার হয়ে যাবে।

বিএনপির মতো ফলাফল আমাদের জন্যও অপেক্ষা করবে। তিনি বলেন, আমার বক্তব্যে মানুষ শান্ত হয়। ধৈর্যধারণ করে। মহিউদ্দিন বলেন, বিএনপি সরকারের আমলে শহরে চ্যাঞ্চল্যকর জালাল কমিশনার হত্যাকাণ্ড, মুক্তারপুরে বসির মাদবর হত্যাকাণ্ড, হাটলক্ষ্মীগঞ্জের শাহিন হত্যা, নয়াগাঁওয়ের আজিজ হত্যা, চর কেওয়ারে খৎনার অনুষ্ঠানে হত্যাকাণ্ড, কাচারী চত্বরে মাসুম হত্যাসহ সদর উপজেলার চরাঞ্চল ও জেলা শহর ৬টি উপজেলায় আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের ওপর হামলা নির্যাতন, বাড়িঘর ভাঙচুর, লুটপাট, চাঁদাবাজি, জ্বালাও-পোড়াওয়ে অতিষ্ঠ মানুষের প্রতিশোধের আগুন দমানো আমার পক্ষে কঠিন ছিল। সেটা আমি করতে পেরেছি।

আমি এলাকায় ফেরার পর কোন রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটেনি। কোথাও কোন প্রতিশোধ, প্রতিহিংসার ঘটনা ঘটেনি। আমি এটি চাইনি। জেলা আওয়ামী লীগের সর্বময় ক্ষমতা নিজের হাতে রাখা, জেলা আওয়ামী লীগের কার্যালয় না করে নিজ বাসায় দলীয় কার্যক্রম পরিচালনা, স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা বসির মাদবর, জালাল কমিশনার হত্যা মামলায় তার নীরব ভূমিকা, বালুমহাল ও মুক্তারপুর ব্রিজের ইজারা নিয়ন্ত্রণে রাখা, তার পুত্র ফয়সাল বিপ্লবকে টেন্ডারসহ বিভিন্ন কাজে সহযোগিতার অভিযোগের বিষয়ে মহিউদ্দিন বলেন, এসব শুধুই অপপ্রচার। তাকে ঘায়েল করতে প্রতিপক্ষের লোকজন এসব প্রচার করছে।

যেসব অভিযোগ তুলেছে এর কোন প্রমাণ তারা দিতে পারবে না। দলের বিভক্তি ও দ্বন্দ্বের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, দলীয় নির্দেশনা আছে জেলার নির্বাচিত কমিটি সাংগঠনিক কার্যক্রম পরিচালনা করবে। এতে এমপির প্রভাব খাটানোর কোন এখতিয়ার নেই। অনেকে নিজেদের এখতিয়ারের বাইরে প্রভাব খাটাতে গিয়ে দলের শৃঙ্খলা ভাঙছেন। এতে দ্বন্দ্বের সৃষ্টি হচ্ছে।

এটি মোটেও কাম্য নয়। অনেকে আবার আমার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছে। ষড়যন্ত্র করে তো কোন লাভ নেই। এতে দলের ক্ষতি হয়, যারা ষড়যন্ত্র করে তাদেরও ক্ষতি হয়। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় তার বিরুদ্ধে করা মামলার বিষয়ে তিনি বলেন, দুর্নীতিবাজ হিসেবে আমাকে তারা তালিকাভুক্ত করেনি।

আওয়ামী লীগে তৎপর ১৬ জন নেতার মধ্যে আমি তাদের তালিকায় ছিলাম। আমার বিরুদ্ধে মামলা দেয়ায় দু’টি লাভ হয়েছে। এর একটি হলো- আমি যে বঙ্গবন্ধুর প্রধান নিরাপত্তা কর্মকর্তা ছিলাম এর কোন কাগজ আমার কাছে ছিল না। সে সময় সেনাবাহিনী খুঁজতে গিয়ে আমার নিয়োগ সম্পর্কে কাগজপত্র পেয়ে যায়। এই পত্র দেখিয়ে তিনি বলেন, এটি আমার জন্য একটি অনন্য দলিল।

এছাড়া আমার ভাই আনিছুজ্জামান আনিস আগে বলে বেড়াতো বড় ভাই হিসেবে মুন্সীগঞ্জে আমি দলীয় মনোনয়ন পাই। তা না হলে তাকেই আওয়ামী লীগের মনোনয়ন দেয়া হতো। গত নির্বাচনের সময় আমি তো এলাকায় ছিলাম না। নির্বাচন করার মতো আমার অবস্থাও ছিল না। তখন আওয়ামী লীগ তাকে মনোনয়ন দেয়নি কেন? মনোনয়নের ক্ষেত্রে তৃণমূলের ভোটেও সে প্রথম হয়েছিল।

কিন্তু মনোয়ন দেয়া হয় ভোটে চার নম্বর হওয়া ইদ্রিস আলীকে। এতেই প্রমাণ হয়, তার বক্তব্য সত্য নয়। মহিউদ্দিন বলেন, আমার প্রতিপক্ষের অনেকে বলে আমি বঙ্গবন্ধুর বডিগার্ড ছিলাম। বডিগার্ড কেন, তার গোলাম হওয়াও তো তার আদর্শের সৈনিকদের জন্য গৌরবের। বঙ্গবন্ধুর পাশে থাকতে পেরে আমি সৌভাগ্যবান।

তাকে কোলে করে আমি স্টিমারে উঠিয়েছি। স্টিমার থেকে নামিয়েছি। এর চেয়ে সুখস্মৃতি আর কি হতে পারে? গত নির্বাচনের পর তার যে বক্তব্যের জের ধরে সদর আসনের এমপি এম ইদ্রিস আলীর সঙ্গে দূরত্ব তৈরি হয়- সে বিষয়ে জানতে চাইলে- মুন্সীগঞ্জে আসার পর আমাকে দেয়া সংবর্ধনায় আমি ৭০-এর নির্বাচনের উদাহরণ দিয়ে বলেছিলাম, মানুষ পাকিস্তানি শাসন ও শোষনে অতিষ্ঠ হয়ে বঙ্গবন্ধুর কলাগাছকেও ভোট দিয়েছিল। তিনি যাকে যেখানে মনোনয়ন দিয়েছিলেন মানুষ তাকেই বিপুল ভোটে বিজয়ী করেছিল। গত নির্বাচনেও শেখ হাসিনা যাকে যেখানে মনোনয়ন দিয়েছিলেন তিনিই নির্বাচিত হয়ে এসেছেন।

তিনি কলাগাছ দাঁড় করালেও নির্বাচিত হয়েছেন। মহিউদ্দিন বলেন, আমার এই কথাকে কেউ ভুল বুঝলে কিছু করার নেই। কারণ শেখ হাসিনার কলাগাছ হওয়াটাও তো অনেক বড় বিষয়। জেলা আওয়ামী লীগের কার্যালয় না থাকার কারণ জানতে চাইলে মহিউদ্দিন বলেন, কাচারী চত্বরে একটি জায়গা নির্ধারণ করে জেলা কার্যালয়ের জন্য লিজ চাওয়া হয়েছিল। তৎকালীন পৌরসভার বিরোধিতার কারণে তা স্থগিত হয়ে যায়।

বর্তমানে সেখানেই অফিস করার জন্য প্রক্রিয়া চলছে। মুন্সীগঞ্জের বালুমহাল ইজারার বিষয়ে তিনি বলেন, বিএনপি সরকারের আমলে দু’বছরে বালুমহাল থেকে আদায় হয়েছে মাত্র ২৬ লাখ টাকা। আর বর্তমান সরকার আমলে সেখানে প্রতি বছর রাজস্ব আয় হচ্ছে ৮ থেকে ১০ কোটি টাকা। প্রকাশ্যে টেন্ডারের মাধ্যমে সর্বোচ্চ দরদাতাকেই ইজারা দেয়া হচ্ছে। মহিউদ্দিন বলেন, বঙ্গবন্ধুর সাহচর্যে থাকার সময় বেশির ভাগ সময় জেলার বাইরে থাকতে হতো।

সে সময় আমি বিশ্বাস করে অনেককে রাজনৈতিক দায়িত্ব দিয়েছিলাম। এখন তারাই আমার সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করছে। আমি ভাবতেও পারিনি তারা আমার সঙ্গে বেইমানি করবে। তিনি বলেন, আমার এক ভাই মোহাম্মদ হোসেন বাবুল নিজের ভুল বুঝতে পেরে এখন আমাকে সহযোগিতা করছে। ছেলে বিপ্লবের বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগের বিষয়ে তিনি বলেন, তার বিরুদ্ধেও ষড়যন্ত্র হচ্ছে।

এর প্রমাণ হলো গত পৌর নির্বাচনে তার নিশ্চিত বিজয় ছিনিয়ে নেয়া, যা মুন্সীগঞ্জের মানুষ প্রত্যক্ষ করেছে। মোহাম্মদ মহিউদ্দিনের জন্ম ১৯৪২ সালের ১০ই মে। মুন্সীগঞ্জ বহুমুখী উচ্চবিদ্যালয়, হরগঙ্গা কলেজে পড়াশোনা শেষে ১৯৬৬ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইসলামের ইতিহাসে মাস্টার্স করেন। ১৯৬১ সালে রাজনীতিতে পা রাখেন। সরকারি হরগঙ্গা কলেজে অধ্যয়নরত থাকা অবস্থায় কলেজ ছাত্রলীগের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি হন।

’৬৯ গণঅভ্যুত্থান ও স্বাধীনতা যুদ্ধে সক্রিয় অংশ নেন তিনি। যুদ্ধকালীন তিনি বিএলএফের ঢাকা বিভাগীয় প্রধান ছিলেন। ২৫শে মার্চ রাতে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ধানমন্ডির ৩২নম্বর থেকে বঙ্গবন্ধুকে গ্রেপ্তারের সময় পাক সেনারা মহিউদ্দিনকে নির্মমভাবে পিটিয়ে মৃত্যু হয়েছে ভেবে বাড়ির নিচতলার রান্নাঘরের পাশে ড্রেনে ফেলে রেখে যায়। বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর পর তিনি জেলার রাজনীতিতে সক্রিয় হন। তিনি দু’বার জেলার সাধারণ সম্পাদক ও তিনবার সভাপতি নির্বাচিত হন।

১৯৮৬ সালের নির্বাচনে তিনি সংসদ সদস্য হয়েছিলেন। এখান থেকে সংগৃহীত ।


এর পর.....

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।