আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

'সুদ' নামক বস্তুটির ভয়াবহ তান্ডবলীলা - ৪

বিবেকিন্দ্রিয়-লোচন

-----------'সুদ' নামক বস্তুটির ভয়াবহ তান্ডবলীলা-৩ এর পরঃ ১০.৩ বহুমাত্রিক ক্ষতির তৃতীয় স্তরঃ উপরের আলোচনা থেকে এখন পর্যন্ত আশা করি এতটুকু পরিষ্কার হয়ে গিয়েছে যে পূঁজিপতিদের পূঁজি আরো বাড়ানোর জন্য যে নিয়ামকটি গুরুত্বপূর্ণ তা হল পূঁজিবাদ! এ কৃত্তিম পদ্ধতির মাধ্যমে পুরো ব্যবস্থাটি এমন ভাবে সাজানো হয়েছে যে একজন পূঁজিপতি কখনো পূঁজি হারাবেন না। আর তার পূঁজি বৃদ্ধির এই খেলায় নাভিশ্বাস হবে সাধারন মানুষের। কিভাবে সাধারন মানুষ কষ্ট করে এ প্রক্রিয়ায় আর কিভাবে তার গুরুত্ব খোদ পূঁজিবাদী সরকারের কাছে নিতান্তই নগন্য তার আলোচনাও করা হয়েছে ইতিমধ্যে। এই সব পূঁজিবাদী সমাজপতিরাই বার বার নির্বাচিত হবে আর এই জঘন্য ব্যবস্থাটি ব্যবহার করে তাদের স্বার্থ উদ্ধার করবেঃ এ কথাটি তারা সাধারন মানুষদের বুঝতেও দিবেনা। সাধারন মানুষের সমস্যার শেষ এইখানেই নয়! এবার আসুন দেখি এই লোভী পূঁজিপতিরা এবং তাদের তৈরী করা এ ব্যবস্থা কিভাবে দ্রব্যমূল্যের দাম বাড়ানোতে অগ্রণী ভূমিকা পালন করে।

যারা অর্থনীতি কিংবা ফিন্যান্স পড়ে এসেছেন তাদের কাছে এ ব্যবস্থার একটি শব্দ খুব পরিচিতঃ value addition বা মূল্য সংযোজন। অর্থ্যাৎ, আপনি চাইলে বাজারে কম চলছে এমন যে কোন জিনিসেরই বিক্রয় বাড়াতে পারেন যদি আপনি তাতে এমন কোন উপাদান সংযোজন করতে পারেন যা ভোক্তাকে আকৃষ্ট করবে। যেমন ধরুন, আগে আমরা খোলা লবন খেতাম। কোন একজন বাজারে লবনটাকে শুধুমাত্র প্যাকেট করে বিক্রি শুরু করল; তবে এতে করে মূল্য সংযোজিত হল। অথ্যাৎ, তার প্যাকেট করা বাবদ লবনের দামের উপর আরেকটি দাম সংযোজিত হল।

আবার আরেকজন মনে করুন তাতে আয়োডিন মিশ্রিত করে বিক্রয় শুরু করল; তবে আরেকটু মূল্য সংযোজিত হল। এই নতুন উপকরনের সংযোজন যে শুধুমাত্র বস্তগত হতে হবে এমনও না। তা অবস্তুগত মূল্যও (abstract value) সংযোজিত হতে পারে। এতে করে প্রতিটি পর্যায়েই দাম বৃদ্ধি পাচ্ছে। সে যাই হোক, এবার একটু বাস্তবতার নিরিখে দেখি কিভাবে তা আমাদের জীবনকে বিষিয়ে দিচ্ছে।

আলু খান তো আপনি? আলু হচ্ছে একটি নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্য। ধরুন বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যা ১৫ জন (বুঝার সুবিধার্থে ১৫ কোটি নিলাম না) এবং তাদের প্রত্যেকে প্রতি মাসে ১ টি করে আলু খায়। তাহলে একটি নির্দিষ্ট মাসে ১৫ জনের জন্য ১৫ টি আলু লাগে। বাজারে প্রতিটি আলুর দাম ধরেন ১ টাকা। সে হিসাবে এক বছরে মোট আলু লাগবে (১৫ x ১২) = ১৮০ টি বা ১৮০ টাকার আলু।

মনে করুন দেশের আলু উৎপাদনের ক্ষমতাও ১৮০ টি আলু। তাহলে অর্থনীতির দৃষ্টিকোন থেকে বাজার সমতায় (market equilibrium) থাকে। অর্থ্যাৎ এক বছরে যে ১৮০ টি আলু উৎপাদিত হয়, তা-ই ১৮০ টাকায় বিক্রি হয়ে যায়। বাজারে পন্যের দামের স্থিতিশীলতা (price stability) বজায় থাকে। সাধারন মানুষ তরকারির সাথে আলু খেতে পারে।

মনে আছে কি আপনার...........এই সাধারন মানুষের ভিড়ে এমন অনেক মানুষ আছেন যাদের আগে থেকেই অঢেল টাকা পয়সা আছে!!? যাদের আমরা পূঁজিপতি বলে পরিচয় করিয়ে দিয়েছি। তার চেয়েও বড় কথা তারা ব্যাংক নামক আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে ধার করতে পারে যা ঐ সব সাধারন মানুষ পারেনা যাদের আগে থেকে টাকা পয়সা নাই। ধরুন, ১৫ জন মানুষের ঐ দেশে এই পূঁজিপতির নাম ‘মি: ক’। মি: ক ঠিক করলেন যে তিনি মূল্য সংযোজন করে নতুন একটি পন্যদ্রব্য বাজারে নিয়ে আসবেন যা আলুকে প্রক্রিয়াজাত করে তৈরী করা হবে। আর তাকে আদর করে ডাকা হবে ‘পটেটো ক্র্যাকার্স’।

মি: ক দেখলেন যে, বাজারে যে পরিমান আলু আছে (১৮০ টি), তার থেকে উনি যদি ১০% নেন অর্থ্যাৎ ১৮ টি (১৮ টি আলুর দাম ১৮ টাকা) দিয়ে বছরে ৩৬ প্যাকেট ক্র্যাকার্স বানাতে পারবেন। এবং প্রতিটি প্যাকেট ১.৫ টাকা করে বিক্রি করে ৩৬ x ১.৫ = ৫৪ টাকায় বিক্রি করতে পারবেন। এতে তার প্রাথমিক লাভ হবে বছরে (৫৪ – ১৮) = ৩৬ টাকা। এখন দেখুন, এই কারখানাটি প্রতিষ্ঠার জন্য এবং কাঁচামাল সংগ্রহের জন্য যে পূঁজির প্রয়োজন পড়বে তার একটা বিরাট অংশ সে ‘ব্যাংক’ থেকে সংগ্রহ করবে এবং ধরুন তা ২০ টাকা। ব্যাংককে আবার সুদ আর আসল দুটোই ফেরত দিতে হবে।

অর্থ্যাৎ, ২০ টাকার সাথে সুদ যুক্ত হবে। তাকে কিছু fixed cost (স্থায়ী খরচ) এবং কিছু variable cost (পরিচলন খরচ) বহন করতে হবে। সব মিলিয়ে ধরুন তা বছরে ১৫ টাকা। তাহলে তার প্রকৃত লাভ হচ্ছে বছরে (৩৬ – ১৫) = ২১ টাকা। এখন খেয়াল করুন............... ১. পূঁজিপতি মি: ক ২০ টাকা ঋণ পরিশোধের জন্য এবং লাভর উদ্দেশ্যে প্রতিটি আলুর দাম .৫০ টাকা বা ৫০ পয়সা করে বাড়িয়ে বিক্রি করেন যা বাজারের চলমান মূল্যের চেয়ে বেশী।

২. পূঁজিপতি মি: ক বাজার থেকে বছরে ১৮ টি আলু সংগ্রহ করে নেয়ার কারনে বাজারে ১৫ জন মানুষের জন্য আলু বাকি থাকবে বছরে ১৬২ টি। অর্থ্যাৎ, মাসে যেখানে ১৫ জন মানুষ ১৫ টি আলু পেতেন, সেখানে এখন (১৬২ ÷ ১২) = ১৩.৫ টি আলু বাকি থাকবে। বাজারে আলুর এই যোগান হ্রাসের জন্য আলুর দাম আর ১ টাকা থাকবেনা (ধরুন তা বেড়ে প্রতিটি আলুর দাম হয়ে গেল ১.৩০ টাকা)। ৩. সংক্ষেপে যদি পুরো ঘটনাটা বলি, তাহলে দাঁড়ায়, একদিকে আপনি বেশী দামে ‘পটেটো ক্র্যাকার্স’ কিনে খাবেন আর অন্য দিকে বাজারে ‘প্রাথমিক পণ্যদ্রব্য’ হিসাবে আপনি আলুর যোগান সংকটে পড়বেন। এত করে আরও একবার, সেই ‘প্রাথমিক পণ্যদ্রব্য’-ই যা থেকে ‘পটেটো ক্র্যাকার্স’ তৈরী করা হয়েছে, তা বেশী দামে কিনতে বাধ্য হবেন।

এভাবে, ‘আম’ থেকে ‘ম্যাংগো জুস’, ‘কলা’ থেকে ‘ব্যানানা চিপস’, ‘চাল’ থেকে ‘প্যাকেটাজাত’ ‘চাল’ কিংবা ‘মুড়ি’, হলুদ থেকে ‘প্যাকেটাজাত’ ‘হলুদ’ ইত্যাদি যা-ই হোক না কেন, তা আপনাকে চড়া দামে কিনতে হবে। আর অপকারতো দেখলেন-ইঃ দুই দিক থেকে হয়!! এখন প্রশ্ন করতে পারেন, “তাহলে কি আমরা ম্যাংগো জুস, চিপস এইগুলো খাবোনা? তৈরী না করলে খাব কিভাবে?”। আপনাকে-ই প্রশ্ন করি, যে ক্ষতি এতক্ষন দেখলেন, তার চেয়ে কি ঐ সব দ্রব্য গলাধকরন করা বেশী গুরুত্ব বহন করে? আর লক্ষ করুন, জুস, চিপস এই পণ্যদ্রব্যগুলো কিন্তু ঐ পূঁজিপতি নিজে এবং সমাজের যাদের অবস্থা ঐ ‘পূঁজিপতির’ চেয়ে তুলনামূলক ভাবে ‘একটু খারাপ’ আর ‘সাধারন আমজনতার’ চেয়ে তুলনামূলক ভাবে ‘একটু ভাল’, এই দুই শ্রেনীর লোকই কিনতে পারবে। যাদের অবস্থা নিতান্তই করুণ (নুন আনতে যাদের পান্থা ফুরায়ঃ ‘সাধারন আমজনতা), তারা কিনতে পারবেনা। অর্থ্যাৎ, ‘মূল্য সংযোজন’ প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে ‘নিত্য প্রয়োজনীয়’ পণ্যদ্রব্যগুলো ‘অভিজাত’ পণ্যদ্রব্যে পরিণত হয় এবং দ্রব্যমূল্যের ‘নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্যদ্রব্যগুলোর’ দাম বেড়ে যায়।

আর সময় ও প্রযুক্তির উন্নতির সাথে সাথে এই প্রক্রিয়া চলতে থাকে যার পরবর্তী প্রভাব আরও গভীর ও প্রকট হয়। -বাকি অংশঃ 'সুদ' নামক বস্তুটির ভয়াবহ তান্ডবলীলা-৫ এ দেখুন

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।