আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

চরিত্র-শেষ পর্ব



আগের পর্ব পরের দিন মিনারে আমাদের সাক্ষাৎ হইল। আমি দুরু দূরু বুকে শুরু করিলাম, “আমার তিনটি শর্ত পালন করতে হবে, প্রথমত কোনমতেই মিথ্যাচারীতা করা যাবে না; দ্বিতীয়ত, মানুষের জীবনে অনেক কিছু ঘটে, যদি তোমার জীবনে এমন কিছু থেকে থাকে যা পরবর্তিতে শুনতে পেলে আমার কষ্ট হবে,তা খোলাসা করে বলতে হবে। আর তৃতীয়ত ,আমার উপর কেবল আমারই অধিকার নাই,অভিভাবকদেরও অধিকার আছে,সুতরাং তাদেরও সমর্থন আদায় করতে হবে”। আমার কথা শুনিয়া রেণু ভীষন আশ্চর্য হইল,এও কি সম্ভব ? সবাই যেখানে বিষয়টা গোপন রাখিতে চায় বিশেষ করিয়া অভিভাবকের দৃষ্টি মাড়াইতে চাহেনা সেখানে অভিভাবক দিয়া শুরু! রেণু বিপুল উৎসাহ লইয়া আমার শর্ত পালনে ব্রতী হইল, আর আমিও চরম আগ্রহে প্রেমের নূতন রাস্তায় হাঁটিতে লাগিলাম। কোনদিন পার্কে যাইতাম,কোনদিন বা সবুজ মাঠে বসিতাম,আবার কখনো কখনো হাঁটিতে হাঁতিতে আমরা গল্প করিতাম,সে গল্পের শুরু আছে শেষ নাই, তল নাই, নাই কোন সীমা পরিসীমা,কেবল আছে অজানার দিকে ধাবিত হইবার প্রবল ইচ্ছা।

আমি মাঝে মাঝেই রেণুকে বলিতাম, "জাগতিক ভোগবিলাসদ্রব্যে আমার তেমন আগ্রহ নাই, তোমার জন্যও হয়তো তার ব্যবস্থা করতে পারব না, তুমি মানতে পারবে তো?" রেণু হাসিয়া বলিত খুব পারিব। আমি চমৎকৃত হইতাম। এমনি করিয়া দুই মাস কাটিয়া গেল। ইতিমধ্যে রেণু একজন অভিভাবকের মন জয় করিয়াছে, আর আমরা দুজন দুজনার আরো নিকটবর্তী হইয়াছি। আমার সুখের সীমা নাই।

কিন্তু সুখের সেদিনে হঠাৎ করিয়া একদিন শনিদেবের আবির্ভাব হইল। হায় দুঃখের অনলে পুড়িতে পুড়িতেই সারাটাজীবন পার করিয়াছি, আজ যখন সুখের শীতল পরশে গা জুড়াইতে দিয়াছি তখন আমার ভাগ্যনিয়ন্তার গাত্রদাহের সূচনা হইল আর আমার সমুচিত ব্যাবস্থা করিলেন। রেণুর মোবাইল হইতে এই তথ্য জানিতে পারিলাম যে, আমি তাহার জীবনে প্রথমজন নহে। সে কথা আমি বলিতে পারিবনা। যে গ্লাণিকর অতীত অতি সযতনে রেণু পাশ কাটাইয়াছে সামান্য মোবাইলই তাহাকে টানিয়া হিঁচড়িয়া বর্তমানকালের এই হতভাগার কাছে উপস্থাপন করিয়াছে।

আমার প্রদত্ত দ্বিতীয় শর্তে যে ভয়, শঙ্কা করিয়াছি, রেণু অবলীলায় তাহা অগ্রাহ্য করিয়াছে । আপত্তিজনক তথ্য গোপন করিয়া আমাকে ঠকাইবার যে অপচেষ্টা সে করিয়াছে আজ তাহার একটা সুরাহা হইয়া গেল। আমার চোখের পানি বাঁধ মানিল না। আমি বিশ্বাসই করিতে পারিলাম না উপরওয়ালা আমাকে এতো বড় শাস্তি দিবেন। আমি তাহাকে ভর্ৎসনা করিলাম না, পরিত্যাগও করিলাম না।

খুনের আসামিরও আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ পাওয়া উচিৎ। আমি যে জানিতে পারিয়াছি তাহা শুনিতেই রেণু কান্নাকাটি করিয়া হুলস্থূল কান্ড বাধাইয়া দিল। সমস্ত শুনিয়া অভিজ্ঞজন বলিলেন, কান্না নারীর প্রধান যুক্তি, ইহাকে খন্ডন করিবার চেষ্টার মত বড় বোকামি আর নাই, পাশ কাটাইয়া পরিত্যাগ করাই উত্তম। কিন্তু আমি আমার ভালবাসাকে পাশ কাটাইলাম না, আমি এর শেষ দেখতে চাই। এই যে শেষ দেখিতে চাহিলাম তাহার শুরুতেই আমার নাওয়া খাওয়া প্রায় বন্ধ হইবার উপক্রম হইল।

প্রেমের জগতের যত রথি মহারথিকে জানিতাম কাহারো দ্বারস্থ হওয়া বাদ গেল না। ঘন্টার পর ঘন্টা ব্যয় করিয়া সমস্ত কথা তাহাদের কাছে উপস্থাপন করিলাম, সঙ্গে রেণুর ভাল দিক এবং আমার প্রতি তাহার ভালবাসার কথাও জানাইলাম। হায়রে প্রেমিক মন! যাহার বিরুদ্ধে মামলা করিলাম, তাহার পক্ষ হইয়াই উকালতি করিলাম কিন্তু আশা পূরন হইল না। অবস্থা বেগতিক দেখিয়া রেণু আংশিক দোষ স্বীকার করিল। বিচারকেরা তাহার কৃত পাপের মাত্রা নিরূপন করিয়া আমাকে পরামর্শ দিলেন, রুচিতে না বাধিলে চালিয়ে যাও আর মন না টানিলে মুক্ত করিয়া দাও।

আমি ভাবিতে লাগিলাম, শুধু রেণুই যে আমাকে ভালবাসিয়াছে তাহাই নহে, এই অল্প সময়ের মধ্যে আমিও কি তাহাকে কম ভালবাসিয়াছি? যাহাকে ভালবাসিয়াছি তাহার পাপ ক্ষমা না করিলে কাহারটা করিব? আমি আমার কট্টর নীতি পরিহার করিয়া ক্ষমা করিলাম এবং এই বলিয়া সাবধানও করিলাম যে, শেষ বারের মত সু্যোগ দিলাম, তথ্য গোপনের বিষয় যদি পরে ফের বাহির হয় তবে ফলটা ভাল হইবে না। রেণু বলিল, আর কোন গোপন কথা নাই। আমি বলিলাম, সেটা না থাকিলেই ভাল। কিছুদিন সবকিছু ঠিকঠাকই চলিল, সেই গল্পগুজব,প্রেমালাপ,হাসাহাসি। পাপ কোনদিনও চাপা থাকে না।

রেণুর ক্ষেত্রেও থাকিল না। আপন পাপের ভারে নিজ মুখ বন্ধ রাখা তাহার পক্ষে সম্ভব হইল না। কি এক প্রসঙ্গে জানিতে পারিলাম যে প্রাক্তন প্রেমিকের মেস পর্যন্ত রেণুর যাতায়াত ছিল। মেসের কান্ডকারখানার কথা আমার অজানা ছিল। আমি হিতাহিত জ্ঞানশুন্য হইয়া নানা কটুবাক্যে রেণুকে ভর্ৎসনা এবং একইসাথে জেরা করিতে লাগিলাম।

থলের বেড়াল বাহির হইল, শেষ পর্যন্ত রেণু এই বলিয়া আক্ষেপ করিল যে, “পাষন্ডটা যখন আমার মধ্যে প্রবেশ করল তখন আমি চিৎকার করে মূর্ছা গেলাম, তার পরে কি ঘটল তা বলতে পারিনা। ” আমি আর স্থির থাকিতে পারিলাম না, রেণুর মূর্ছা যাবার কথা শুনিয়া আমারও সংজ্ঞা লোপ পাইয়া বিছানায় উবু হইয়া পড়িতে বিলম্ব হইলনা। খানিকবাদে চেতনা ফিরিয়া আসিল বটে,কিন্তু বাকশক্তি সহসা ফিরিয়া আসিল না এবং যখন ইহাও ফিরিয়া আসিল তখন একগাদা অশ্রাব্য শব্দগুচ্ছ মুখ হইতে বাহির হইল যাহার শ্রোতা হইল আমার পাশের চার দেয়াল ও আমি। রেণুর ভাগ্যে কি ঘটিল তাহা আর বলিবার দরকার নাই। আমার অতি শুভাকাঙ্খিরা এই বলে আমাকে উৎসাহ দিল যে, “মরাকে মারিলে পাপ নাই, পাপিয়সীতো সব হারিয়েছেই,তুমি তার কাছ থেকে নতুন অভিজ্ঞতা নিতে পার।

” আমিও অনুরূপ ইচ্ছাই পোষণ করিলাম। কিন্তু আমার ভেতরের মানুষটা হুংকার দিয়া বলিল, দেহভোগে প্রশান্তি আসিলেও কৌমার্য বিসর্জনে তোমার অগৌরব হয়; চরিত্রহীনতার যে কদর্য বস্তুকে এতকাল দূরে রাখিতে সক্ষম হইয়াছ , প্রতিশোধ লইতে গিয়া বিষ ছুরি নিজের বুকে বসাইয়া তুমি কি সুখী হইবে?” আমি চমকিয়া উঠিলাম, এ আমি কি ভাবিতেছি; যাহাকে একদিনের জন্য হলেও ভালবাসিয়াছি, দূর্বলতার সুযোগ লইয়া তাহাকে ঠকানোর চিন্তা করিতেছি ? আমার অবচেতন মন ধিক্কার দিয়া বলিল, ছিঃ ! এইকথা আমার অজানা নহে যে, এই দুনিয়ার সবাই নিজেকে বাঁচানোর চেষ্টারত; নিজেকে বাঁচাতে গিয়া সে প্রতিনিয়িত অন্যকে জখম করিয়া ফেলিতেছে, রেণু কেবলমাত্র বিফল হইয়াছে। আমি চীরকালই খারাপকে ঘৃণা করিতে শিখিয়াছি, ভালবাসিতে শিখি নাই। সার্বজনীন ভালবাসা নাই যেইখানে সেইখানে পশ্চাৎপদতা ছাড়া আর কিছু থাকিতে পারে না। কখনো কখনো এমনও মনে হইয়াছে যে, ইন্টারনেট আর ফেন্সিডিলের যুগে সতীত্ব কিংবা সাধুত্বতো পণ্য, আমি তাহাতে আপত্তি করিবার কে? আপত্তিতো করিব তাহাদেরকে লইয়া যাহারা মেয়ে মানুষকে মায়ের আসনে বসাইয়া পূজা করে আবার একটু দোষ পাইলেই ঘৃণাভরে পরিত্যাগ করে।

কখনও কখনও তাহাদেরকে পতিতা বানাইয়া আবার তাহারদের কাছেই গোপনে বারবার কৌমার্য বিসর্জন দিয়াও কুমার থাকি। সেসব সবাই বোঝে কিন্তু তাহা মানিতে বাধে। কতদিন কতভাবে রেণু আমাকে বুঝানোর চেষ্টা করিয়াছে, আমি বুঝিয়াও বুঝি নাই, বারবার তাহাকে অপমান করিয়াছি। সে অবিরল অশ্রুপাত করিয়াছে, আমার প্রতিশোধের তপ্ত কড়াই ঠান্ডা হয় নাই। অনেকদিন পার হইয়াছে, এখনও তাহার ঐ সুন্দর মুখখানি ভুলিতে পারি নাই, একথা আর কেউ না জানুক, অন্তঃত আমি জানি , রেণুর যে মিষ্টিমাখা হাসি আর করুণ চাহনি আমাকে প্রেমিক সাজিতে বাধ্য করিয়াছিল তাহা কোনদিনও অসুন্দর হইতে পারেনা।

ইস্ অতীত যদি পরিবর্তন করা যাইত তবে সর্বাগ্রে রেণুর দোষকে শোধরাইতাম, কিন্তু তাহা অসম্ভব এবং এও সত্য যে, ভালবাসার আবরনে ঢাকা আমার ভালবাসার মানুষটির যে মূর্তি মনে একদা স্থাপন করিয়াছিলাম তাহা কোনদিনও অপবিত্র হইতে পারেনা সেটা করার ক্ষমতা কোন মহাপরাক্রমশালীরই নাই, আমার মনের অন্দরে যে কেবল আমারই ঢোকার ক্ষমতা আছে, আর কারো নাই। সবকিছু ছিন্ন করিয়াছি, প্রেমিকাকে ছ্যাঁকা দিবার কথা গর্বভরে বন্ধুদের কাছে প্রচার করিয়াছি, কিন্তু এখনও রেণুকে ভুলিতে পারি নাই,মাঝে মাঝে মাঝরাত্রিতে কে জানি কানের কাছে ফিসফিস করিয়া বলে, “ভালবাসি,ভালবাসি তোমায়। ” আমি কানে আঙ্গুল দিয়া প্রাণপণে কানের ছিদ্র বন্ধ করিবার চেষ্টা করি, কিন্তু সে শব্দের প্রতিধ্বনি উচ্চ হইতে উচ্চতর হয় ক্ষাণিকবাদে সব শুন্যে মিলাইয়া যায়, কেবল বর্তমান থাকে রাতজাগা পাখির আর্তনাদ আর আমার নির্ঘুম দুটি চোখ,যাহার অন্তরালে লুকিয়ে আছে অনুদার এক প্রেমিক। এফ এইচ রিগ্যান ১৪.০২.১১


এর পর.....

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।