আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

যে কথা তোমায় আজও বলা হয়নি!


“বাবা তোমার গলা এমন শোনাচ্ছে কেন? তোমার কি শরীর খারাপ?” এপাশ থেকে অবাক হয়ে যাই, কত জনের সাথে একে একে কথা বললাম কেউ ধরতে পারল না! মা, তুমি কি জানো আমার চোখ এখন ছল ছল!! সাত ভাই আর এক বোনের সংসারে পিঠা-পিঠি ভাইবোন আমরা! ছোটকালে দেখেছি মা একটুও বিরক্ত হতেন না আমাদের হই-চই আর আবদারে। আর বাবা সবসময় গম্ভীর, ভাবখানা, 'হতচ্ছাড়া গুলো এমন করছে কেন?' মায়ের চোখে দেখতাম ভালবাসা আর মমতা নিয়ে বাবার দিকে তাকিয়ে বলছেন, "আপনি এমন করেন কেন, ওরা ছোট, বোঝেনা!" মা, মাগো... আমার সব মনে আছে। তুমি আমাদের কি মমতায় বড় করেছ, বাবা সারাদিন ব্যস্ত তাঁর ব্যবসা আর কাজ নিয়ে। সেই সকালে বেরিয়ে যায় ফিরে সন্ধ্যের অনেক পর। সাথে এক-গাদা বাজার, তুমি একটু বিরক্ত হতেনা! বরং তোমার চোখে মুখে দেখতাম এক ধরনের প্রশান্তি কাজ করছে।

ফুলির মাকে নিয়ে ব্যস্ত মাছ কাটতে, রাতের খাবার যোগাড়ে, এরই মাঝে আমাদের জন্য চা, নাস্তা; বাবার জন্য চা, তাঁর সব কিছু এগিয়ে দিতে অক্লান্ত ভাবে। আমরা কে কি খেতে ভালবাসি তা তুমিই জানতে আর তাই তোমার রান্না হত সে রকম করেই! মা, তোমার মনে আছে আমি ইলিশ মাছ ভাজা ছাড়া খেতে পারতাম না, আর মুরগির কলিজা আমার জন্য কেউ ভাগ পেতোনা!! মা, তুমি আমায় শিখিয়েছ কি করে নিচু স্বরে কথা বলতে হয়, তুমি বলেছ, "বাবা কখনো মিথ্যা বলবেনা, অন্যায় করবেনা, চুরি করবেনা, অন্যের হক মেরে খাবেনা, অন্যায়কারীকে প্রশ্রয় দেবেনা, অসৎ লোকের সাথে মিশবে না, যারা গরিব আর অসহায় নিজের জীবন দিয়ে তাঁদের সেবায় ঝাঁপিয়ে পড়বে!!" তুমি শিখিয়েছ বড়দের কি করে সম্মান দিতে হয়, অতিথিকে কিভাবে আপ্যায়ন করতে হয়। তুমি শিখিয়েছ মানুষের প্রতি মানুষের ভালবাসা কেমন হতে হয়..!!! এই তোমার কঠিন মুখটিও আমি দেখতাম!শুক্রবার এলে বলতে,”সারা বছরতো নামাজ পড়-ই না,আজ ঝাটা নিয়ে বসলাম,নামাজ না পড়লে খানা নেই!!” মা, তোমার মনে আছে বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার দিন গুলোর কথা? এক বিশ্ব-বেহায়ার বিরুদ্ধে আন্দোলন করি; রাজপথে, মিছিলে, পিকেটিং-এ ব্যস্ত থাকি.... বাবা সব খবর পেয়ে সেকি মার; সারা গায়ে দগদগে ঘা। তুমি কেঁদেছ নিরবে, সেই ঘায়ে মলম লাগিয়েছ, তোমার চোখের জল, নোনা জল আমার জ্বলুনি বাড়ালেও কি আবেগে যে ভেসেছিলাম সেদিন মা! তুমি বাবার সাথে রাগ করে ৩ দিন কথা বলনি, বাবা শুধু রাগে গর গর করছেন, আর তুমি ঘুমালে আমার ঘরে....... বাবা বলতেন, "কি হবে এই দেশের নষ্ট রাজনীতি করে? মাওলানা ভাষানীর মত নিঃস্বার্থ দেশ প্রেমিক নেতা কোথায়!!শেখ মুজিব আর জেঃ জিয়া দেশকে ভালবেসে নিজেদের প্রান উৎসর্গ করে গেছেন। কোন রাজনৈতিক নেতার ছেলেকে দেখেছ গুলি খেয়ে মারা পড়তে,কিম্বা বিশ্ববিদ্যালয়ে গোলাগুলি করে মারা পড়তে?এসব ধোঁকা,এছাড়া আমার ব্যবসার ক্ষতি হয়, সরকারী দলের লোকেরা শাসায়, ”আপনার ছেলেকে সাবধান করেন, নাহলে ধরে এনে জেলে ঢুকাবো"।

বাবা চাইতেন না তার ছেলে এসব করুক...। মা বলতেন, ''আর যাবেনা'' বাবাকে লুকিয়ে সবই করতাম, প্রশ্রয় দিতেন মা......... এরই মাঝে ফার্স্ট ইয়ার ফাইনাল পরীক্ষা এসে গেল। নিয়ম মত শতকরা ৭৫ ভাগ উপস্থিতি চাই, আমার তা নেই। চেয়ারম্যান স্যার বললেন, "তুমি এক্সাম দিতে পারবেনা, যদিনা তোমার বাবা। মা সুপারিশ করেন"।

বাবা আসেননি, মা এগিয়ে এলেন তাঁরই কোনো এক বান্ধবীকে (যিনি শিক্ষিকা ছিলেন) ধরে আমার এক্সাম এর ব্যবস্হা করিয়ে দিলেন, স্যারকে কথা দিলেন এরপর তিনি নিজে আমার বিষয়টি দেখবেন। মা তোমার মনে আছে তুমি বলেছিলে, ''হলে উঠে যাও তাহলে ক্লাস মিস হবে কম। '' বাবার সাথে এ নিয়ে আবার তোমার মনমালিন্য হলো। আমি হলে উঠে গেলাম। ক্যান্টিনের খাবার মুখে দিতে পারিনা।

ডালের পানি দেখলে চোখে জল আসে!!! তুমি লুকিয়ে টাকা দিতে; সেই টাকায় 'নিরব' বা 'মিতালি'তে খেতাম। বাসায় এসে তোমায় বলতাম, "মা তোমার মত করে কেউ রাঁধতে পারেনা, আমি হোস্টেল এ যাবনা"। তুমি বলতে,"ঠিক আছে অন্তত দুপুরে এসে বাসায় খেয়ে যেও"। রিক্সা ভাড়ার টাকা বাবাকে লুকিয়ে মা-ই দিতেন। আমার বন্ধুরা বলত, ''দোস্ত হলের ক্যান্টিনের খাবার খেতে খেতে পেটে চর পরে গেছে।

খালাম্মার হাতের রান্না খাব। '' মায়ের অতিথি আপ্যায়নের কথা ভুলিনি। ২। ৩ রিক্সা চড়ে বাসায় গিয়ে হানা দিতাম অসময়ে। মা মোটেও রাগ করতেন না।

বলতেন, "আহারে আমার বাছাদের মুখ শুকিয়ে গেছে। এই সরবত আর বিস্কুট খাও; এখনি খাবার দিচ্ছি। '' বন্ধুরা যা যা খেতে ভালবাসত, সেই উচ্ছে আর চিংড়ি ভাজা, পুঁই-শাক, ইলিশ মাছের মুড়ো দিয়ে কচুঁশাক... নিমিষে রান্না হয়ে যেত! মা আজ কতদিন সেই সব খাবার খাওয়া হয়না তুমি কি জানো? তোমায় ছেড়ে আজ একটি যুগ প্রবাসী হয়েছি। তুমি প্রায়-ই বল, "কেন পড়ে আছো বাবা! অনেক তো হলো আর কি চাও? কতদিন তোমায় দেখিনা। লক্ষ্মী বাপ আমার, এবার চলে আসো।

আমি আর তোমায় বিদেশ করতে দেবোনা। " "মা মাগো এমন তো কথা ছিল না... আমিতো আজীবন আদরে আহ্লাদে বড় হয়েছি, একটু রোদে যাবার জো'টি ছিল না তোমার বকুনিতে আজ তোমার মুখটি অস্পষ্ট মা! মাগো! এমন তো কথা ছিলনা... আমি একটু সুখের আশায় তোমায় ছেড়ে যোজন যোজন পথ পাড়ি দিয়েছি সেই সুখ আজ নিয়নের আলোয় ভেসে যাচ্ছে... তুমি কি তা বুঝতে পারো?" তোমায় বড্ড মনে পড়ছে মা
 

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।