আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

কেন আমি আদালতে গেলাম?

জানতে ভালোবাসি,...তাই প্রশ্ন করি...

লেখক:ড:মুহাম্মদ ইউনূস সর্বোচ্চ আদালতের রায় আপনারা জেনে গেছেন। আমি কেন আদালতের শরণাপন্ন হয়েছি, কেন আমি গ্রামীণ ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক থাকতে চেয়েছি, কেন দেশে-বিদেশে অনেকে এ নিয়ে উদ্বিগ্ন হচ্ছে- এসব নিয়ে কারো কারো মধ্যে কিছু ভুল বোঝাবুঝি সৃষ্টি হয়েছে। এ সম্পর্কে আমার বক্তব্যটি জানতে পারলে হয়তো এর অবসান হবে। আমি আদালতে গিয়েছি একটি সুনির্দিষ্ট কারণে। বাংলাদেশ ব্যাংক গ্রামীণ ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালকের পদ থেকে কোন জবাবদিহিতার সুযোগ না দিয়েই আমাকে অপসারণ করার জন্য একটি পত্র দিয়েছে, যাতে এও বলা হয়েছে যে গত এগারো বছর ধরে আমি এ পদে অবৈধ ভাবে আছি (যদিও বাংলাদেশ ব্যাংক নিয়মিতভাবে বাৎসরিক ভিত্তিতে এই সময়কালে গ্রামীণ ব্যাংক পরিদর্শন করেছে এবং কখনও গ্রামীণ ব্যাংকের কোন বিষয় নিষ্পত্তিহীন রয়েছে বলে কোন অভিযোগ তোলেনি)।

আমি এই পত্র আইন সঙ্গত হয়নি এবং এর মাধ্যমে আমার প্রতি ও গ্রামীণ ব্যাংকের প্রতি অন্যায় করা হয়েছে বলে মনে করেছি। গ্রামীণ ব্যাংকের পরিচালনা বোর্ডের ৯ জন সদস্যও একই রকম মনে করেছেন। তাই আমি ও তারা পৃথকভাবে আদালতের শরণাপন্ন হয়েছি যাতে আমার ও গ্রামীণ ব্যাংকের ওপর পত্রটির মাধ্যমে যে অন্যায় হয়েছে বলে আমরা মনে করেছি তার নিরসন হয়। এজন্য বাংলাদেশের বিচার ব্যবস্থায় বিচার পাওয়ার যতগুলো সম্ভাব্য পর্যায় আছে তার প্রত্যেকটিতে চেষ্টা আমাকে করতেই হতো এবং সেটিই আমি করেছি। জড়িয়ে আছে চার কোটি গরিব মানুষের ভাগ্য আমি ঠিক করেছিলাম যে, মহামান্য আদালতের শেষ রায় দ্বারা যদি নির্ধারিত হয় যে বাংলাদেশ ব্যাংকের পত্রটি সঠিক ছিল না তাহলে আমরা যথারীতি গ্রামীণ ব্যাংকের স্বার্থে কাজ করবো, সুন্দররূপে কিভাবে আমার দায়িত্ব হস্তান্তর করতে পারি সে চেষ্টা করবো।

আর যদি সেই রায় আমরা না পাই তা হলে স্বাভাবিক ভাবেই বোর্ড বাংলাদেশ ব্যাংকের পত্র অনুযায়ী পরবর্তী সিদ্ধান্ত নেবে। আমার আদালতে যাওয়ার কারণ এটুকুই। এ ক্ষেত্রে সুবিচার পাওয়ার আশায় আমাকে এ কাজ করতেই হয়েছে। কিন্তু গ্রামীণ ব্যাংকের ভবিষ্যৎ রক্ষা এবং এর প্রায় এক কোটি দরিদ্র ঋণ গ্রহীতার (যারা এই ব্যাংকের ৯৬.৫ শতাংশ শেয়ারের মালিকও বটে) আশা-ভরসার স্থলটুকুকে রক্ষার বিষয়টি অনেক বড় ও ব্যাপক বিষয়। এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে দেশের চার কোটি দরিদ্র মানুষের ভাগ্য এর পরোক্ষ প্রভাব পড়বে সারা দুনিয়ায় ক্ষুদ্র ঋণ কার্যক্রমে জড়িত বিশাল দরিদ্র জনগোষ্ঠীর ভবিষ্যতের ওপর।

দারিদ্র্য দূরীকরণের এই সফল মডেলটির অস্তিত্বের প্রশ্নগুলোও অবহেলা করার মতো নয়। গ্রামীণ ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে বিদায় নেবার আগে-পরে এর ভবিষ্যৎ রক্ষার ক্ষেত্রে আমি কি ভূমিকা নিতে পারলাম বা পারলাম না- এটিই আমার এবং সেই সঙ্গে অনেকের বড় ভাবনা। কেউ কেউ বলেছেন, আদালতে না গিয়ে অর্থমন্ত্রী মহোদয়ের অনুরোধ অনুযায়ী বিদায় নিলে আমার সম্মান থাকতো। আমি সেটি মনে করি না। তাতেও আমার বিদায়ের ক্ষেত্রে এবং গ্রামীণ ব্যাংকের ভবিষ্যতের ক্ষেত্রে ফলশ্রুতি একই হতো।

বরং আমি এমন একটি আকস্মিক প্রস্তাব মেনে নিয়ে অসংখ্য কর্মী ও ঋণ গ্রহীতার পরিবারকে স্বেচ্ছায় অনিশ্চয়তার মধ্যে ঠেলে দিলে আমি নিজের কাছে অপরাধী হয়ে থাকতাম। সেটি আমি সজ্ঞানে করতে পারিনি। কেউ কেউ অভিযোগ করেছেন গ্রামীণ ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালকের পদটি যতদিন পারা যায় আঁকড়ে ধরে থাকাটাই আমার উদ্দেশ্য। আপনারা জানেন এই পদটিই আমার জীবনের পরম আরাধ্য ধন নয়। আমি নিজেও খুবই সচেতন ছিলাম ও আছি যে, আমার বাকি কাজ এই পদে থেকে নয়, বরং অন্য কোন অবস্থান থেকে তরুণদের সঙ্গে নিয়ে সারা জীবনের মূল কাজটি চালিয়ে যাওয়া- সেটি হলো এদেশ থেকে এবং পৃথিবী থেকে দারিদ্র্যকে নির্বাসনে পাঠাবার চেষ্টা।

তবে সেটি যেন গ্রামীণ ব্যাংকের মতো একটি প্রতিষ্ঠানকে কোন রকমের ঝুঁকিতে ফেলে না করতে হয় সেজন্য আমার চিন্তার অন্ত ছিল না। অর্থমন্ত্রী মহোদয়কে এক বছর আগে লেখা চিঠি প্রকাশ করার মাধ্যমে আমি সেই চিন্তার কথাটিই সবার সামনে তুলে ধরেছি। কিভাবে ওরকম ঝুঁকি এড়িয়ে কাজটি করা যায় সে সম্পর্কে দু'টি বিকল্প আমি তাকে দিয়েছিলাম। আমার সে প্রচেষ্টায় সাড়া আসেনি। কাজেই কেউ যদি বলেন, অন্যায় ভাবে পদ ধরে রাখা বা ব্যবস্থাপনা পরিচালকের পদে পরিবর্তনের চেষ্টার সঙ্গে সহযোগিতা না করাটাই আমার উদ্দেশ্য, তাহলে আমার প্রতি অবিচার করা হবে।

গত কয়েক মাস ধরে আমার বিরুদ্ধে, গ্রামীণ ব্যাংকের বিরুদ্ধে এবং ক্ষুদ্র ঋণের ধারণার বিরুদ্ধে বিস্তর লেখালেখি হচ্ছে। কি প্রক্রিয়ায় এটা হচ্ছে সেটি সবাই লক্ষ্য করছেন। দ্বন্দ্বের আবহাওয়ায় নেতৃত্বে পরিবর্তন মঙ্গলজনক হবে না আমার, দেশবাসীর ও বিশ্ব সমাজের উদ্বেগের কারণ এখানেই। এই উদ্বেগ আমার জন্য যতটা নয়, তার চেয়ে অনেক বেশি গ্রামীণ ব্যাংকের জন্য ও তার কোটি ঋণ গ্রহীতার ভবিষ্যতের জন্য। এ জন্যই আমি বার বার বলছি যে, দ্বন্দ্বের আবহাওয়ায় গ্রামীণ ব্যাংকের নেতৃত্বে পরিবর্তনের উদ্যোগ নিলে তাতে প্রতিষ্ঠানটির জন্য অমঙ্গল বয়ে আনতে পারে।

আমার বরাবর আশা একটি সৌহার্দ্যপূর্ণ যৌক্তিক পরিবেশে এটি হওয়া উচিত, যাতে গ্রামীণ ব্যাংকের অগ্রযাত্রা অব্যাহত থাকে। এখানে অনেক প্রশ্ন জড়িত রয়েছে। রাজনৈতিক প্রভাবের বাইরে ভবিষ্যতে গ্রামীণ ব্যাংকের মতো একটি প্রতিষ্ঠান তার অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে পারবে কিনা, সফল হতে পারবে কিনা, সে সাফল্য ধরে রাখতে পারবে কিনা এগুলোই বড় প্রশ্ন। রাজনৈতিক প্রভাবের ছায়া পড়লে আমাদের দেশের আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর কি হয় তা তো সবার জানা। আর গ্রামীণ ব্যাংক তো চলে বিশ্বাস আর আস্থার ওপর নির্ভর করে।

শুধু গ্রামীণ ব্যাংক কেন, রাজনৈতিক বলয়ের বাইরের ও নাগরিক সমাজের কোন জনকল্যাণ উদ্যোগ ও সফল প্রচেষ্টা ভবিষ্যতে তার স্বকীয়তা ও নিরপেক্ষতা বজায় রেখে এদেশে চলতে পারবে কিনা সেটা বিবেচনা করে দেখতে হবে। গ্রামীণ ব্যাংকের ভেতরে বাইরে যেখানেই থাকি এক্ষেত্রে আমার নিজের দায়িত্বটিকে অবহেলা করা আমার পক্ষে সম্ভব হবে না। গ্রামীণ ব্যাংকের স্বকীয়তা ও গরিবদের মালিকানা রক্ষা একটি সাধারণ ঘটনা মাত্র নয়, দরিদ্র মানুষের ভবিষ্যৎ নির্ধারণের ক্ষেত্রে এটি একটি সুদূরপ্রসারী প্রশ্ন। এর জন্য যা কিছু করা সম্ভব তা করা আমাদের সবার দায়িত্ব বলে মনে করি। বিশ্ব সমাজে সিভিল সোসাইটি উদ্যোগের স্বকীয়তা ও স্বাধীনতার অধিকারকে যে আন্তর্জাতিকভাবে সুশাসনের অবিচ্ছেদ্য অংশ বলে মনে করা হয়- এটি সর্বজনবিদিত।

বিশেষ ভাবে যেখানে তৃণমূলে দারিদ্র্য নিরসনের ব্যাপক কর্মকাণ্ডে পৃথিবীর একটি সফলতম মডেলের ক্ষেত্রে এ প্রশ্ন ওঠে তখন অনেকেই বিচলিত হন। যে যত ধনী দেশই হোক, এই মডেল তাদের দেশেও বহুদিন যাবত প্রচলিত আছে। তাদের দেশের গরিব মানুষ এর মাধ্যমে উপকৃত হচ্ছে বলে তারা এই মডেলের জন্য বাংলাদেশের কাছে কৃতজ্ঞ। আমাদের দেশের পরিচিতি বিশ্ববাসীর কাছে পরিচিত হয়ে উঠেছে নাগরিক উদ্যোগের এবং উদ্ভাবনীমূলক কর্মকাণ্ডের সাফল্যের কারণে। সারা পৃথিবীতে বাংলাদেশ হয়ে উঠেছে সিভিল সোসাইটি এ্যাকশন ও তার সাফল্যের উজ্জ্বলতম উদাহরণ।

বাংলাদেশকে বাইরের দুনিয়ায় অসংখ্য মানুষ সম্মান দিতে শুরু করেছে এ কারণেই। এটিই হলো আমাদের গর্ব, বিশ্বের দরবারে আমাদের উজ্জ্বল ভাবমূর্তি। এই ভাবমূর্তি বিনষ্ট হলে জাতি হিসেবে আমরা কি ক্ষতিগ্রস্ত হবো না? আমাদের গর্ব আর আত্মবিশ্বাসে কি চির ধরবে না? এই প্রশ্ন আপনাদের কাছে রেখে আমি সম্ভাব্য আশঙ্কাগুলো থেকে গ্রামীণ ব্যাংককে, বিশেষ করে দরিদ্র নারীর ক্ষমতায়নকে এবং সার্বিকভাবে নাগরিক সমাজের উদ্যোগকে অব্যাহত রাখা নিশ্চিত করতে সবার কাছে আবেদন জানাচ্ছি। চল্লিশ বছরের মূল্যবান অর্জনগুলো ধরে রাখতে হবে জাতি হিসেবে এ বিষয়ে আমাদের মধ্যে ঐকমত্য সৃষ্টি করতে না পারলে আমাদের ৪০ বছরের মূল্যবান অর্জনগুলো ধরে রাখা এবং আরও বহু উচ্চতর অর্জনের দিকে নিয়ে যাওয়া সম্ভব হবে না। গ্রামীণ ব্যাংকের ব্যাপারে গত চার মাসে দেশের সব স্থান থেকে প্রতিবাদ এসেছে।

পত্রপত্রিকা, টেলিভিশনে সোচ্চার বক্তব্য এসেছে। গ্রামীণ ব্যাংকের ঋণগ্রহীতা এবং তাদের পরিবারের ৩৭ লাখ মানুষ মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কাছে তাদের লিখিত আবেদনের মাধ্যমে নীরবে প্রতিবাদ জানিয়েছে। প্রবাসী বাংলাদেশীরা ইউরোপ আমেরিকার বহু শহরে ব্যক্তিগতভাবে এবং সংঘবদ্ধভাবে প্রতিবাদ জানিয়েছে। যতক্ষণ না নিশ্চিত হচ্ছি যে আমরা ব্যাংকের অগ্রযাত্রা অব্যাহত রাখা নিশ্চিত করতে পেরেছি, ততক্ষণ আমাদের প্রতিবাদ জানিয়ে যেতেই হবে। গরিব মহিলার মালিকানার ব্যাংক দরিদ্র মহিলার মালিকানায় প্রতিষ্ঠিত গ্রামীণ ব্যাংকের মতো বিশ্বখ্যাত এবং দেশের গৌরবের প্রতিষ্ঠানকে অনিশ্চয়তার পথে ঠেলে দেয়ার কোন সুযোগ সৃষ্টি হোক এরকম কোন পরিস্থিতি আমরা কেউ কামনা করি না।

গত ৩৫ বছরে আমরা গ্রামীণ ব্যাংককে একটি মজবুত আর্থিক প্রতিষ্ঠানে পরিণত করতে পেরেছি। ব্যাংক প্রতি বছর মুনাফা অর্জন করতে পারছে। সে মুনাফা শেয়ার মালিক হিসেবে ঋণগ্রহীতাদের কাছে পৌঁছে দিতে পেরে আমরা আনন্দ পাচ্ছি। যে ব্যাংকের যাত্রা শুরু হয়েছিল ৮৫৬ টাকা দিয়ে সে ব্যাংক এখন মাসে এক হাজার কোটি টাকা ঋণ বিতরণ করছে। এর আমানতের পরিমাণ দশ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে গেছে।

এর মধ্যে অর্ধেকেরও বেশি আমানত এসেছে ঋণগ্রহীতাদের কাছ থেকে। আমাদের এমন শাখাও আছে যেখানে সদস্যদের আমানতের পরিমাণ তাদের নেয়া ঋণের দ্বিগুণ। আমাদের ১১শ' ৫০টি শাখা আছে। যেখানে সদস্যদের আমানতের পরিমাণ ঋণের পরিমাণের ৭৫ শতাংশ বা তার চাইতে বেশি। এতেই পাওয়া যায় সদস্যদের আর্থিক বিবর্তনের ইতিহাস।

সব চাইতে আনন্দের বিষয় হলো- প্রায় ছয় হাজার কোটি টাকা যেটা সদস্যদের আমানত হিসাবে ব্যাংকে জমা আছে তার ৯৭ ভাগই হলো মহিলাদের সঞ্চয়। এই টাকার ওপর মহিলাদের আর কোন ভাগীদার নেই। এছাড়া গৃহঋণের মাধ্যমে প্রায় ৭ লাখ মহিলা নিজ মালিকানায় গৃহনির্মাণ করতে পেরেছেন। এতে মহিলাদের ক্ষমতায়নেরও একটা পরিমাপ পাওয়া যায়। গ্রামীণ ব্যাংকে যে মহিলারা যোগ দিয়েছেন তাদের সন্তানদের বয়সও এখন বেড়েছে।

শুরুতেই তাদের সবাইকে আমরা স্কুলে পাঠাতে পেরেছি এটাই আমাদের আনন্দ। তাদের অনেককে বৃত্তি দিতে পারছি, উচ্চ শিক্ষার জন্য ঋণ দিতে পারছি তা আমাদেরকে তৃপ্তি দেয়। আজ পর্যন্ত আমরা ১৮ কোটি টাকা বৃত্তি বাবদ দিয়েছি, চারশ' কোটি টাকা উচ্চশিক্ষা ঋণ দিতে পেরেছি। উচ্চশিক্ষা ঋণ পেয়ে ৫০ হাজার ছেলেমেয়ে এখন ডাক্তারি, ইঞ্জিনিয়ারিং এবং বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপড়া করছে। অনেকে পি.এইচডি ডিগ্রি সমাপ্ত করেছে।

গ্রামীণ ব্যাংকের নতুন প্রজন্মকে আমরা একটা নতুন জীবন দিতে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। তাদের মধ্যে আমরা এই অঙ্গীকার জাগিয়ে তুলছি যে 'আমরা চাকরি করবো না, আমরা চাকরি দেবো। ' তাদের জন্য আমরা নতুন উদ্যোক্তা ঋণ চালু করেছি। এখন আমাদের সামনে চ্যালেঞ্জ হলো দ্বিতীয় প্রজন্মকে চিরস্থায়ীভাবে দারিদ্র্য থেকে অনেক দূরে সরে আসার সুযোগ সৃষ্টি করে দেয়া। এ কাজে দ্রুত সাফল্য নিশ্চিত করাই হবে এখন আমাদের লক্ষ্য।

সংবাদ মাধ্যমের একাংশ মারফৎ ক্রমাগত প্রচারিত হতে থাকায় কিছু ভুল ধারণা হয়তো মানুষের মনে সৃষ্টি হয়েছে। এ সুযোগে সেগুলো সম্বন্ধে দু'একটা কথা বলছি। মানুষের মনে হয়তো এরকম ধারণার সৃষ্টি হয়েছে যে, গ্রামীণ ব্যাংক বিদেশী টাকায় চলে। এটা মোটেই সত্য নয়। ১৯৯৫ সালের পর থেকে আর আমরা বিদেশী টাকা গ্রহণ করিনি।

গ্রামীণ ব্যাংক সম্পূর্ণ নিজের টাকায় চলে। আমানতের খাতে যে টাকা জমা হয় তা দিয়েই ঋণ দেয়া হয়। ঋণের দেয়া টাকার চাইতে আমানতের টাকা প্রায় দেড়গুণ। কাজেই বাইরের কারও কাছ থেকে ঋণ বা অনুদান নেয়ার প্রশ্নই আসে না। তাছাড়া, অতীতের যেসব বিদেশী ঋণ ছিল তা সব আমরা শোধ করে দিয়েছি।

মানুষের মনে ধারণা দেয়া হয়েছে গ্রামীণ ব্যাংকের সুদের হার বেশি, তা সত্য নয়। গ্রামীণ ব্যাংকের সুদের হার বাংলাদেশের ক্ষুদ্রঋণ জগতে সর্বনিম্ন। ক্রমহ্রাসমান পদ্ধতিতে শতকরা ২০ টাকা। সরল সুদ। অর্থাৎ সুদের ওপর সুদ হয় না।

অথচ আমানতের ওপর চক্রবৃদ্ধি হারে সুদ দেয়া হয়। রিভিউ কমিটির রিপোর্টে বিষয়টি পরিষ্কারভাবে তুলে ধরা হয়েছে। কেউ কেউ বলেন, এটা সরকারি ব্যাংক। কেউ কেউ বলেন, এটা এনজিও। বাস্তবে এটা সরকারি ব্যাংকও নয়, এনজিও নয়।

এটা একটা বিশেষ আইনে সৃষ্ট গরিবের মালিকানায় বেসরকারি ব্যাংক। অভিযোগ করা হয়- গরিবের ওপর জোর-জুলুম করে টাকা আদায় করা হয়। জোর-জুলুমের কোন প্রয়োজন নেই গ্রামীণ ব্যাংকে। ঋণগ্রহীতা নিজেই গ্রামীণ ব্যাংকের মালিক। ঋণ পরিশোধের সময়সীমা ক্রমাগতভাবে বাড়ানো যায়।

কত টাকা কিস্তি দেবেন সেটা সম্পূর্ণ ঋণগ্রহীতার ওপর নির্ভর করে। ঋণগ্রহীতা বা তার স্বামীর মৃত্যু হলে সঙ্গে সঙ্গে ঋণের অবশিষ্ট টাকা মওকুফ হয়ে যায়। ঋণের দায়িত্ব পরিবারের কারও ওপর বর্তায় না। মৃত ঋণগ্রহীতার জানাজার খরচের জন্য ব্যাংক থেকে অনুদান দেয়া হয়, জানাজায় ব্যাংকের ম্যানেজার বা তার প্রতিনিধিকে উপস্থিত থাকতে হয়। ঋণগ্রহীতার নিজের সঞ্চয়ী হিসাবে সব সময় যথেষ্ট সঞ্চয় জমা থাকে।

অনেকের সঞ্চয়ের পরিমাণ ঋণের পরিমাণের চাইতেও বেশি। সামগ্রিকভাবে গ্রামীণ ব্যাংক যত টাকা ঋণ বিতরণ করে তার অর্ধেক পরিমাণ টাকা ঋণগ্রহীতার সঞ্চয়ী তহবিলেই জমা আছে। গ্রামীণ ব্যাংকের মতো বিশাল একটি প্রতিষ্ঠান সম্বন্ধে ভুল ধারণার অবসান ঘটিয়ে আমরা যতবেশি নাগরিক উদ্যোগের প্রতি যত্নবান হতে পারি ততবেশি মঙ্গল হবে। সামাজিক ও অর্থনৈতিক পরিবর্তন আনার ক্ষেত্রে নাগরিক উদ্যোগ একটা বিরাট ভূমিকা রাখতে পারে। সরকারি উদ্যোগের পাশাপাশি তাকে ক্রমাগতভাবে সমপ্রসারিত করতে হবে।

এক্ষেত্রে সরকারি উদ্যোগ ও নাগরিক উদ্যোগের লক্ষ্য একই- দেশের সামাজিক, অর্থনৈতিক এবং পরিবেশগত সমস্যাসমূহের সমাধান নিশ্চিত করা। এক ধরনের সমস্যা আছে যেখানে খয়রাতি সাহায্য ছাড়া আর কোন সমাধান এখনও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না, সেখানে খয়রাতি সাহায্য অবশ্যই জোরদার করতে হবে। কিন্তু সব সমস্যার সমাধানে খয়রাতি সাহায্যের ওপর ভরসা করে থাকলে মূল সমস্যার সমাধান কখনও আসবে না। দরিদ্রতম মানুষের মধ্যেও কর্মশক্তি আছে, নিজের দায়িত্ব নিজে নেয়ার ক্ষমতা আছে- তাকে ক্রমে ক্রমে জাগিয়ে তোলার আয়োজন করতে হবে। সেটা করার জন্য নাগরিক সমাজকে তাদের সৃজনশীলতা নিয়ে এগিয়ে আসতে হবে।

এক্ষেত্রে আমি সামাজিক ব্যবসার ধারণাটাকে কাজে লাগানোর প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি এবং অন্যদেরও এ ব্যাপারে আগ্রহী করার চেষ্টা করছি। দেশে এবং বিদেশে অনেকে আগ্রহী হয়ে এগিয়ে আসছেনও। স্বাস্থ্য ক্ষেত্রে, পরিবেশের ক্ষেত্রে, কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে, নারীর ক্ষমতায়নের ক্ষেত্রে, প্রযুক্তির উদ্ভাবনশীল ব্যবহারের ক্ষেত্রে, ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের বৃহত্তর গণ্ডিতে প্রবেশের ক্ষেত্রে, তরুণ উদ্যোক্তা সৃষ্টির ক্ষেত্রে, ব্যাংকিংয়ের ক্ষেত্রে, এরকম আরও বহু ক্ষেত্রে সামাজিক ব্যবসার ধারণা এবং কাঠামো অত্যন্ত কার্যকর ভূমিকা রাখবে বলে আমি মনে করি। এই সমর্থন নাগরিক উদ্যোগের অগ্রযাত্রার প্রতি সমর্থন গ্রামীণ ব্যাংকের ক্ষেত্রে যে সমর্থন দেশের ভেতরে এবং বাইরে স্বতঃস্ফূর্তভাবে প্রকাশিত হয়েছে সে সমর্থন শুধু গ্রামীণ ব্যাংকের প্রতি সমর্থনই নয়, সে সমর্থন নাগরিক উদ্যোগের অগ্রযাত্রার প্রতিও সোচ্চার সমর্থন। এই সমর্থনকে অব্যাহত রাখতে হবে।

জোরদার করতে হবে। এই সমর্থনকে সক্রিয় উদ্যোগে পরিণত করার আয়োজন করতে হবে। সামাজিক ব্যবসার মাধ্যমে আমি আমার উদ্যোগ অব্যাহত রাখবো। এ কাজে শরিক হওয়ার জন্য আপনাদেরও আহ্বান জানাচ্ছি। সবাইকে সামাজিক ব্যবসা করতে হবে এমন কোন প্রস্তাব আমি দিচ্ছি না।

যে যেভাবে পছন্দ করেন এগিয়ে আসবেন। আমার মূল প্রস্তাবটি হচ্ছে আমাদের প্রত্যেকের মধ্যে সামাজিক সমস্যা সমাধানের প্রচুর ক্ষমতা আছে। সে ক্ষমতাকে কর্মক্ষেত্রে ব্যবহারের জন্য যেন আমরা এগিয়ে আসি। সে বিপুল ক্ষমতাকে সুপ্ত রেখে, কর্মক্ষেত্রে তাকে বিন্দুমাত্র ব্যবহার না করে শুধু আক্ষেপ আর হা-হুতাশ করে যেন আমরা পৃথিবী থেকে বিদায় না নিই। ২০৩০ সালের মধ্যে যদি আমরা দারিদ্র্যমুক্ত বাংলাদেশ গড়তে চাই তার ভিত্তি তো আমাদের এখনই প্রতিষ্ঠিত করতে হবে।

আমাদের প্রত্যেকের সুপ্ত ক্ষমতাকে অবিলম্বে কাজে লাগাতে পারলে সে ভিত্তি তৈরি করা অবশ্যই সম্ভব। চল্লিশ বছর আগে এদেশের ৮৫ শতাংশ মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে ছিল। এখন আছে ৩২ শতাংশ মানুষ। আর পরবর্তী বিশ বছরে ৩২ শতাংশ মানুষকে দারিদ্র্যসীমার ওপর ওঠানো কি এতই অসম্ভব? আমার কাছে তা মোটেই অসম্ভব মনে হয় না- বিশেষ করে পৃথিবীর এবং তার সঙ্গে আমাদের নিজেদের পরিবর্তনের গতি অবিশ্বাস্য রকম দ্রুত হওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে এবং আমাদের তরুণদের মধ্যে বিশ্বের পরিবর্তনের গতিটাকে দ্রুত আত্মস্থ করার ক্ষমতার পরিপ্রেক্ষিতে। আসুন, আমরা গ্রামীণ ব্যাংকের অগ্রযাত্রা নিশ্চিত করি, যে ব্যাংক গরিব মহিলাকে তার সুপ্ত ক্ষমতা প্রকাশের সুযোগ সৃষ্টি করে দিয়েছে যে ব্যাংক পৃথিবীতে স্বনির্ভরতার মাধ্যমে দারিদ্র্য সমস্যার মোকাবিলা করার এক অনন্য প্রতিষ্ঠান ও পদ্ধতি প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছে।

তার সঙ্গে নিশ্চিত করি নাগরিক সমাজের সব উদ্যোগের স্রোতকে বাধাহীনভাবে বেগবান করার নিরাপত্তাকে। আসুন, সমবেতভাবে নিশ্চিত করি এ-জাতির আত্মমর্যাদায় মহীয়ান ভবিষ্যৎকে, আর আগামী পৃথিবীতে মানব কল্যাণে আমাদের নেতৃত্ব দেয়ার সুযোগকে। সরকার এবং নাগরিক সমাজ পারস্পরিক আস্থা এবং সহযোগিতার মধ্যে কাজ করতে পারলে আমাদের এই অর্জন সহজেই সম্ভব। এ সুযোগকে যেন আমরা কিছুতেই হাতছাড়া না-করি। মূল লেখা এখানে


অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।