আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

বিন লাদেন হত্যা ।। নোম চমস্কির প্রতিক্রিয়া

ভাবনারা মাথার ভিতর অবিরত তুলছে ঢেউ
'আমাদের এখন নিজেদেরই প্রশ্ন করা দরকার যে, ইরাকি কমান্ডোরা যদি জর্জ ডব্লিউ বুশের বাড়িতে নেমে, তাকে হত্যা করে, লাশটা অ্যাটলান্টিকে ফেলে দেয়, তাহলে আমাদের কেমন লাগবে। ' প্রশ্নটা সরাসরি তুলেছেন মার্কিন চিন্তক নোম চমস্কি। মানবাধিকার, আন্তর্জাতিক আইন নিয়ে সদা বাগাড়ম্বর মার্কিন ক্ষমতা কাঠামোর মুখোশ উন্মোচনে চমস্কির যুক্তি আর ভাষা খুবই সাবলিল। সন্ত্রাস-বিরোধি যুদ্ধ কী করে নিজেই সন্ত্রাসী তার যৌক্তিক প্রমানও রাখলেন তিনি। নিজ প্রতিক্রিয়ায় লাদেন বধের মার্কিন মহাকাব্যর এক অভূতপূর্ব ময়না তদন্তও হাজির করেন চমস্কি।

চমস্কির সেই প্রতিক্রিয়াটা অনুবাদ করেছেন কর্তৃত্ব-বিরোধি মঞ্চের বন্ধু পার্থ প্রতীম দাস। বিন লাদেন হত্যা । । নোম চমস্কির প্রতিক্রিয়া মে ৬, ২০১১ এটা খুবই স্পষ্ট যে, লাদেন হত্যার মার্কিনি অভিযানটা একটা পরিস্কার গুপ্তহত্যা। একই সঙ্গে এটা আন্তর্জাতিক অনেক আইন-আচরণবিধির লঙ্ঘনও বটে।

তারা নিরস্ত্র লাদেনকে গ্রেফতার করার কোন চেষ্টাই করেনি। ৮০ জনের কমান্ডো দলের জন্য যেটা ছিল খুবই সহজ একটা কাজ। আর তাদেরকে তো সেখানে কোনরকম প্রতিরোধের মুখেও পড়তে হয়নি। তাদের দাবি অনুসারে, একমাত্র প্রতিরোধটা এসেছিল লাদেনের স্ত্রীর কাছ থেকে। আইনের প্রতি বিন্দুমাত্র শ্রদ্ধা আছে, এমন দাবিওয়ালা সমাজে তো সন্দেহভাজন অপরাধীকে গ্রেফতার করে বিচারের আওতায় আনার কথা।

আমি কিন্তু ‘সন্দেহভাজন’ শব্দটার উপরে বিশেষভাবে জোর দিচ্ছি। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে সবচেয়ে গভীর অনুসন্ধানের পর ৯/১১ হামলার পরিকল্পনাটা যে আফগানিস্থানেই করা হয়েছিল, এটা শুধু এফবিআই এর ‘বিশ্বাস’, কোন তথ্য ছিল না। পরিকল্পনার বাস্তবায়নটা আবার হয়েছিল সৌদি আরব ও জার্মানিতে! ২০০২ সালের এপ্রিলে, এফবিআই প্রধান রবার্ট মুলার সংবাদমাধ্যমগুলোকে এই তথ্য জানিয়েছিলেন। এপ্রিল ২০০২ সালে তারা শুধু যেই জিনিসটা বিশ্বাস করলো, স্পষ্টতই তার ৮ মাস আগে সেটা করতো না, যখন কিনা তালেবানরা ওয়াশিংটনকে প্রস্তাব করেছিল যে বিন লাদেনের বির’দ্ধে প্রমাণ হাজির করতে পারলে তারা তাকে বিচারের জন্য হস্তগত করবে। ওয়াশিংটন এই প্রস্তাব শোনেনি।

তাই যখন ওবামা তাঁর হোয়াইট হাউজ বিবৃতিতে বলেন যে, ‘আমরা খুব তাড়াতাড়িই জানতে পেরেছিলাম, ৯/১১ হামলাটা আল কায়েদাই করেছিল’, তখন তিনি যে পুরোপুরি মিথ্যা কথা বলছেন, এটা বোঝাই যায়। তখন থেকে এখন পর্যন্ত কোন আমাদের কাছে কোন গুরুতর প্রমাণই হাজির করা হয়নি। বিন লাদেনের ‘স্বীকারোক্তি’ নিয়ে অনেক কথাবার্তা হয়েছে। কিন্তু সেরকম স্বীকারোক্তি তো আমারও আছে। বোস্টন ম্যারাথন জিতলেও আমি সেরকম স্বীকারোক্তি দিব! তিনি যেটাকে একটা বিশাল অর্জন বলে মনে করেছেন, সেটাই তিনি শুধু প্রকাশ্যে স্বীকার করেছেন।

এখন পাকিস্তানের উপর ওয়াশিংটনের ক্ষোভ নিয়ে মিডিয়াতে অনেক কথাবার্তা হচ্ছে যে, কেন তারা লাদেনকে যুক্তরাষ্ট্রের হাতে তুলে দিল না। যেখানে আব্বোটাবাদে লাদেনের উপস্থিতির কথা পাকিস্তানি মিলিটারি ও নিরাপত্তাকর্মীরা জানত বলে ধারণা করা হচ্ছে। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের উপরও পাকিস্তানের যে অনেক ক্ষোভ, সেটা নিয়ে কোনই কথাবার্তা নেই। যুক্তরাষ্ট্র যে তাদের সার্বভৌমত্বকে বুড়ো আঙ্গুল দেখাল, রাজনৈতিক গুপ্তহত্যা করার জন্য তাদের এলাকায় প্রকাশ্যে হামলা করল- এগুলো নিয়ে কোন আলাপই নেই। আমেরিকা বিরোধী অনুভূতি আগে থেকেই পাকিস্তানে প্রবল মাত্রায় ছিল।

এই ঘটনাটা যে সেটাকে আরও উস্কে দেবে, সেটা বলাই বাহুল্য। লাদেনের মৃতদেহ সমুদ্রে ভাসিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্তটাও নিশ্চিতভাবে মুসলিম বিশ্বের সংশয় এবং ক্রোধ দুটোই অনেক বাড়িয়ে দেবে। আমাদের এখন নিজেদেরই প্রশ্ন করা দরকার যে, ইরাকি কমান্ডোরা যদি জর্জ ডব্লিউ বুশের বাড়িতে নেমে, তাকে হত্যা করে, লাশটা অ্যাটলান্টিকে ফেলে দেয়, তাহলে আমাদের কেমন লাগবে। বুশের অপরাধের পরিমাণ নিশ্চিতভাবেই লাদেনের গুলোকে পেছনে ফেলবে। কোন বিতর্ক ছাড়াই এ কথা বলা যায়।

এবং বুশ ‘সন্দেহভাজন’ও না। কিন্তু অবশ্যই ‘‘সিদ্ধান্তদানকারী’’ যে কিনা অন্য যেকোন যুদ্ধাপরাধ থেকে আলাদা করে একটি মহান আন্তর্জাতিক অপরাধ করতে নির্দেশ দিয়েছিল সব শয়তানদের এরমধ্যে সম্পৃক্ত করে (নুমেনবার্গ ট্রায়াল থেকে উদ্ধৃত)। যেকারণে নাজি অপরাধীদের ফাঁসিতে ঝোলানো হয়েছিল- হাজার হাজার মৃত্যু, লক্ষ লক্ষ শরনার্থী, দেশে দেশে ধ্বংসযজ্ঞ, তীক্ত গোষ্ঠীগত দ্বন্দ্ব, যা এখনো বেশিরভাগ জায়গায় ছড়িয়ে আছে। কিউবার এয়ারলাইন বোমারু অরল্যান্ডো বস্ককে নিয়ে তো নতুন করে কিছুই বলার নাই। ইনি ১৯৭৬ সালে কিউবার একটা বেসামরিক বিমানে বোমা হামলা চালিয়ে ৭৩জন নিরপরাধ মানুষকে হত্যা করেছিলেন।

মাত্র কিছুদিন আগেই তিনি ফ্লোরিডায় শান্তিপূর্ণভাবে মৃত্যুবরণ করেছেন। ‘বুশ মতবাদ’ অনুসারেই, যারা সন্ত্রাসীদের লালন-পালন করে বা আশ্রয় দেয়, তারাও সন্ত্রাসীদেরই সমতুল্য এবং তাদের সঙ্গে সেরকম আচরণই করা উচিৎ। কেউ এটা খেয়ালই করল না যে, একথা বলে বুশ নিজেই নিজের ধ্বংস এবং যুক্তরাষ্ট্রে বহিরাক্রমনের দাওয়াত দিচ্ছেন। অপারেশন জেরোনিমো। এই নামটার ক্ষেত্রেও একই কথা।

তারা এটার মধ্য দিয়ে লাদেনকে আরও বেশি মহান হিসেবে উপস্থাপন করছে। লাদেনকে তারা দেখাচ্ছে হানাদার-বাহিনীর গণহত্যার বিরুদ্ধে সাহসী প্রতিরোধের প্রতীক হিসেবে। পশ্চিমা সমাজে সাম্রাজ্যবাদী মনোভাবটা এত গভীরভাবে প্রোথিত যে কেউ এটা উপলব্ধিই করে না। এটা হলো আমাদের অপরাধগুলোর শিকার হওয়া মানুষদের নামে প্রাণঘাতি অস্ত্রের নামকরণ করার মতো ব্যাপার: অ্যাপাচি, টোমাহক...। চিন্তা করেন, জার্মান বিমানবাহিনী লুফটওয়াফে তাদের জঙ্গি বিমানগুলোকে ডাকছে “ইহুদি” বা “জিপসি” নামে! আরও অনেক ব্যাপার নিয়ে কথা বলার আছে।

কিন্তু এই মৌলিক ব্যাপারগুলোও আমাদেরকে চিন্তার অনেক ভালো খোরাক যোগাতে পারে। নোম চমস্কি
 

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।