আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

মোটর সাইকেল ডায়েরী – এক তরুনের বিপ্লবী হয়ে ওঠা

একটি বৈষম্যহীন, শোষণহীন, অসাম্প্রদায়ীক ও ঐক্যবদ্ধ পৃথিবীর স্বপ্ন দেখি

বইটা আগেই পড়া ছিল, আবার পড়তে শুরু করলাম। বিপ্লবী রাজনীতির প্রতি আগ্রহ থেকে চে সম্পর্কে জানার আগ্রহ হয়। চে সম্পর্কে আমি প্রথম জানি ম্যারাডোনার হাতের ট্যাটু থেকে। এর আগে এই আর্জেন্টিনিয়ান সম্পর্কে খুব একটা জানতাম না। পত্রিকায় পড়ে যতটুকু জানা সেটা হল চে আর্জেন্টিনার নাগরিক এবং কিউবা বিপ্লবের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ কুশীলব, যাকে পরবর্তিকালে সিআইএ বলিভিয়ার এক স্কুল ঘরে হত্যা করে।

বইটি সম্পর্কেঃ ১৯৫২ সালেই চে গুয়েভারা এই গ্রন্থটি লিখেছিলেন। তেইশ-চব্বিশ বছর বয়সে লেখা হলেও এই মোটর সাইকেল ডায়েরীটি তাকে বোঝার জন্য অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। তাঁর বিপ্লবী হওয়ার প্রস্তুতি পর্বটাকে পাওয়া যায় এই বইতে। । এই ভ্রমনকে শুধুমাত্র ল্যাটিন আমেরিকা ভ্রমন বলা যাবে না।

এ সময় বিভিন্ন দেশের ইতিহাস, ঐতিহ্য ও জনজীবনের অবস্থা প্রত্যক্ষ করেছিলেন তিনি। লোকজনের সাথে মিশে তাদের অতীত বর্তমান বোঝার চেষ্টা করেছিলেন। এ সময় প্রচুর পড়াশুনাও করেছিলেন তিনি। চে বইটি আবার লেখেন কিন্তু দীর্ঘদিন এটি লোকচক্ষুর আড়ালে কিউবার রাজধানী হাভানায় চে’র ব্যক্তিগত আর্কাইভে থেকে যায়। সম্ভবত চে’র আবেগের বহিঃপ্রকাশ এবং রহস্যময় বর্ণনার কারণে কিউবান কর্তৃপক্ষ এটি প্রকাশ করেনি।

বইটি প্রথম প্রকাশিত হয় ইতালীর মিলান থেকে ১৯৯৩ সালে, চে’র মৃত্যুর প্রায় ২৬ বছর পরে। ১৯৯৫ সালে প্রকাশিত হয় এর ইংরেজী সংস্করণ। অনুবাদটি প্রকাশিত হয় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে, অনুবাদ করেন এ্যান রাইট এবং সম্পাদনা করেন চে’র স্ত্রী এ্যালিদা মার্চ ডি লা তোরে। বইটির পেপারব্যাক সংস্করণের প্রচ্ছদ চে’কে জানতে এই বইটি এ কারনেই গুরুত্বপূর্ণ এই বইটি নিছক কোন ভ্রমন কাহিনী নয়। এই বইটিতে একজন অ্যাডভাঞ্চারার আর্নেস্তোর একজন বিপ্লবী 'চে' তে রুপান্তর হওয়ার ব্যাপারটি বোঝা যায়।

“বিলম্বিত উপলব্ধি” পরিচ্ছেদ থেকে একটি ঘটনা উল্লেখ করছি এটা পড়লে কিছুটা হলেও বোঝা যাবে চে’র জীবনে এই ভ্রমনের প্রভাব। এই ঘটনাটি সম্ভবত চে বাড়িতে এসে লিখেছিলেন। ভ্রমনে কোন এক সময়ে (পরিস্কার উল্লেখ নেই)একজন মানুষের সাথে পরিচয় হয় তার। প্রাথমিক পরিচয় আর মত বিনিময়ের পরে তাদের কথা বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। ফিরে যাবার সময় সেই মানুষটি চে’র দিকে ফিরল, মুচকি হেসে বেশ দৃড়তার সঙ্গেই বলল, “সব মানুষেরই ভবিষ্যত থাকে, ধীরে ধীরে কিংবা হঠাৎ করেই তারা ক্ষমতাবান হয়ে ওঠে, এখানে কিংবা সারা পৃথিবীতে এই হয়।

সমস্যা হল, মানুষ শিক্ষিত হতে চায় কিন্তু ক্ষমতা না আসা পর্যন্ত তা তারা পারে না। তারা শুধু পারে তাদের ভূলগুলো বুঝতে- এটা খবই ভয়াবহ একটা ব্যাপার এবং এর ফলে অনেক সুন্দর জীবন নষ্ট হয়ে যায়। এমন নাও হতে পারে, হয়ত সব জীবন সুন্দর নয় কারণ যারা পাপ করে তাদের ক্ষমতা থাকে না মানিয়ে নেয়ার............ধরো তুমি আমি হয়ত মরে যাব ঐ ক্ষমতাটা অর্জন করতে গিয়েই- মারা যাব বেশি ত্যাগ করতে গিয়ে। বিপ্লব নৈর্ব্যক্তিক- এজন্য এতে জীবন যায়, এর জন্য স্মৃতিকে ব্যবহার করা হয়, বিশেষ করে তরুনদের সপক্ষে আনার জন্য। আমার দোষ কারণ আমি বেশী চুপচাপ এবং বেশী অভিজ্ঞ।

তুমি যা ইচ্ছা তাই ভাবতে পারো- তবে আমি জেনেই মরছি যে, আমাদের পচ-গলা সভ্যতার মধ্য থেকেই আমাদের ত্যাগী সত্ত্বার উত্থান ঘটেছে। আমি এও জানি এর ফলে ইতিহাসের গতি বদলাবে না কিংবা তোমার ব্যক্তিগত বিশ্বাসও না। । তুমি তোমার বিশ্বাস এবং দৃড়তা নিয়েই মরবে কারণ তোমার মধ্যে ঘৃ্নার বোধ আর সংগ্রামশীলতা দুই-ই আছে। তবে তুমি সমাজের একমাত্র উদাহরণ নও।

তুমি সমাজের এমন এক সদস্য যাকে ধ্বংস করা হবে। একটা শক্তি কথা বলবে তোমার মুখ দিয়ে আর কাজ কর্যেৃ নেবে। তুমি আমার মত উপকারী কিন্তু তুমি বুঝতে পারছ না তোমার ত্যাগ সমাজের জন্য কতটা উপযোগী হবে। " এরপর চে তার অনুভূতি বর্ণনা করছেন, “ ............... আমি তখনি বুঝেছিলাম আমার ভাগ্য নির্ধারিত হয়ে গেছে- আমার বিশ্বাস আর কাজের প্রতিক্রিয়ায়। মানসিকভাবে আমি গড়ে পিটে উঠছি।

যেকোন শত্রু, রক্তভীতি, বাধা, খানা, খন্দক কিছুই আমাকে রুখতে পারবে না, আমি হাত বাড়ালেই শত্রু পরাজিত হবে। আর তখন আমার মনে হল আমার সত্বা উৎসর্গিত হয়েছে বিপ্লবের জন্য। ” এখান থেকেই বোঝা যায় এই ভ্রমন চে’র জীবনে কতটা প্রভাব ফেলেছে। ভ্রমনের সংক্ষিপ্ত বিবরণীঃ তারা যাত্রা শুরু করেন আর্জেন্টিনা থেকে। পর্যায়ক্রমে তারা চিলি, পেরু এরপর কলম্বিয়া হয়ে সবশেষ ভেনিজুয়েলায় এসে তাদের এই মোটর সাইকেল যাত্রা শেষ হয়।

যাত্রা শুরু করেন ১৯৫২ সালের ৪ জানুয়ারী এবং শেষ হয় ২৬ জুলাই। এসময় অনেক ঘটনা ঘটে যা অত্যন্ত সুন্দরভাবে বইটিতে চে উল্লেখ করেছেন। আর্জেন্টিনা -কর্ডোবা, ডিসেম্বর ১৯৫১ -বুয়েন্স আয়ার্স ত্যাগ ৪ জানুয়ারী ১৯৫২ -ভিল্লা জেসেল, ৬ জানুয়ারী -মিরামার, ১৩ জানুয়ারী -বাহইয়া ব্লাঙ্কা, ১৫ জানুয়ারী -চোয়েল চোয়েলে যাত্রা, ২২ জানুয়ারী -চোয়েল চোয়েল, ২৫ জানুয়ারী -পিয়েদ্রে দেল আগুইলা, ২৯ জানুয়ারী -সান মার্টিন ডি লস আন্দিজ, ৩১ জানুয়ারী -বারিলুচি, ১১ ফেব্রুয়ারী চিলি -পিউল্লা, ১৪ ফেব্রুয়ারী -তেমুকো, ১৮ ফেব্রুয়ারী -লাউতারো, ২১ ফেব্রুয়ারী -লস এঞ্জেলেস, ২৭ ফেব্রুয়ারী -সান্টিয়াগো ডি চিলি, ১ মার্চ -ভ্যালপারাইসো, ৭ মার্চ -সান আন্তোনিও জাহাজে যাত্রা, ৮-১০ মার্চ -আন্তোফাগাস্তা, ১১ মার্চ -ব্যাকুয়েদানো, ১২ মার্চ -চুকুইকামাতা, ১৩-১৫ মার্চ -ইকুইকুই, ২০ মার্চ [এ সময় তোকো, লা রাসিয়া এ্যাভেনচুরা এবং প্রসপারিদাদ নাইট্রেট খনি পরিদর্শন] -এ্যারিকা, ২২ মার্চ। পেরু -তাকানা, ২৪ মার্চ -তারাতা, ২৫ মার্চ -পুনো, ২৬ মার্চ -টিটিকাকা হৃদে নৌকায় চড়ে যাওয়া, ২৭ মার্চ -জুলিয়াকা, ২৮ মার্চ -সিকুয়ানি, ৩০ মার্চ -কুজকো, ৩১ মার্চ - ৩ এপ্রিল -মাচ্চুপিচ্চু, ৪-৫ এপ্রিল -কুজকো, ৬-৭ এপ্রিল -এ্যাবানকেই, ১১ এপ্রিল -হুয়ানা কারামা, ১৩ এপ্রিল -হুয়া্মবো ১৪ এপ্রিল -আন্দাহুয়াইলাস, ১৬-১৯ এপ্রিল -হুয়ানতা, -আইয়াকুচো, ২২ এপ্রিল -হুয়ানকাইরো -লা মারসেড, ২৫-২৬ এপ্রিল -ওক্সাপাম্পা ও সান র‍্যামনের মাঝামাঝি, ২৭ এপ্রিল -সান র‍্যামন, ২৮ এপ্রিল -তারামা, ৩০ এপ্রিল -লিমা, ১-১৭ এপ্রিল -সেরো ডি প্যাসকো, ১৯ মে -পুকাল্লপা, ২৪ মে -লা সেনেপা, স্টিমারে চড়ে উকাইয়ালি নদী পথে আমাজন জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে চলা ২৫-৩১ মে -ইকুইটস ১-৫ জুন -এল সিসনে স্টিমারে চড়ে সান পাবলোর কুষ্ঠ কলোনীতে যাওয়া, ৬-৭ জুন -সান পাবলোর কুষ্ঠ কলোনী, ৮-২০ জুন -মাম্বো ট্যাঙ্গো ভেলায় চড়ে আমাজন নদী পাড়ি দেওয়া আমাজন নদীতে মাম্বো ট্যাঙ্গো নামক কাঠের নৌকায় চে এবং গ্রানাদো কলম্বিয়া -লেতিসিয়া, ২৩ জুন-১ জুলাই, ২ জুলাই প্লেনে লেতিসিয়া ত্যাগ -ট্রেস এসকুনাসে যাত্রা বিরতি, ২ জুলাই -মাদ্রিদ মিলিটারি এয়ার পোর্ট, বোগোটার ৩০ কিলোমিটার দূরে। -বোগোটা, ২-১০ জুলাই -কুকাতা, ১২-১৩ জুলাই ভেনিজুয়েলা -সাম ক্রিস্টোবাল, ১৪ জুলাই -কারকুইসিমেটো এবং কোরোনার মাঝামাঝি, ১৬ জুলাই - ক্যারাকাস, ১৭-২৬ জুলাই ভ্রমনের জায়গার তালিকা দেখলেই বোঝা যায় ভ্রমন কাহিনী হিসেবেও কম আকর্ষনীয় নয় বইটি।

সংক্ষেপে চে’র জীবনঃ ১৯২৮ সালের ১৪ই জুন আর্নেস্তো গুয়েভারা লা সেরনা জন্ম নিয়েছিলেন আর্জেন্টিনার রোজারিওতে। বাবা আর্নেস্তো গুয়েভারা লিঞ্চ ছিলেন স্থপতি, মা’র নাম সেলিয়া ডি লা সেরনা। লিঞ্চ ও সেরনার পাঁচ সন্তানের মধ্যে সবার বড় ছিলেন আর্নেস্তো গুয়েভারা লা সেরনা। শিশু অবস্থায় হাঁপানিতে গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়ায় গুয়েভারা পরিবারটি বুয়েন্স আয়ারস থেকে কর্ডোবা প্রদেশের আলটা গ্রাশিয়ায় চলে যায়। ১৯৪৮ সালে গুয়েভারা বুয়েন্স আয়ারস বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হলেন চিকিৎ্সা শাস্ত্র পড়তে।

তার আগ্রহ ছিল সাহিত্য, ভ্রমনে আর খেলাধুলাতে। ফুটবল আর রাগবি খেলতেন তিনি। হাঁপানির কারনে সেনাবাহিনীতে যোগ দিতে পারেননি তিনি। ১৯৫০ সালেই গুয়েভারা একবার মোটর সাইকেল চড়ে উত্তর আর্জেন্টিনার ৪ হাজার মাইল পরিভ্রমন করেছিলেন একেবারে একা। ১৯৫১ সালে তোলা ছবি, ২২ বছর বয়সে।

১৯৫২ সালে ঘুরেছিলেন পুরো দক্ষিন আমেরিকা। তাঁর ভ্রমন সঙ্গী ছিল আলবার্তো গ্রানাদো – এক প্রগতিশীল ডাক্তার কুষ্ঠরোগ বিশেষজ্ঞ। বয়সে ব্যবধান থাকলেও বন্ধু ছিলেন দু’জনে। ১৯৫৬ সালে ২৯ বছর বয়সে যুক্ত হলেন কিউবার বিপ্লবের সাথে। মধ্যেখানে অবশ্য কাটিয়েছেন বলিভিয়া, গুয়েতেমালা, মেক্সিকোতে।

এসব জায়গার বিপ্লবী রাজনীতির সাথে যুক্ত ছিলেন। বলিভিয়ায় তিনি ১৯৫২ সালের জাতীয় বিপ্লবের পরে গৃহীত কৃ্ষি সংস্কার প্রত্যক্ষ করেন। এছারা এখানকার শ্রমিক সংগঠনের কাজ দেখার সুযোগও তার হয়েছিল। মেক্সিকোতে থাকাকালীন সময়ে পেরুর মেয়ে হিলদা গাদিয়াকে বিয়ে করেন, বাবা হন এক মেয়ের যাঁর নাম হিলদিতা। ১৯৫৯ সালে কিউবা বিপ্লব সফল হয়।

পরবর্তিতে তিনি কিউবান সরকারের বিভিন্ন গুরত্বপূর্ণ পদে আসীন হন। মার্কিনসহ সাম্রাজ্যবাদী বিশ্বের চিন্তার কারণ হয়ে ওঠেন তিনি। এসময় তিনি বিয়ে করেন এ্যলিদা মার্চ ডি লা তোরেকে। বেরেটা মাথায় তারুণ্যের প্রতীক চে'র সেই ঐতিহাসিক ছবি ১৯৬৫ সালে তিনি কিউবা ত্যাগ করেন-অন্যান্য দেশে বিপ্লবে অংশ নেয়ার জন্যে। তিনি আফ্রিকা সফর করেন, কঙ্গোতে যুদ্ধে অংশ নেন।

১৯৬৬ সালেই তিনি ল্যাটিন আমেরিকায় ফিরে আসেন, সংগঠিত করেন একাধিক গেরিলা সংগঠন। ছদ্মনামে চলে যান বলিভিয়াতে। চে, তোমার মৃত্যু আমাকে অপরাধী করে দেয় ১৯৬৭ সালে বলিভিয়ার সরকারী বাহিনীর সাথে লাগাতার যুদ্ধের এক পর্যায়ে ধরা পড়েন ৮ই অক্টোবর। । ৯ই অক্টোবর লা হিগুয়েরায় এক মাটির দেয়ালের স্কুল ঘরে মদ্যপ এক সৈনিক মারিয়ো তোরন তাকে হত্যা করেছিল।

তবে তাকে কি আদৌ হত্যা করা গিয়েছিল ? চে তো একটা চেতনা, তাকে হত্যা করা কি এতই সহজ? বইটি বাংলায় অনুবাদ করেছেনঃ আবীর হাসান, প্রকাশ করেছেঃ সন্দেশ মূল্যঃ ১২০ টাকা

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।