আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

মে দিবস, একজন সালমা, এবং আমার অন্ধ বিবেক

সত্য ও সুন্দরের জন্য

পটভুমি সালমার বাবা থেকেও নেই। সালমার মা কে তালাক দিয়ে অন্য জনের সাথে সংসার করছে। বিপদে পড়েছে সালমার মা। মেয়েকে খাওয়াবে পরাবে কী। এটা ওটা ভেবে পারার বাবলুর পরামর্শে শহরে একটা বাসায় কাজ করতে দিলো মেয়েকে।

নিজেও কাজ নিল একটা। এখান থেকেই সালমা নামক কাজের মেয়টির গল্প শুরু। বিবেকের দংশন গল্পের বাকি অংশের দর্শক আমরাই-যারা লিখতে পারি, পড়তে পারি, কাজের লোক রাখতে পারি। তাই এই জানা গল্প বলে বিরক্ত করবো না। ববং, প্রয়োজনীয় কিছু কথা বলার চেষ্টা করি।

দিনশেষে, আমিও তো সালমাদের একজন চাকুরীদাতা। সালমাদের জন্য অনেক কিছুই করার আছে; সেটার দায়িত্ব আমাদের। কারণ, সুশীল সমাজ, শিক্ষিত সমাজের, ও বিত্তবান সমাজের সুস্বামীপনা ও সুগৃহিনীপনার একটা বিশাল কর্তৃত্বের দাবিদার তো সালমারাই। বাসায় বাবার প্রিয় মাছ, বোনের কফি, মায়ের ডাল ভাজা, ভাইয়ের গরু ভুনা, বাবুটির প্রিয় পানীয়- এগুলো দিনশেষে সালমাদের অক্লান্ত পরিশ্রমের ফসল। কিন্তু সালমাদের কে যখন দেখি রান্নাঘরের কোনায় পরে মাথাগুঁজে ঘুমায়, উচ্ছিষ্ট খাওয়ার আশায় বসে থাকে; বিরামহীন কাজ করার পরও কামচোরের খোঁটা মিলে; তখন মাঝে মাঝে বিবেক নাড়া দেয় দেখি (হয়ত ওটা এখনো আছে কিছুটা)।

এ কেমন সালমার চাকুরেদাতা আমি। আমার কাজ, আইনের, আমি যে সমাজে ন্যায় প্রতিষ্ঠায় ব্রত; আমি শিক্ষক, আমার কাজ আলো ছড়িয়ে দেয়া; আমি হুজুর, ধর্মের কথা বলি; আমি ছাত্র, শেখার তপস্যা করি; আমি আইটি প্রফেশনাল, ডিজিটাল ডিভাইড এ আমার মন কাঁদে; আমি ব্যবসায়ী, অযাচিত ট্যাক্স আমার বুক কাঁপায়; আমি মহান পরামর্শদাতা, সমস্যাগুলো সব ভয়ে একাকার; আমি এই সমাজ, আমি আমরাই, আমি তোমরাই। আমার ঈদের উৎসবে সালমা ছাড়া যে আমার চলে না। মেহমানরা খাবে কী? বাবুটাকে কে দেখে রাখবে এমন উৎসবে। সালমা ও সালমার মা বসে থাকে কবে একসাথে উৎসব করবে।

ছেলের পরীক্ষা আসছে। তাকে ভালো খাওয়াবে কে। আমি শপিং এ যাবো, আমি দেশের বাইরে যাবো; কাজেই সালমার আর ছুটি মিলে না। আমার বিবেক যেমন ছুটি পায়নি আমার জনম থেকে; সালমা ও তার মা আর ছুটি পেলো না সমাজ থেকে। আমার প্রয়োজনে নিরলস খেটে গেল; চুপচাপ সেবা করে গেল।

তবু যখন এপ্রিল এর পনের তারিখ "দি ডেইলি স্টার" এ দেখি "বিগত চার মাসে ১৪ জন সালমা জীবন দিয়েছে সমাজের বিবেকের কাছে" তখন ভাবি এক ফেলানী তো ঝুলল সীমান্তে; কিন্তু লক্ষ ফেলানী যে ঝুলছে আমার ঘরের আংগিনায়; পুড়ছে আমার বিবেকের সকেটে, ফাঁস খাচ্ছে আমার শিক্ষা ও বিত্তের লকেটে। আমার কবিতাগুলো ছন্দ হারায়; গদ্যে রুপ নেয়। আইন কী বলে আমি আইনের ছাত্র নই। তাই এই বিষয়ে ভূল কিছু বললে আমার জ্ঞানহীনতাকে দোষ দিবেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আমি “Legal Environment of Business” এই কোর্সে "Bangladesh Labour Code" টা পড়েছি।

শিশুশ্রম নিষিদ্ধ আছে, এককথায়। কিন্তু খিদের তাড়নায় যখন কাতরায় মানুষ,আইন প্রয়োগকারীরা জানেন যে এটার কঠোর বাস্তবায়ন সম্ভব নয়। আইনে শ্রমিকদের বিভিন্ন অধিকার, যেমন, নিয়োগ, ছুটি, স্যাস্থ্যসম্মত কাজের পরিবেশ, যথাযথ নোটিশ ও সুবিধা নিশ্চিত করে ছাঁটাই ইত্যাদি নিয়ে অনেক ভালো কথা বলা আছে। কিন্ত আইনে শিশুশ্রম বলে কোন কিছুই যে নেই; তাদের আবার অধিকার কি? পরে মনে হল বিবেকের উপর সমপুর্ণ দখল আইন নিতে পারে না। তাই হয়ত স্রষ্টা আমাদেরকে আমাদের নেহাত প্রয়োজনেই বিবেক দিয়ে দিয়েছেন।

আমরা যে মানুষ সেটাও আইন কে বলে দিতে হবে? আমাদের যে বিবেক আছে, সেটাও কি সংসদে পাশ করতে হবে? কিছু করণীয় আগেই বলে রাখি, কেউ আবার ভাববেননা আমি শিশুশ্রমের পক্ষে। আমাদের ধরা কে সরাজ্ঞান করার বাতিক আছে। যাই হোক; আমরা যদি কোন সালমাকে বাসায় রাখি (সে শিশু নাও হতে পারে; হলে রাইখেননা), তাহলে একটু নিন্মের বিষয়গুলো নিশ্চিত করতে পারি। আমাদের কর্মস্থলেও এগুলো না থাকলে আমাদের মনে রোষ-এর শেষ থাকেনা। ১) ওদেরকে কাজের ফাঁকে ব্রেক নিতে দিন।

প্রতিদিন ব্রেকগুলা কখন তা আগেই জানিয়ে দিন। আপনিও অফিসে এরকম ব্রেক নেন, তা ভুলে যাবেননা দয়া করে। ২) ওদেরকে বছরের কখন কখন ছুটি দিবেন তা বলে রাখুন। যেসব দিনগুলোতে আপনি অফিস থেকে ছুটি নিতে চান সেসব দিনে সালমাদের ছুটি দিন। অসুস্থতার ছুটি এবং সাহায্যর কথা ভুলবেননা।

৩) আপনার যেমন সাপ্তাহান্তে ছুটি চাই, সালমাদেরকেও সাপ্তাহিক ছুটির ব্যবস্থা করুন। ৪) ওরা যদি আপনার বাসায় থাকে তবে স্যাস্থ্যসম্মত এবং প্রাইভেট বাসস্থানের ব্যবস্থা করুন। ৫) বিবেক যদি চায় আরও অনেক কিছুই করতে পারেন। মোদ্দা কথা আমরা পরিশ্রমী জাতি। দেশে ও দেশের বাইরে খেটে যাচ্ছি অক্লান্ত।

রক্তও দিয়েছি পতাকার জন্য, ভাষার জন্য। সালমাদেরকে ভালোবেসে আমারা আরেকটি গৌরবমুকুট পরতে পারি। শ্রম একটি মহান ব্যপার। নিজেরাই কোন না কোন জাতের শ্রমিক হয়ে এটাকে আর কলংকিত না করি। আর যদি করতে চান মনে রাখুন "মানুষকে দাবাইয়া রাখতে পারবানা"।

বিশেষ দ্রষ্টব্যঃ সালমা একটি কাল্পনিক নাম

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।