আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

সুর সাগর হিমাংশু দত্ত ,প্রায় বিস্মৃত এক সঙ্গীত প্রতিভা

একবার আপনারে চিনতে পারলে রে , যাবে অচেনা রে চেনা

সুর সাগর হিমাংশু দত্তের নামটি প্রথম শুনি সুমন চট্টোপাধ্যয়ের( আজকের কবির সুমন ) 'তোমাকে চাই' গানে । গানটিতে একটি লাইন ছিল "..... ভুলে যাওয়া হিমাংশু দত্তের সুরে / সেই কবেকার অনুরোধের আসরে ......." হিমাংশু দত্তের নামটি তখন মনে কৌতুহল তৈরী করে ...মনে গেঁথে ও যায়। তারপর একদিন হাতে পেলাম সুরসাগর হিমাংশু দত্তের দশটি গানের একটি অ্যালবাম, সুমনেরই গাওয়া । অ্যালবামটির শিরোনাম তারায় তারায়। এক অসাধারন অনুভূতি হলো গান গুলি শুনে।

কথা আর সুরের কি অদ্ভূত মেলবন্ধন। মনটা শিথিল আর আচ্ছন্ন হয়ে পড়ে । সুর সাগর তার উপাধি। সেটা ১৯৩০। উপাধি প্রাপকের বয়স তখন মাত্র বাইশ।

সেই উপাধি মাত্র ছত্রিশ বছরের জীবনে আক্ষরিক অর্থেই সার্থক করে গিয়েছেন হিমাংশু দত্ত (১৯০৮-১৯৪৪)। শুরুটা হয়েছিল কুমিল্লার জেলা স্কুলে। ছোটবেলায় কুমিল্লার এক ধর্মমন্দিরে (সম্ভবত ঈশ্বর পাঠশালা) ভজন গান পরিবেশন করে সকলকে আশ্চর্য ও বিমোহিত করেন হিমাংশু। আস্তে আস্তে চতুর্দিকে তার গানের দীপ্তি ও খ্যাতি ছড়িয়ে পড়েছিল। বন্ধু সহপাঠি সুবোধ পুরকায়স্থের সঙ্গে চলত গান লেখা, সুর দেওয়া।

হিমাংশু সুবোধ পুরকায়স্থের লেখা বেশিরভাগ গানে সুর দিয়েছেন। এছাড়াও তিনি অজয় ভট্টাচার্য এবং বিনয় মুখোপাধ্যায়ের অনেক গানে সুরারোপ করে বিশিষ্ট সুরকার হিসেবে খ্যাতি অর্জন করেন। তাঁর গানের সুরে রাগ-সঙ্গীতের প্রাধান্য লক্ষ্য করা যায় । আছে করুণ রস বা মেলোডী। মীড় আর কোমল স্বরের ব্যবহার তার গানের বিশেষ বৈশিষ্ট।

তার প্রকাশ ও বিকাশ ঘটে মূলত কলকাতায়। বি এ পড়ছেন তখন হিমাংশু, থাকেন কর্নওয়ালিস ষ্ট্রিটের হিন্দুস্তান বোর্ডিংয়ে। তার আগেই পরিচয় ক্ষিতিমোহন সেন এর সঙ্গে। বিচিত্রা পত্রিকায় ক্ষিতিমোহন যখন ‘মীরার সঙ্গীত জীবন’ লিখছেন, তখন তার সঙ্গে দেওয়া মীরার ভজনের স্বরলিপি করে দিচ্ছেন হিমাংশু। বিচিত্রায় রবীন্দ্রনাথের গানেরও স্বরলিপি করেছিলেন তিনি, ‘সকরুণ বেণু বাজায়ে...’।

নজরুলের অনেক গানের সুরকার তিনি। তবে গান গুলো আলাদা করা মুশকিল। তার পরে একের পর এক বিখ্যাত আধুনিক গান, * আলোক আঁধার যেথা * তুমি যে আঁধার *চাঁদ কহে চামেলি গো, *বিরহিণী চিরবিরহিণী, *নিশীথে চলে হিমেল বায়, *বরষার মেঘ নামে, *তব স্মরণখানি *আলোছায়া দোলা *আবেশ আমার যায় উড়ে কোন ফাল্গুনে * খুঁজে দেখা পাইনে যাহার * ডাক দিয়ে যায় কেগো আমার বাজিয়ে বাঁশি * তব স্মরণখানি * তুমি তো বঁধু জান * নতুন ফাগুন যবে * বরষার মেঘ ডাকে ঝড় বরিষণে * মম মন্দিরে ..ইত্যাদি। কিন্তু এই সুর সাগরের জীবনতথ্য আজও ধোঁয়াশায় ভরা। হয়তো তার শেকড় কুমিল্লায় বলে।

এ বাংলার মানুষ তাকে মূল্যায়ন করেনি, চেনেই না অনেকে। আর ও বাংলার মানুষ কুমিল্লায় এসে তার শেকড় সন্ধান করবে এত গরজ কোথায়? তাঁর বহু গান এখনও সুলভ নয়। বিভিন্ন শিল্পীর কণ্ঠে ‘সুরসাগর হিমাংশু দত্তের গান’ (সারেগামা) আর সুমন চট্টোপাধ্যায়ের গলায় তাঁর দশটি গানের অ্যালবাম “তারায় তারায় ”ছাড়া বাকি হিমাংশু দত্ত এই শতবর্ষেও দুর্লভ। সুমনের সেই তারায় তারায় অ্যালবামটিও আজকাল সহজে চোখে পড়েনা। তার সব অ্যালবামই পাওয়া যায় কিন্তু ওটা পাওয়া যায়না।

আমার বিবেচনায় সুমনের গায়ক জীবনের সেরা কাজ ছিল সেটি। বেঙ্গল ফাউন্ডেশন থেকে ইফ্ফাত আরা দেওয়ান এবং খায়রুল আনাম শাকিল পুরাতন বাংলা গানের দুটি অ্যালবাম করেছিলেন। সেখানে তার গোটা চারেক গান ছিল। ২০০০ সালের দিকে একবার গিয়েছিলাম কুমিল্লা রামঘাটের ঈশ্বর পাঠশালায়। আমি তখন মেডিকেল কলেজের ছাত্র।

ঈশ্বর পাঠশালার জনৈক শতবর্ষী তত্ত্বাবধায়কের সাথে কথা হয়েছিল। তিনি তার স্মৃতি হাতড়ে বলেছিলেন হিমাংশু দত্ত,কাজী নজরুল,শচীন দেব বর্মন আর অজয় ভট্টাচার্যের গল্প, তাদের বন্ধুত্বের কথা। রানীর দীঘির পাড়ে বসে গানের আড্ডার গল্প। কুমিল্লায় হিমাংশু দত্তের এক ভাই থাকতেন, পরিমল দত্ত। তিনি যে হিমাংশু দত্তের ভাই তা সেখানকার অনেক সংস্কৃতি বোদ্ধাই জানতেন না।

তবে তার ছিল নিজস্ব আরেকটি পরিচয়। তিনি ছিলেন স্ব মহিমায় উজ্জ্বল স্বদেশী আন্দোলনের এক প্রবাদ পুরুষ। ছিলেন রবীন্দ্র সঙ্গীতের একনিষ্ঠ সাধক। কুমিল্লার বিখ্যাত অভয় আশ্রমের সাথে ছিলেন আমৃত্যু। আজ থাক ।

পরিমল দত্তের কথা না হয় আরেকদিন বলব। (সম্পাদিত ও রিপোস্ট)

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।