আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

এটা কী এয়ারপোর্ট নাকি সদরঘাট?

আমি দলে যাই যত বন্ধন, যত নিয়ম কানুন শৃঙ্খল

অফিস থেকে একটা মিটিং’এ অংশগ্রহণ করতে মালয়েশিয়া যাবো। মালয়েশিয়ান এয়ারলাইনের রাতের একটি ফ্লাইট ধরতে আমরা কয়েকজন সহকর্মী অন্তত আড়াই ঘণ্টা আগে বিমানবন্দরে পৌঁছে গেলাম। দুর্ভাগ্যক্রমে তখন সন্ধ্যার পর থেকে একটা নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত ঢাকা বিমানবন্দরের রানওয়ে’র সংস্কারের কাজ চলছিল। রাতে ফ্লাইটের সংখ্যা বেশি হওয়ায় ভিড় এমনিতেই বেশি হয়। সেখানে সংস্কারের কাজ চলাকালীন বিমান উঠা-নামা বন্ধ থাকায় বিভিন্ন গন্তব্যের ফ্লাইটগুলো জমে একেবারে দলা পাকিয়ে গেছে! আর জমে যাওয়া ফ্লাইটগুলোর যাত্রীদের চলাফেরা, হাঁকডাক, শোরগোলে এয়ারপোর্ট মাথায়! যাত্রীদের বেশিরভাগই শ্রমিক।

দেখা যাবে ফ্লাইট রাতে হলেও, এদের অনেকে সকালেই শহরে চলে এসেছে। আশেপাশের মার্কেট, আত্মীয়স্বজনের বাসায় ঘুরেফিরে, হেসে-নেয়ে, কেঁদেকেটে, এখানে কোথাও গড়াগড়ি করে সন্ধ্যাটা কাটিয়ে তবেই এখন লাইনে এসে দাঁড়িয়েছে। বদ্ধ বাতাসে তাদের ঘামের গন্ধে এয়ারপোর্টের ভেতরটা একেবারে গুমট হয়ে আছে! গন্ধে আমার মাথাটা চক্কর দিয়ে উঠল। শ্রমিকের গাঁয়ের ঘামের গন্ধে মাথা চক্কর দিলে অবশ্য করার কিছু নাই। বাজেট ঘাটতিতে দেশের অর্থনীতির মাথা চক্কর দিলে, এই শ্রমিকদের ঘাম বেঁচা টাকা দিয়েই ঘাটতি পূরণ হয় আর চক্করের চিকিৎসা হয়।

তো, থেকে থেকে সহ্য করা, চক্কর খেতে খেতে বোর্ডিং পাস নিয়ে ইমিগ্রেশনে গিয়ে দেখি ডেস্কের পেছনে লাইনগুলো লম্বা হয়ে একটা আরেকটার সাথে পেঁচিয়ে গেছে; লাইনের শেষ প্রান্ত খুঁজে নিয়ে দাঁড়ানোই দায়! শেষ পর্যন্ত কষ্টেসৃষ্টে বেছে আমরা কলিগ’রা একটা লাইনের পিছনে গিয়ে দাঁড়িয়ে পড়লাম। দাঁড়িয়ে আছি তো দাঁড়িয়েই আছি! কিছুক্ষণ পরে মাথাটা ছেড়ে, আমার পা দুটো নিয়ে চিন্তায় পরে গেলাম। এভাবে দাঁড়িয়ে থাকলে কেমন করে এই ‘দুইজন’কে টেনে নিয়ে এতদূর যাই? হঠাৎ সম্বিৎ ফিরে পেলে খেয়াল করলাম গত দেড় ঘণ্টায় লাইন ছোট তো হয়নিই, বরং বেশ বড়সড় আর হৃষ্টপুষ্ট হয়ে উঠেছে! কি ব্যাপার? দেখি, ইমিগ্রেশন ডেস্কের ঐ পাশ থেকে সুন্দর চেহারার, ইউনিফর্ম পরিহিত কিছু ভদ্রলোক এসে এসে তাদের যাত্রীদের ডেকে ডেকে লাইন ভেঙে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। “কাতার এয়ারওয়েজ কারা আছেন হাত তোলেন, কাতার এয়ারওয়েজ? দেখি সামনে আসেন, সামনে আসেন” এইভাবে, ইত্তেহাদ ইত্তেহাদ করতে করতে ইত্তেহাদ এয়ারওয়েজ এলো; বিমান বিমান করতে করতে বাংলাদেশ বিমান এলো! ভাবলাম, “কোথায় আছি? এয়ারপোর্ট না সদরঘাট?” যাহোক, হাঁক শুনে লাইনের বিভিন্ন স্থান থেকে যাত্রীরা হাত তুলছে তো তাদের তারা ডেকে নিয়ে লাইনের শুরুতে দাঁড় করিয়ে দিচ্ছে। ঘটনা হল, এদের ফ্লাইট ছাড়ার সময় পার হয়ে যাচ্ছে, অথচ অনেক যাত্রী ভিড়ের কারণে এখনও ইমিগ্রেশনই পার হতে পারেনি।

লাইনের হাজার হাজার যাত্রীর তুলনায় ডেস্কের সংখ্যা নিতান্তই অপ্রতুল! এদিকে সেই উঁচু ডেস্কগুলোর পেছনে পুলিশের ইউনিফর্ম পরিহিত ইমিগ্রেশন অফিসারেরা বসে কি যে করছিল তা তারাই ভাল বলতে পারত! চারিদিকে এত অস্থিরতা, দুশ্চিন্তামাখা ভিড় থৈ থৈ করছে অথচ এদের ভাবভঙ্গিতে তাড়াহুড়ার লেশমাত্র নাই। একসময় মালায়সিয়ান এয়ারলাইনের লোকজন এসে আমাদেরকেও অন্যদের মত করে সামনে ডেকে নিয়ে গেল। ইমিগ্রেশন ডেস্কে গিয়ে পৌছলে আমি পাসপোর্ট, টিকেট আর ইমিগ্রেশন ফর্মটা এগিয়ে দিয়ে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে বিস্ময়ের সাথে অফিসারের কাজকর্ম দেখলাম। সে মাউস টিপছে নাকি গোলানো ময়দা ডলে কুলুই-সেমাই বানাচ্ছে বুঝা মুশকিল! কি-বোর্ডে আঙ্গুল টেপা দেখলে মনে হয় ওগুলো আঙ্গুল নয়, বক। কি-বোর্ড নামক ধানী জমিতে মাছ-পোকা খুঁজে খুঁজে খুটে খাচ্ছে।

হাত টিপে টিপে, চোখ পিট পিট করে, আড়মোড়া ভেঙে, হাই তুলে তুলে, চশমার কাঁচ পরিষ্কার করে মধ্য বয়স্ক অফিসারেরা শম্বুক গতিতে কাজ করছিলেন। আর মাঝে মাঝে অলস কণ্ঠে ডেস্ক সংখ্যার অপ্রতুলতাকে দুষছিলেন। বিস্ময়কর নয় যে এদের ওপর নির্ভর করে থাকা লাইনগুলো জীবন্ত প্রাণীর মত আকারে বড় হয়। লাইনে ফ্লাইট মিস হয়ে যায় কি না সেই আশংকায় উদ্বিগ্ন মুখগুলো যখন একে অপরের মাথার ওপর দিয়ে উঁকি দিচ্ছে, অস্থির হয়ে উঠছে, সেই সময় ডেস্কের অফিসার আমার সাথে কিছুক্ষণ খোশগল্প করার মেজাজে হাবিজাবি প্রশ্ন করলেন। আমিও হাসি মুখে জবাব দিলাম।

পায়ের ব্যথায় আমার নিজেরও কমন স্নায়ুগুলো অবশ হয়ে ছিল। আমাদের যখন ধাতব ডানায় ভর করে উড়াল দিয়ে চলে যাওয়ার কথা, তখন আমরা পায়ে হেঁটে সিটে গিয়ে বসলাম। আমাদের মতো আরও বেশ কয়েকজন যাত্রীর জন্য ফ্লাইট বিলম্ব হয়ে গেল। যাহোক, প্লেনে উঠতেই অন্য জগতে চলে গেলাম। সুন্দর, স্বাস্থ্যকর ঘ্রাণে, ফ্লাইট ক্রু’দের মিষ্টি হাঁসিতে বাতাস বেশ হালকা এখানে।

ফ্লাইট বিলম্ব হওয়ার কারণে পাইলট স্পিকারে ক্ষমা চেয়ে নিলেন এবং গতি বাড়িয়ে দিয়ে অবতরণের সময় সমন্বয় করে নেবার প্রতিশ্রুতি দিলেন। আধুনিক প্লেনটির জানালার পাশে গোছান একটি সিটে নিজেকে এলিয়ে দিয়ে জানালায় বাইরের অন্ধকার আর বিচ্ছিন্ন আলোর বিন্দুগুলো দেখতে দেখতে ভাবছিলাম, এই দেশে এরা ফ্লাইট-অপারেট করে, হাসিমুখে ব্যবসা করে চলেছে। ব্যবসা বলে কথা! http://www.notun-din.com/?p=5494

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।