আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

নামহীন...(১ম পর্ব)



- - - - ১ "এক পা আগাইলেই হাফ ভলি পায়। আর সেগুলা ঠেকাইয়া ম্যাচটা হারাইলো। আজকে আর খেতে পারবনা ডাইনিং এ। খালি পঁচাবে। " চট্টগ্রাম শহরের অভিজাত কলেজগুলোর প্রতিটির নিজস্ব খেলার মাঠ আছে ।

মাঠগুলোতে ছোট ছোট ভাগ হয়ে সারাদিনই চলতে থাকে ক্রিকেট, ফুটবল। তার ই একটাতে খেলছিল রাসেলরা। কলেজ বন্ধের দিনে খেলতে আসে ওরা। কথাগুলো বলছিল অনির্বান। রাসেল কে উদ্দেশ্য করেই বলা।

"আরে ভাই ইশতিয়াক ভাই এর বল এত টার্ন করে !!" "আরে বাদ দে তো" বলল শুভ "সামনের সপ্তাহেই হারায় দিব" । "আরে ব্যাটা, এই সপ্তাহটা যে পুরাটা আমাদেরই বাজার করতে হবে। ধ্যাত !" - নিজের হাতেই অন্য হাত দিয়ে ঘুসি দিলো অনির্বান। "শিট! " একসাথে বলে উঠল রাসেল আর শুভ। এক ই স্কুল থেকে এস এস সি পাশ করে এসেছে ওরা তিনজন।

রাঙ্গামাটি সরকারী উচ্চ বিদ্যালয়। এখন চট্টগ্রামে পড়তে এসে আলাদা কলেজে পড়লেও থাকে একটা হোস্টেল এ। সেই হোস্টেলেরই বড় ভাইদের সাথে ম্যাচ খেলে ওরা। এ ধরনের টিমগুলোতে সাধারণত কেউ ক্যাপ্টেন থাকেনা। কিন্তু পুরো সপ্তাহ ধরে চলতে থাকে ওদের ম্যাচ খেলার চিন্তা।

কারণ প্রতি সপ্তাহে যারা হারবে তারাই বাজারে যাবে পরের সপ্তাহে। তাই ওরা জুনিওররা অনির্বান কে ক্যাপ্টেন বানিয়েছে। “আরে ব্যাপার না। জুনিওরগুলারে ধরাই দিব। “ পাশ থেকে সজীব বুদ্ধি দিল।

"ঠিক ঠিক। সামনে আমাদের পরীক্ষা। বাজারে কেমনে যাবো?" এক রুমের চার বাসিন্দা ওরা। সজীব এসেছে নোয়াখালি থেকে। দুমাস পর থেকে সবার এইচএসসি শুরু।

এটাই ওদের শেষ ম্যাচ পরীক্ষার আগে। সবাই বিষন্ন হয়ে ফিরল হোস্টেল এ। ঢোকার মুখে হিমেল ভাই মুচকি হেসে বলল, better luck next time মেজাজটাই খারাপ হয়ে গেল ওদের। “কিরে আবার হারলি নাকি?? তোদের কে খেলা শিখিয়েছে বল দেখি !” ফ্লোরে উঠতেই তৌহিদ বলল। জীবনে মনে হয়না ব্যাট-বল ধরেছে।

সারাদিনই পড়ে। বাকিরা ভেবে পায়না এত কি পড়ে ! “আমি ব্যাট করলে দেখতি….” হাতের গামছাটা দিয়ে অদৃশ্য বলকে ছক্কা মারল। “থাক থাক। আর ব্যাট করতে হবেনা আপনারে। আপনি গোসল সেরে তাড়াতাড়ি পড়তে যান।

“ রাগে গজগজ করতে করতে বলল শুভ। “cool down baby” অনির্বান হাসতে হাসতে বলল। “ওই যে শোনা যাচ্ছে আবুলটার গান”- বাথরুম থেকে হিন্দী গানের শব্দ শুনতে পেয়ে যেন আরও রেগে গেল শুভ। রাসেল আর শুভ আগে থেকেই একই স্কুলে পড়ত। একদম ন্যাংটা কালের বন্ধু যাকে বলে।

অনির্বান অন্য স্কুল থেকে এসেছে ক্লাস নাইন এ। এসেই বন্ধুত্ব হয়ে গেছে ওদের। এক সাথে থাকতে থাকতে এখন যেন একপ্রাণ হয়ে গেছে ওরা। ওদের রুমমেট সজীব এসেছে পটিয়া থেকে। ‘পটিয়া’- কি হাস্যকর নাম।

এসএসসি তে জিপিএ ৫ পেয়েছিল অনির্বান। গোটা রাঙ্গামাটি থেকে মাত্র নয়জন পাওয়ায় জেলা প্রশাসন থেকে সংবর্ধনা দিয়েছিল। নাচতে নাচতে সেগুলোতে অনির্বান এর সংগী হয়েছিল রাসেল আর শুভ। ওদের রুম এ সজীব ও জিপিএ ৫ পাওয়া। ভাল রেজাল্ট আর বড় কিছু হওয়ার জন্য ওদের পরিবার ছেড়ে পড়তে আসা।

প্রত্যেকের বাবা মা-ই বেশ ভালো ভালো উপদেশ দিয়ে গেছেন- খেলবেনা, ঠিকমত খাবে, পড়বে। আড্ডা দেবেনা। কিন্তু ১৮/১৯ বছরের এই পাঁচটি কিশোর কবেই সেসব ভুলে গেছে। সজীব বরাবরই serius পড়ালেখায়। এখন অন্যদেরকে ও serius হতে হচ্ছে।

তারপরও থামেনি ওদের আড্ডা। থামেনি মাঝে মাঝে উদ্দেশ্যহীন হাটা। টাকা জমিয়ে এক টিকেটে দুই ছবি দেখতে যাওয়া! থেমে থাকেনি পাশের বিল্ডিং এর সুন্দরীটার মোবাইল নাম্বার জোগাড়ের চেষ্টা। ২ কোচিং এ সবার মডেল টেস্ট শেষ। সবার পরীক্ষাই হয়েছে মোটামুটি।

সজীব যদিও ঘোষণা দিয়েছে সে ফার্স্ট হবে কোচিং এ। বাকিরা বুঝলনা গ্রেডিং সিস্টেমে ফার্স্ট হবে কি করে! সবাই ঠিক করেছিল রাতে আড্ডা হবে। “আমি বুঝিনা ২ মাসে ৩বার revise দিলি কি করে” ভাত খেয়ে সজীবকে প্রশ্ন করল অনি। -দুর শালা আজকেও পড়ালেখা! -কেন এইচএসসি পরীক্ষা কি তোর শ্বশুর দিবে?? – শুভকে বলল অনি। -দিতেও তো পারে! -মানে কি ?? দুইজোড়া চোখ শুভর দিকে ঘুরে গেল।

সাধারণত যা হয় এ ধরনের আড্ডাতে, মেয়েবিষয়ক কথাই বেশিই হয়। আর মেয়ে বিষয়টা নিয়ে শুভ স্কুল থেকেই মোটামুটি বিশেষজ্ঞ। বরাবরই মেয়েদের সাথে তার সম্পর্ক কেন জানি ভালো। একটা মেয়েকে শেষমেষ পছন্দও করে ফেলেছিল। মেয়েটার নাম ছিল প্রতিচী।

প্রতিচী শব্দের অর্থটা দেখব দেখব করেও দেখা হয়নি। মেয়েটাকে পছন্দের কথা বলেও ফেলেছিল শুভ। কিন্তু বেশিদূর আগায়নি। মেয়েটা এখন কুষ্টিয়ায়। এসবই জানতো রাসেল আর অনি।

কিন্তু… “শ্রাবণী” – সজীব সবজান্তার ভঙ্গি করে বলল। রসায়ন দ্বিতীয় পত্র বই হাতে বসেছে। কলেজের অনেকগুলো ছেলেকে ঘুরায়। ঘুরায়না, ছেলেরা ওর পেছনে ঘুরে। সংশোধন করে দিল শুভ।

-কেন? পিছনে কি আছে যে ঘুরবে? হাসতে হাসতে বলল অনি। -সাবধান। তার বাবা কিন্তু কলেজের প্রফেসর। এই ধরণের পছন্দ টছন্দ আমার ভাল লাগেনা। বাবা-মা ঠিক করে দিবেনে।

- সজীব বই থেকে মুখ না তুলেই বলল। রাসেলের হাতে একটা রুবিক্স কিউব। সেটা মেলাতে মেলাতে সে বলল, “হ। তুই মেয়ে দেখতে যাবি। আর বলবি,একটু হেটে দেখাও,গান শুনাও,চুল দেখি।

উফফ!” -সেটাই। তার চেয়ে প্রেম ই ভাল। - সায় দিল শুভ। কিন্তু কেন জানি আমাদের দেশের বাবা-মারা প্রেম করাটা পছন্দ করে না। – আলোচনায় যোগ দিল অনি।

‘ঠিক। ‘ - সাপোর্ট পেয়ে কথা বলে উঠলো সজীব। “কিন্তু আমার যদি একটা মেয়েকে পছন্দ হয়ে যায় আমি কিছু করবনা??” - শুভর প্রশ্ন। “আদম-হাওয়া বসে থাকেনি, এডাম-ইভ বসে থাকেননি। কৃষ্ণ তার মামীর সাথে প্রেম করতো।

আর আমরা করলেই দোষ??” - কিউবটা মিলিয়ে রাসেল এবার বিছানা থেকে নিচে এসে বসল ওদের সাথে। “দেখ, আমি এত কিছু জানিনা। আমি আমার বাপ-মারে কষ্ট দিতে পারবনা। বলব তোমরা পছন্দ করো। পরে আমি ওই মেয়ের সাথে কথা বলে…. টিডিং টিডিং করে ফেলব।

” - অনির্বান খুশি হয়ে বলে উঠল। “তোমার বিয়া হইছে এই জনমে। এখনকার মায়াগুলারে তো চিনস না। তোমার জন্য কেউ বসে থাকবেনা। তার চেয়ে প্রেম করে গড়ে-পিঠে বউ বানাবো” – শুভর উত্তর।

হেসে উঠলো সবাই। এইরকম আরো নানা বিষয় নিয়ে আড্ডা চলে তাদের। রাজনীতিও বাদ যায়না। ওরা কথা বলতে থাকে। এই বয়সে ওদের মন সবসময়ই উত্তেজিত থাকে।

শরীর কিছু একটা করতে চায়। সমরেশ এর গর্ভধারিনী পড়ে ওদের রক্ত ছলছল করে উঠে। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের গান-তীর হারা ওই ঢেউয়ের সাগর শুনে ওদের লোম খাড়া হয়ে যায়। চারপাশের নানা অসামঞ্জস্যতা, নানা অত্যাচার বেশি বেশি চোখে লাগে। ওরা যে কি চায় নিজেরাও জানেনা।

স্বপ্ন দেখতে ভালোবাসে। দেশকে ভালবাসে। অনির্বান একদিন বলেছিল, আমার যদি আর একটা ভাই থাকত তাইলে হয় আমি সন্যাসী হতাম অথবা রাজনীতিবিদ হতাম। এর সাথেই চলতে থাকে দাবা, লুকিয়ে একটা সিগারেট কে চার জনে খাওয়া! (চলবে)

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।